#বসন্ত_এসেছে
#পর্ব_৬
#মাহিমা_রেহমান
মাঝরাতে নিজের মেয়ের বিয়ের কথা শুনে মাথা ঘুরে উঠল রুমি রওশনের।ভাসুরের ছেলেকে নিজের মেয়ের স্বামী হিসেবে মানতে নারাজ রুমি রওশন।কারণ একটাই,, সে তার বান্ধবী আলিফা কে কথা দিয়েছে,, মেয়েকে বিয়ে দিলে তার বান্ধবীর ছেলের সাথেই দিবে! কিন্তু মাঝখান দিয়ে এ কী কাণ্ড ঘটিয়ে আসলো বেলা? রাগে বিভৎস হয়ে তিনি তেড়ে গেলেন বেলার দিকে।শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সপাট করে চড় মেরে দিলেন গালে।তেঁতে উঠলেন জিসান রওশন।স্ত্রীকে দুহাতে জাপটে ধরে আটকালেন।বলে উঠলেন,
-“পাগল হয়ে গেলে রুমি? মারছো কেনো ওকে তুমি?”
-“ছাড়ো বলছি আমাকে? ওকে আমি আজকে মেরেই ফেলব।”
তৎক্ষণাৎ বেলাকে নিজের বক্ষঃস্থলে ঠায় করে দিল রায়ায।শক্ত কণ্ঠে রুমি রওশনের উদ্দেশ্যে বলল,
-“ছোট মা ভুলে যেও না,,সে এখন আমার স্ত্রী।আর তোমার থেকে এখন ওর উপর আমার অধিকার বেশি।তাই নেক্সট টাইম ওর গায়ে কেউ হাত তুলুক।তা আমি মোটেও সহ্য করব না।”
জহির রওশন ছেলের দিকে এগিয়ে এসে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,
-“যা করার করেছ তাই বলে এই নয় এখনই বেলাকে তোমার হাতে তুলে দেব আমরা।সবার আগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করো। নিজের একটা শক্ত জায়গা তৈরি করো,,,বেলাকে সুখে রাখার রাস্তা বের করো তাহলেই তুমি বেলাকে পাবে তার আগে নয়। কোনো মাই তার মেয়েকে বেকার ছেলের হাতে তুলে দিতে চায় না সেখানে তুমি রাজনীতি করে গুন্ডাদের মত পুরো এলাকা ঘুরে বেড়াও। নিজেদের ফ্যামিলি বিজনেস থাকতেও সেখানে অ্যাটেন্ড করো না। আগে নিজেকে প্রমাণ করো।
ততদিন বেলা আগের মতই এবাড়ির মেয়ে হয়ে থাকবে,,তোমার স্ত্রী নয়। আর তুমি ওবেলার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলবে।”
কথাটা বলে তিনি রুমি রোশনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-“বেলাকে ভিতরে নিয়ে যাও। আর ভুলে ওর গায়ে আর একটা ফুলের টোকাও দেওয়ার চেষ্টা করবে না। দোষ কেবল ওর একার না। দোষ আমার ছেলেরও। তাই ও একা ক্যান শাস্তি পাবে? শাস্তি পেলে দুজনেই পাবে।
আর এদের শাস্তি হলো,, এরা একে-অপরের থেকে আলাদা থাকবে।যেদিন রায়ায প্রমাণ করতে পারবে ও বেলার যোগ্য,,সেদিনই ও বেলাকে নিজের স্ত্রী রূপে পাবে।তার পূর্বে এরা আগের মতই আলাদা আলাদা রুমে থাকবে।”
পুনরায় বেলা আর রায়াযের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন,
তোমরা দুজন এবার যার যার রুমে যাও ।অনেক কিছুই তো দেখিয়ে ফেলেছ আমাদের।”
কথাটা বলেই তিনি নিজের রুমের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন।রুমি রওশন শক্ত হাতে বেলার বাহু চেপে ধরে টানতে টানতে নিজের সাথে নিয়ে গেলেন। ছলছল চোখে তখনো বেলা রায়াযের দিকে তাকিয়ে।প্রিয়সীর এহেন ব্যাথাতুর দৃষ্টি দেখে অন্তঃকরণ ধপ করে উঠল রায়াযের। সেদিকে শক্ত মুখে তাকিয়ে রইল সে।
.
.
ধাক্কা মেরে বেলাকে রুমের ভিতর ফেলে রুমি বেগম বাহির দিয়ে তালা দিয়ে দিলেন।সত্বর নিজের ট্যাবটা খুজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো বেলা। সৌভাগ্যবশত পেয়েও গেল।দ্রুতহাতে সে কল করলো রায়াযের হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে।বেলার নম্বর থেকে কল আসতে দেখে কল রিসিভ করলো।কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বেলা বলতে লাগলো,
-“রায়ায ভাই দেখুন না,, মা আমাকে রুমের মধ্যে বন্দী করে রেখে গেছে।”
বলে ফুঁপিয়ে উঠলো সে। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো রায়ায। বলল,
-“কাঁদছিস কেন বোকা মেয়ে? কাঁদার কি হলো এখানে? ছোট মা একটু রেগে আছে তো তাই হয়তো এমন করেছে।
চুপ কর! আর কাঁদতে হবে না। আচ্ছা ওয়েট, ভিডিও কল দিচ্ছি।আমার সাথে কথা বলতে থাক।”
কথাটা বলেই রায়ায বেলাকে ফোন লাগালো। পরবর্তীতে তারা দুজনের কেউই আর ঘুমালো না সারারাত জেগে একে-অপরের সাথে কথা বলতে বলতে কাটিয়ে দিল। ভোরের দিকে রায়ায বেলার উদ্দেশ্যে বলল,
-“অনেক কথা হয়েছে এবার চুপচাপ ঘুমাতে যা।”
সায় জানালো বেলা। তারও বেশ মাথা ধরেছে।
অতিরিক্ত কান্না ও সারারাত জেগে থাকার কারণে এখন এই অবস্থা।ট্যাবটা পাশে রেখে বেলা তলিয়ে গেল ঘুমের দেশে। এক ধ্যানে বেলার মুখপানে তাকিয়ে রায়ায। যতক্ষণ তার চোখ না লেগে যায় ততক্ষণ সে তাকিয়ে রইল প্রিয়সীর ঘুমন্ত মুখের দিকে।
.
.
ঘড়ির কাঁটা বেলা আটটার ঘরে এসে টিক টিক করতেই মেয়ের রুমের দিকে এগিয়ে এলেন রুমি রওশন।তালা খুলে প্রবেশ করলেন রুমে। আদরের মেয়ের শুকিয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কয়েক পল। ডাকতে যেও ডাকতে পারলেন না। তাই আর না ডেকে নিঃশব্দে প্রস্থান করলেন।
খাবার টেবিলে উপস্থিত সকলে। কেবল বেলা আর রায়ায ছাড়া। ঠিক তখনই নিচে নেমে এসে টেবিলে বসল রায়ায। জহির রোশনের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“বাবা আমি আজ থেকে অফিসে জয়েন করতে চাচ্ছি।”
খাবার মুখে নিতে নিতে জহির রওশন জবাব দিলেন,
-“তা বেশ তো। যাক অবশেষে তোমার সুবুদ্ধি হলো।”
রুমে প্রবেশ করে বেলাকে ভিডিও কল দিল রায়ায। প্রথমবার ফোন রিসিভ হলো না অপরপাশ থেকে।পরবর্তীতে কল করার সাথে সাথে ফোন রিসিভ হলো।বেলার ঘুম জড়ানো মুখের দিকে তাকিয়ে রায়ায। বেশ স্নিগ্ধ লাগছে তাকে। চোখ জড়িয়ে গেল রায়ায। মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,
-“তাড়াতাড়ি ওঠে গিয়ে দরজা খোল। দেখ যুথী তোর জন্য নাস্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে দরজা খুলতে চলে গেল বেলা। দরজার বাইরে হাতে খাবার প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে যুথী।বেলাকে দেখতে পেয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
-“বেল আপা রায়ায ভাই আপনার জন্য নাস্তা পাঠাইছে তাড়াতাড়ি খাইয়া লন।”
-“তুই খেয়েছিস?”
-“হ সবাই, খাইছি এখন আপনি খান তাড়াতাড়ি।”
খাবারটা হাতে নিয়ে বেলা রুমের ভিতর চলে এলো। খাবার নিয়ে বসে পড়লে ট্যাবের সামনেম ওপাশ থেকে তখনও বেলা কার্যকীর্তি দেখে চলছিল রায়ায। মৃদু সুরের সে বলল,
-“তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। তোকে খাইয়ে এখন আমি অফিসে যাবো।”
অবাক হলো বেলা। জিজ্ঞেস করল,
-“অফিসে! আপনি অফিসে কেন যাবেন?”
হাসলো রায়ায। উত্তর দিল,
-“আস্ত একটা বউ পালতে তো টাকা দরকার তাই না? বউকে খাওয়াতে, তার সকল চাহিদা পূরণ তো আমাকেই করতে হবে। তাই টাকা কামাই করতেই অফিসে যাচ্ছি।”
চোখ ছলছল করে উঠলো বেলার। মানুষটা কত কষ্টই না করছে তার জন্য।ভেজা কন্ঠে বেলা বলল,
-“কিন্তু রায় আজ ভাই আপনার চোখগুলো তো অনেক লাল লাল দেখাচ্ছে। সারারাতও তো ঘুমাননি।সকালে ও ঘুমিয়েছেন বলে তো মনে হয় না ।এ অবস্থায় আবার অফিসে যাচ্ছেন? নিজের উপর এতটা প্রেশার দেওয়া কি খুবই দরকার? কাল থেকে যান।”
মৃদু হাসলো রায়ায।অমায়িক স্বরে বলল,
-“কিন্তু তোকে যে আমার যত শীঘ্রই সম্ভব নিজের করে চাই !”
পরমুহুর্তে রায়ায আবার বলল,
-“তবে একটা জিনিস আমার মোট হজম হচ্ছে না তুই
এখনো কেন আমাকে ভাই ভাই করছিস? আমি কি তোর ভাই লাগি?”
লজ্জায় লাল বর্ণ ধারণ করল বেলার মুখমন্ডল। মাথা পতিত করে জবাব দিল,
-“না।”
-“তাহলে এত ভাই ভাই করছিস কেন? কোথাও কি দেখেছিস নিজের স্বামীকে ভাই বলে ডাকতে?”
নিচু স্বরে বেলা জিজ্ঞেস করল,
-“তাহলে কি বলে ডাকবো?”
-“ভাই ছাড়া যা খুশি তাই বলেই ডাক। এই ভাই শুনতে শুনতে আমার কান পচে গেছে। ভাই ডাক যেন না শুনতে হয় তার জন্য বিয়ে করে নিলাম।এর পরেই ও যদি ভাই ডাকিস…? এবার অন্তত থাম!”
-“স্বামীকে তো মেয়েরা ওগো, কিগো বলে ডাকে আমি কি আপনাকে তাই বলে ডাকবো?”
-“ইচ্ছা।”
-“আমার ভীষণ লজ্জা করবে আপনাকে এগুলো বলে ডাকতে রায়ায ভাই।”
হতাশ হয়ে মাথা চাপড়ালো রায়ায। আবার ও সেই ভাই!
.
.
বেলার খাওয়া শেষ হতেই রায়ায বলল,
-“তাড়াতাড়ি তৈরি হয়েনে। তোকে আজকে কলেজে ভর্তি করে দিয়ে আমি অফিসে যাব।”
বেলা মাথা নাড়িয়ে তৈরি হতে চলে গেল। তৈরি হওয়া শেষ বেলা একটা টেক্সট করে দিল রায়াযের নাম্বারে। তারপর দুজন বেরিয়ে পরলো একসাথে। সদর দরজা দিয়ে বেলাকে রায়াযের সাথে কোথাও যেতে দেখে তার হাত শক্ত করে চেপে ধরলেন রুমি রওশন। জিজ্ঞেস করলেন,
-“কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
আতঙ্ক ছেয়ে গেল বেলার পুরো মুখোমণ্ডল। ভীত চোখে সে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। পাশ থেকে রায়ায বলে উঠলো,
-“ও আমার সাথে যাচ্ছে ছোট মা। ওকে কলেজে ভর্তি করাতে নিয়ে যাচ্ছি।”
-“কোথাও যাওয়া দরকার নেই। আজ থেকে পড়ালেখা বন্ধ ওর। ঘরের বাহিরে এক পা ও রাখবে না।”
এবার যেন রাগ হলো রায়াযের শক্ত কণ্ঠে বললো,
-“ছোট মা আমি বেশ বুঝতে পারছি তুমি আমার রাগ বেলার উপর ঝাড়ছো। কিন্তু কালকের ঘটনায় বেলার কোন হাত নেই।আমিই ওকে জোর করে কাজী অফিসে নিয়ে বিয়ে করেছি।যা করেছি সব আমি করেছি ওর তো কোন দোষ নেই। তাহলে তুমি ওর সাথে কেন এমন করছ? আর তাছাড়া তোমার থেকে এখন ওর উপর আমার অধিকার বেশি। সেই সূত্রে আমি আমার স্ত্রীর পড়ালেখা বন্ধ করে দিব না চালু রাখবো তার সম্পূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার কেবল আমার।”
কথাটা বলে একটানে বেলা কে রুমি রওশনের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিজের সাথে নিয়ে যেতে লাগলো রায়ায।
কলেজে ভর্তি করা শেষ হলে বেলাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গেল রায়ায।নিজে চলে গেলে অফিসের উদ্দেশ্যে। আজ থেকে তার কর্মজীবনের নতুন অধ্যায় শুরু।
.
.
.
চলবে কী…?