“বসন্ত এসেছে পর্ব_১

0
786

শাড়ির আঁচল এক পাশে ফেলে রেখে কেবল কুঁচি গুলো ঠিক করার চেষ্টা করছিল বেলা ঠিক সেই সময় খট করে দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করল কেউ।সেদিক তাকিয়ে চমকে উঠল বেলা।দ্রুত হাতে কোনমতে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে নিল।লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে তার।বেলাকে এহেন লজ্জা পেতে দেখে তার দিকে কয়েক কদম এগিয়ে এলো রায়ায।মাথা নত করে রায়াযকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে খপ করে বেলার হাতটা ধরে তাকে থামিয়ে দিল রায়ায।চোখ তুলে তাকাল বেলা।সাথে সাথে আবার নায়িয়ে নিল চোখ।রায়ায এই গভীর অটল চোখ দুটোর দিকে খুব বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারে না বেলা।কেমন গা শিরশির করে উঠে তার।নিজের ভাবনায় মগ্ন বেলা,,আকস্মাৎ শুনতে পায় রায়াযের রাশভারি কন্ঠস্বর,

-“তোর সব কিছু কী আমার রুমে এসে করতে হবে?এমন কী শাড়িটা ও আমার রুমে এসে পড়তে হবে?আর এই সকাল সকাল শাড়ি পরে কী করবি তুই?আমার জানামতে ফ্যাংশন সন্ধ্যা*র পর।এতো তাড়াতাড়ি শাড়ি পরে করবি টা কী?”

নিম্নস্বরে বেলার জবাব,

-“মেহমান দিয়ে বাড়ির আশেপাশে গিজগিজ করছে।কোথাও কোনো রুম ফাঁকা নেই।কেবল আপনার রুমটাই ফাঁকা ছিল তাই আপনার রুমে এসেছি।”

ভ্রু কুঁচকে রায়ায পুনরায় প্রশ্ন করল,

-“আর সকাল সকাল শাড়ি পরে কাকে দেখতে যাচ্ছিস?”

বেলার অকপট জবাব,

-“কাকে দেখতে যাবো রায়ায ভাই!আমিতো এমনিতেই ট্রায়াল দেওয়ার জন্য পড়ছিলাম।”

বুকে হাত গুজে কিছুটা শক্ত কণ্ঠে রায়ায বলল,

-“সবই বুঝলাম।কিন্তু শাড়ি না পড়ে এভাবে উদ্ভট সেজে কোথায় পালাচ্ছিলি?শরীরের প্রতিটা ভাঁজ বোঝা যাচ্ছে।”

বেলাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে পুনরায় বলে উঠল,

-“ফর্সা পেট আর কোমর দুটোই তো দেখা যাচ্ছে।বুকের আঁচল ও ঠিক নেই।এভাবে শরীর দেখিয়ে ছেলে পটাতে চাইছিলি বুঝি?”

কথাটা বলেই বেলার বুকের আঁচল খানা নিজ হাতে ঠিক করে দিল রায়ায।

চকিতে রায়াযের দিকে তাকিয়ে বেলা জবাব দিল,

-“এসব কী বলছেন রায়ায ভাই? ছিঃ ছিঃ! আমি কেন এসব করতে চাইবো?”

-“তাহলে এমন অগোছালো অবস্থায় কেনো রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলি?যদি কোনো ছেলে এই অবস্থায় তোকে দেখে ফেলত?তাহলে কী হতো?

শাড়ির আঁচল আঙ্গুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে ভীতু কণ্ঠে বেলা জবাব দিল ,

-“আসলে আপনি চলে আসায় তাড়াহুড়ো করে বেরোতে চাইছিলাম তো তাই।”

-“ঠিক আছে, সব বুঝলাম এখন তাড়াতাড়ি শাড়ি পরে রুম থেকে বের হো।”

বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বেলা জিজ্ঞেস করল,

-“আপনার সামনে?”

সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে আরাম করে বসতে বসতে রায়াযের জবাব,

-“হ্যা পরবি।তাতে সমস্যা কোথায়?”

নিচু কণ্ঠে বেলার জবাব,

-“আমার লজ্জা করবে রায়ায ভাই!”

ভ্রু কুঁচকে রায়ায জবাব দিল,

-“বারে!ছোটবেলা যখন আমার সামনে খালি গায়ে ঘুরঘুর করতি তখন বুঝি লজ্জা করতো না।”

লজ্জার ললবর্ণ ধারণ করলো বেলার চোখমুখ। গাল আর কান দুটো হয়ে উঠল আগুনের ন্যায় গরম।লজ্জায় মিইয়ে যেতে যেতে অস্ফুষ্ট স্বরে বলে উঠল,

-“তখন ছোট ছিলাম রায়ায ভাই।”

তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এবার বেলার দিকে এগিয়ে এলো রায়ায।শক্ত হাতে স্পর্শ করল বেলার উন্মুক্ত কোমর।মৃদু কেঁপে উঠে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিল বেলা।নিজের বক্ষঃপটে বেলার কোমল হাত চেপে ধরে গম্ভীর কণ্ঠে রায়ায প্রশ্ন করল,

-“এখন তাহলে নিশ্চয়ই খুব বড় হয়ে গেছিস তাই না?তাহলে আমার বুকের পা পাশে প্রণয়ের আগুনে দগ্ধ হওয়া হৃদযন্ত্রের বেদনা এখনো কেনো বুঝে উঠতে পারছিস না বেলা।”

চকিতে রায়াযের মুখপানে তাকাল বেলা। কম্পণরত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

-“মা….নে!?

বেলাকে ছেড়ে উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে পড়ল রায়ায।সামলে নিল নিজেকে।নিজের অনিয়ন্ত্রিত অনুভূতিকে।পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে লাইটারের সাহায্যে ধরিয়ে তা মুখে পুরে নিল।বার কয়েক টান দিয়ে কাঠখোট্টা কণ্ঠে জবাব দিল,

-“কিছুনা। তাড়াতাড়ি শাড়ি পরে বের হো আমার রুম থেকে”

অভিমানে চোখ ভরে এলো বেলার।রায়ায ভাই সব সময় তার সাথে এমন করে।প্রথম প্রথম নিজেই বেলাকে কীসব উদ্ভট টাইপ কথাবার্তা বলে।বেলা যখন বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে উঠে,,তখনই কেমন কঠোর কণ্ঠে তার সাথে কথা বলে উঠে রায়ায।তাকে কেমন নিজের থেকে দুরদুর করে।যা বেলার কোমল মনে খুব গভীর থেকে গভীরে আঘাত করে।কিন্তু ভয়ে মুখ ফুটে রায়াযকে কিছু বলতে পারে না বেলা।যদি আরও বেশি বোকা দেয়।তাহলে আরো বেশি কষ্ট পাবে বেলা।সে ভয়ে চুপ থাকে সে।বেলাকে সেই তখন থেকে মূর্তির ন্যায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে এবার তার দিকে ফিরে তাকাল রায়ায।রক্তের ন্যায় লাল হয়ে যাওয়া রায়াযের চোখ জোড়া দেখে ভয়ে কেঁপে উঠল বেলা।ললাট কুঁচকে রায়ায প্রশ্ন করল,

-“কী ব্যাপার বেলা?এখনো দাঁড়িয়ে আসিস যে। শাড়ি ঠিকঠাক করে না সেই কখন যেতে বলেছি।স্কুলে যাবি না নাকি? খাম্বার মত না দাড়িয়ে থেকে এবার তাড়াতাড়ি বের হো ।”

মাথা নত করে বেলা জবাব দিল,

-“আমি শাড়ি পরতে পারি না রায়ায ভাই।যাবো কী করে বাহিরে।কষ্ট করে একটু মা কিংবা বড়মা কে ডেকে দিবেন?”

মুখ থেকে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বেলার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রায়ায।অসস্তিতে হাসফাঁস করতে লাগল বেলা।বেলার মিইয়ে যাওয়া লজ্জারাঙ্গা মুখের দিকে তাকিয়ে আড়ালে মৃদু হাসল রায়ায। যা মিস করে গেল বেলার দৃষ্টিকোণ।হ্যাঁচকা টানে বেলাকে নিজের কাছে নিয়ে এলো রায়ায।হকচকিয়ে গেল বেলা। ফলস্বরূপ তার সিক্ত ওষ্ঠ এসে স্পর্শ করল রায়াযের বক্ষঃস্থল। বেলা চোখ বড় বড় করে তাকাল রায়াযের মুখপানে।চোখমুখ শক্ত করে তার দিকেই তাকিয়ে রায়ায।ভয়ে ঢোক গিলল বেলা।এবার বুঝি রায়ায তার পিন্ডি চটকাবে।কিন্তু বেলাকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে বেলার সম্মুখে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল রায়ায।অনুভূতিহীন মানবের ন্যায় এক এক করে ভাঁজ করতে লাগল বেলার শাড়ির কুঁচি। একের পর এক শক যেন আর নিতে পারল না বেলা।বিস্মিত কণ্ঠে রায়াযের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে উঠল,

-“রায়ায ভাই আপনি শাড়ি ও পরাতে জানেন?”

জবাব নিল না রায়ায।ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বেলার শাড়ি ঠিক করে দিতে লাগল নিরবে।রায়াযের এহেন নিরবতা ভীত সৃষ্টি করল বেলার চিত্তে।নিজেকে আর সংযত রাখতে পারল না।কম্পিত কণ্ঠে রায়াযের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল,

-“কার জন্য শাড়ি পড়া শিখেছেন আপনি রায়ায ভাই?নাকি এর আগে কাউকে পড়িয়েছেন শাড়ি?”

অকস্মাৎ বেলার এহেন উদ্ভট প্রশ্নে হাতজোড়া আপনা আপনি থেমে গেল রায়াযের।নির্নিমেষ কয়েক পল বেলার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে পাল্টা প্রশ্ন করে উঠল,

-“তোর কী মনে হয়?”

