#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২১
তিতিরের করা প্রশ্নে চমকে ওঠে মাশরিফ। আমতা আমতা করে কী জবাব দিবে ভেবে পেলো না। তারপর ভাবলো সত্যটাই বলে দিক। একদিন যখন সত্যটা জানতে পারবে তখন হয়তো ভুল বুঝবে! তাই আগেভাগেই সত্যটা বলে দিলে এই ভুল বোঝাবুঝিটা হবে না বা কিছুটা হলেও কমবে। তাই মাশরিফ মুচকি হেসে তিতিরের প্রশ্নের জবাবে বলল,
“হ্যাঁ। আমি আর্মিতে আছি। হঠাৎ আপনার এই প্রশ্নটা কেন মনে হলো?”
জবাবের বদলে তিতির পাল্টা প্রশ্ন করল,
“আপনি যে আর্মিতে আছেন এটা সেদিন বললেন না কেন? আপনাকে তো জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল আপনি কী-সে পড়েন বা কী করেন?”
তিতির কথায় সন্দেহের ধাঁচ। মাশরিফ ঠোঁট কা*ম*ড়ে হেসে উত্তর দিল,
“কী করি তা জিজ্ঞেসা করা হয়নি। আমি মেডিকেলে পড়ি কী-না তা জিজ্ঞেসা করা হয়েছিল। তাই ওইটুকুই জবাব দিয়েছি। তাছাড়া আমি তো এখন পড়াশোনাই করছি না।”
এমন দুর্বোধ্য জবাবে তিতির থতমত খেয়ে গেলো। ছেলেটা সহজ প্রশ্নের ঘুরিয়ে জবাব দেয়! যেনো, খাবার সরাসরি না খেয়ে মাথার পেছোন দিয়ে ঘুরিয়ে এনে খাওয়া! তিতির ফুঁস করে লম্বা শ্বাস ফেলে বলে,
“আপনি ঠিকই বলেছেন। আমরা তো আপনাকে জিজ্ঞাসা করিনি, আপনি কোথায় জব করেন? তাই না? আপনার জবাব আপনার দিক দিয়ে ঠিকই আছে। মানে জিজ্ঞাসা না করলে কেনই বা বলবেন!”
মাশরিফ ঠোঁট চেপে হাসি কন্ট্রোল করল। তারপর একটুখানি হেসে বলল,
“তোমার মনে কোন প্রশ্ন থাকলে সরাসরি প্রশ্ন করবে। সংকোচ করবে না। আমি জবাব দিতে একটুও কার্পণ্য করি না। এই যে একটু আগে প্রশ্ন করলে, আমি আর্মিতে কিনা? জবাব তো দিলাম। তাই না?”
তিতির অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে মুখ হালকা ভে*ঙাল! তারপর বিড়বিড় করে বলল,
“এহ! এসেছে প্রশ্নের জবাব দিতে! প্রতিটা কথায় নিজেই প্যাঁ*চ লাগিয়ে মনে প্রশ্নের সৃষ্টি করে দেয়! সে আবার জবাব দিবে!”
কিন্তু এসবেও তিতিরের মনে একটা খুঁতখুঁতে ভাব রয়ে যায়। তার মনে একটা প্রশ্ন উুঁকি দিচ্ছে। করবে কি? করবে না? ভেবে মৌন থাকার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু মাশরিফ তো এই অস্থীরতা তিতিরের মুখ দেখে বুঝে গেছে। তাই মাশরিফ নিজেই জিজ্ঞাসা করল,
“তুমি কি কিছু বলতে চাও? বলতে চাইলে নিঃসন্দেহে, নিঃসংকোচে বলো।”
তিতির হকচকিয়ে তাকায়। লোকটা কি তার মনের খবরও রাখে! এখন সে প্রশ্নটা করতে চাইল না। কারণ যাতে মাশরিফের চিন্তাশক্তি সত্য প্রমান না হয়। তিতির মাথা নাড়িয়ে বলল,
“কই নাতো।”
মাশরিফ আর জবাবে কিছু বলল না। অভী এবার বলে ওঠে,
“গাইজ, আমাদের বার্থডে বয় নিজের হাতে কাল রাতে তার মায়ের রাগ ভাঙ্গাতে কেক বানিয়েছে। কিন্তু আন্টির তো ডা*য়বেটিস আছে তাই আন্টি এক পিসের বেশি খেতে পারেনি। ওদের বাড়িতে এখন আর কেউ নেই। তাই সে কেকটা আমাদের জন্য নিয়ে এসেছে। ওয়ান্না টেস্ট ইট?”
