#এক_জোড়া_নুপুর (১৩)
অপমানে শরীর জ্বলে উঠল নির্বার। শাহানের নিকট থেকে এমন বাক্য শুনতে মোটেও অভ্যস্ত নয় সে। দুটি চোখ যেন জ্বলন্ত দা বা নলে পরিনত হয়েছে। সে দু পা পিছিয়ে এল। বিশ্বাস হচ্ছে না তার। অত্যন্ত রাগ থেকে সে চেচিয়ে উঠল, “ছি,এসব কথা আপনার মুখ থেকে আশা করি নি আমি। এত নিচু আপনি!”
“নিচু মানুষের পেছন ঘুরা বন্ধ কর। যাও এখান থেকে।”
নির্বা আরো কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু আশে পাশের মানুষ গুলো কেমন করে তাকাচ্ছে ওদের দিকে। ইতিমধ্যেই অনেক কিছু ঘটে গেছে। নির্বা চাইছে না কথা বাড়াতে। সে টেবিল থেকে কোনোমতে পার্স উঠিয়ে চলতে লাগল। একটা মানুষ যাকে সে পছন্দ করে,সেই মানুষটাই আজ তীব্র অপছন্দের পরিণত হলো। জীবন এমনও হয়?
বাসায় ফিরে এক চোট কান্নাকাটি করেও শান্তি হলো না নির্বার। সে বুকের ভেতর জ্বলতে থাকা দাবানল নেভাতে পারছে না। অন্যদিকে পারছে না অনুভূতি ভুলতে। তার এই অদ্ভুত মন তাকে বরাবরই কষ্ট দেয়। নাহলে সকালে যতটা হাসি খুশি হয়ে গিয়েছিল বিকেলে ঠিক ততটাই কষ্ট নিয়ে ফিরতে হয়?
কান্না করার ফলে তার কণ্ঠটা কেমন ভেঙে এসেছে। রাগে দুঃখে নিজের চুল নিজেই ছিঁড়বে এমন দশা। এমনকি দুপুরে খাবারও খেল না। তাতেও অবশ্য শান্তি পেল না সে। রাগে দুঃখে গোসল করল ঘন্টার পর ঘন্টা। কিছুটা হাল্কা লাগছে এখন। বিছানার উপর উবু হয়ে বসে রইল। মাথার উপর চলছে ফ্যান। সেই সাথে চলছে নির্বার জীবন।
সকালে খুব বেশিই আনন্দিত ছিল নির্বা। গত রাতে শাহানের সাথে কথা হলো। হুট করেই ঠিক হলো দেখা করবে। শাহান নিজেই বলল কথাটা। সব ঠিকই ছিল। বেশ ফুরফুরে ছিল সময়টা। রাতে ঘুম হলো না ওর। সকাল হতেই উত্তেজনা বৃদ্ধি পেল। নির্বা নিজেকে পরিপাটি করে বের হলো। মাঝ রাস্তা থেকে একটা গোলাপ ও কিনল। কেন কিনল জানা নেই। তারপর সেটা গুঁজে নিল চুলের মুঠিতে। এমনিতেই ভারী সুন্দর মেয়েটি। তার উপর লাল গোলাপে তাকে আরো মোহনীয় লাগছিল। রেস্টুরেন্টে এসে দেখল শাহান আগে থেকেই বসে আছে। ছেলেটাকে দেখেই ওর লজ্জা লাগছিল। অন্যদিকে শাহান ছিল বেশ নিশ্চুপ শান্ত। সে বসতেই শাহান বলল, “কেমন আছ?”
“ভালো। আপনি?”
“হুম ঠিক ঠাক। অর্ডার করো।”
“না,না আপনি করেন।”
“ওকে।”
শাহান যখন অর্ডার করছিল তখন নির্বা নজর নিচু করে রাখলেও আড়চোখে বার বার দেখছিল মানুষটাকে। তাদের মধ্যে ভাব বিনিময় হয়নি কখনোই। অথচ শাহানের অজানা নয় নির্বা তার উপর দূর্বল। খানিক বাদে অর্ডার করা খাবার গুলো এসে যায়। খাবার খাওয়ার সময় দুজনের কারোই কথা হলো না। শেষ দিকে এসে শাহান বলল, “তুমি কাউকে পছন্দ করো?”
