খেলাঘর_১৫

0
370

#খেলাঘর_১৫

কায়নাত অনেক্ষণ চুপচাপ বসে আছে,এতক্ষণ যা ভেবেছিলো এখন দ্বন্দ্বে পড়ে গেছে আদৌও সে সাহেবকে সব বলবে কি না, সাহেব এবার অনেকটা বিরক্ত হয়ে বলল,
—তুই কি আমার সাথে নকশা করতিছিস? আমার খিদা লাগছে যদি দশ মিনিটের মধ্যে কথা না শেষ করিস তাইলে চল একটা রেস্টুরেন্ট এ বসি তুই খাবার অর্ডার করে চুপচাপ বসে থাক আমি খাই।
কায়নাত ফোস করে উঠে কিছু বলতে গিয়েও বলল না,সাহেব একটা সিগারেট জ্বালালো,আয়না নরম কণ্ঠে বলল,
—এত সিগারেট খাস কেন তুই?লিলি তোকে কিছু বলে না?
—আমার সিগারেট খাওয়া নিয়ে মন্তব্য করতে তুই এখানে আসিস নাই কায়নাত, তুই আসছিস তোর আর প্রহরের কথা বলতে, যদিও আমি জানি তাও আমি ভেবেছিলাম তুই বলবি
কায়নাত মাথা নিচু করে বলল,
—তুই কি জানিস?
—আমি এই জানি যে প্রহর আর তুই এখন আর একসাথে থাকছিস না, প্রহরের তিতলী নামের একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে, তিতলী নামের মেয়েটার সামনে বিয়ে।
কায়নাত চমকে উঠলো,
—তুই এত কিছু কিভাবে জানলি!
—সেটা জানতে হলে তোকে আরো পড়াশোনা করতে হবে এখনো তোর জানার সময় হয় নি,
সাহেব সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল,
—এখন বল তুই কি করতে চাইছিস?
—আমি প্রহর কে ভালোবাসি
—জানি
—আমি কিচ্ছুতে মন বসাতে পারছি না সাহেব আমি কি করব?
—আয়না আপারও হয়তো এমন লাগে তাই না রে?আপা কেমন আছে রে?
কায়নাত চমকালো, ওর মনে হলো এক বাড়িতে থেকে আপার খোজ নেয় না ও অনেক দিন! সাহেব হাসলো,
—অথচ তোর মতো একটা সময় কিন্তু আপাও পার করেছে, বরং তোর চেয়েও খারাপ,একজন যাকে সে ভালোবাসে তাকে সে পাবে না আবার এমন একজন যে তাকে ভালোবাসে কিন্তু তাকে সে চায় না তারপরও আপা তোর খেয়াল রেখেছে আঙ্কেলের খেয়াল রেখেছে চাকরি করেছে।আচ্ছা কায়নাত তুই তো এমন ছিলি না! তুই তো আপাকে বুঝতি আপার জন্যে ভাবতি, তুই এমন পালটে গেলি কি করে রে! তুই একবার ভেবে দেখিস তো নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে তুই তলিয়ে যাসনি তো!
সাহেব খেয়াল করলো কায়নাত কাদছে,সে জ্বলন্ত সিগারেট ডান হাতের মুঠোয় বন্দী করে নিভিয়ে ফেললো,
—কাদছিস কেন! কান্না বন্ধ কর।তুই প্রহরকে চাস?
কায়নাত অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সাহেবের দিকে সাহেব যা বোঝার নিজেই বুঝে নিলো।

লিলি অনেক্ষণ টেবিল চেয়ারে বসে পড়ছে সাহেব এতক্ষণ বিছানায় বসে পড়ছিলো এবার সে মেঝেতে বসে বিছানার সাথে হ্যালান দিয়ে পড়তে বসেছে,পড়তে বসেছে বললে ভুল হবে সে ঘুমে ঢুলছে এতক্ষণও পড়েনি সে পড়তে বসে তার ১৪৭ টা কল এসেছে এবং সে তাদের সাথে একেকবার ঝাড়ি মেরে একবার নরম সুরে একবার আদেশের কণ্ঠে কথা চালিয়েছে, তার ঘুম আসলেও লিলির জন্যে ঘুমুতে পারছে না কারণ লিলি পড়ালেখা করবে আর সে ঘুমাবে এইটা কিছুতেই হতে পারে না। লিলি টেবিল ছেড়ে উঠে গেলো, সাহেবের কাছে গিয়ে বলল,
—উঠে আসুন
—কোথায়?
—সুন্দরবন যাবো
বলেই লিলি ঘর থেকে বের হলো সাহেব আড়চোখে তাকিয়ে উঠে লিলির পিছু পিছু গেলো।
রান্নাঘরে এসে লিলি রান্নাঘরের তাকে পা ঝুলিয়ে বসে বলল,
—দুই কাপ চা, বানিয়ে ফেলুন তো ঝটপট।
সাহেব কিছুক্ষণ লিলির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
—তুমি আমাকে বলছ!
—আজকে আমি আপনার একটা বিরাট বড় উপকার করেছি কি না বলুন?
সাহেব ডান ভ্রু উচিয়ে বলল,
—তার কমিশন চাইছো?
—আপনি সেধে কোনো উপহার দিলে তো আর চাইতে হতো না
সাহেব ভাবলো এই মেয়ের সাথে তর্ক করা বৃথা।
সাহেব ঠুকঠাক শব্দ করে চা পাতা চিনি খুজতে লাগলো লিলিকে জিজ্ঞেস করলে সে বললো খুজে দেখতে বলল।অনেক মেহানত করে সে দুই কাপ চা বানালো।কাপে ঢালা হলে লিলি এক কাপ নিয়ে ঘরে যেতে যেতে বলল,
—আশা করি ঘুম কেটে গেছে এখন পড়তে পারবেন।
সাহেব কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো,একটু মুচকি হাসলো,মনে মনে বলল,তুমি বুদ্ধিমতি লিলি খুব বুদ্ধিমতি।সাহেব ঘরে এসে দেখলো লিলি বেলকনিতে, সাহেবের বেলকনিতে কোনো রেলিং নেই অনেকখানি প্রশস্ত খোলা বারান্দার মতো লিলি কোনায় গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসে চা খাচ্ছে।রাতের মৃদু বাতাসে সাহেবও লিলির পাশে গিয়ে বসলো।
—লিলি একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
—আমি জানি আপনি কি বলবেন
সাহেব হাসলো, সে জানতো একমাত্র সে ই পারে অন্যের না বলা কথা জেনে ফেলতে কিন্তু লিলি অন্যরকম একদম অন্যরকম।
—শুনুন সাহেব আমরা সবাই স্বার্থপর আমিও আপনিও
—আমি স্বার্থপর?
লিলি হাসলো,
—আপনি অবশ্যই স্বার্থপর নিজের স্বার্থের জন্যে আপনি তারেক ভাইকে ধরে রেখেছেন, আপনি জানেন তার বাবা চাইছে তাকে বাইরে পাঠিয়ে দিতে আপনি তাকে যেতে দিচ্ছেন না কারণ সে গেলে আপনি একদম একা হয়ে যাবেন,
—এরকম কিছুই না, ও ওখানে গিয়ে মানিয়ে নিতে পারবে না, তাছাড়া আঙ্কেলের শরীরও ভালো নয় ও গেলে আঙ্কেলকে কে দেখবে!
—এটা আপনার ব্যাখ্যা নিজের দেওয়া নিজেকে সান্ত্বনা।
—আবরার ভাইয়া কোথায় আছে আপনি জানেন কিন্তু কাউকে বলছেন না আপনি চাইছেন আয়না আপার সাথে বাদশা ভাইয়ার সম্পর্ক ঠিক হয়ে যাক
সাহেব এবার চুপ হয়ে গেলো
—আপনি জানেন যে, কায়নাত আপু প্রহর ভাইয়া কে ভালোবাসে তাও আপনি চাইছেন তিতলী আপুর বিয়েটা ভেঙে দিতে কারণ আপনি স্বার্থপর। আপনি এজন্যে কায়নাত আপুর থেকে নিজের ভালোবাসার কথা লুকিয়ে দূরত্ব বাড়িয়ে দেন নি যে আপনি চান সে ভালো একটা জীবন কাটাক, আপনি এজন্য লুকিয়ে রেখেছেন কারণ আপনার ভয় হতো যে এতে আপনাদের বন্ধুত্বটাও নষ্ট হয়ে যেতে পারেন।
লিলি চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে চুল খুলে দিলো,এক দমকা বাতাস এসে লিলির চোখ মুখ ছুতে দিলো,লিলি স্বভাবসুলভ হেসে বলল,
—আমি আপনাকে বিয়ে করেছি ওই বাড়ি থেকে মুক্তি পেতে, আপনাদের বাড়ির সবাইকে ভালোবেসেছি নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করতে, আপনাকে আজ প্রোটেক্ট করেছি নিজের সম্মান রক্ষা করতে।আমরা কেউ অন্যের জন্যে কিছুই করি না যা করি নিজের জন্যে করি।কায়নাত আপু কষ্ট পেলে আপনার কষ্ট হয় তাই আপনি চান সে ভালো থাকুক শুধু তাকে ভালোবেসে আপনি তাকে ভালো রাখেন না।
সাহেব মাথা নিচু করে রইলো মাথা তুলল না,
—এবার বলুন আপনি কি বলতে চান?
সাহেব অনেক্ষণ চুপ থেকে বলার মতো খুজে পেলো না কিছুই,লিলি উঠে যাবে এমন সময় বলল
—তার মানে তোমার মনে আমার সম্পর্কে ধারণা খুব একটা ভালো নয়, আচ্ছা যদি রিদিদের কথা তুমি নিজে না শুনতে তাহলে আজকের ঘটনা তুমি বিশ্বাস করতে তাইতো?
লিলি উঠতে গিয়েও উঠলো না বসে রইলো,
—যে মানুষটার ঘরে আমি সম্পূর্ণ নিরাপদ তাকে অবিশ্বাস করার ক্ষমতা আমার নেই।আপনাকে নিয়ে আমার কি ধারণা সেইটুকু আমার মনেই থাক, আপনি একজন দারুণ মানুষ সাহেব অসম্ভব রকমের ভালো মানুষ আমি জানি।
লিলি উঠে চলে গেলো।সাহেব উঠলো না বসেই রইলো,এই মেয়েটা একটু আগে তাকে ভেঙেচুড়ে এখন আবার বলছে সাহেব ভালো! কি অদ্ভুত মেয়ে! তার আরো একটা রাতযে নির্ঘুম কেটে যাবে আজ সাহেব বেশ বুঝলো।