ইমরান, রণক সবার আগে সমস্বরে উৎসাহী কন্ঠে বলে ওঠে,
“হ্যাঁ হ্যাঁ।”
নাদিয়া অবিশ্বাস্য কণ্ঠে শুধাল,
“সত্যি? সত্যি ভাইয়া নিজে কেক বানিয়েছেন? ওয়াও! তাহলে তো টেস্ট করে দেখতে হয়।”
অর্ক একটু গর্ব করে বলল,
“আমাদের মাশরিফ সবসময় অলরাউন্ডার! রান্নাবান্না থেকে কাপড় কাঁচা সবেতে সে সেরা!”
অর্কর কথায় সবাই ফিক করে হেসে ফেলল। মাশরিফ অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল,
“আরে না। আমি মায়ের রাগ ভাঙাতে অনেকটা সময় নিয়ে ইউটিউবে ভিডিও দেখে দেখে কেকটা বানিয়েছি। এমনিতে রান্না বলতে ডিম ভা*জি, ডিম পোস ও কফি বানাতে পারি।”
জারিন বলে,
“সমস্যা নাই ভাইয়া। আপনি কেকটা বের করেন। আমরাও একটু টেস্ট করি।”
মাশরিফ হাতে থাকা ছোটো শপিং ব্যাগ থেকে একটা বাটি বের করল। তাতে কেকের পিস কে*টে কে*টে আনা হয়েছে। তারপর নিজেই সবার কাছে বাটি নিয়ে গেল। সবাই এক পিস করে কেক তুলে নেয়। তিতিরও ভদ্রতা সূচক হেসে কেকের পিস তুলে নেয়। কেকটা সামান্য খেয়ে মনে হলো ভালোই খেতে। সবাই প্রশংসা করল। তিতির এবার পাশে বসা ফাইজাকে নিচু স্বরে বলল,
“শোন, উনাকে জিজ্ঞেসা করতো, উনি আর্মিতে কোন পদে আছে?”
ফাইজা ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
“তুই জিজ্ঞেসা কর।”
“আরে তুই কর না। কৌতুহল হচ্ছে।”
“আচ্ছা ওয়েট। একটু পর জিজ্ঞাসা করি।”
মাশরিফ তিতিরের দিকে আড় নজরে লক্ষ্য করছিল। তিতিরকে ফাইজার কানের কাছে কিছু বলতে দেখে তার মন কৌতুহলী হলো কিন্তু সে তো ওদের ফিসফিসানি কথা শুনতে পাচ্ছে না। এদিকে মাশরিফের বন্ধুরা কেকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ!
কেক খাওয়া শেষ হওয়ার পর ফাইজা বলল,
“ভাইয়া তো দারুন কেক বানান। কেকটা জাস্ট ওয়াও! একজন আর্মির হাতের কেকও যে এতো সফট হতে পারে ধারণাতে ছিল না। ভেবেছিলাম হয়তো সফট হবে না। কিন্তু ধারণা বদলে গেলো। তা ভাইয়া? আপনি আর্মিতে কোন পদে আছেন?”
মাশরিফ চোখে হাসল। খানিক উ*সকা-তে বলল,
“যার প্রশ্ন সে করলেই পারত। আমি মাইন্ড করতাম না। আমি আর্মিতে মেজর পদে আছি। এই এক মাসের কিছুটা বেশি সময় হলো মেজর পদে পদোন্নতি হয়েছে।”
মাশরিফের প্রথম কথাটাতে তিতির খুব অপ্রস্তুত হয়ে পরল। কিছুক্ষণ আগেও এই প্রশ্নটা সে জিজ্ঞেসা করতে চেয়েও করেনি আর এখন বান্ধবীকে দিয়ে বলানোর পরেও বুঝে গেল! কিভাবে তা বোধগম্য হচ্ছে না তার। কিন্তু শেষোক্ত কথায় তার বুক ধ্বক করে ওঠল। মেজর! মনে সন্দেহের দানা যেনো কুঁড়িতে রূপান্তরিত হচ্ছে।
জারিন এবার মাশরিফকে প্রশ্ন করল,
“আর্মিতে ঢুকেছেন কতো বছর হলো ভাইয়া? এতো দ্রুত মেজর কিভাবে হলেন? না মানে, কিছু মনে করবেন না। আমার আইডিয়া নেই ব্যাপারটাতে।”
মাশরিফ হেসে জবাব দিল,
“আরেহ না। আমি কিছু মনে করেনি। আমাদের এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের পরপরই আমি আর্মিতে ভর্তি হই ক্যাডার হিসেবে। তখনি এপ্লাই করতে হয়। তারপর চার বছর কোর্সের শেষে দুই বছর আগে সেকেন্ড ল্যাফটেনেন্ট(আমার জানামতে সেকেন্ড ল্যাফটেনেন্ট প্রথমে হয়) হই তারপর আমার পদোন্নতি দ্রুতই হয়। সেই সাথে অভীরও। যেহেতু আমি ও অভী ক্যাডেটের স্টুডেন্ট এবং সবার থেকে আমার ও অভীর পারফর্মেন্স ভালো ছিল এটাও একটা কারণ তবে আমাদের দুজনের বাবাও আর্মিতে ছিলেন ও আছেন। তাছাড়া পদোন্নতির জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। অনেকের দ্রুত পদোন্নতি হয় আবার অনেকের দেরীতে। আর্মিতে পদোন্নতি দেরিতে হলে চাকুরির সময়ও জলদি শেষ হয়। দুই বছরে আমি মেজর হয়েছি।”
“ওহ আচ্ছা।”
তিতির নিরবে নিজের মনের ভিতরেই হিসেব মিলানোর চেষ্টাতে আছে। ‘এই মেজর মাশরিফ ইকবাল কোনোভাবে সেই চিঠির মালিক নাতো? আবার সেদিন সন্ধ্যায় যেই লোকটা আশ্রয়ের জন্য এসেছিল, তার নামও মা তো মাশরিফই বলেছিল।’ তিতিরের মস্তিস্কে একের পর এক তথ্য খোঁ*চাচ্ছে কিন্তু ক্লিয়ার হতে পারছে না।
ওদের কথার মাঝেই সেখানে ইনায়া, আরভি, রিনি, তাইজুল, আসফি, তাওহীদরা হাজির। ইনায়া এসে উচ্ছাসিত কণ্ঠে বলল,
“হাই গাইজ। কেমন আছো সবাই?”
তৎক্ষণাৎ রাফি কপালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে। ইনায়া গিয়ে রাফির পাশেই বসল। তারপর সকলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছু*ড়ল,
“কী নিয়ে কথা হচ্ছে? আরেহ! রণিত, রাতুল, মাশরিফ, অভী ভাইয়ারাও এসেছেন দেখছি। কেমন আছেন আপনারা?
রাতুল রাফির অবস্থা দেখে হাসি চেপে রেখে বলে,
“এইতো আলহামদুলিল্লাহ্। তুমি কেমন আছো ইনায়া?”
“কেমন থাকতে পারি বলুন? আপনার বন্ধু তো আমায় চোখেই দেখে না।”
ইনায়ার কন্ঠে দুঃখী ভাব। রণিক ফিক করে হেসে দেয়। রাফি ওর দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙালে রণিত নিজের মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে। অভী ইনায়ার কথার ধাঁচেই বলল,
“আহারে! এটাতো মহা অন্যায়! একে তো চরম থেকে চরমতর শা*স্তি দিতে হয়।”
মাশরিফও অভীর সাথে তাল মিলিয়ে বলল,
“একদম। বল রাফি, ১৫০০ মিটার দৈর্ঘ্যের মাঠ ১০ বার চক্কর দেওয়ার পা*নিশমে*ন্ট নিবি?”
“মে*রে*ই ফেল আমাকে!”
রাফির কথায় সবাই হেসে ওঠে। মাঝ দিয়ে রিনি বলল,
“তোমরা সবাই আমার এই ছোটো সুইট, ইনোসেন্ট বোনটার সাথে মজা নিচ্ছ কেনো? হ্যাঁ? আর রাফি ভাই, তুমিও?”
“এরে ভুলেও ইনোসেন্ট বলো না রিনি। তোমাকে বাজারে দশবার বে*চে-কি*নে আসতে পারবে।”
রাফির কথায় আবারও হাসির রোল পরে। ইনায়া মুখ ফুলিয়ে বসল। হাসির মধ্যেই মাশরিফ কেকের বাটি এগিয়ে দিয়ে বলল,
“নাও কেক নাও।”
ইনায়া ফটাফট কেক নিয়ে খেতে শুরু করে। রিনি কেকের পিস নিতে নিতে বলল,
“হঠাৎ কেক কেনো?”
রিনির প্রশ্নের জবাবে শুভ বলল,
“তুমি তো নিজের জন্মদিনই ভুলে যাও। কিভাবে যে আমারটা মনে রাখো আল্লাহ জানে! তাও একবার বারোটা এক মিনিটে লাস্ট মনে হয় আমাদের রিলেশনের প্রথম দিকে একবার উইশ করেছিলে। তারপর থেকে আধাঘণ্টা, দুই ঘন্টা, সকালে এভাবে উইশ করো। তাহলে তুমি মাশরিফের জন্মদিন জানবেই বা কিভাবে? অথচ এক বছর আগে ভালোই ট্রিট নিয়েছিলে।”
রিনি হালকা হেসে মাশরিফকে জন্মদিনের অভিনন্দন জানায়। সেই সাথে ইনায়ারাও। রিনি তারপর বলে,
“মেডিকেলে পড়তে পড়তে মনে হয় স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে গেছে। আর এক বছর ইন্টার্নির পর আবার এফসিপিএসের জন্য পড়াও শুরু করতে হবে। সেই সাথে মেডিকেল জবও। তোমাদের আর এক মাস বাকি তারপর তোমরাও পড়া শুরু করবে।”
অর্ক বলে,
“এখনি না। বিসিএসের জন্য তো সমানতালে তো পড়ছিই। এফসিপিএস কয়েকমাস পর ভর্তি হবো। জীবনটা শেষ হয়ে গেল! কই বিয়ে-টিয়ে করে সংসার করব! তা না!”
আরভি একটু লাজুক স্বরে বলল,
“মানা করল কে? করে ফেলুন। সব রাজি তো কেয়া করেগা কাজি!”
“ঠিক বলেছ। এক মাস পর বাসায় গিয়ে সরাসরি বিয়ের পিঁড়িতে বসব। মা তো মেয়ে ঠিক করেই রেখেছে।”
অর্ক কথাটা ইচ্ছাকৃতই বলেছে। আরভি মেয়েটা খারাপ না কিন্তু সে ডাক্তার মেয়ে বিয়ে করতে নারাজ।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।