#এক_জোড়া_নুপুর (১)
সিগারেট পোড়া ইষৎ কালচে হওয়া ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় নুইয়ে পড়ল নির্বা। এমন নয় মানুষটি তার নিকটে দাঁড়িয়ে। তবু তার শুভ্র সুন্দর মুখশ্রী লজ্জায় রক্তিম হয়ে এসেছে। ছবিটার দিকে যতবার তাকাচ্ছে ঠিক ততবারই লজ্জায় ডুবে যাচ্ছে। এমন আরও কয়েকবার করে,জানালা খুলে ফেলল সে। তার পনেরো বছরের কিশোরী হৃদয় কেমন উতলা হয়ে আছে! অথচ প্রেম কি জিনিস সে জানে না, বোঝে না। নির্বা বরাবরই স্বপ্ন দেখতে পছন্দ করে। তার স্বপ্নে সর্বদাই এক রাজপুত্র থাকে। যে পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর তবে শুদ্ধ নয়। কল্পনাতেও সে শুদ্ধ মানুষকে প্রেমিক হিসেবে জায়গা দিতে পারে না। তার ধারণা প্রেম করা মানুষগুলো অত্যন্ত অভদ্র হয়। ভদ্র মানুষ হলে কি প্রেম করত নাকি? নির্বার আকাশ পাতালের কল্পনাতে থাকা রাজপুত্র রোজ তাকে স্বপ্ন দেখায়,তবে বাস্তবে আসে না। এ তো আর প্রদীপের জিন নয়,যে ঘষলেই বিশাল দৈত্য এসে সব ইচ্ছে পূরণ করে দিবে। তবে এভাবেও যে কারো প্রতি অনুভূতি আসতে পারে তা নির্বা ঘুণাক্ষরেও বুঝে নি। তার চোখ দুটো আটকে আছে জানালার পাশে থাকা পদ্মদিঘীর জলে। চাঁদের আলোয় চকচক করছে পানি। দু একটা কচুরিপানা হেলে দুলে দোল খাচ্ছে। অথচ মন, সে তো চলে গেছে দূর থেকে বহুদূর। কিছুদিন আগের ঘটনা। নির্বা নবম শ্রেণিতে পড়ছে। স্কুল থেকে ফেরার পথে ফুচকা খাচ্ছিল। ভীরের মাঝেও তার গলার স্বরটা সব থেকে বেশি জোরালো। ওমন সময় এক দল ছেলে এসে দাঁড়াল। ফুচকার অর্ডার দিয়ে বাইকে হেলান দিয়ে ফোনে কথা বলছিল। ঠিক সে সময়েই ঝালের কারণে চেচামেচি করছিল নির্বা। লম্বাটে দেহের ছেলেটি সবার প্রথম এগিয়ে এসে বলল, “মামা ঝাল না খেতে পারলে এমন পিচ্চিদের ঝাল কেন দেন?”
“জোর করে নেয় মামা। ঝালের দাম বেশি,দিতে চাই না। তবু জোর করে নেয়।”
“জোর করলেই দিতে হবে?”
“রেগুলার কাস্টোমার মামা।”
বড়ো বিরক্ত বোধ করল ছেলেটি। ততক্ষণে একটা ছেলে পানি কিনে এনেছে। বোতলটি নির্বার দিকে এগিয়ে দিল। নির্বার ছোট মস্তিষ্ক বিষয়টি ধরতে পারল না। সে নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে। ধমকে উঠল শাহান।
“একটু আগেই তো ঝালে চেচামেচি করছিলে। এখন পানি নিচ্ছ না কেন?”
নির্বার ছোট দেহটা নড়েচড়ে উঠল। সে চোখ নামিয়ে বলল, “ঝাল কমে গেছে।”
শাহান পুনরায় কিছু বলল না। তবে পানির বোতলটা রেখে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে নির্বার শরীর মন থরথর করে কাঁপতে লাগল। বন্ধুরা ভেবেছে মেয়েটা ভয় পেয়েছে। দু হাতে আগলে নিল। কিন্তু নির্বা জানে,তার ছোট এই মনে ভূমিকম্প হয়ে গেছে। যেই ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গেছে নির্বার সবটুকু!
তার পরের ঘটনাটা আরও রোমাঞ্চকর। নির্বা জানত না ছেলেটির নাম কিংবা পরিচয়। এক পলকের দেখা নিয়েই তার তনু মন অনুভূতির সাগরে ভাসছিল। আজ বিকেলে বান্ধবীর বাড়িতে দাওয়াত ছিল। স্কুল থেকে একটু দূর বিধায় মা কখনোই পারমিশন দেন না। আজ অনেকজন যাবে তাই বুকে কিছুটা সাহস এসেছে। না জানিয়েই চলে এসেছে বান্ধবীর বাড়ি। ওদের আড্ডা চলছিল। মুড়ি মাখা তুলে নিতেই নির্বার হাত থমকে গেল। শ্যামবর্নের পুরুষালী বুকে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু জল ওকে অভদ্র করে দিল মুহূর্তেই। লজ্জাহীন ভাবে তাকিয়ে রইল সে। সেই মুহূর্ত কল্পনা করলে এখনো কেঁপে উঠে নির্বার মন। মেয়েটির ধ্যান ভাঙে বান্ধবীদের চেচামেচিতে। নিজেকে ধাতস্থ করে নিতেই হেরা বলল, “মুড়ি মাখা না তোর পছন্দ। খাচ্ছিস না কেন?”
“এই তো খাচ্ছি।” বলেই এক মুঠো মুখে দিতেই ঘরের ভেতর প্রবেশ করল শাহান। উন্মুক্ত বুকে একটা তোয়ালে দেওয়া। সম্ভবত কাছের নদী থেকেই গোসল করেছে সে। লজ্জায় নির্বা মুখ তুলতে পারছে না। এত লজ্জা সে তার পুরো জনমেও পায় নি। ওর বান্ধবীরা যখন এক যোগে বলল, “শুভ জন্মদিন শাহান ভাইয়া।” তখন মেয়েটির বুকের ভেতর ধীম ধীম আওয়াজ হতে লাগল। শাহান মৃদু হেসে শুভেচ্ছা গ্রহণ করল। বাইরে বের হতেই বন্ধুরা ডিম আটা দিয়ে ভূত বানিয়ে দিয়েছে। নদী থেকে গোসল করার পর ও শরীর থেকে ডিমের গন্ধ আসছে। নির্বার বান্ধবীরা নিজের সঙ্গে করে আনা উপহার তুলে দিলেও নির্বা কিছু দিতে পারল না। সে মুখটা অত্যন্ত কালো করে বলল,”উপহার বাসায় ফেলে এসেছি।”
বান্ধবীরা সান্ত্বনা দিল। নির্বা আর একটা কথাও বলতে পারে নি। বাড়ি ফিরেই হেরার প্রোফাইল থেকে শাহানের আইডি খুঁজে নিয়েছে। প্রতিটা ছবি দেখার সময় তার মুখ লাল হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু একটা ছবিতে পোড়া ঠোঁটটা যেন একটু বেশিই আকর্ষণীয়!
জোনাক পোকার দল টিম টিম করে আলো ছড়িয়ে চলেছে। একদল পিপিলিকা পিল পিল করে ঘরে ফিরছে। রাতের মধ্যভাগে পাখির দল কিছু সময় পর চেচামেচি করছে। সে শব্দ এতই মধুর যে নির্বা হারিয়ে গেল কোথাও। তারপর পার হয়ে গেল কয়েক সপ্তাহ। শাহানের ছবি দেখে ঘুমানো নির্বার অভ্যাসে পরিণত হলো। মৃদু হাওয়ায় কচি পাতাটি যেমন দোল খায় তদ্রুপ দোল খেতে লাগল ওর মন। মেয়েটি যেন একটা ঘোরে চলে এসেছে। বান্ধবীর ভাইটির প্রতি এমন সব অনুভূতি জাগবে কল্পনাও করতে পারে নি যে। এখন তো নির্বার দিন ও পেরোতে চায় না। বুকের ভেতর ধীম ধীম করে। কোথাও একটা আকুলতা জাগে। তার সদ্য কিশোরী মন কেমন সব বড়ো কল্পনা করে! মাঝে মাঝে সে নিজেই অবাক হয়ে পড়ে। রাতের আঁধারে কত গল্পই না করে। অথচ ছবি কি কোনোদিন কথা বলতে পেরেছে? পারে নি। মাঝে মাঝে নির্বার রাগ হয়, হয় অভিমান। কেন মানুষটা আসে না তার স্কুলের সামনে?
সেদিন সকালটা বেশ বাজে ভাবে শুরু হলো নির্বার। ঘুম থেকে উঠেই মায়ের কাছে বকা খেল। স্কুল যেতে ও লেট হলো। ক্লাসে মন ছিল না বিধায় স্যার ও কথা শোনালেন। নির্বার ভাঙাচোরা মন কোথাও একটা চলে গেছে। বন্ধুরা টিফিন টাইমে এসে বেশ জেরা করছিল। নির্বা তাই চলে আসে। স্কুলের পাশে নদী। সেখানে পাকা করে ঘাটলা করা। দুপুর টাইম হওয়াতে মানুষ নেই। সেখানেই এসে বসল সে। পা ভেজাচ্ছে শীতল পানিতে। মাঝে মাঝে দু একটা নৌকা চলে যাচ্ছে। হালকা একটু ঢেউ সৃষ্টি হচ্ছে। দেখতে ভালো লাগছে। সে দু চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিল। মুক্ত বাতাসে ভরে উঠল বুক। শাপলা ফুটেছে কিছু। সেটা দেখেই উতলা হলো মন। কিন্তু ঘাটলা থেকে কিছুটা দূরে। পাশেই পাটকাঠি শুকানো হচ্ছে। সেখান থেকে একটা পাটকাঠি এনে শাপলা তোলার চেষ্টা করল। কিন্তু হচ্ছে না। সে আরেকটু নিচে নামল। এবার শাপলাটা ছুঁতে পারল। উত্তেজিত হয়ে উঠল সে। আর একটু হলেই শাপলা ধরতে পারবে। সে আরেক ধাপ নিচে নামল। এবার পায়জামা কিছুটা ভিজে গেল। তোয়াক্কা করল না তবু। ফুলটা যেন ওকে সম্মোহন করে ফেলেছে। সে হাতটা আরেকটু বাড়ানোর চেষ্টা করল। ঘাটলার সিঁড়ি দীর্ঘদিন যাবত ভেজা। শ্যাওলা জমেছে। অসর্তক থাকাতে পা হড়কে গেল। ওমনি ভিজে গেল সে। পানিতে নাকানিচুবানি খেয়ে কোনো মতে উঠে এল। ভীষণ কান্না পাচ্ছে এখন। বাড়ি ফিরবে কেমন করে? ওদিকে টিফিন টাইম শেষ। বেল পড়ে গেছে। নির্বা কান্নাভেজা চোখে বসে রইল। পাশ দিয়েই যাচ্ছিল শাহান। স্কুল ড্রেস পরা নির্বাকে দেখে ভ্রু কুচকে ফেলল। নির্বা কি করবে বুঝতে পারছে না। এত লজ্জা লাগল ওর।
“স্কুল বাদ দিয়ে পানিতে নেমেছ কেন? ভয়ডর নেই? টিচার কিছু বলে না?”
লজ্জাতে মেয়েটার গাল লাল হয়ে গেছে। শাহান একটা ধমক দিল।
“এই পিচ্চি কথা কানে যায় না? এমন পাগলামি করতে স্কুলে আসো?”
বহু কষ্টে নির্বা বলল, “ইচ্ছে করে করি নি।”
শাহান বড়ো বিরক্ত হয়ে তাকাল। তারপর বলল, “বাড়ি চলে যাও। এভাবে ঠান্ডা লেগে যাবে।”
মানুষটা বাইক নিয়ে চলে গেল। নির্বা থরথর করে কাঁপছে। ওর চোখ দুটো রিক্ত। এমন লজ্জায় পড়তে হবে জানলে ইহজনমে এখানে আসত না। সকাল থেকে বকা খেতে হচ্ছ। পুরো দিনটাই খারাপ!
চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি