#খেলাঘর_৯
লিলি ভার্সিটি থেকে এসে দেখলো সাহেব বেঘোরে ঘুমুচ্ছে, ও ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ পায়চারি করতে লাগলো,তার আর ধৈর্য কুলালো না সে সাহেবের ঘুম ভাঙার অপেক্ষা না করেই তাকে ডেকে তুললো,সাহেব একটু বিস্মিত হলো প্রয়োজন ছাড়া লিলি তার সাথে কখনো কথা বলে না হঠাৎ ডেকে তুলছে কেন!ও ঘুম থেকে উঠে একদম স্বাভাবিক ব্যাক্তির মতো কথা বললো,
—কি ব্যাপার লিলি কোনো সমস্যা?
লিলি আড়চোখে তাকালো কে বলবে এই লোক এতক্ষণ বেঘোরে ঘুমিয়েছিলো!ঘুমের কোনো রেশ তার চেহারার কোথাও নেই নিজেকে সামলে লিলি একটা চেয়ার টেনে গম্ভীর মুখ করে বসলো,সাহেবের কেন জানি হাসি পেয়ে গেলো এরকম চেহারা একমাত্র লিলি তার সামনেই করে বাকি সবার সাথে তাকে দেখা যায় অন্যরূপে,
—সমস্যা, বিরাট সমস্যা
এবার সাহেব একটু নড়ে চড়ে বসলো
—কি হয়েছে তোমার বাবা…
লিলি হাতের ইশারায় থামিয়ে বললো
—আমার বাবা বিষয়ক সমস্যা আমি নিজেই সমাধান করতে পারি সেটা আপনার চেয়ে ভালো কেউ জানে না সমস্যা টা আপনি
—আমি?
—জ্বী
—কিরকম
—আজকে ভার্সিটি তে কি হয়েছে জানেন?
সাহেব চোখ সরু করে কপালে ভাজ ফেলে বলল,
—কি হয়েছে? কেউ তোমাকে কিছু বলেছে? কে সে? কিন্তু এরকম তো কিছু হলে তোমার আগে আমি জানতে পারতাম, আমার লোক…
—এক্সাক্টলি,আপনার লোক, আপনার যে সারা দুনিয়ায় এত ভাই তা তো আমি জানতাম না, এখানে সেখানে যেখানেই যাচ্ছি সেখান থেকেই কেউ না কেউ ভাবি ভাবি বলে চিল্লাচ্ছে ক্যান্টিনে,মাঠে, ক্লাসের বাইরে যে কেউ দেখলেই সালাম দিয়ে বলছে ভাবি ভালো আছেন কোনো সমস্যা?মানে আমি কি জাতীয় ভাবি?আজকে তো সব লিমিট ক্রস হয়ে গেছে, ভালো কথা আজ যে আপনার অনার্সের রেজাল্ট দিয়েছে জানেন?
সাহেব এতক্ষণ লিলিকে দেখছিলো, আজ প্রথম সে সাহেবের সামনে খোলস ছেড়ে নিজ স্বভাবে কথা বলছিলো, রেজাল্টের কথায় হঠাৎ ওর টনক নড়লো ওর কেমন জানি লজ্জা করতে লাগলো এই প্রথম ওর মনে হচ্ছে একটু হলেও পড়া লেখা করলে আজ লিলির সামনে চোখ নিচু করে ফেলতে হতো না, এমনিতে অবশ্য ওর পড়ালেখা নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই কিন্তু লিলি খুব ভালো স্টুডেন্ট যাকে বলে মাত্রাতিরিক্ত ভালো তার সামনে ওর রেজাল্টের কথা শুনতে খুবই অপমানিত বোধ হচ্ছে
—কই নাতো!
—গ্রেট! যার বিয়ে তার হুশ নেই পাড়া পড়শির ঘুম নেই
—কার বিয়ে!?
লিলি ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
—আজকে আপনার ফাইনাল ইয়ারের রেজাল্ট দিয়েছে আপনার পয়েন্ট ২ .৮০, মানে আপনি পাশ করেছেন আর এই খুশিতে সারা ভার্সিটিতে আপনার সাঙ্গ পাঙ্গরা মিষ্টি বিতরণ করছে, আপনি একটু শান্ত মাথায় ভেবে বলুন এটা মিষ্টি বিতরণ করার মতো রেজাল্ট কি?তারা কি করেছে জানেন? আমার ডিপার্টমেন্ট এর সবাইকে মিষ্টি দিয়ে বলেছে সাহেব ভাই ২ .৮০ পেয়ে পাশ করেছে ভাবির উসিলায় সবাই মিষ্টি খাও, কিছু মেয়ে খুব আগ্রহ নিয়ে মিষ্টি খেয়েছে আর কিছু ছেলে মুখ টিপে হাসছিলো,ভাবতে পারেন আমি কতটা লজ্জা পেয়েছি,আমি জানি সবাই সব পারে না আমি মেনেও নিলাম কিন্তু আপনি বলুন এভাবে যেচে অপমানিত হতে কে চায়?
সাহেব এবার একটু ভ্রু কুচকে তাকালো,তার জন্যে সে যে পাশ করেছে এই ঢের কিন্তু লিলি কি বলতে চাইছে সে কি সাহেব কে অপমান করছে?
—কি বলতে চাইছো?
—আপনি এখনো বোঝেন নি?