একটু অদ্ভুত লাগে নির্বার নিকট। মানুষটা হুট করেই এসব কেন বলছে? তারপরই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “হয়ত।”
“সে কে?”
“আছে কেউ।”
“তাকে বলো নি?”
“উহু।”
“বলছ না কেন?”
“ভয় করে।”
“আজীবন চুপ করে থাকবে?”
“কি জানি।”
দুজনের মধ্যেই নীরবতা চলে আসে। নির্বার হৃদয়ের শব্দ বেড়ে গেছে। সে একটু সময় নিয়ে প্রশ্ন করে, “কাউকে পছন্দ হলে কেমন করে বলতে হবে?”
“সরাসরি বললেই হবে। এটাই তো বেটার মনে হয়।”
“হুম।”
নির্বা চুপ হয়ে যায়। শাহান কাচের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি নেমেছে। ফোঁটা ফোঁটা জল কাচের জানালা বেয়ে নেমে যাচ্ছে। আকাশ কিছুটা কালো হয়ে আছে। সেই সাথে আসছে মাতাল করা সুবাস। মিশ্র অনুভূতিতে ভরে উঠেছে চারপাশ। ঠিক তখনি নির্বা বলল, “যদি বলি মানুষটা আপনি।”
অসম্ভব গতিতে চোখ ফিরিয়ে তাকাল শাহান। নির্বার দু চোখে আজ একটুও লজ্জা নেই। আছে কেবল আকুলতা। বুকের ভেতর শব্দ। যেই শব্দ তাকে ছিন্ন করে যাচ্ছে। শাহান উঠে যাচ্ছিল। নির্বা চটজলদি বলল, “যাচ্ছেন কেন? আমি এর জন্যেই কিছু জানাতে চাই নি। প্লিজ ইগ্নোর করবেন না।
আমি কখনো এসব বলব না। উত্তর ও চাইব না।”
“পছন্দ করো আমায়?”
“জী।”
“তাহলে চলো আমার সাথে।”
“কোথায়?”
“বেড রুমে। গার্লফ্রেন্ড হতে গেলে যা করতে হয়।”
নির্বা চমকে তাকাল। শাহানের কথাটা বোধগম্য হয়নি তখনো। কিছু সময় পর ছেলেটা এত বিশ্রি শব্দ উচ্চারণ করল যে নির্বার নিজের কানকে বিশ্বাস করতেও ইচ্ছে হলো না। মেয়েটা থমকে গেল। পুনরায় একই কথা বলায় নির্বা রেগে গেল। শাহানের প্রতি প্রবল ঘৃণা জন্মাল। অনুভূতি মানেই কি কাছে আসা?
দরজায় নক পড়তেই উঠতে হলো নির্বাকে। সুমিতা দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে খাবার।
“মা বলে এসেছিলাম তো এখন খাব না।”
“সেই কোন সকালে বের হয়েছিলি। এসে খাবি না বললি। সন্ধ্যা হয়ে এল তারপর ও না করছিস। কি হয়েছে তোর?”
“কিছু হয়নি মা।”
“সব বাদ,এখন হা কর।”
“খিদে নেই মা।”
“কি এমন খেয়ে এসেছিস?”
