#এক_জোড়া_নুপুর (১০)
হুট করেই বৃষ্টি নেমে এল। রোদ্দুরে হঠাৎ বৃষ্টি হওয়ায় চমকে উঠছে প্রায় সকলেই। তবে বিষয়টা মন্দ নয়। ভালো লাগছে। সিদ্ধান্ত আগে আগে চলছে। ছেলেটার ঠান্ডার ধাচ রয়েছে। বৃষ্টিতে একটুখানি ভিজলেই জ্বর উঠে যায়। নাজুক শরীর কীনা। অন্যদিকে শাহানকে অনিচ্ছাকৃত ভাবে হলেও ওদের সাথে আসতে হলো। সুরভী ছাড়ছিলই না। এদিকে নিশুটা ও বেঁকে বসেছিল। অবশ্য নির্বা এই বিষয়ে ভালো মন্দ কোনো কথাই বলেনি। এমনকি তাকাল না অবধি! এই কাহিনীটাই শাহানকে বিরক্ত করছে। হুট করেই কি মেয়েটি এত বদলে গেল? নাকি বদলে যাওয়ার অভিনয় করল। কিছুতেই এই সমীকরণ মিলছে না। এসব ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল সে। আনমনে চলতে চলতে গোবরে পা ডুবিয়ে দিল হঠাৎ। বড়ো বিরক্তি ফুটে এল তার মুখ্রশীতে। নির্বা সাহায্য’র জন্য আগাতে গিয়েও পারল না। সুরভীর মাথায় হাত।
“মন হারিয়ে বসেছিলেন ভাইয়া?”
“তেমনি কিছুটা।”
সুরভী অদ্ভুত শব্দ করে হাসল। পুকুর থেকে পা পরিষ্কার করল শাহান। নিশু আগে আগে চলছে। সিদ্ধান্ত তার সাথে জমিয়ে গল্প করছে। এর আগে ফোনে কথা হলেও বাচ্চা মেয়েটা প্রথমবারের মতো সিদ্ধান্তকে সরাসরি দেখতে পেল। এত অমায়িক ব্যবহার আশা করে নি সে।
সিদ্ধান্ত’র আসার খবরটা খুব জলদি পৌছে গেল চারপাশে। হৈ হৈ শুরু হয়ে গেছে। নির্বার অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। এই মুহূর্তে শাহান কিংবা সিদ্ধান্ত কাউকেই ভালো লাগছে না ওর। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো দুটি মানুষই তার জন্য যন্ত্রণার। একটু নয় অনেকটা যন্ত্রণার। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এত লোকের মাঝে সে কান্নাও করতে পারছে না। দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকে রাখল। শাহানকে এক প্রকার জোর করে খাবারের টেবিলে বসিয়ে দিয়েছে সুরভী। ছেলেটা সম্পর্কে মোটামুটি সকলেই জানে। স্কুলে বেশ নাম আছে।তার সমাদরে কোনো ক্রুটি রইল না। এদিকে সিদ্ধান্তকে বাতাস করতে নেমেছে পাড়ার কিশোরী মেয়েরা! কিশোরী হৃদয় গুলো সিদ্ধান্তকে দেখেই জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ তো উপহারও নিয়ে এসেছে। এত সব সামলাতে বেশ কসরত হলো ওর। সে একটু নিরালা জায়গা খুঁজছে। তার লোকেরা মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সবাইকে সরিয়ে দিল। নদীর ধারে টেবিল বসানো হয়েছে। বাড়ির পাশেই নদীটা। নির্বার বাবা জামাল এদিকটা ছোট পরিসরে বাগান করেছেন। নানা রকমের গাছে ভরপুর। গাছের ছায়া আর নদীর হাওয়া এক অন্যরকম অনুভূতির সৃজন করেছে। ব্যক্তিগত ভাবে প্রকৃতিকে বেশ পছন্দ করে সে।
“সিদ্ধান্ত,বাবা খাবার এখানে দিতে বলব?”
“পরে খাব আঙ্কেল। আপাতত পরিবেশ উপভোগ করি।”
“আচ্ছা যা ভালো বুঝো।”
“আঙ্কেল,নির্বাকে একটু পাঠিয়ে দিবেন। কিছু কাজ করতে হবে।”
“নিশুকে বলছি ডেকে দিতে। এখন তবে হাল্কা নাস্তা পাঠাতে বলি?”
“আচ্ছা।”
কিছু সময় পর এল নির্বা। সিদ্ধান্ত ওকে দেখে চমৎকার করে হাসল। হাতের ইশারায় বসতে বলল।
“তোমাকে তো পাওয়াই যাচ্ছে না গার্ল।”
“বাসায় অনেক গেস্ট এসেছে,তাদের সামলাতে হচ্ছে।”
“তাই বলে আমাকে ভুলে যাবে?”
“জী,না মানে।”
ওর শুকনো মুখ দেখে শব্দ করে হেসে উঠল সিদ্ধান্ত। কিছুটা লজ্জা পেল নির্বা। নিশু ও তার বান্ধবীরা এসে নাস্তা রেখে গেল। এই সুযোগে বাচ্চা গুলো প্রাণ ভরে দেখে নিল তাদের স্বপ্নপুরুষকে।
সিদ্ধান্ত মানুষ হিসেবে দারুণ। তার খাবার খাওয়ার ভঙ্গিমাটাও মুগ্ধ করার মতো। নির্বা নজর সরিয়ে নিল। সিদ্ধান্ত একই ভঙ্গিতে খাবার খাচ্ছে।
“তুমি খাবে না?”
“পরে খাব।”
“এর জন্যেই শরীরের এই অবস্থা।”
“অতোটাও না।”
“ওজন কত?”
“৪৪কেজি।”
সিদ্ধান্ত এবার নজর ঘুরাল। চোখের দৃষ্টিতে ভালো মতো মেপে নিয়ে বলল, “এর থেকে বেশি আশাও করা যায় না। হাইট অনুযায়ী ৫০ কেজি হওয়া উচিত। ৬ কেজি কম আছ, বুঝেছ?”
পঞ্চাশ কেজি শুনে নির্বার মুখটা আসলেই হা হয়ে গেছে। এটা আহামরি কোনো ওজন নয় কিন্তু সে কিছুতেই নিজেকে পঞ্চাশ কেজিতে ভাবতে পারে না। সিদ্ধান্ত আরেকটা বাটিতে স্যুপ ঢেলে দিয়ে বলল, “খাও। একটা কথা কি জানো মিউজিক ওয়াল্ডে কণ্ঠের সাথে সাথে আউটলুক ও পারফেক্ট হতে হয়। এমন নয় শুধুমাত্র ভয়েস দিয়ে কিছু করা যায় না। তবে মনে রাখবে অল রাউন্ডারের দাম একটু বেশি।”
কথাটা শুনে চট করেই সিদ্ধান্ত’র বাহ্যিক গঠনে নজর দিল নির্বা। শুভ্র সুন্দর মুখ, চিকন নাক, সিল্কি চুল আর স্টাইলিং পোষাক পরিহিত মানুষটি সন্দেহহীনভাবে ভীষণ সুন্দর। নির্বার হৃদয় ছ্যঁত করে উঠল। এই পৃথিবীর সৌন্দর্য’র মোহে ডুবেনি এমন কেউ আসলেই নেই।
এস এস সি তে দারুণ ফলাফল হয়েছে নির্বার। সবাই আগে থেকে নিশ্চিত থাকলেও চিন্তাটা কম ছিলই না। অবশেষে সুখবরটা এল। হেরাকে কল করল সে। হেরাও গোল্ডেন পেয়েছে। খুশিতে পা ছড়িয়ে কান্নার ইচ্ছে হলো নির্বার। তার বন্ধুমহলের সবাই সন্তোষজনক ফলাফল করেছে। পেছনের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে ওদের ব্যাচ। মুহূর্তেই ঠিক হলো সকলে স্কুলে যাবে। নির্বা কোনো মতে চুল গুছিয়ে ছুট লাগাল। উত্তেজনায় কাঁপছে সে। আজকের পর হয়ত বা আর কখনোই সবাইকে একসাথে দেখা হবে না। একটা আবেগ কাজ করছে। নির্বা মুখে হাত দিয়ে ফেলল। এত ভালো লাগছে তার। স্কুল গেটের কাছে একদল ছেলেমেয়ে দেখে নির্বার হৃদপিণ্ডর গতি বেড়ে গেছে। সে ভীড় ঠেলে ভেতরে এল। সেখানে ওর বন্ধুমহল অপেক্ষা করছে। সবার ঠোঁটের কোণে হাসি। নির্বা ছুটে গিয়ে হেরাকে জড়িয়ে ধরল। হেরা চিল্লিয়ে বলল, “দোস্ত আমরা পেরেছি। শতভাগ উত্তীর্ণ আর হিউজ পরিমাণ এ প্লাস। এটা অবিশ্বাস্য।”
“আল্লাহর নিকট শুকরিয়া।”
বন্ধুদের নিয়ে টিচার্স রুমে এল নির্বা। সেখানে আগে থেকেই একটি ব্যক্তি বসা ছিল। যার ঠোঁটে হাসিরা ঢেউ খেলে চলেছে। নির্বার পা থমকে গেল। শাহানকে এই মুহূর্তে দেখতে পাবে কখনোই ভাবে নি। হেরা ভাইয়ের সাথে দেখা করল। একবার এদিকে তাকাল শাহান। তারপরই চোখ ফিরিয়ে নিল। টিচার্স রুমে মিষ্টি দিয়ে ভরে গেছে। খুশির বন্যা বইছে। শাহান উঠতে চেয়েও পারছে না। একদল ছেলে এসে চেপে ধরল ওকে। সকলের দাবি ঝালমুড়ি খাওয়াতে হবে। নির্বা ছটফটে নয়নে তাকাল। শাহানের সাথে প্রথম দর্শন পুনরায় ভেসে উঠল। শাহান এখন হেসে হেসে কথা বলছে। অবশেষে ঠিক হলো ঝালমুড়ি ট্রিট দিবে সে। নির্বা দাঁড়িয়ে ছিল। হেরা এসে ধাক্কা দিল।
“আসছিস না কেন?”
“আমিও?”
“তো? পাগল মেয়ে।”
হেরা নিজ থেকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে। নির্বার ভীষণ অস্বস্তি হলো। কিন্তু মানুষটাকে দেখার লোভ সামলাতে পারল না। ঝালমুড়ির দোকানে ভীষণ ভীড় লেগে গেল। হেরা আর নির্বা সবার শেষে পড়ে গেছে। ভীড় কমলে ঝালমুড়ি দিতে বলল হেরা। নির্বা পাশ থেকে বলল, “মামা ঝাল দিয়েন না।”
হেরা অন্যদের সাথে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নির্বা মাথা নিচু করে আছে। ব্যক্তিগত ভাবে ঝাল খুব পছন্দ করে সে। অতীতের ঘটনা স্মরণ করেই ঝাল নিল না সে। এক চামচ মুখে দিবে ওমন সময় শাহান ঝাল ছড়িয়ে দিল। নির্বা ভীষণ বিস্ময়ে তাকিয়ে। শাহান তার শান্ত,স্থির,কণ্ঠে বলল,
“মাঝে মাঝে ঝাল খেলে কিছু হয় না। ভালোলাগা গুলোকে মূল্য দিতে হয়।”
এই একটা কথার রেশ ওর মস্তিষ্কে রইল অনেকক্ষণ। শাহান বিল মিটিয়ে চলে গেল। অথচ নির্বার খাওয়া হলো না। তার শরীর অসম্ভব গতিতে কেঁপে চলেছে। সুন্দর চোখ দুটো থেকে,থেকে জ্বালা করছে। আবছা হয়ে এসেছে দৃষ্টি। এখনি কি জল গড়িয়ে নামবে বৃষ্টি?
চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি