#অব্যক্ত_প্রিয়তমা
#ফাতেমা_তুজ
#part_22
নির্ভীক চলে গেছে আজ তিন দিন। অনিন্দিতা যেন নির্বিকার হয়ে গেছে। খাওয়া দাওয়া গোসল সব ছেড়ে দিয়ে থম মেরে বসে থাকে। অনুভূতির কোনো স্থান নেই। তবে সে নিজেই জানে তাঁর অনুভূতি গুলো কতো টুকু অবহেলিত। হৃদপিন্ডের শেষ স্পন্দন টি ও যেন ক্রন্দন করে বলতে চায়
” নির্ভীক আমি ভালো নেই। আপনাকে ছাড়া ভালো নেই। পারি নি ভুলতে আমি। ব্যর্থ হয়ে গেছি আমি। আপনাকে ভালোবেসে সমস্ত কিছু তুচ্ছ করে নিয়েছি। ”
তবে সব কথা যেন গলায় এসে আটকে যায়। শক্ত আদলে গড়া মেয়ের মতো নিজেকে গুটিয়ে নেয়। পরিবারের থেকে নিজের অনুভূতি সংযত হয়। নির্ভীক কে কেউ অপমান করবে তাঁর কোনো সুযোগ দেয় না। কারন প্রিয় মানুষটির প্রতি ভালোবাসা। নিজে কষ্টে মরে যাবে তবে নির্ভীকের নাম উচ্চারন করবে না। তবে আসিম আর ইশরাকের সামনে ভেঙে পরে অনিন্দিতা। বুক ফাঁটা চিৎকার আসতে চায়। তবু ও সংযত হয়। এভাবেই কেঁটে যায় পনেরো দিন। ডায়েরী আর নির্ভীকের রক্তে মাখা পাতা টুকু বুকে তুলে রাখে। হাসে খেলে মনে মনে কথা বলে। বাইরে থেকে সব ই দেখে ইশরাক। সে বুঝতে পারে অনিন্দিতা যতো দিন যাচ্ছে ততো মানসিক রোগী তে পরিনত হচ্ছে। এভাবে কোনো কথা বার্তা ছাড়া থাকলে অনিন্দিতা বাক শক্তি হারাবে। গভীর চিন্তায় ছুটে যায় আসিমের কাছে। আসিমের অবস্থা ও ভালো নয়। অনিন্দিতার চিন্তায় পাগল হয়ে যায় নি যে এটাই অনেক। ইশরাক বলে
” অনিন্দিতা কে এভাবে থম মেরে থাকতে দিলে সমস্যা হবে। ”
” সেটা আমি ও বুঝতে পারছি। ”
” অন্য কোনো কেস হলে আমি আমার মতো ট্রিট করতাম। বাট এটা পুরোই ভিন্ন। আমি জানি তুমি আমাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোনো হেল্প করতে পারবে না। তবে তোমার মতামত আমার প্রয়োজন। আমি একা সব কিছু গোছাতে পারছি না।”
” অনি কে বোঝাতে হবে। ”
” কি বোঝাবো ? ”
” নির্ভীক স্যারের স্মৃতি আঁকড়ে থাকলে কখনোই নির্ভীক স্যার ওকে ক্ষমা করবে না। পরিস্থিতি কখনোই বদলাবে না। যেখানে নির্ভীক স্যার অন্য মেয়ে কে নিয়ে সুখে ঘর করার পরিকল্পনায় আছে। যেখানে অনির ভালোবাসা ওনার কাছে অভিনয় স্বরূপ।
যেখানে অপাত্রে ভালোবাসা দান করে চলেছে। কিংবা নির্ভীক স্যার এ সবে বিরক্ত হচ্ছে তাই ওর উচিত নিজে কে সংযত করা। ”
” সংযত করতে পারবে না অনিন্দিতা। ”
” সেটার জন্য পাওয়ারফুল মেডিসিন তো আছেই। ”
” রিক্স নেওয়া ঠিক হবে ? ”
” হবে। আমি নিতে চাই রিক্স। অনি কে বাঁচতে হবে। ”
” ওকে। আমি সব ব্যবস্থা করছি। তুমি ওর সাথে কথা বলো। ”
ইশরাক চলে যায়। ধীর পায়ে এগিয়ে আসে আসিম। বেডের এক কোনে বসে আছে অনিন্দিতা। হাতে তাঁর প্রিয় ডায়েরী। যেখানে লেগে আছে নির্ভীকের রক্ত। সেটা তে হাত বুলাচ্ছে মেয়েটা। হঠাৎ করেই চমকে উঠে সে। আসিম ও বিব্রত হয়। অনিন্দিতা ডায়েরী টা তে হাত বুলাতে থাকে। বুকে জড়িয়ে নেয়। যেন কেউ এটা নিয়ে যেতে চাইছে। ছুটে যায় আসিম। অনিন্দিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে
” এই অনি। কি হয়েছে তোমার ? ”
কোনো কথা বলে না অনিন্দিতা। ডুকরে কেঁদে উঠে। আসিম বলে
” অনি , শান্ত হও। ফেলো ডায়েরী টা। ”
বিস্ফোরিত চোখে তাকায় অনিন্দিতা। এই মুহুর্তে আসিম কে তাঁর চির শত্রু মনে হচ্ছে। আসিম আগাতেই ভয় পেয়ে যায় অনিন্দিতা। সামনে থাকা স্টিলের ওয়াটার বোতল ছুড়ে মারে। মাথার ডান সাইটে আঘাত লাগে ছেলেটার। মৃদু আর্তনাদ করে এগিয়ে যায়। চেঁচিয়ে উঠে অনিন্দিতা। দীর্ঘ পনেরো দিন পর মুখ দিয়ে কিছু উচ্চারন করলো অনিন্দিতা। আসিমের চোখে মুখে উৎকন্ঠা। হাসি মুখে আবারো অগ্রসর হয়। অনিন্দিতা যেন তাতে ও তেঁতে উঠে। এক মুহুর্তের জন্য আসিম কে চিনতে পারে না সে। বলে
” সরে যাও তুমি। আমি তোমায় খুন করে ফেলবো। আমার থেকে নির্ভীক কে সরাতে এসেছো তাই না ? কিছু তেই না। নির্ভীক ভাই কে আমি ভালোবাসি। আমি ভালোবাসি ওনাকে। ”
” অনি আমার কথা শোনো। ”
” নির্ভীক ভাই কোথায় গেলেন। আসিম , এই আসিম কোথায় তুমি ? নির্ভীক ভাই কে খুঁজে আনার কথা ছিলো তাই না। কোথায় গেলে তুমি ? ”
চারপাশে ঘুরে ঘুরে কথা টা বলে অনিন্দিতা । প্রচন্ড অবাক হয় আসিম। অনিন্দিতার বাহু চেপে ধরে বলে
” আমাকে চিনতো পারছো না তুমি ? ”
” তুমি ! তুমি ! হ্যাঁ তুমি। ”
মুহূর্তেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে অনিন্দিতা। আসিম যেন আকাশ থেকে পরেছে। অনিন্দিতা কে কোলে করে নিয়ে বেডে শুইয়ে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে ছুটে যায় ইশরাকে কাছে।
কোনো এক টা মেডিসিন নিয়ে নাড়াচাড়া করছে ইশরাক। আসিম কে দেখে হাসে। আসিম বলে
” ডক্টর ইশরাক , অনি আমাকে ও গুলিয়ে ফেলেছে। ”
” তোমার কি মনে হয় ঔষধ টা শুধু নির্ভীক কে ভুলতেই সাহায্য করবে ? এটা ঔষধ আসিম। কোনো ম্যাজিক নয় যে শুধু মাত্র ওর স্মৃতি থেকে নির্ভীক কেই সরানো যাবে। সব ভুলে যাবে ওহ। ”
দেয়ালে ঘুষি মারে আসিম। চুল খামচে ধরে বলে
” আগে কেন বলেন নি ? ”
