#খেলাঘর_শেষ
সাহেব লিলিকে নিয়ে বাড়ি ফিরতেই বাড়ি গমগম করে উঠলো,রেহেনা লিলির কপালে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কান্না করলেন অনেক দিনের চেপে রাখা কান্না,লিলি আতঙ্কে আছে সাহেবের বাবার সামনে সে কিভাবে মুখ দেখাবে! ও তো নিজের দেওয়া কথা রাখতে পারে নি! সুপ্তি লিলির হাতের মধ্যে হাত নিয়ে বললো,
—তুমি আমাকে চেনো না কিন্তু আমি তোমাকে চিনি,আমি এ বাড়িতে আসার পর এমন কোনো দিন নেই যেদিন লিলির নাম এ বাড়িতে নেওয়া হয় নি,আমি তোমাকে চিনেছি এ বাড়ির সবার নজরে,আমি তোমাকে চিনেছি তোমার ভাইয়ার খুব আদরের ছোট বোন হিসেবে,তোমার শ্বাশুড়ির কটকটে বৌমা হিসেবে এমন এক ছেলের বউ যার নামে তিনি রোজ বদনাম করে, তার গুষ্টি উদ্ধার করে, দস্যি সে বউমার জন্যেই কেদে ফেলতেন ।আমি ছোট সাহেবের চোখে তোমার জন্যে আকাঙখা দেখেছি,এক অদ্ভুত শূন্যতা দেখেছি,সারা রাত জেগে সকালের ক্লান্ত চোখে জেদ দেখেছি, অদম্য আশা দেখেছি তোমায় ফিরে পাওয়ার।
লিলি মলিন হেসে বললো,
—আর ভালোবাসা?
লিলি খেয়াল করলো সুপ্তি একই ভঙ্গিতে হাসলো,
—ভালোবাসা তো বোঝা যায়, আমরা কাকে ভালোবাসি কে আমাদের ভালোবাসে,তুমি বুঝে নাও তো সে তোমাকে ভালোবাসে কি না?
লিলি ভয়ার্ত চোখে ভেতরের ঘরের দিকে তাকিয়ে বলল,
—আমি বেশীক্ষণ এখানে থাকতে পারব না আমায়,আমাকে….. ফিরতে হবে।
সাহেব আর রেহেনার চোখাচোখি হলো সাহেব খপ করে লিলিকে টেনে নিয়ে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।
আয়না কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলো,
—তুমি কাদছো নাকি?!
বাদশা কিছু বলল না পেছন ঘুরে দাড়ালো,আয়নার মুখোমুখি সে দাড়াতে পারছে না।আয়না খুব বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল,
—ডাক্তার সাহবে কে যখন আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম, আমার কোনো হুশ ছিলো না, আমি এতটাই অবুঝ হয়ে গেছিলাম যে আমি তোমাকে বলেছিলাম তাকে খুজে দিতে,আমি একটুও বুঝতে পারি নি এই কথাটা তোমাকে বলা যায় না,তুমি সেবার বলেছিলে আবরার কে খুজে দিয়ে তুমি আমার ম্যাজিশিয়ান হবে আরেকবার শেষবার।কিন্তু আসলে তা না, তুমি আমার ম্যাজিশিয়ান ছিলে আজও আছো আর থাকবে আজীবন, তুমি সেই জাদুর জ্বীন টা যা আমার গল্পে সবসময় থাকবে ঠিক যখন যখন আমার দরকার পরে আমি তোমাকে পেয়ে যাই,কিভাবে কিভাবে যেন তুমি আমাকে খুজে ফেলো।কিভাবে বলো তো?
বাদশা ঢোক গিলে বলল,
—ঘরে যাও তো আয়না এত রাতে ছাদে আসা ঠিক না।
—মা মারা যাবার পর সবার থেকে লুকিয়ে যখন আমি ছাদে এসে কাদতাম তখন এভাবে ধমকে তুমি বলতে ঘরে যাও তো আয়না ঘরে গিয়ে মুখে পানি দাও আর একফোটা চোখের পানি যেন না পড়ে।আমি দাতে ঠোট কামড়ে কান্না আটকাতাম।তুমি কোনো কথা বলেছো আর আমি শুনি নি এরকম কখনো হয় নি।কোনোদিন হবে না।
আয়না সিড়ির দিকে নেমে গেলো।বাদশা অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো আকাশের দিকে মুখ করে।
কায়নাত আর সৌহার্দ্য ফাকা রাস্তায় হাটতে লাগলো, কায়নাত জানে না সে কেনো এলো তবে সে ভাবলো না এলে অনেক বড় ভুল হয়ে যেতো,ফাকা রাস্তা ফুটপাতে মাঝে মাঝে কুকুর আর আশ্রয়হীন মানুষ পাশাপাশি শুয়ে আছে,ল্যাম্পপোষ্টের আবছা আলো,মাঝে মাঝে দুই একটা গাড়ি চলছে,রাস্তা ফাকা চাইলেই বিরাট রাস্তার মাঝ বরাবর হেটে যাওয়া যায় দিনের বেলা যা ভাবা অসম্ভব, মাঝে মাঝে হালকা বাতাস! রাতের সৌন্দর্য যে এত বেশী তার জানাই হতো না।কায়নাতের ইচ্ছে হলো সৌহার্দ্য কে একটা ধন্যবাদ জানাতে। সৌহার্দ্য হুট করে ফুটপাতে বসে পড়লো,কায়নাত বিস্মিত হয়ে বলল,
—কি হলো স্যার বসলেন কেন?
—ক্লান্ত হয়ে গেছি
—এটুকুতেই? খুব না বললেন ভোর পর্যন্ত হেটে যাবেন।
—আমি ভোর পর্যন্ত একসাথে হাটতে চেয়েছিলাম একা একা কোনো গন্তব্যের দিকে কেউ খুব বেশীক্ষন হাটতে পারে না
কায়নাতের অস্বস্তি হতে লাগলো।কিছুটা কঠোর হয়ে বলল,
—মানুষের মোহ, পাগলামি খুব অল্প সময় থাকে আমি নিজে এর প্রমাণ অযথা পাগলামি করবেন না সৌহার্দ্য।
সৌহার্দ্য কায়নাতের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
—তুমুল ভালোবাসার পরে আমার বাবা মায়ের বিয়ে হয়েছিলো পরিবারের অমতে।আমার মা আজ বিশ বছর যাবত প্যারালাইজড। বাবা এখনো ঘুম থেকে উঠে আগে মায়ের কপালে চুমু খান। মা কে না খাইয়ে তিনি খাবার খান না,রোজ মায়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি কিছুক্ষণ পরপর দেখেন নিঃশ্বাস আছে নাকি, শুধু এইটুকুই আশা তাকে বাচিয়ে রাখে।ছোটবেলা থেকে এসব পাগলামি দেখেই বড় হয়েছি।পাগলামির সঙ্গা আমার কাছে খুব সুন্দর খুব।
সৌহার্দ্য উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
—চলুন হাটি।
কিছুদূর হেটে পেছনে তাকিয়ে দেখলো কায়নাত সেখানেই দাঁড়িয়ে।সৌহার্দ্য জোড়ে বলল,
—কায়নাত এসো আমি অপেক্ষা করছি, চলো একসাথে ভোরের দিকে হাটি।
কায়নাতের অনেকদিন পর চোখ ছলছল করে উঠলো।ও সন্তর্পণে তা আড়াল করে দ্রুত পায়ে সৌহার্দ্যের দিকে এগিয়ে গেলো।তারা একসাথে ভোরের দিকে হাটতে থাকলো।
অনেক্ষণ রাগত স্বরে বলার পরেও লিলি যখন কিছুতেই থাকতে চাইছে না তখন সাহেব দুই হাটু গেড়ে বসে পড়লো মাথা নিচু করে ক্লান্ত কণ্ঠে বললো,
—আর পারছি না লিলি,এবার থেকে যাও। এবার ধরা দাও।আমার কষ্ট হচ্ছে খুব।
লিলি বিস্মিত হয়ে দু পা পিছিয়ে বিছানায় বসলো একদম সোজা হয়ে সাহেব কে এরকম ভেঙে পড়তে সে কখনোই দেখে নি।সাহেব হাটু ভর দিয়ে লিলির দিকে এগিয়ে এসে ওর কোলের উপর থেকে হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল,তোমার মতো কঠিন মেয়ে আমি দেখি নি, তোমার মতো সহজে মিশে যেতেও আমি কাউকে দেখিনি,তুমি দুম করে আমার জীবনে এলে বেশ কিছুদিন দাপিয়ে বেড়ালে, নিঃশব্দে হেটে ধীর পায়ে চলে গেলে।তুমি এলে, আমাকে গুছিয়ে দিলে আমার জীবনে লক্ষ্য ধরিয়ে দিয়ে আমাকে একা করে চলে গেলে।তুমি বলেছো আমি তারেককে ওর সফলতার দিকে এগিয়ে দিয়েছি,একা আমি আরো একা হয়ে গেছি,তুমি বলেছো আমি স্পষ্ট করে আমার অনুভূতি কায়নাত কে জানিয়ে দিয়েছি,তুমি বলেছো আমি আবরার ভাইয়ের ঠিকানা ভাইয়া কে দিয়ে দিয়েছি।বাবার রাজনীতির কোনো ক্ষতি না হয় খেয়াল রেখেছি,নিজের জব করেছি,বাসার সবার সাথে মিশেছি হাসি মুখে, তোমায় খুজেছি আমার শহর, তোমার মামার শহর তোমার পরিচিত সবার শহর চষে ফেলেছি আমি তোমাকে পাই নি।আমি তোমাকে চেয়েছি প্রতিরাতে ক্লান্ত হয়ে শূন্য হাতে শূন্য ঘরে ফিরে আমি ডুকরে কেদে উঠেছি।তবুও আমি ব্যর্থ! আমি বুঝি নি আমার বাবার পাশের বালিশে শুয়ে মা সবটা বুঝতেন বাবার শরীরে অন্য কারো ঘ্রাণ পেয়েও তিনি অন্ধ সেজে থাকতেন, বুঝেও না বুঝে থাকতেম, বোকা সেজে সংসার করতেন।
লিলি প্রচন্ড অবাক হয়ে বলল
—মানে!
