#খেলাঘর_২০
সাহেব কিছুক্ষণ এলোমেলো গাড়ি নিয়ে শহর ঘুরলো, তারেক ওর পাশের সিটেই বসা, সাহেব ভাবতেই পারছে না এত কিছু হয়ে গেছে আর ও টেরই পায় নি! একবারের জন্যেও না!তারেক নিজেও বিস্মিত, ও সাহস করে বলল,
—এখন কি করবি?
সাহেব কথা বলল না,
—আমি এক্সাক্টলি জানি না ওরা কোথায় আছে আর মৃদুল ও তো এখানে মেসে থেকে পড়তো।
সাহেবের ফোনে ফোন আসলো,ও রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কিছু কথার পরেই সাহেব বলল,
—এখন সুস্থ আছে?মানে অবস্থা স্টেবল?
বলেই ফোন কেটে দিলো।তারেকের দিকে না তাকিয়েই বলল,
—চল তোদের লিলির খোজ পেয়ে গেছি।
কায়নাত চুপচাপ বারান্দায় বসে আছে আজকের পরিবেশ টা কেমন গুমোট লাগছে।বৃষ্টি হবে নাকি,এমন সময় ওর ফোনে টেক্সট আসলো,
—ম্যাডাম হাটতে যাবেন?
নম্বরটা সৌহার্দ্যের কায়নাত একটু অবাক হলো সে ভেবেছিলো সৌহার্দ্য আর কায়নাতকে চাইবে না কিংবা কথাও বলবে না,কায়নাত কে সম্পূর্ন ভুল প্রমাণ করে দিয়ে সৌহার্দ্য তাকে মেসেজ করেছে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে!ও রিপ্লাই দিবে না ভেবেও লিখলো,
—সকালে যাই,এখন অনেক রাত!
কিছুক্ষণ পরেই টুং করে শব্দ এলো,
—কাল ভার্সিটি বন্ধ। চলুন আমরা রাত হেটে পার করি ভোরের দিকে এগিয়ে যাই…..। আমি আপনার বাসার নিচে।অপেক্ষা করছি।
কায়নাত বসে রইলো কি করবে বুঝে উঠলো না আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো বৃষ্টি হবে কি?
লিলি ওর অসুস্থ বড় মামাকে দেখা শেষ করে রাতেই মামাবাড়ি থেকে বের হলো। ও সকালে ল্যান্ড করলেও দিনের বেলা বের হয় নি।মৃদুল লিলির সাথেই ছিলো, মৃদুল লিলিকে এয়ারপোর্টের পাশে একটা হোটেলে তুলে দিতে যাচ্ছে, লিলি তাই চায়।
—তুই শিওর লিলি তুই কালই চলে যাবি?
—হ্যা,একদিনের বেশী দুইদিন থাকলে সাহেব আমাকে খুজে ফেলবে
—তুই পালাচ্ছিস কেন লিলি?
লিলি শান্ত ভাবে মৃদুলের দিকে তাকিয়ে বলল,
—কারণ টা কি তোর অজানা?
—সাহেব ভাই তোকে ভালোবাসে
—তুই ওকে চিনিস না আমি চিনি,ও নিশ্চিত আমার ছেড়ে আসা মেনে নিতে পারে নি এজন্য আমাকে খুজছে, একবার পেলে আমাকে মেরেই ফেলবে।কি যে শয়তান লোক!
—বাজে কথা বলিস না
লিলি হাসলো
—সত্যিই তুই তো চিনিস না ওকে
—তুই তো চিনিস, ওই শয়তান লোকটাকে পাগলের মতো ভালোবাসিস কেন?
লিলি চুপ করে গেলো মৃদুল মুখ গোমড়া করে বলল,
—এড়িয়ে যাস প্রত্যেক বার এড়িয়ে যাস লিলি!
লিলি ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—নাহলে যে আমি শেষ হয়ে যাবো মৃদুল! ভালোবাসব না, কোনোদিন ফিরে তাকাবো না,পাশে থাকব না, ছেড়ে চলে আসবো জেনেও তো ভালোবেসেছি,ওর কোনো কমতি যাতে কেউ দেখাতে না পারে এ জন্য অপমান করেছি,খোচা মারা কথা বলেছি, কত শত রাত পড়া হয়ে গেলেও শুধু ওর জেদ জাগানোর জন্যে টেবিলে বসে থেকেছি,কারণ আমি ওকে ভালোবেসেছি।আমি বাসতে চাইনি বিশ্বাস কর আমি তো জানি ও কায়নাত কে ভালোবাসে আমি তো জানি আমরা এক হবো না তবু ভালোবেসে ফেলেছি। একটা ছেলের সাথে আমি এতগুলো দিন এক ঘরে ছিলাম সে কখনো আমাকে রাগ দেখায় নি,অসম্মান করে নি, অবজ্ঞা করেনি।হাজারটা দিন ওর ক্লাস না থাকলেও আমার জন্যে ভার্সিটির গেটে দাঁড়িয়ে থেকেছে,আমার কোন বন্ধু আমায় অপমান করলো,কে আমার দিকে খারাও নজরে তাকালো তাদের মার্ক করে পরের দিন তাদের পাঠিয়েছে আমাকে ভাবি বলে সালাম দেওয়াতে,আমি কোথায় গেলাম, আমার কোনো অসুবিধা অলো কি না, আমি খেয়েছি কি বা আমার মন খারাপ কি না সবটার খেয়াল রেখেছে।সমান তালে নিজের পরিবার,লেখাপড়া,বাইরের মানুষ সব হ্যান্ডেল করেছে, যার মধ্যে অহংকার নেই, দাম্ভিকতা নেই,যে প্রতিটা কাজ মাথা ঠান্ডা রেখে করে, যার বিবেচনা শক্তি এত প্রখর এমন একজন পারর্ফেক্ট মানুষ কে ভালো না বেসে পারা যায় না থাকা যায় না।সাহেবকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি বারবার আমি ওর প্রেমে পড়েছি প্রতিদিন। কিন্তু….
লিলি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
—সাহেব কায়নাত আপু কে ভালোবাসে স্বার্থ ছাড়া, আমি দেখেছি কায়নাত আপুর কি হলো,প্রহর কি করলো, তার পড়ালেখা কেমন চলে সব খবর সে রেখেছে। তাই আমি আমার অনুভূতি ব্যাক্ত করি নি করারর সুযোগ পাই নি,পেলেও আমি তা করতে পারি না।আমি শুরুতেই বলেছিলাম ছেড়ে চলে আসবো।তাছাড়া কায়নাত আপুর তো ডিভোর্স ও হয়ে যাবে অনেকদিন আলাদা থাকছে তাই আর….
লিলি আরো কিছু বলার আগেই মৃদুল গাড়ির ব্রেক কষলো,
—কি হলো?!
—আরে সামনে একটা গাড়ি রাস্তা আটকে দাঁড়ানো তুই বয় আমি দেখি
—আমিও আসি
—আচ্ছা আয়…
বলেই দুজনেই গাড়ি থেকে নামলো। বাইরে এসে দেখে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বুকে হাত বেধে গাড়ির সাথে হ্যলান দিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে আছে,পাশে তারেক ভাই!কি আশ্চর্য! অতীত এভাবে এসে দাঁড়াবে কেন! তারেক ভাই এখন এখানে! যেন ওনাকে এখানেই থাকার কথা ছিলো সাহেবের পাশেই এভাবেই ওনারা দুজন এসে দাঁড়াবে বলেই তারেক ভাইয়ের দেশে ফেরা!শেষ বার যেরকম দেখেছিলো ঠিক সেরকমই! মানুষ টা এত সুন্দর কেন!লিলি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইলো তারপর কি একটা ভেবে এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাড়ালো,সাহেব দেখলো লিলি কিছুটা লম্বা হয়েছে গায়ের রঙ অনেকটা উজ্জ্বল হয়েছে চুলগুলো স্ট্রেইট ছেড়ে দেওয়া গাল দুটো ফোলা ফোলা হয়েছে কিন্তু চোখ দুটো সেই আগের মতো গভীর, যাতে তলিয়ে গেলে আর ওঠা যায় না।লিলি ইতস্তত করে বলল,
—কেমন আছেন সাহেব?
সাহেব কোনো ভণিতা না করে বলল,
—বাড়ি চলো
লিলি স্তব্ধ হয়ে গেলো ঢোক গিলে স্বকীয়তায় ফিরে বলল,
—না।
সাহেব নিঃশ্বাস ফেলে ঠাস করে লিলির গালে চড় বসিয়ে দিলো,
—আমার মুখের ওপর না বলার সাহস কারো নেই।কথা ক্লিয়ার? অনেক পালিয়েছো এবার শাস্তি ভোগ করার পালা।
লিলির চোখ টলমল করে উঠলো,এতদিন পর দেখা আর সে কি না কেমন আছো জিজ্ঞেস না করে চড় বসালো।লিলি চড় খাওয়া গালে হাত বসিয়ে বলল,
—আমি যেতে পারবো না, আমায় ফিরতে হবে।
সাহেব হুট করে লিলির হাত টেনে জোর করে গাড়িতে নিয়ে বসলো গাড়ির জানালা দিয়ে উকি দিয়ে বলল,
—তারেক তুই এই ব্যাটার সাথে চলে যা
—ওমনি না? আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছিস!
—চুপ থাক তুইও আমাকে ফেলেই গেছিলি
বলে সাহেব গাড়ি হাকালো।তারেক হাসলো।মৃদুলের দিকে তাকিয়ে বলল,
—কিরে ভাই লিফট দিবি নাকি?
মৃদুল হাসলো।
আয়না বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললো, শুরু থেকে প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসেব নিয়ে বসলো।মাকে হারিয়ে,সংসার এর হাল ধরা একই সাথে লেখাপড়া করা,বাদশা কে পাওয়া,প্রচুর মানসিক কষ্ট নিয়ে তাকে হারিয়ে ফেলা,আবরারের সাথে বিয়ে,বাবাকে হারানো,আবরার কে পাওয়া।একটা মেয়ের জন্য পৃথিবীর সর্বোচ্চ সৌভাগ্য পেয়ে বারবার হারানো।সব কিছু এত জটিল কেন! আবরারের জীবনটাই বা কেমন না ছোট বেলায় পরিবার পেলো আর না এখন! আয়নার আর বেচে থাকতে ইচ্ছে করে না একটুও না।ছাদের কোণায় দাঁড়িয়ে ভাবছে এখান থেকে নিচে পড়লে কি সে এ সব কিছু তে মুক্তি পাবে? বাবা মা কে খুজে পাবে? আবরার মুক্তি পাবে?দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আয়নার বুক চিরে।কিছু একটা করে ফেলার আগেই কেউ ডাকলো,
—ম্যাজিক মিরর…
আয়না থমকে গেলো,বাদশা মোটেই ধমক দিলো না নরম কণ্ঠে বলল,
—তুমি বেচে আছো, তোমার সাথে আবরার আছে,তুমি ভালো আছো জেনে আমি আছি। তুমি বলেছো সংসারী হতে আমি হয়েছি,কারণ আমি তোমার কাছে অপরাধী তোমার দেওয়া সব শাস্তি আমার প্রাপ্য।সুপ্তি খুব ভালো মেয়ে মাটির মানুষ, রোজ সে আমার বুকের উপর শুয়ে হাজার রকমের কথার ঝুলি খুলে বসে, আমি মনোযোগ দিয়ে শুনি কারণ তুমি চাও আমি যাতে তাকে না ঠকাই,তবুও সে হাতরে,আনাচে কানাচে কোথাও আমার আমি কে খুজে পায় না সে আমাকে পায় তোমার কথায় চলা আমি হিসেবে, তার অভিযোগ নেই।তবুও সে থাকে,আমার সংসারে হেসে খেলে বেড়ায়।আমার সহ্য হয় না যা কিছুতে তোমার ছোয়া থাকার কথা ছিলো,তোমার দাপিয়ে বেড়ানীর কথা ছিলো সে সব জায়গায় সে নিরবে হেটে যায় মাঝে মাঝে আমার কষ্ট হয় সব ছেড়ে ছুড়ে নিরুদ্দেশ হতে ইচ্ছে করে কিন্তু আমি থেকে যাই।কারণ তুমি আছো।তুমি আমাকে মেরে ফেলো না প্লিজ।এমন কোনো শাস্তি তুমি আমায় দিও না যাতে আমি মুখ দেখার আয়না খুজে না পাই আমি বিলীন হয়ে যাই।
চলবে….
সামিয়া খান মায়া