” রিক্স নিতে নিতে তুমি ভুলে গেছো অনিন্দিতার মস্তিষ্ক কোনো মেশিন নয়। তোমাকে বলেছিলাম ঔষধ টা এখন দেওয়া উচিত হবে না। এনি ওয়ে পরের রিক্স টা নিতে চাও তুমি ? আমার কোনো অসুবিধা নেই। ইনফেক্ট নির্ভীকের ও কোনো অসুবিধা নেই। ওহ এর মধ্যে ইনভলব হবে না। ”
” ডক্টর ইশরাক ! ”
” বুদ্ধিমত্তা হারিয়ে ফেলেছো আসিম। যেখানে একটা ভালোবাসা গড়তে এতো সময় লাগে। সেখানে তুমি কি করে মুহূর্তেই ভোলাতে পারবে, বলে ভাবলে ? দেখো আসিম তুমি বুদ্ধিমান ছেলে। তবে সব কিছুর সলিউশন ইস্টার্ন হয় না। নির্ভীক তোমার উপর ভরসা করেছে কেন জানো কারন তোমার সাথে অনিন্দিতার বন্ডিং খুব ভালো। আর তুমি অনিন্দিতার ভালো চাও। ইনফেক্ট এই মুহুর্তে দাড়িয়ে নিজেকে ভরসা করে না নির্ভীক।”
কোনো কথাই বলে না আসিম। ইশরাকের কেবিন থেকে বেরিয়ে পরে। ইশরাকের চোখ মুখে কিছু টা বিস্ময়। হঠাৎ করেই ফোন বেজে উঠে। ছুটে যায় ইশরাক। চার দিকের পাগলামি ওকে পাগল করে দিবে। এরা মানুষ নাকি এক এক টা ভালোবাসার সমুদ্র। কি করে পারে এমন ভাবে ভালোবাসতে ?
.
দীর্ঘ ছয় মাস পর অনিন্দিতা সুস্থ হয়। তবে কথা কম বলে। প্রয়োজনের বাইরে কোনো কথাই বলে না। নির্ভীক কে ভুলার জন্য কোনো প্রকার ঔষধ দেওয়া হয় নি। শুধু মাত্র মানসিক ভাবে সবল হওয়ার জন্য বল দেওয়া হয়েছে। এই কয়েক মাসে পৃথিবী এফোর ওফোর করেছে আসিম। যতো ভালো ভালো সাহিত্যিক আছে , মানসিক শান্তি দেওয়ার জন্য স্বাক্ষাৎ করিয়েছে। চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখে নি। তাঁর সাথে দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু পাওয়াফুল মেডিসিন । যা মানসিক ভাবে শান্তি তে রাখবে অনিন্দিতা কে। রোজ কয়েক বার করে বুঝিয়েছে আসিম। নির্ভীকের ভালো থাকার জন্য হলে ও ভুলতে হবে বলে মনস্থির করেছিলো অনিন্দিতা। অবশেষে সক্ষম হয়েছে মেয়েটা। তবে ভুলতে পারে নি প্রিয় মানুষটি কে। সবার সামনে নতুন করে অভিনয় করা শুরু করেছে সে। নির্ভীকের চিঠি তে বলা শেষ কথাটাই মেনে নিয়েছে ওহ। অভিনয় , এই অভিনয় ই হবে ওর জীবনের সঙ্গী।
বাসায় আসতেই প্রিয় মুখ গুলো যেন অনিন্দিতা কে কাঁদাতে বাধ্য করে। এরি মাঝে দু বার হার্ট এট্রাক করেছেন আরশাদ। বাবা কে জড়িয়ে ডুকরে কাঁদে মেয়েটা। সবার চোখে পানি। চারুলতা ছুটে আসেন অনিন্দিতার কাছে। ছোট থেকে নিজের মেয়ে মতো ভালোবাসেন কি না। সবাই কে নিয়ে শুরু হয় অনিন্দিতার নতুন পথ চলা। ঘুরে দাঁড়ানোর অভিনয়ে অনেক টাই সুস্থ তাঁর মস্তিষ্ক। এখন আর আগের মতো আচারন আসে না। ভেতরে ভেতরে কষ্ট টা ও কমে গেছে। শুধু মাঝে মাঝে বুক চিরে বের হয় দীর্ঘশ্বাস আর হাহাকার।