আজ নীরা নামের মহিলাটি মারা গেছেন, মা সবইই জানতেন তিনি তার জানার কথা কাউকে জানান নি,বাবাকে না আমাদেরও না।আমি আমার মায়ের ভেতরে পড়তে পারি নি আমি তোমাকে পড়তে পারি নি আমি হেরে গেছি।আর পারি না আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি।
লিলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে সাহেবের মুখ আজলা ভরে ধরল,সাহেব দেখলো লিলির চোখ ছলছল করছে আশ্চর্য মেয়েটা কাদতেও জানে!
—আমার বাবা যখন মাকে ঠকিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করলেন মা মেনে না নিয়ে আত্মহত্যা করলেন, সেইদিন থেকে আমি বাবাকে ঘৃণা করি,ছোট মা খারাপ নন, তিনিও আমার বাবার জালে ধরা পড়ে গেছেন তিনিও অসহায়।আমি বাবাকে ঘৃণা করে, বাবার মতো পেশার সবাইকে ঘৃণা করি।তাই আপনার প্রতি আমার খুব বিতৃষ্ণা ছিলো।বাবাকে শাস্তি দিতে আপনাকে বিয়ে করে বুঝলাম আপনার পরিবার একটা স্বর্গ টুকরো, এর দেয়ালের প্রতিটি ইটে শান্তি, আপনার বাবা দোষী নন তিনি প্রতি মুহূর্তে অনুতপ্ত স্পষ্ট বোঝা যায়। আমি আপনাকে রোজ দেখতাম, আমার একুশ বছরের আস্তর পড়া মনে আপনি উথাল পাতাল ঝড়ের মতো।আমি আপনাকে আড়াল থেকে দেখতাম, আপনি ঘুমিয়ে গেলে দেখতাম আমার কান্না লেয়ে যেত আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে মায়ের সাথে আপনাকে নিয়ে কথা বলতাম।আমি আপনাকে ভালোবেসেছি আপনাকে স্পর্শ না করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছি।আপনি স্পষ্টবাদী, আপনি ধীর আপনি যেমন ঠিক তেমন ভাবে আমার প্রিয়।
লিলি সাহেবের কপালে ঠোঁট রাখলো, লিলির চোখের জল সাহেবের মুখের উপর গড়িয়ে পড়লো।সাহবে শুকনো ঢোক গিললো।শান্তির নিঃশ্বাস ফেললো।সে মাটিতে বসেই লিলির কোলে মাথা রেখে বলল, নড়বে না আমি ঘুমাবো তুমি জেগে থাকো বাকি হিসেব নিকেশ কাল পুষিয়ে দেবো।আমি অনেক কাল ঘুমাই না।
আয়না ঘরে এসে আবরারের বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লো গোপন করা নিঃশ্বাস ফেলে দু হাতে আবরার কে জড়িয়ে বলল,
—আমার জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি এসেছে সবচেয়ে বড় অপ্রাপ্তির মাধ্যমে আমি এভাবে হেরে যেতে পারি না।
আবরার বিড়বিড় করে বলল,
—আমাকে হারিয়ে দিও না, আমি সবটা ভুলে গেছি তোমাকে পেয়ে।আমার কোনো অপ্রাপ্তি নেই।
তারেক দু মাসের ছুটি কাটিয়ে আজ ফ্লাই করছে।ইমিগ্রেশনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবছে,সাহেব যখন কায়নাত কে ভেবে সিগারেট পোড়াতো পাশে দাড়িয়েই কায়নাতের প্রতি নিজের মুগ্ধতার গলা টিপে ধরতে সে।আজ সবাই ভালো আছে সাহেবও কায়নাতও।শুধু একজীবনে কায়নাত কে না পাওয়া তাকে ভালো থাকতে দেবে না। তবুও…. তারা তো ভালো আছে।সঙ্গী হীনা একজীবন কাটিয়ে দেওয়া কি খুব কঠিন হবে?দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,কি জানি….!
শেষ
সামিয়া খান মায়া