খেলাঘর_১৮

0
320

#খেলাঘর_১৮

ছাদের কোণায় দাঁড়িয়ে বাদশা দেখলো হালকা কুসুম রঙের শাড়ি পড়ে আয়না আবরারের সাথে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আয়নার মুখ থমথমে, আবরার আয়নার কানে কানে কিছু বলতেই আয়না মুচকি হেসে ফেললো, আয়নাকে হাসতে দেখে বাদশাও হাসলো।কিছুক্ষণের মধ্যেই রিক্সায় ওরা কোথাও চলে গেলো।বাদশা আকাশের দিকে তাকালো,ভাবলো যেদিন আবরারের কাছে আয়না ফিরে গেলো সেদিনও এরকমই কোনো একটা রঙের শাড়ি সে পড়েছিলো,বাদশা বিড়বিড় করে বলল,
—তোমার পরিকল্পনা এত অদ্ভুত কেন সৃষ্টিকর্তা? কিছু মানুষের প্রতি টান কখনোই কমে না কেন? কিছু মানুষকে কাছে পাওয়ার তীব্র ইচ্ছে থাকা শর্তেও কেন তাকে পাওয়া হয় না! একজন মানুষ কি করে এতখানি জুড়ে থেকে যায়!?

ভার্সিটিতে কায়নাতের আজ মেকআপ ক্লাস নেওয়ার ছিলো বলে বাড়ি ফিরতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেছে অবশ্য আগে বাড়ি গিয়েও বা কি করবে আপু দুলাভাইও নাকি বাইরে গেছে। কায়নাত রিক্সা নিলো না উদ্দেশ্যহীন ভাবে রাস্তা ঘেষে হাটতে লাগলো।কিছুদূর এগোতেই দেখতে পেলো প্রহর দাঁড়িয়ে! কায়নাত আর সামনে না এগিয়েই রিক্সা খুজতে থাকলো, প্রহর নিজেই কায়নাতের সামনে দাড়ালো কায়নাত মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাতেই প্রহর অনুনয়ের সুরে বলল,
—কায়নাত!
কায়নাত চুপ করেই রইলো।
—তুমি আমার সাথে একমিনিট বসো প্লিজ কোথাও।
—দুঃখিত, আমি অপরিচিত কারো সাথে বসতে পারবো না,
প্রহর মেজাজ দেখিয়ে বললো,
—আমি তোমার অপরিচিত? তাহলে কার সাথে বসতে চাও তুমি? সাহেব?নাকি সৌহার্দ্য?
কায়নাত বিরক্ত হয়ে বলল,
—নান অফ ইওর বিজনেস,
—তুমি কিন্তু ভুলে যাচ্ছো এখনো আইনত তুমি আমার স্ত্রী,
—ডিভোর্স লেটারে আমি অনেক আগেই সাইন করে দিয়েছি,আমি নিজেকে আপনার স্ত্রী হিসেবে মানি না।
প্রহর আরো কিছু বলতো তার আগেই দূর থেকে দেখে সৌহার্দ্যকে ডাকলো কায়নাত, সৌহার্দ্য এইদিকে পার্কিং জোনে গাড়ি বের করতে এসেছিলো,কায়নাত ওকে ডেকেছে শুনেই ও সেদিকে গেলো,
—কি ব্যাপার আজ মিস আমাকে ডাকছেন!
—ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আপনি কি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারবেন প্লিজ?
সৌহার্দ্য অবাক হলো! এর আগে অনেকবার সে নিজে কায়নাতকে পৌঁছে দিতে চাইলে ও রাজি হয় নি, আজ সে নিজেই বলছে!সৌহার্দ্য হাসি মুখে বলল,
—শিওর!
—থ্যাংক ইউ সো মাচ!
—ইটস মাই প্লেজার
প্রহর রেগে গিয়ে বলল,
—তুমি কিন্তু আমার সাথে যেতে পারতে!
—আমি তা চাচ্ছি না।
বলেই কায়নাত গটগট করে সৌহার্দ্যের গাড়িতে গিয়ে বসলো।সৌহার্দ্য কিছুদূর চুপচাপ ড্রাইভ করে একটু কনফিউজড হয়ে বলল,
—এনি প্রবলেম ম্যাডাম?লোকটা কে?
—আমার হাজবেন্ড, হাজবেন্ড বললে ভুল হবে ডিভোর্স এর প্রসেসিং চলছে।
সৌহার্দ্য গাড়ি থামিয়ে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে কায়নাতের দিকে তাকালো কিন্তু কায়নাত তাকালো না ও সামনের দিকেই তাকিয়ে রইলো আশেপাশে তাকানো অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে সে, এখন শুধু সামনে তাকাতে চায় শুধুই সামনে।কায়নাত থমথমে মুখে ভাবতে লাগলো কি বোকাটাই না সে ছিলো! সেদিন যখন প্রহর এসে বললো ফিরে চলো কায়নাত আমি ভুল করেছি! কায়নাত মহানন্দে সব ভুলে প্রহরের সাথে চলে গেলো।কয়েকটা দিন প্রহর ভালোই ছিলো কায়নাতের মনে হলো এই তো সুখ! ও আবারো ভুল ভাঙলো, প্রহরের মা খুব অসুস্থ ছিলেন সে চাইছিলো ছেলে আর ছেলের বউকে একসাথে দেখতে, কিন্তু হুট করেই সে মারা যাবার পর প্রহর আগের মতো হয়ে গেলো, কায়নাতের প্রতি উদাসীন, তবে এবার সবচেয়ে জঘন্য যে কাজটি সে করেছিলো তা হলো তিতলীর বিয়ের পরও কেন প্রহর তার সাথে কথা বলে এই প্রশ্ন করতেই প্রহর তাকে চড় বসিয়ে দিয়েছিলো।সেদিন কায়নাত অবাক হয়েছিলো খুব অবাক ওর আপু এত রাগী কোনোদিন কায়নাতের গায়ে হাত দেয় নি না বাবা কে দিতে দিয়েছে! ওই মুহুর্তে কায়নাত সে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলো, আর কখনো প্রহরের দিকে ফিরে তাকায় নি।ডিভোর্স ও ফাইল করেছে, কিন্তু মাস ছয় হলো প্রহর এগ্রেসিভ হয়ে গেছে কায়নাতের জন্যে, কায়নাত শুনেছে তিতলী নাকি কন্সিভ করেছে নিশ্চয়ই এখন ও নিজের সংসার নিয়ে সুখী থাকতে চাইছে,আর প্রহর যে তিতলীকে দেখানোর জন্যেই আবার কায়নাত কে ফেরাতে চাইছে স্পষ্ট।প্রহরকে কায়নাত ভালোবাসে ঠিকই কিন্তু ওকে প্রশ্রয় সে আর কোনোদিন ই দেবে না ওর সাথে সংসার কায়নাতের আর হয়ে উঠবে না।এতদিন সাহেবকে কায়নাত কিছু জানায়নি এবাত মনে হচ্ছে ওর হেল্প দরকার।
কায়নাত আনমনে এসবই ভাবছিলো হঠাৎ খেয়াল হলো সাহেব অন্য রাস্তায় গাড়ি ঢুকিয়েছে, কায়নাত একটু লজ্জিত হয়ে বলল,
—সৌহার্দ্য আপনি আমায় এখানেই নামিয়ে দিন আমরা অন্য রাস্তায় চলে এসেছি
সৌহার্দ্য শান্ত কণ্ঠে বলল,
—তাহলে এখানে কেন নামবেন
—আপনার দেরী হয়ে যাচ্ছে
—হচ্ছে না, আপনি বলুন গাড়ি কোনদিকে নেবো?
কায়নাত আর কথা বাড়ালো না, বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই কায়নাত ভেতরে আসতে বলল,অন্যদিন আসবে বলে সৌহার্দ্য গাড়ি নিয়ে চলে গেলো।কায়নাত হাসলো, নিশ্চয়ই পালালো কায়নাত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো এখন নিশ্চয়ই আর সৌহার্দ্য কায়নাতকে অযথা লিফট দিতে চাইবে না।

রাতের বেলা সবাই সাহেবদের ড্রয়িং রুমে বসা,সুপ্তি সবার জন্যে নাস্তা তৈরি করে টেবিলে রাখছিলো ওর মুখে কোনো কথা নেই, কথা প্রসঙ্গে রেহেনা বললেন,
—জানো সুপ্তি?তুমি ঠিক যতটা চুপচাপ লিলি ততই বকবকিয়ে ছিলো আমার এমন কোনো কথা ছিল না যার জবাব আমাকে সে দিত না,আমার সাথে ঝগড়া না করলে ওর পেটের ভাত হজমই হতো না!
রেহেনা কেদে ফেললেন, সুপ্তি অবাক হয়ে চেয়ে রইলো মেয়েটা ঠিক কেমন হলে তার জন্যে শাশুড়ি কাদেন! সুপ্তির খুব ইচ্ছে হলো একবার সামনাসামনি লিলি কে দেখার,সাহেব হেসে বলল,
—মা!এই না তুমি লিলিকে তাড়ানোর জন্যে অস্থির থাকতে!যতদিন ওকে না পাই ততদিন তুমি একটু শান্তিতে থাকো,
—ওকে কি আমরা আর কখনো পাবো!
সাহেব শান্ত কণ্ঠে বলল,
—পাবো, তাকে আমার পেতে হবেই মা।
আহসান চৌধুরী উঠে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন, সাহেব খেয়াল করেছে লিলি প্রসঙ্গ উঠলেই তিনি একরকম পালিয়ে যান! কেন! লিলিকে খুব ভালোবাসে তাই?আহসান চৌধুরী ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে বসলেন, মাথা নিচু করে কুজো হয়ে ভাবতে লাগলেন,মেয়েটা আসলে কোন ধাতুর ছিল! সাহেব যেভাবে লিলিকে খুজছে পাতাল থেকে হলেও সে খুজে বের করবে, লিলি কি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারবে? আহসান চৌধুরী কখনো ভাবেন নি তার একটা ভুল এভাবে তার সন্তানের জীবন নষ্ট করে দেবে! সে ভাবতে লাগল,কি সুন্দর ভাবে শরীফুল ইসলাম তাকে হারিয়ে দিলো,তার সব’চে বড় দুর্বলতার সুযোগ সে নিলো।আহসান চৌধুরীর জীবনেও ভুল ছিলো যখন সাহেব ছোট তিনি একটা মোহে পড়ে গেলেন জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল তিনি করলেন দ্বিতীয় বিয়ে করে,তবে যাইহোক এতবছর তিনি তা লুকিয়েই রেখেছিলেন,মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে দিলেই নীরা চুপ থাকতো।আহসান চৌধুরী কখনও বুঝতে পারেন নি শরীফুল ইসলাম নীরার খোজ জেনে যাবেন!দুই বছর আগে, কি নিষ্ঠুর ভাবে সে বলল,নীরার খবর গোপন রাখতে হলে লিলিকে ফিরে আসতে হবে! আহসান চৌধুরী নিজে মেয়র পদ থেকেও রিজাইন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু শরীফুল ইসলাম চান তাকে মানসিক অশান্তি দিতে। লিলি আর আহসান চৌধুরীকে ডেকে সুন্দর মতো তিনি বুঝিয়ে দিলেন রেহেনা কতটা ইমোশনাল এটা শুনলে সে বেচে থাকতে পারবে না, লিলি শুধু সব শুনেছিলো সেদিন আহসান চৌধুরীর মনে হচ্ছিলো এর চেয়ে তার মৃত্যুই ভালো ছিলো হয়তো!লিলি কি সুন্দর করে হেসে শরীফুল ইসলাম কে বলেছিলো,
—আমি চলে গেলে কথা গোপন থাকবে কি করে বিশ্বাস করব?
—তুমি ভালো করেই জানো লিলি তোমার বাবা কথা দিয়ে কথা রাখেন
—আমি কিছুই জানি না।
লিলি আহসান চৌধুরীর সামনে গিয়ে বললো
—আমি বিয়েটা করেছিলাম এই লোকটাকে শাস্তি দিতে, আপনাকে আমি বাবা হিসেবে মেনেছি আপনার কোনো অশান্তি আমি হতে দেব না, তাছাড়া সাহেবের জীবনে আমি তেমন কেউ নই বাবা।আপনাকে মাথা নিচু করে মানায় না একদম না।বাড়ি চলে যান। আপনার দুর্বলতা মানেই আমার দুর্বলতা।
আহসান চৌধুরী ছোট নিঃশ্বাস ফেলে তার ফোন থেকে কাউকে ফোন করে বললেন,
—মা….