—তুমি কি বলতে চাইছো আমার দ্বারা লেখাপড়া সম্ভব না?
—এই কথা আমি সরাসরি কিভাবে বলি?আপনিই বলুন এই যে রেজাল্ট এতে আপনার অবদান কতটুকু?
সাহেব সহজে কোনো কথা গায়ে মাখে না কিন্তু আজ লিলির কথাগুলো ও নিতে পারছে না ও হঠাৎ রেগে লিলির বাহু ধরে বললো,
—মিস লিলি এত অহংকার ভালো না সাহেব চৌধুরী চাইলে পারে না এমন কাজ এই দুনিয়াতে খুব কম আছে,
লিলি অন্য হাতে হাই আটকে বললো
—হ্যা সেই কম কাজের মধ্যে পড়ালেখা একটা,আর মিস না মিসেস।
সাহেব এবার আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না ওর ঘরের সোফার কোনায় লাথি মেরে বললো,
—বলো মাস্টার্স এ কি রেজাল্ট তুমি দেখতে চাও?
লিলি ডান ভ্রু উচু করে বললো,
—ভেবে বলছেন?
—স্পিক আপ
—আপনি টেনে টুনে ৩ .৪০ পেয়ে দেখান
সাহেব কিছু না বলে দুম দাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আহসান চৌধুরী আর বাদশা এসে লিলিদের ঘরে ঢুকলো আহসান চৌধুরী খুব উদ্বেগ নিয়ে বললো,
—কিরে মা?কাজ হয়েছে? নবাবজাদা তো দেখলাম রেগে বেরিয়ে গেলেন।
—ভাইয়া তুমি কার্ড রেডি রেখো বাজিতে তুমি হেরে যাবে শপিং কিন্তু করাতে নিতে হবে
—তোর মনে হয় সাহেব পড়তে বসবে?
—বসবে মানে গড়াগড়ি করে বসবে,
বলেই তিনজনে চোরের মতো হেসে উঠলো
কায়নাতের আজ রেজাল্ট দিয়েছে বরাবরের মতোই সে টপ টেনের একজন,এর আগে যতবার ওর ইয়ার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে ততোবার বাড়িতে একটা উৎসব উৎসব ভাব, আপা জমিয়ে রান্না করেছে বাবা গিফট কিনে দিয়েছে অথচ আজ! এবাড়িতে কেউ জানেই না ও কত ভালো রেজাল্ট করেছে,ওর বুক ফেটে কান্না আসছে এমন সময় ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো
—ফোর্থ হইছিস ট্রিট দিবি না?
—তুই পাশ করছিস
—সাহেব চৌধুরী কখনো ফেইল করে না
—তোর রেজাল্ট এ যে তোর কতটুকু অবদান তা আমার ভালোই জানা
—দেখ তুইও খোচা মারা কথা বলতিছিস কিন্তু
—আমিও মানে? তার মানে লিলিও?
কায়নাত একটু হাসলো
—ওই ফালতু মেয়েটার নাম আমার মুখের সামনে বলবি না
কায়নাত ওদের খুনসুটির কথা ভেবেই উদাস কণ্ঠে বললো
—তার মানে তোদের সংসার বেশ জমে উঠেছে তাইতো? তাও ভালো
—তুই বলছিস তোর সংসার জমে নি? কি লীলা খেলা দেখিয়ে তো ধাই ধাই করে নেচে নেচে বিয়ে করলি এতটুকুতেই সাধ মিটে গেলো নাকি?
—খুব মিটেছে
সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
—কায়নাত?
—বল,
—তুই ভালো নেই না?
কায়নাত তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল
—খুব ভালো আছি আমাকে ভালো থাকতেই হবে।
ভার্সিটির আপডেট জানাস তো আমাকে জানলে মাস্টার্স এর। এখন রাখছি কেমন?
—রেখে দে।
কায়নাত ফোন কেটে ফুপিয়ে কেদে উঠলো ওর বাবার শরীর একদম ভালো নেই, মাথার সব চুল ঝরে গেছে শুকিয়ে হাড় বেরিয়ে এসেছে, কত আশা করে দুটি মেয়ের বিয়ে সে দিয়েছে! যদিও তার আপা বাবাকে খুশি করতে দুলাভাইকে এখন ওদের বাড়িতে এসে থাকার অনুরোধ করেছে বলে সে এখন তাদের বাড়িতে আছে, কিন্তু বাবা খুব বোঝে আপা ভালো নেই,এর মধ্যে যদি কায়নাতও গিয়ে ওই বাড়িতে ওঠে এটা বলে যে সে স্বামী সংসার করতে পারলো না তাহলে ওর বাবা হবে এই পৃথিবীর সবচেয়ে অসুখী মানুষ, এই কটা দিন আর ও বাবাকে কষ্ট দিতে চায় না।
কায়নাত ফোন টা কেটে দিতেই সাহেব ওর ফোন টা ছুড়ে মারলো একটা গাছের সাথে লেগে তা কয়েক টুকরো হয়ে গেলো, ও জানে কায়নাত ভাল নেই কায়নাতের কণ্ঠ বলছে সে ভালো নেই।সাহেব একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিলো,ধোয়ার সাথে সাথে বিষন্নতাগুলো ওকে ঘিরে ধরলো।
চলবে…..
সামিয়া খান মায়া