বসন্ত_এসেছে #পর্ব_৮ #মাহিমা_রেহমান

0
321

#বসন্ত_এসেছে
#পর্ব_৮
#মাহিমা_রেহমান

দরজায় ঠকঠক শব্দ হতেই ভাবনার সুতো ছিঁড়ে বাস্তবে পদার্পণ করল বেলা। দরজা খুলতেই অবাক হয়ে দিল এক চিৎকার। অর্পিতা এসেছে আজ প্রায় দুই মাস পর। বোনকে পেয়ে খুশিতে জাবুডাবু অবস্থা তার। বেলাকে সরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল অর্পিতা। অর্পিতার পিছু পিছু বেলা ও গেল। খাটে আরাম করে বসে অর্পিতা কনুই দিয়ে বেলাকে গুঁতো মেরে বলল,

-“হুমমম… তলে তলে এতকিছু আর, আমরা বললে কিছুই না!”

লজ্জায় পড়ে গেল বেলা। আমতা আমতা করে বলল,

-“কিসের কথা বলছো তুমি অর্পিতা আপু?”

বেলাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে অর্পিতা বলল,

-“ইশ! আর ঢং করতে হবে না। কাল রাতের সব খবরই আমার কাছে পৌঁছেছে। এজন্যই তো আজকে সকাল সকাল চলে এলাম।”

লজ্জায় নুইয়ে গেল যেন সে। বেলার এখন লজ্জা মাখা মুখ দেখে জোরে হেসে উঠল অর্পিতা। হাসতে হাসতে বলল,

-“হয়েছে থাক! আর লজ্জা পেতে হবে না। চল নিচে যাই।”

সায় জানিয়ে অর্পিতার সাথে নিচে চলে এলো বেলা। লিভিং রুমে গিয়ে রায়াযকে ফোন করলো অর্পিতা। অপরপাশ থেকে ফোন রিসিভ হতেই অতি উৎসাহের সাথে অর্পিতা বলল,

-“কিরে ভাই! তুই যে এত ফার্স্ট তা তো জানতাম না। এত বড় কান্ড ঘটিয়ে এখন কোথায় লুকিয়ে আছিস হুম? তাড়াতাড়ি বাড়িতে আয়। তোর থেকে বিশাল আকারের ট্রিট পাওনা কিন্তু আমি।”

ওপাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠের আওয়াজ উত্তর দিলো,

-“ওয়েট কর আজকে অফিসের প্রথম দিন, তাই তাড়াতাড়ি আসতে পারবো না। রাতে এসলে তোর ট্রিট তুই বুঝে নিস।”

কথাটুকু বলে ফট করে ফোন কেটে দিল রায়ায। সারাদিন অপেক্ষা করে ও রায়াযের কোনো দেখা মিলল না। তাই অবশেষে মন খারাপ করে সন্ধ্যার দিকে অর্পিতা শশুর বাড়ি চলে যেতে চাইলে তাকে যেতে দিল না কেউ। সকলের জোড়াজুরিতে অবশেষে বাধ্য হয়ে থেকে গেল অর্পিতা । দেখতে দেখতে ডিনারের সময় হয়ে গেল কিন্তু রাজের কোন খবর নেই। এক এক করে সকলেই ডিনার করে চলে গেল। কিন্তু রয়ে গেল কেবল বেলা। উদাস মনে তখনো সে লিভিং রুমের সোফায় বসে। রাতের খাবার না খেয়ে মেয়েকে এমন উদাস মনে বসে থাকতে দেখে তীর্যক চাহুনি নিক্ষেপ করে তীক্ষ কন্ঠে রুমি রওশন জিজ্ঞেস করলেন,

-“কি ব্যাপার বেলা? সকলে খেয়ে চলে গেল। তুই এখনো খাচ্ছিস না কেন? উদাস মনের সোফায় বসে করছিসটা কি? তাড়াতাড়ি খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর। ঘুমাতে যাব আমি।”

দুদিকে মাথা নাড়ল বেলা। যার অর্থ সে এখন খাবেনা। সন্দেহজনক চাওনি নিক্ষেপ করলেন এবার রুমি রওশন মেয়ের উপর। মায়ের এমন চাহনি দেখে মৃদু ঢোক গিলল বেলা। আমতা আমতা করে বলে উঠলো,

-“না মানে মা! আমি এমনি খাব না, ইচ্ছে করছে না। আমি এখন বসে বসে টিভি দেখবো।”

কথাটা বলেই টিভি অন করে দিল সে। জহুরী চোখে মেয়েকে কয়েক নজর পর্যবেক্ষণ করতে করতে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। মেয়ে তার অনেক বড় হয়ে গেছে! তা আর বুঝতে বাকি নেই তার! তাই আর কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন তিনি। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও টিভির দিকে একধারে তাকিয়ে আছে বেলা। চোখ টিভিতে আটকে থাকলেও মন তার অন্যদিকে। প্রকৃতপক্ষে সে অপেক্ষা করছে রায়াযের জন্য।রায়াযের আসার অপেক্ষায় বসে সে।আড়চোখে বেলা একবার তাকালো দেয়াল ঘড়ির দিকে। রাত এখন ১১ঃ৩০। রায়ায’তো এতো রাত করে কখনো বাড়িতে ফিরে না! কিন্তু আজকে তার এতো দেরি?কপালে ভাঁজ পড়ল বেলার। প্রথম দিন অফিসে কি এতই চাপ ছিল? চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে তার। অপেক্ষা করতে করতে কখন যে চোখ লেগে গেল টেরই পেল না বেলা। সোফায় মাথা এলিয়ে দিয়ে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় সে। রাত একটার দিকে বাড়িতে প্রবেশ করে রায়ায। নিজের কাছে এক্সট্রা চাবি থাকায় তা ব্যবহার করে ঢুকে পড়ে ভিতরে।কলিংবেল বাজিয়ে কাউকে ডিস্টার্ব করার মুড আপাতত তার নেই। প্রথম দিন হওয়ায় বেশ খাটুনি গেছে আজকে তার উপর দিয়ে। ব্যস্ততা এতই ছিল যে সারাদিন তেমন কিছু খাওয়াও হয়নি। ক্ষুদা ও লেগেছে বেশ। ক্লান্তিতে হাঁসফাঁস করতে ভিতরে প্রবেশ করতেই চোখ আটকে যায় তার লিভিং রুমের সোফার দিকে। ছোট ছোট কদম ফেলে সেদিকে এগিয়ে যায় সে। বেলার মুখোমুখি এসে মৃদু ঝুঁকে পড়ে তার দিকে। আলতো করে নিজের ওষ্ঠ স্পর্শ করে বেলার ললাটে। ঘুমের ঘোরে মৃদু কেঁপে উঠে সে। হাসে রায়ায। বেলার শুকিয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে নিমিষেই বুঝে যায়,,এখনো নিশ্চয়ই কিছু পেটে পড়ে নি মেয়েটার।তার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে নিশ্চয়ই। অতি সন্তর্পণের বেলাকে পাঁজাকোলা তুলে নেয় সে। নিজের রুমের বিছানায় নিয়ে সুন্দর করে শুইয়ে দেয় বেলাকে। নিজে চলে যায় নিচে। দুইহাতে খাবারের দুটো প্লেট এনে রাখে বেড সাইড কেবিনেটের উপর। মৃদু আওয়াজ করে ডেকে উঠে বেলাকে। পিটপিট করে চোখ মেলতেই নিজের সম্মুখে রায়াযকে দেখে এক লাফে উঠে বসে বেলা। রায়ায ভ্রু কুঁচকে বেলার দিকে তাকিয়ে থাকে। ইতস্তত বোধ করে বেলা জিজ্ঞেস করে,

-“রায়ায ভাই আপনি এসে গেছেন?”

রাগি চোখে বেলার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রায়ায। তার এহেন ভয়ংকর দৃষ্টি দেখে শুকনো ঢোক গিলে বেলা। ভীতু কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

-“আমি কী আবার কোন রকম ভুল কিছু করেছি রায়ায ভাই?”

রাগের মাত্রা যেন এবার ছাড়িয়ে যায় রায়াযের। দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দেয়,

-” স্টুপিড! আমি কি এখনো তোর ভাই লাগি? এক চড় দিয়ে দাঁত সব ফেলে দিব!”

মাথা নিচু করে বেলা জবাব দেয়,

-“সরি! আসলে অভ্যাসবশত হয়ে যায় বারবার।”

কিছু বলে না রায়ায।মাথা নেড়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। মৃদু ধমক দিয়ে বলে,

-“এতো রাত হয়েছে, খাস নি কেন এখনো?”

চকিতে রায়াযের দিকে তাকায় বেলা। আমতা আমতা করে বলতে লাগে,

-“ইয়ে! আসলে।”

-“থাক, আর ইয়ে মানে করতে হবে। হা কর।”

রায়াযের কথা মত মুখ হা করতেই তার মুখের ভিতর খাবার ঢুকিয়ে দেয় রায়ায। চোখ টলটল করে উঠে বেলার। রায়ায ভাই তাকে কতই না ভালোবাসি? তার জন্য কতই না কষ্ট করছে সে ! খাওয়ার একপর্যায়ে কেঁদে দেয় বেলা। বেলাকে কাঁদতে দেখে বেশ অবাক হয় রায়ায। অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

-“কী হয়েছে বেলা? এভাবে কাঁদছিস কেন? খুব বেশি বকে ফেলেছি কী আমি? আচ্ছা আর কাঁদিস না। আর বকবো না তোকে!”

মুখ চেপে কেঁদে উঠে বেলা। অস্থিরতার মাত্রা ছাড়িয়ে যায় এবার রায়াযের। আলতো হাতে বেলার গাল স্পর্শ করে জিজ্ঞেস করে,

-“কী হয়েছে এমন করছিস কেন? আমাকে বল”

নিজেকে আর সামলাতে না পেরে রায়াযের বুকে ঝাঁপিয়ে পরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগে,

-“খুব বেশি কষ্ট করতে হচ্ছে আপনার তাই না? কেবলমাত্র আমার জন্য হয়েছে সব কিছু। সেই কখন অফিসে গেছেন আর ফিরলেন এই রাতে! সারাদিন নিশ্চয়ই কিছু খাননি? কিন্তু নিজে না খেয়ে সেই আমাকেই খাইয়ে যাচ্ছেন। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রায়ায ভাই। আপনার এত কষ্ট আমি আর দেখতে পারছি না।”

বেলার মাথায় আদুরে হাত বুলাতে বুলাতে মৃদু কণ্ঠে রায়ায জবাব দেয়,

-“কে বলেছে আমার কষ্ট হচ্ছে? মোটেও কষ্ট হচ্ছে না আমার। তাছাড়া আমারই ছোট বউটাকে পেতে আমি এটুকু কষ্ট তো করতেই পারি তাই না? তা না হলে,, আমার পুতুল বউটাকে যে কেউ আমাকে দিবে না। বাই দ্যা ওয়ে অনেক কান্নাকাটি হয়েছে এবার খেয়ে নে জলদি।”

বলেই নিজের বুক থেকে বেলার মাথাটা তুলে পুনরায় তাকে খাইয়ে দিতে লাগল রায়ায। বেলার খাওয়া শেষে মুখ মুছিয়ে দিয়ে আরেকটা প্লেট ধরিয়ে দিল বেলার হাতে। বলল,

-“নে আমার ডিউটি শেষ। এবার তোর ডিউটি তুই পালন কর।”

অবাক হলো বেলা জিজ্ঞেস করল,

-“মানে?”

প্লেটে ইশারা করে রায়ায বলল,

-“খাইয়ে দে আমায়।”

চোখ ভরে এলো পুনরায় বেলার। মৃদু হেসে রায়াযকে খাইয়ে দিতে লাগল সে। খাওয়া শেষে নিজের ওড়না দিয়ে রায়াযের মুখ মুছিয়ে দিল বেলা। বেশ অবাক হলো রায়ায। সুর তুলে বলে উঠলো,

-“ইশ! তুই দেখি একদম গিন্নি গিন্নি হয়ে গেছিস। যাক বউটা আমার এতোটা ও ছোট না।”

বলেই আলতো করে গেল টেনে দিল। খানিক লজ্জা পেল বেলা। লাল বর্ণ ধারণ করল তার গাল দুটো। সেদিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে রায়ায বলে উঠলো

-“থাক আর লজ্জা পেতে হবে না। তোর এই লজ্জারঙ্গা মুখ দেখে এই মধ্য-রাত্তিরে,, আমি না আবার নিজের কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলি। তখন তোর ও সমস্যা, আমারও সমস্যা।”

কথাটা বলেই বেলাকে নিজের অতি সন্ন্যিকটে টেনে নিল রায়ায।নিজের বক্ষঃস্থলে ঠায় করে দিল প্রিয়সীকে।জড়িয়ে ধরে তলিয়ে গেল ঘুমের দেশে।
.
.
.
চলবে কী…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here