খেলাঘর_১৬

0
348

#খেলাঘর_১৬

সুপ্তি এবং রেহেনা যে সকাল থেকেই সাহেবের জন্মদিনের জন্যে বিরাট আয়োজন করেছে তা খাবার টেবিলে এসেই বোঝা গেলো,সাহেব অসহায়ের মতো একবার বাবা আর একবার ভাইয়ার দিকে তাকালো, সবার দৃষ্টিই সাহেবের দিকে,সাহেব কোনোরকমে সব পদ একটু একটু মুখে দিয়ে বলল,
—আর বেশি দেরী করে গেলে আমাকে ভার্সিটি তে ঢুকতে দেবে না,
সুপ্তি হেসে বলল,
—ছোট ভাইয়া তুমি আর ভার্সিটির স্টুডেন্ট নেই লেকচারার হয়ে গেছো তোমার কি সে খেয়াল আছে
বাদশা কৌতুকের সুরে বলল,
—থাকবে কি করে সাহেব কখনো পড়ালেখা কে গুরুত্ব দিয়েছিলো নাকি?আমি তো এখনো বুঝি না ওকে কেন ভার্সিটি এলাও করলো ওর অনার্সের রেজাল্ট এক্কেরে যাচ্ছে তাই
সাহেব ভ্রু কুচকে সুপ্তির দিকে তাকিয়ে বলল,
—ভাবি কিছু বলো,
সুপ্তি চায়ের কাপ সাহেবের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল,
—তুমি কি ভুলে যাচ্ছো? আমার ছোট ভাইয়া মাস্টার্সে ফার্স্ট হয়েছে? সে চাইলেই তখনই জয়েন করতে পারতো স্যারদের বললেই,কিন্তু সে কষ্ট করেছে পড়ালেখা করেছে, এপ্লাই করেছে তারপর জয়েন করেছে।
সাহবে আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিচ্ছে,বাদশা সুপ্তি কে থামিয়ে বলল,
—থামো, সারাদিন ছোট ভাইয়া ছোট ভাইয়া করো তোমার পিপাসা পায় না, এক ঢোক পানি খাও।আর তুমি তো জানো না এ আগে কি গাধা ছিলো নকল করে, অন্যের খাতা দেখে পাশ করতো।নেহাতই লিলি ওর জীবনে এসেছিলো,নয়তো এখনো ঘুরে ঘুরেই বেড়াতো।

সাহেব এবার নরম করে হাসলো,
—তুমি বলতে চাচ্ছো আমি আজ যা কিছু সব লিলির জন্যে?
রেহেনা চৌধুরী হেসে বলল,
—অবশ্যই, এতে কোনো সন্দেহ আছে?
সাহেব হেসে বেড়িয়ে যেতে যেতে বলল,
—মা! তুমি না লিলিকে একদম দেখতে পারতে না!?
রেহেনা কিছু বললেন না, সাহেব হাসতে হাসতে বেড়িয়ে যেতে যেতে ভাবলো, সবার জীবনে কি দারুন ভাবে তুমি গেথে আছো লিলি তা যদি জানতে!