চুপ রইল নির্বা। সুমিতা ভাতের লোকমা মুখে তুলে দিলেন। খাবারটা মুখে দিয়ে নির্বার মনে হলো দু চোখ ভিজে উঠল। কোনো মতে নিজেকে আড়াল করল মেয়েটি। সুমিতা বহু চেষ্টা করেও দ্বিতীয় লোকমা ভাত খাওয়াতে পারলেন না। মেয়ের এই বিধ্বস্ত চোখ মুখ ওনার চোখ এড়াল না।
সিদ্ধান্ত ইদানীং একটু বেশিই সময় দেয় নির্বাকে। আগের থেকেও বেশি। যা নির্বাকে পুরোদমে তৈরি হতে সাহায্য করছে। ছেলেটার সাথে ইতোমধ্যেই বেশ ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। শাহান যাওয়ার পর সিদ্ধান্ত যেন ওর জীবনে সবথেকে সুন্দর সময় উপহার দিয়েছে। মেয়েটি মাঝে মাঝে তাকিয়ে থাকে। একটা মানুষ যেমন সুন্দর ঠিক তেমনি তার ভালোবাসার প্রকৃতি। মাঝে মাঝে শাহানের কথা মনে পড়লেও আগের মতো খারাপ লাগাটা কাজ করে না। সময় তাকে সয়ে নেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছে। এর মধ্যেই ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষাটা শেষ হয়ে গেল। হাতে বেশ সময় আছে। একটু আগে সিদ্ধান্ত কল করে জানাল তাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে। নির্বার বেশ খুশি লাগছে। ছেলেটার সাথে বেশ মিশে গেছে নির্বা। নিজের ঘরে রেডি হচ্ছিল সে। নিশু এসেই এমন ভাবে ধাক্কাচ্ছে যেন দরজা ভে ঙে ফেলবে।
“বুবু এই বুবু সিদ্ধান্ত ভাইয়া বসে আছে। সেই কখন এসেছে। তোর কত টাইম লাগবে?”
“আর পাঁচ মিনিট। ওকে অপেক্ষা করতে বল নিশু।”
“অপেক্ষা করতে পারবে না আর।”
“কেন?”
“এত লেট করছো তুমি।”
“আর একটু অপেক্ষা করতে বল। আমি পাঁচ মিনিটেই আসছি।”
“সিদ্ধান্ত ভাইয়া চলে যাবে বলেছে।”
“তাহলে বল চলে যেতে। আমি অতো দ্রুত তৈরি হতে পারব না।”
নিশু ড্রয়িং এ ফিরে এসে সংবাদটা দিল। সিদ্ধান্ত হতাশ ভঙ্গিমায় বসে রইল। সুমিতা এসে দ্বিতীয় বারের মতো চা দিয়ে গেলেন। চা কাপে চুমুক দিতেই নির্বা হাজির।
“চলো,লেট হয়ে যাচ্ছে।”
সিদ্ধান্ত ছোট চোখে তাকাল। নির্বা ভ্রু দিয়ে ইশারা করে বলল, “কি?”
“আটত্রিশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছি।”
“মাত্র!”
“এটাকে মাত্র মনে হলো তোমার?”
“তো?”
“গার্ল ইউ আর ক্রেজি?”
“তুমি আসবে? না হলে কিন্তু যাব না।”
“চা শেষ করে নিই।”
“শেষ করা লাগবে না। আসো তো।”
নির্বা এক প্রকার টেনে নিল সিদ্ধান্তকে। মেয়েটির কান্ডে হেসে ফেলল নিশু। সিদ্ধান্ত পেছন ঘুরে বলল, “এই রকম বান্দর মেয়ে যে কার কপালে আছে কে জানে।”
পাশ থেকে নির্বা স্মিত হেসে বলল, “তোমার কপালেই জুটে যাই যদি?”
“মন্দ হয় না।”
কথা শেষে নির্বা আর সিদ্ধান্ত দুজনেই হাসল। সিদ্ধান্ত তার জন্য একটি গোলাপ এনেছে। যা পেয়ে নির্বার মন আনন্দিত হয়ে গেল। দুজনে একসাথে অনেকগুলো ছবিও তুলল। দুদিন পরেই তাদের দুজনের প্রথম যুগল গান রেকর্ড হবে।দর্শকরা বেশ মুখিয়ে আছে। সিদ্ধান্তের ধারণা বিগত সব রেকর্ড ভেঙে ফেলবে তাদের যুগল গান।
**গল্পটি আর দুটি পর্ব হবে। যেহেতু ছোট গল্প তাই কাহিনী দ্রুত এগিয়ে চলেছে।**
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি