#এক_জোড়া_নুপুর (১১)
প্রিয় মানুষের প্রত্যাখ্যান মানুষকে পরিবর্তন করে ফেলে। নির্বার সাথে শাহানের দেখা হয়েছিল সেই ছয় মাস আগে। দেখতে দেখতে চলে গেল সময়টা। নির্বা এখন শহরের খুব নামকরা কলেজে পড়ে। তার দিন যেমন রঙিন নয় তেমনি বেরঙিনও বলা চলে না। চলছে জীবনটা রোবর্টের মতো। মাঝে মাঝে নির্বা ভাবে তার এই অমসৃণ জীবনের জন্য দায়ী তার নিজের মনটাই। এই মনটা জীবনের পদে পদে সঠিক ডিসিশন নিলেও কিছু ক্ষেত্রে বড়ো ভুল করে ফেলেছে। পাবলিক কলেজে চান্স পাওয়া নির্বার জন্য সহজ হয়নি। এখানে এসে বুঝতে পেরেছে পড়াশোনায় কতটা খামতি ছিল। ইদানীং মনে হয় সে পড়াশোনায় বেশ ফাঁকি দিয়ে এসেছে। মাঝ রাতে হুট করেই কান্না চলে আসে। তার একাদশের জীবনটা আসলেই কঠিনভাবে চলছে। বাবা মা আর ছোট বোনকে নিয়ে প্রায়শই ছুটে যায় গ্রামে। সেখানে কত স্মৃত রয়েছে। বন্ধুদের কথা ভীষণ মনে আসে। কিন্তু সময় নিয়ে খোঁজ নেওয়া হয় না। তারাও খোঁজখবর নেয় না তেমন। অবশ্য নিবেই বা কেমন করে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে সে তো বড়ো অনিয়মিত। যেমন আজ মাস দেড়েক পর অনলাইন হলো সে। শুরুতেই ম্যাসেজ দেখার ইচ্ছে হলো না। নোটিফিকেশন ও দেখল না। সার্চ করল শাহানের আইডি। ব্যক্তিটা বড়ো নি ষ্ঠু র। নির্বার হৃদয়ের ধুকপুক বেড়ে গেল। সে শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে রাখল। কিন্তু আইডিটা পাচ্ছে না। এই মুহূর্তে নির্বার ইচ্ছে করছে নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে। কেন আসছে না? সে পর পর কয়েকবার চেষ্টা করল। পরক্ষণেই মনে পড়ল মানুষটা আইডির নামে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। নিজের কান্ডে নিজেই বিরক্ত সে। এদিকে বুবু বুবু করে ডেকে যাচ্ছে নিশু। এক আকাশসম বিরক্তি নিয়ে তোয়ালে নিল সে। বাথরুমের কাছে এসে বলল, “বে য়া দব,গোসলের আগে তোয়ালে নেওয়ার কথা মনে থাকে না?”
“স্যরি বুবু।”
রাগের সমাপ্তি দিয়ে শান্ত হয়ে বসল নির্বা। সবে কলেজ থেকে এসেছে। ঘামে ভিজে গেছে শরীর। ফ্যান অন করে আরাম করে বিছানায় উঠে বসল। শাহানের বর্তমান আইডির নাম সার্চ করে প্রোফাইলে ঢুকল। ছেলেটা গত দেড় মাসে তিনটে পোস্ট করেছে। এর মাঝে একটা ভিডিও আছে। ভিডিওটা অন করে তাকিয়ে রইল নির্বা। শাহান ও তার বন্ধুদের পিকনিকের ভিডিও। গ্রামের কোনো এক নিরালায় কাচ্চি রান্না করছে তারা। ছোট ছোট ক্লিপস একত্র করে চার মিনিটের একটি ভিডিও বানানো হয়েছে। পুরো ভিডিওতে মাত্র দুবার দেখা গেল শাহানকে। নির্বা সেগুলোর স্ক্রিনশর্ট নিতে না নিতেই নিশু বলল, “কি করছো বুবু?”