তারপর কেঁটে যায় দেড় বছর। দেড় বছরের প্রতি টা সময় নিজেকে নিয়ে ছিলো মেয়েটা। পড়াশোনায় ভীষন মনোযোগী হয়েছে। কখনো নির্ভীকের নাম উচ্চারন করে নি। তবে ভেতরে ভেতরে নির্ভীকের নামেই লিখেছে শত গান। যাঁর প্রতি টা লাইন অব্যক্ত। ইচ্ছে হয়নি কখনো প্রকাশ করার। এই পরিবর্তন যেন চার পাশে সবার জন্য সুখময়। অনিন্দিতা নিজে ও খুশি প্রিয় মানুষ গুলোর হাসির কারন হতে পেরে।
হঠাৎ করেই শরীরে ধাক্কা অনুভব হয়। চোখ পিট পিট করে তাকায় অনিন্দিতা। আসিম বলে
” ঘুমিয়ে পরেছিলে ? ”
” ওহ হ্যাঁ। ডায়েরী টা লিখতে গিয়েই ঘুমিয়ে পরেছিলাম। তবে শেষ পাতা টা এখনো পরিপূর্ন হচ্ছে না। ”
” হয়ে যাবে। সন্ধ্যা নেমে গেছে। চা খাবে ?”
” রাস্তায় জ্যাম ছিলো ? ”
” প্রচুর। ”
” ইসস পুচকো টা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ”
” খুব বেশি সময় লাগবে না। আর আধ ঘন্টার পথ। ”
” আচ্ছা চলো, পাশেই তো টং এর দোকান চা খেয়ে আসি। ”
” আসো। ”
আসিমের সাথে নেমে যায় অনিন্দিতা। চায়ের দোকান থেকে মাটির খোঁড়া করে চা নিয়ে আসে পাহাড়ের ঢালে। সন্ধ্যার মৃদু অন্ধকার নেমেছে কেবল। হালকা আলো তে এখনো চারপাশ স্পষ্ট। ঘাসের উপর বসে দুজনে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ঘোলা চোখে তাকায় আসিম। অনিন্দিতার প্রতি পাগলামি করতে ইচ্ছে হয়। পুরো পৃথিবী কে বলতে ইচ্ছে হয় মনের কথা। না হয় তছনছ করে দেওয়ার বাসনা জাগে। না থাকবে ত্রিভুবন আর না থাকবে যন্ত্রণা। কিছু টা অসামাজিক ভাবনায় হতবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে আসিম। অনিন্দিতার হাত ধরে টেনে উঠিয়ে নেয়। কিছু বোঝার পূর্বেই অনিন্দিতা কে নিয়ে ছুট লাগায়। পাহাড়ের বাঁকা পথে দুটো তারকাবাজি যেন ঝলমল করছে। অনিন্দিতা নিজে ও খুব ইনজয় করে বিষয় টা। পাহাড়ে দৌড়ানোর মাঝে এতো ভালোলাগা কাজ করে বুঝি ?
বাতাসের গতি বেশ ভালো। কানে যেন বাতাসের শব্দ ই শোনা যায় শুধু। হঠাৎ করেই অনিন্দিতা থমকে যায়। পিছু ফিরে তাকায় মেয়েটা। যেন কানের কাছে ভেসে আসে চিরচেনা একটাই ডাক ” অনিন্দিতা। ”
একটা আপু অব্যক্ত প্রিয়তমা গল্পের জন্য পিক এডিট করে দিয়েছিলে। একটু কমেন্ট করো তো সে। আমি নাম টা ভুলে গেছি।
**অনিন্দিতা নির্ভীকের হাতের লেখা খুব ভালো করেই চিনে। তাই অবশ্যই চিঠি টা নির্ভীকের লেখা।
পরবর্তী গল্প #চলো_রোদ্দুরে
বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন ।
চলবে