—ভাই, আমি ভাবির মামা স্ট্রোক করে হাসপাতালে আছেন, আমি হাসপাতালের বাইরেই দাড়িয়ে কিছু জানলে আপনাকে জানাবো।
ফোন কেটে পকেটে রেখে সাহেব সিগারেটের ধোয়া আকাশের দিকে ছেড়ে ভাবতে লাগলো,
—তুমি বুদ্ধিমতী লিলি, বরাবরের রহস্যময়ী কি চমৎকার ভাবে হারিয়ে গেলে তোমাকে খুজেই পাচ্ছি না! লুকোচুরি খেলায় আমাকে এভাবে হারিয়ে দিও না।তোমার রহস্যের জালে তলিয়ে গিয়ে যেদিন বুঝলাম ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়! তোমাকে ছাড়া চলবে না! যেদিন ভাবলাম আজ থেকে সবটা বিবাদ ভুলে আমার হবে তুমি সেদিনই হারিয়ে গেলে! কি নিষ্ঠুর তুমি! কি নিষ্ঠুর! কখনো মনে হয় তুমি অনেক সরল তোমার সবটা আমি জানি, আমি চিনি তোমাকে আমি পুরোটাই চিনি, তুমি এমন কেউ যাকে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় এইতো তুমি আমার অনেক কাছে একদম আমার বারান্দায়। ঠিক এই তুমিই মাঝে মাঝে এত কঠিন হয়ে যাও! তোমাকে বোঝানো যায় না, তোমাকে একদমই বোঝা যায় না, তোমার জায়গা থেকে তোমাকে নড়ানো যায় না টলানো যায় না চাইলেই তোমার মনের কথা একদমই শোনা যায় না।তুমি একটুও আমাকে শান্তি দাও না শান্ত থাকতে দাও না তবুও এই সহজ সরল তুমি আমার প্রিয়, এই দূর্ভেদ্য তুমিও আমার প্রিয়।
আজকাল আমি ক্লান্ত হয়ে যাই তোমায় পেয়ে, হারিয়ে, আবার খোঁজার খেলায় আমি দ্বিধায় পড়ে যাই।তারপর আবার উঠে দাড়াই মনে হয়, আমার তোমাকে চাই,আমার তো তোমাকে চাই!

চলবে…
সামিয়া খান মায়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here