কায়নাত আয়নার ঘরে এসে আয়নার মাথার কাছে বসলো, ওর মনে হলো আপুকে অনেক নিষ্পাপ লাগছে অনেক বেশি,একদম বাচ্চাদের মতো। ও কি আয়না কে ডেকে তুলে জিজ্ঞেস করবে?
—আপু তুমি কেমন আছো?তোমার কোথায় কষ্ট হচ্ছে আমাকে একটু বলোতো।
কায়নাত এমন কিছুই করলো না সে উঠে চলে এলো।বারান্দায় এসে দাড়াতেই তার মনে হলো রাস্তার ঠিক অপরপাশে খুব পরিচিত এক অবয়ব। খুব পরিচিত।

চারবছর অনেক সময় চার বছর পর সাহেবের পরিবর্তন চোখে লাগার মতো,সাহেব আজ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছে, রোজই ভোরে ওঠে এখন মনে হয় জীবনে সকাল দেখাটা মিস করা উচিত নয় সব মানুষের জীবনে সকাল দেখাটা জরুরি কি সুন্দর ধীরে ধীরে অন্ধকার কেটে যায়! এতক্ষণ সাহেব তার সেই বিখ্যাত বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চারিদিকে আলো ফুটতে দেখলো,হঠাৎ দরজায় কাউকে নক করতে শোনা গেলো সাহেব জানে এতসকালে এটা সুপ্তি ছাড়া কেউ না।সাহেব দরজা খুলতেই দেখলো পুতুলের মত একটা মেয়ে শাড়ি পড়ে হাসি মুকে দাঁড়িয়ে আছে, সাহেব হেসে বলল,
—শুভ সকাল ভাবি
—শুভ সকাল ছোট ভাইয়া, জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা
—শুধুই শুভেচ্ছা নাকি গিফট এর ব্যাবস্থা আছে?
—বুড়ো হয়ে যাচ্ছো ভাইয়া এখনো গিফট চাই
—কোথায় বুড়ো হলাম উনত্রিশ বছরের এক তাগড়া যুবকে তুমি বুড়ো বলছো ভাবি?
বাদশা ড্রয়িং রুমে এসে হাই ছাড়তে ছাড়তে বলল,
—ছি সুপ্তি ফিডার খাওয়া বাবুকে তুমি বুড়ো বলো তোমার তো সাহস কম না!
সুপ্তি হেসে বলল,
—অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে সাহেবের নিকট এই নিতান্তই বাদী ক্ষমাপ্রার্থী
—ক্ষমা মঞ্জুর করা হলো,
তারপর তিনজনই হেসে উঠলো।

চলবে….
সামিয়া খান মায়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here