কায়নাতের ক্লাস নেওয়া শেষ করে বের হতেই দেখলো সাহেব হাসিমুখে অন্য প্রফেসরদের সাথে করিডোরে দাড়িয়ে কথা বলছে, সাহেবকে দেখে কায়নাত একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ছেলেটাকে ফর্মাল ড্রেসেও কত মানিয়েছে! হাতা ভাজ করে ব্লেজার হাতে নিয়ে অন্য হাত পকেটে রেখে কি সুন্দর হেসে হেসে কথা বলছে! এই ছেলেটাই নাকি একসময় ফর্মাল ড্রেসের ধারে কাছে যেতে চাইতো না! কায়নাতও হেসে এগিয়ে গিয়ে বলল,
—সব স্যারেরা কি জানে আজ আমাদের কেমিস্ট্রি স্যারের বার্থডে, তা স্যার আমাদের কি ট্রিট দেবেন সেটুকু কি বলেছেন?
সাহেব নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—ম্যাম নিশ্চয়ই আমার জন্যে গিফটের ব্যাবস্থা করেই ট্রিট চাইছেন তাই না?
সৌহার্দ্য স্যার হেসে বলল,
—স্যার ট্রিট কিন্তু চাই
—হ্যা বেশ বুঝেছি কায়নাত ম্যাম যখন বলেছেন তখন তো অবশ্যই চাই।এমনিতেও সিনিয়র স্যারদের আমি এসেই ট্রিট দিয়ে দিয়েছি,এবার আমরা জুনিয়ররা মিলে চলুন পাশের রেস্টুরেন্ট এ বসি।আপনাদের ক্লাস আছে নাকি আর?
কায়নাত হেসে বলল,
—আমি নিনিতা ম্যাম কে একটা কল করে ডেকে নেই?
সাহেব বেশ বিরক্ত হলেও বলল,
—ডাক ডেকে নে।
সবাই এক যোগে হাসলো,নিনিতা ম্যামের সাহেবের প্রতি এক্সট্রা ঝোক সবাই জানে।
রেস্টুরেন্টে সবাই অনেক আনন্দ করার পরে বেড়িয়ে গেলো,শুধু কায়নাত, সাহেব আর সৌহার্দ্য রইলো।সৌহার্দ্য কায়নাত কে বলল,
—আমি কি যাবার সময় আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাবো ম্যাডাম?
—না সৌহার্দ্য আমি সাহেবের সাথেই চলে যাবো আপনাকে কষ্ট করতে হবে না, সাহেব এখন বাসায়ই যাবে।
সাহেব কিছু বললো না।সৌহার্দ্য একটু মলিন হেসে বেড়িয়ে গেলো,
—আমি কিন্তু এখন বাসায় যাবো না, আমার এখন ফর্মাল লাইফের বাইরের বন্ধু ছোট ভাইদের খবর নিতে হবে
—আমি জানি
—তাহলে তুই স্যারের সাথে গেলি না কেন?
—ইচ্ছে করলো না তাই
—কায়নাত আমার মনে হয় তোর সৌহার্দ্য স্যারকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত
কায়নাত হাসলো,
—এখন আর ইচ্ছে করে না, তবে তুই চাইলে অন্য কথা,
—আমার চাওয়ার কোনো মূল্য আছে নাকি কারো কাছে
কায়নাত চুপ করে গেলো
—লিলির ওপর খুব অভিমান তোর তাই না?
সাহেব বিল মিটিয়ে বের হতে হতে বলল,
—নাহ।
কায়নাত অনেক্ষন দাড়িয়ে রইলো, এভাবেই কিছু মানুষ একা হয়ে যায়।একা থেকে যায়।
বাইরে থেকে সাহেব ফিরলো অনেক ক্লান্ত হয়ে তবুও বাড়ির সবার সাথে বসলো রাতের খাবার খেলো আড্ডা দিলো,অনেক রাতে ঘরে ঢুকলো।ক্লান্ত হয়ে বিছানায় উপর হয়ে শুয়ে পড়লো,অজান্তেই ওর চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। বরাবর অনেক মানুষের মধ্যে সাহেব বড় হয়েছে এখনো অনেকের মাঝে তার চলাফেরা তবুও, তবুও একটা মেয়ে ওকে এতটা একা করে দেবে ও কখনো ভাবে নি, কোনোদিন না।সাহেব উঠে দাড়ালো ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে একটা নোট খাতা আর একটা কাচের জার নিয়ে ওর বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসলো। ঠিক ১১:৫৯ এ ও জারের মুখ খুলে দিলো জোনাকি পোকার আলোয় ওর বারান্দা জ্বলতে লাগলো, মাথার নিচে হাত দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে সাহেব ভাবতে লাগলো, লিলির সাথে ওর যেবার প্রথম জন্মদিন ছিলো সকাল থেকেই রেহেনা হৈচৈ শুরু করে দিয়েছিলো সাহেব নিজেও বরাবর তার জন্মদিন নিয়ে খুব এক্সাইটেড থাকতো,সাহেব চাইতো এই দিনে সবাই তাকে ঘিরে থাকুক।সবাই সাহেবকে উইশ করলো ও না হলেও ১০ টা কেক কাটলো ভার্সিটির ছোট ভাই বন্ধু বান্ধব,প্রতিবেশী এমনকি রাস্তার দোকানদারও জানতো আজ সাহেবের জন্মদিন সবাই উপহার দিলো কায়নাতও কি সুন্দর একটা ঘড়ি গিফট করলো! অথচ লিলি তার কোনো হেলদোল নেই দিব্যি সারাবাড়ি ঘুরে বেড়ালো, পিরিচে একেক ফ্লেভারের কেক নিয়ে খেলো অথচ যার জন্মদিন তাকে একবার উইশও করলো না! সারাদিনে অসংখ্যবার লিলির সামনে দিয়ে সাহেব ঘোরাঘুরি করলো কারণে অকারণে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলো কি লাভ হলো! কিচ্ছুই না।রাতের বেলায় সাহেব ঘরে ঢুকলো মুখ গোমড়া করে মেজাজ খারাপ করে, কত মেয়ে আজ সারাদিন সাহেবকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে গিফট সব আনলে ঘরে রাখারা জায়গা হতো না! আর এই মেয়ে! মিনিমাম ভদ্রতা তো দেখাতে পারতো!
লিলি ঘরে এসে সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল,
—আপনার মুখ এত শুকনো কেন আপনি কি ক্লান্ত?
সাহেব লিলির সাথে কথা বলল না,
লিলি টেবিলে পড়তে বসে গেলো সাহেব অবাক হয়ে বলল,
—তুমি এখন পড়তে বসবে!
—তাছাড়া কি!
—কিছুনা।
—ওহ শুনুন আপনাকে তো আপনার বার্থডে গিফট টা দেওয়াই হয় নি
সাহেব মনে মনে খুশি হলো কিন্তু কৌতূহল চাপিয়ে কিছু বলল না! আর ওইদিকে লিলিও এই কথাটা বলেই আবার পড়ায় মন দিয়েছে! সাহেব এবার আর থাকতে না পেরে বলল,
—জন্মদিনের গিফট কি তুমি পরের বার দেবে?
লিলি কি যেন একটা ভেবে বললো,
—ওহ হ্যা তাইতো! আচ্ছা আপনি বারান্দায় গিয়ে দাড়ান আমি আসছি,
সাহেব দ্রুত পায়ে বারান্দায় চলে গেলো।লিলি একটা নোটবুক সাহেবের হাতে দিয়ে বলল,
—এই নোটসগুলো আপনি খুজছিলেন না?দেখুন তো
সাহেব নোটসগুলো দেখলো এইগুলোই ও খুজছিলো! কিন্তু কায়নাত এত্ত পাজি বলে কি না নিজে করে নিতে!
—তুমি কোথায় পেলে!
—আম কে পেড়েছে তা তো আপনার দেখা লাগবে না আপনি দেখুন মিষ্টি কি না?গিফট পছন্দ হয়েছে?
—এইটা আমার বার্থডে গিফট
—হ্যা!
সাহেব হাল ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো বারান্দাতেই। ঠিক ১১:৫৮ এ সাহেবে লিলি ধাক্কা মেরে তুলল,
—সাহেব, সাহেব! ঘুমিয়ে গেছেন?
সাহেব চোখ বন্ধ করেই বলল,
—না
—তাকান
সাহেব চোখ খুলে দেখলো বারান্দার বাতি নেভানো লিলি একটা কাচের জার খুলে দিয়েছে শয়ে শয়ে জোনাকিতে তার বারান্দায় আলো দিচ্ছে সাহেব বিস্ময় নিয়ে উঠে বসতেই বললো
—জন্মদিনের শুভেচ্ছা, আপনার সকল চাওয়া পূর্ণতা পাক,আপনার সব প্রিয় মানুষ আপনার সঙ্গেই থাক।
সেইদিন সাহেবের মনে হয়েছিলো তার আজ সারাদিনে পাওয়া অন্য সব উপহার তুচ্ছ এত সুন্দর ভাবে কেউ কোনোদিন তাকে উইশ করেনি,অনেক সারপ্রাইজ সে পেয়েছে কিন্তু এরকমভাবে কেউ তাকে চমকে দেয় নি।
সাহেব চোখ খুললো,একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে একরাশ মন খারাপ নিয়ে জোনাকিগুলোর দিকে তাকালো আজকেও ঠিক এরকম একটা রাত কিন্তু তার আশেপাশে কোথাও লিলি নেই!
চলবে…..
সামিয়া খান মায়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here