অস্থির হয়ে পড়ল বেলা।অস্থির স্বরে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,

-“বলুন না! কার জন্য এতো সুন্দর করে শাড়ি পরা শিখলেন রায়ায ভাই?”

অকপট কণ্ঠে রায়াযের জবাব,

-“যায় জন্যই শিখি না কেনো?তোর জন্য শিখি নি এটা তুই সিউর থাক।

চোখ ভরে উঠল বেলার!এখনই বুঝি গড়িয়ে পরল এক ফোঁটা জল। কিন্তু নিজেকে সংযত করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সে।বুকের পাশের আঁচল ঠিক করতে করতে রায়ায বলল,

-“কাঁদতে চাইছিস বুঝি?”

চমকে রায়াযের দিকে তাকাল বেলা।নিজেকে ধাতস্থ করে জবাব দিল,

-“কই না তো।”

রায়াযের নির্লিপ্ত জবাব,

-“তোর চোখে অহরহ বেদনার ঝাঁক দেখতে পারছি আমি বেলা।এতো কিসের কষ্ট তোর এই বয়সে শুনি!”

-“কিছু না রায়ায ভাই।আমি একদম ঠিক আছি।”

-“ঠিক আছে তাহলে যা এবার।”

এক মিনিট ও ব্যয় না করে দ্রুত পায়ে রায়াযের রুম ত্যাগ করল বেলা।বেলার যাওয়ার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে রায়ায বিড়বিড় করে উঠল,

-“আমার হৃদয়াসিক্ত চন্দমল্লিকা! কবে বড় হবি তুই?”
.
.
বেলার ক্রন্দনরত কণ্ঠ কর্ণপাত হয়েই ধক করে উঠল রায়াযের অন্তঃকরণ।কেবল মাত্র স্নান সেরে বেরিয়েছিল সে।কোমরে তার কেবল একটা তোয়ালে জড়ানো।কোনো দিক-বেদিক বিচার না করেই রায়ায ছুটতে লাগল বেলার রুমের উদ্দেশ্যে।বেলাকে কাঁদতে দেখে দ্রুত এগিয়ে গেল তার দিকে।দুহাতে আগলে ধরে,, নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল বেলাকে।মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত করতে লাগল।রুমি রওশনকে দৃষ্টিপাত হতেই জিজ্ঞেস করল,

-“কী হয়েছে ছোট মা?বেলা এবাবে কাদঁছে কেনো?তুমি কী ওকে কিছু বলেছো?”

অবাক কণ্ঠে রুমি রওশন রায়াযের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

-“তার আগে তুই বলে!তুই এমন অর্ধনগ্ন হয়ে শুধু একটা তোয়ালে পরে এতগুলো মহিলা মানুষের সামনে ঘুরঘুর করছিস কেনো?”

কথাটা শেষ করতেই রুমে উপস্থিত থাকা সকলে জোরে হেসে উঠল।সংবিৎ ফিরে এলো রায়াযের।তবে একচুলও নড়ল না সে।আগের মতই শক্ত করে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে রইল বেলাকে। আঁতকে উঠল বেলা।নিজেকে রায়াযের বাহুডোরে থেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলে উঠল,

-“এ কী করলেন রায়ায ভাই?এখন বিয়ে বাড়ির সব মেয়েগুলোও নিশ্চয়ই আপনাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে!”

বেলার কথা শুনে আশেপাশে নির্নিমেষ চোখ বুলালো রায়ায।সত্যি!মেয়েগুলোও কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে।সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বেলাকে জিজ্ঞেস করল,

-“কী হয়েছে? তখন এভাবে কাঁদছিলি কেনো?”

জবাব দিল রুমি রওশন,

-“আর বলিস না এই মেয়ের কার্যকলাপের কথা!চুল আঁচড়ায় না মনে হয় এক বছয় ।চুলে কী জটলাই না বাধিয়েছে।এখন চুলের জটলা ছাড়িয়ে চুলে বেনুনি করে দিতে চেয়েছিলাম।আর এই শুরু হলো তার নাটক।শুরু করে দিল বাচ্চাদের মত ভ্যাঁ ভ্যাঁ করা।বলি বয়স তো আর কম হলো না তোর।১৬ বছর হয়ে গেছে অনেক আগেই।কিছুদিন পর তো বিয়ে দেওয়া যাবে।

অভিমানী কণ্ঠে বেলার জবাব,

-“আমি কোনো নাটক করিনি রায়ায ভাই। সত্যি আমার খুব ব্যাথা লাগছিল।”

বেলার মুখপানে একপলক তাকিয়ে থেকে রায়ায বলল,

-“চল আমার সাথে।”

অবাক হলো রুমি রওশন।অবাকান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

-“কোথায় যাবে ও আবার তোর সাথে।”

বেলার হাত নিজের মুঠোয় পুরে নিয়ে রায়াযের ভাবলেশহীন উত্তর,

-“আমার রুমে।”
.
.
.
চলবে কী…?

#বসন্ত_এসেছে
#পর্ব_১
#মাহিমা_রেহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here