হঠাৎ কণ্ঠ শুনে চমকে উঠল সে। হাত থেকে ছলাৎ করে পরে গেল ফোনটা। নির্বা তড়িৎ গতিতে ধরতে গিয়েও পারল না। চোখের নিমিষে চলে গেল ডিসপ্লে! নির্বা কতবার চেষ্টা করল হিসেব নেই। নিশুও ভয় পেয়ে গেছে। সে এক কোণে দাঁড়িয়ে। নির্বা চিৎকার করে উঠল।
“কি করলি এটা। তোর জন্য আমার ফোনটা নষ্ট হয়ে গেল।”
“আমি তো কিছু করিনি বুবু।”
“তোর জন্যেই এমন হয়েছে।”
“আমায় দোষ দিচ্ছ কেন? আমি কি করলাম।”
নির্বা রেগে আগুন। সে চট করেই থা প্প ড় মারল বসিয়ে দেয় নিশুর বাহুতে। নিশু কেঁদে ফেলল। মাথায় থাকা তোয়ালেটা বিছানার উপর ছুড়ে চলে গেল। নির্বা অস্থির হয়ে গেছে। এ বছরই ফোনটা কিনল। আর এর মধ্যেই এমন হলো। কান্নায় ভেঙে পড়ল মেয়েটি। নিশু মায়ের কাছে পুরো ঘটনা বর্ননা করল। নির্বাকে অবশ্য এ ঘটনার জন্য তেমন কিছু বলা হয় নি। সারাটা বিকেল কান্না করে পার করল সে। সন্ধ্যায় গানের রেওয়াজ ছিল। সেখানেও গেল না। সিদ্ধান্ত অনেক রাত করে কল করল। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা পেরিয়ে সবে ফ্রেস হয়েছে সে। মাথার চুল গুলো তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, “আসো নি কেন গার্ল?”
“অসুস্থ।”
“উম,আন্টি তো অন্য কিছু বলল।”
“মা কি বলেছে?”
“ফোন নষ্ট হওয়াতে তোমার মন খারাপ।”
নির্বা হতাশ কণ্ঠে জবাব দিল, “তেমন না। মাথাটা ব্যথা…”
“বুঝেছি,কান্না করে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছ। আমি দেখলেই বুঝে যেতাম। তাই লজ্জা পেতে হতো। এই জন্যেই আসো নি। এম আই রাইট গার্ল?”
এত দুঃখের মধ্যেও হেসে ফেলল নির্বা। চোখের কোণ মুছতে মুছতে বলল, “কান্না করার সময় আমি লজ্জা পাই না।”
“গুড। তবে গোসল না করাটা কিন্তু লজ্জার।”
নির্বা আসলেই লজ্জা পেল। সিদ্ধান্ত হেসে বলল, “গোসল করে ফেলো। রাতের খাবার খেয়ে ঘুম দাও। কাল তো অফ ডে, আর সকালেই তোমার রেওয়াজ আছে। মিস দিবে না কেমন?”
ফোন রেখে শ্বাস ফেলল মেয়েটি। শরীরটা ইষৎ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ভাঙা ফোনের দিকে তাকিয়ে বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে। ধীর পায়ে এগোলো বাথরুমের দিকে। শরীরটা ভীষণ ভারী ঠেকল। কান্না করলে বুঝি শরীর ভারী হয়ে যায়?
সিদ্ধান্ত’র থেকে ফোন নেওয়ার ইচ্ছেটা একদমই ছিল না। কিন্তু ছেলেটা এত রকমারি পাঁয়তারা করেছিল যে ফোনটা নিতেই হলো। নতুন ফোন পেয়ে মনে মনে নির্বা ভীষণ খুশি। তবে মুখে প্রকাশ করল না। কলেজে এসে বান্ধবীদের ট্রিট দিবে বলেও জানাল। সিদ্ধান্ত’র সাথে পরিচয় থাকার সুবাদে কলেজে বেশ দাম আছে মেয়েটির। কেউ কেউ অবশ্য হিংসে করতেও ছাড়ে না। সেসব নিয়ে নির্বার মন খারাপ নেই। সে থাকে তার মতো,নিজের জগৎ নিয়ে। কলেজ শেষ হলো দুপুর দুটোয়। এ সময়টা সাধারণত লাঞ্চ টাইম বলেই গণ্য করা হয়। কিন্তু বান্ধবীদের লাঞ্চ করানোর মতো টাকা নেই ওর কাছে। সে অল্প খরচেই বাঁচতে চায়। তাই স্ট্রিট ফুড খাওয়াবে বলেই স্থির করেছে। বন্ধুরা এতেই খুশি। ফ্রিতে যা পাবে তাই তো লাভ। কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে পড়ল ওরা। বন্ধুদের মধ্যে দুই বিনুনি করা ছিমছাম নির্বাকে দেখতে সবথেকে ছোট লাগছে। মেয়েটি বয়স ওজনে কিংবা দৈর্ঘ্যতে বান্ধবীদের থেকে বেশ ছোট খাটোই। নির্বা মাঝে মাঝে ভাবে শহরের এই মেয়েরা নিশ্চিত ফার্মের জাত। নতুবা কেন এত ভারী আর বিশাল হবে? নির্বা শুরুতেই মমো অর্ডার করল। পার পিস বিশ টাকা করে। মমো তৈরি হতে হতে বান্ধবীরা কিছু সেল্ফি নিল। ঠোঁট সরু করা স্টাইলে ছবি তুলতে গিয়ে শাহানকে নজরে এল নির্বার। রাস্তার প্রচন্ড জ্যামে আটকে আছে ছেলেটা। নির্বার কি হলো কে জানে সে তড়িৎ গতিতে ছুটে গেল শাহানের নিকটে। শুরুতেই দেখতে পায় নি শাহান। জ্যাম ছুটতেই সে বাইক স্টার্ট করল। নির্বা বুদ্ধি জ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল। বাইকের মিররে মেয়েটিকে দেখতে পেল শাহান। ভ্রু কুঁচকে গেল তার। বাইক থামিয়ে পেছন ঘুরতেই নির্বা উপস্থিত। হাঁপিয়ে গেছে সে।
“তুমি এখানে!”
“আপনাকে দেখেই তো ছুটে এলাম।”
“হু বাট,কোথায় থাকছো?”
“সামনেই। কেমন আছেন আপনি?”
“ভালো।”
“শুকিয়েছেন?”
“হয়ত। তুমি তো বোধহয় কিছুটা ওজন বাড়াতে পেরেছো।”
নির্বা লজ্জার সহিত মাথা নাড়াল। শাহান ঘড়িতে টাইম দেখে বলল, “কলেজ এখন ছুটি হলো?”
“হুম।”
“বাসায় না গিয়ে রাস্তায় কি করো? রোজ এভাবেই টইটই করো,পড়াশোনা বাদ দিয়ে?”
“না,না। আমি তো গুড গার্ল।”
“জানি তো। স্কুলে থাকতে নদীর ধারে ঘুরতে আর এখন রাস্তার পাশে।”
কথা শেষ করেই হেলমেট পড়ল শাহান। নির্বা নিজের বিনুনি মোচড়াচ্ছে।
“বাড়ি যাও।”
“আপনি চলে যাবেন?”
“থাকার কথা ছিল?”
“না,মানে।” নির্বা কথা বলতে পারল না। শাহান বাইক স্টার্ট করতেই নির্বা চেচিয়ে বলল, “গ্রামে যান না এখন?”
“কম যাই।”
শাহান মিলিয়ে গেল। নির্বার বুকের ভেতর কেমন এক অনুভূতি হচ্ছে। কতদিন পর মানুষটার সাথে দেখা হলো। স্বাভাবিক আচারণ পেয়ে সে আরো বেশি খুশি হয়েছে। খানিক বাদে ওর বান্ধবীরা এল।
“এখানে কি করিস তুই?”
“এমনি এলাম।”
“ঐদিকে মমো হয়ে গেছে। তুই নেই দেখে খেতেও পারছি না।”
এক মুহূর্তের জন্য নির্বার মায়া হলো। বন্ধুরা বুঝি এমনি হয়। তাকে রেখে খাবে না বলেই ছুটে এল! ওর এই ভাবনায় এক বালতি পানি ঢেলে একজন বলল, “ভাগ্যিস পেলাম তোকে। আমরা তো ভেবেছি তুই হাপিস হয়ে গেছিস। শেষে বিল গুলো না আমাদের পকেট থেকেই দিতে হয়।”
মুখ বাকিয়ে ফেলল নির্বা। কি ভেবেছিল আর কি বের হলো! এতক্ষণ পর সে বুঝতে পারল বিষয়টা। বিলের জন্যেই খাবার খায়নি এরা! আর সে কিনা মন খারাপ করে ফেলেছিল।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি