#এক_জোড়া_নুপুর (২)
শুষ্ক ঠোঁট জোড়া জ্বিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিল নির্বা। পুরো শরীর ভেজা। মায়ের নিকট কি বলবে মাথায় আসছে না। এমন এক কান্ড হলো যে বানিয়ে বলেও সুবিধা হবে না। পা টিপে বাড়িতে প্রবেশ করল সে। মাথাটা ভন ভন করছে। পুরোটা দিন খারাপ গেলেও এই সময়টা ওর সঙ্গ দিল। মা বাসায় নেই। ছোট বোন উঠানে খেলছে। ব্যাগটা বোনের কাছে দিয়ে তাগাদা দিয়ে বলল, “দ্রুত জামা এনে দে নিশু। আধ ঘন্টা ধরে ভিজে শরীরে।”
নিশু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। বোনের কথা বুঝতে পারে নি সে।
“কি রে? যাচ্ছিস না যে!”
“তুমি এ সময়ে বাড়ি এলে কেন বুবু?”
“এমনি এসেছি। যা বলছি তাই কর।”
“ভেজা কেন!”
“এত সময় ধরে কি বললাম? যা না বোন,অসহ্য লাগছে ভেজা শরীরে।”
ব্যাগ নিয়ে ছুটে গেল নিশু। নির্বা কল থেকে ভালো মতো পা পরিষ্কার করল। আজ জুতো ও বেইমানি করল! মাঝ পথেই ছিঁড়তে হলো।
ঠান্ডায় তিনদিন ধরে ভুগতে হচ্ছে নির্বার। একেবারে যা তা অবস্থা। বিকেলে মা চা করে দিয়েছেন। সেটা খেয়েও বিশেষ লাভ হলো না। সন্ধ্যায় বাবা বাড়ি ফিরেই ডাক্তারের নিকট নিয়ে এলেন। মেয়েটা কথাও বলতে পারছে না। গলা বসে গেছে। নির্বার ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। সামনেই গানের অনুষ্ঠান। সে খুব ভালো গান করে। প্র্যাকটিস করতেও পারছে না। ওর কান্না পেল। সন্ধ্যার দিকে বাজারে ভীষণ ভীড় থাকে। বিশেষত পুরুষ মানুষের ভীড়। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। দোকানের বাইরে বেঞ্চ পাতা। তার পাশেই আবার চা সিঙ্গারার দোকান। নির্বা চুপ করে অপেক্ষা করছে। আশে পাশের এলাকায় একটাই ডাক্তার। তাই দোকানটিতে বিশাল ভীড়। নির্বার বাবা জামাল মেয়েকে সিঙ্গারা আর চা এনে দিলেন। সিঙ্গারাতে কামড় দিয়ে চা মুখে নিতে ভীষণ ভালো লাগে নির্বার। দ্বিতীয় কামড় দিতেই হাসির শব্দ শুনতে পেল। ক্যারামের দোকানটাতে ক্যারাম খেলছে একদল ছেলে। তাদের মধ্যে থাকা শাহানকে চিনতে অসুবিধা হলো না ওর। বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। নির্বা ভেতরে ভেতরে বড়ো বিচলিত হয়ে পড়ল। কিছু সময় পর একটা ছেলে সিঙ্গারা আর চা অর্ডার করল। দোকানদার আগের ভাঁজা সিঙ্গারা দিতেই চেচিয়ে বলল,”নতুন করে ভেঁজে দেন মামা।”
“নতুন আর কি দিব,গরম আছে তো।”
“উহু অন্য গুলো ভেঁজে দেন।”
“এখন তো আর ভাঁজব না মামা। নিলে এই গুলোই লন।”
“কি আশ্চর্য! সিঙ্গারা তো বানানোই আছে। ভেঁজে দেন না।”
দোকানদার সিঙ্গারা ভাঁজতে নারাজ। ছেলেটার সাথে তর্কাতর্কি চলছে। পাশের ক্যারামের দোকান থেকে শাহান এল। নির্বা তখন হা হয়ে দেখছে সব।
“সিঙ্গারা কি আর ভাঁজবেন না মামা?”
“না এখন আর না।”
“এই তোরা আয় তো।”
ছয় সাতটা ছেলে ছুটে এল। শাহান আদেশের সুরে বলল, “মামার দোকানে যেন মাছিও না আসতে পারে সেই ব্যবস্থা কর।”
দোকানদার বিরক্ত মুখে তাকিয়ে রইল। ছেলে গুলো দোকানের সব বেঞ্চে বসে পড়েছে। এই সন্ধ্যা বেলায় চা সিঙ্গারার জমজমাট ব্যবসা। নিম্ন আয়ের মানুষ গুলো দোকানে বসে খায়। এত গুলো ছেলে এভাবে বসে থাকলে তারা আসবে না। দোকানদার কটমট করে তাকিয়ে সিঙ্গারা ভাঁজতে বসলেন। শাহান মিটিমিটি হাসছে। একটা ছেলে চা এনে দিল। চা মুখে দিয়ে গল্প করার সময় নির্বাকে চোখে পড়ল। পাশের বেঞ্চেই বসা। একদম কাচুমাচু হয়ে আছে। চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। হাতে চায়ের কাপ। প্লেটে আধ খাওয়া সিঙ্গারা। চোখে ভয়। শাহান কিছু বলল না। নিজের মতো করে চা পানে ব্যস্ত হলো। খানিক বাদে নির্বার ডাক পড়ল। ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ নিচ্ছিল। সে সময়েই শাহান এল। পকেট থেকে কিছু ঔষধের খালি প্যাকেট বের করে সেগুলো দিতে বলল। নির্বার থেকে এক হাত দূরে সে। অথচ এত অস্বস্তি লাগল মেয়েটির। বাবার হাতটা চেপে রইল। শরীর কাঁপছে থরথর করে। তার থেকে বেশি কাঁপছে বুক!
নির্বার অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা এসে গেছে। পরীক্ষা শেষ হলেই গানের অনুষ্ঠান। বেশ বড়ো উৎসব। শুনেছে ঢাকা থেকে অতিথি আসবে। তাদের মধ্যে শিল্পী গোছের কেউ ও আছে। ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজিত সে। মায়ের জন্যে প্রকাশ করতে পারছে না। পড়ার টেবিলে বসেও কল্পনায় চলে গেল। এত মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে ওর। নিশু পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। বেশ ভালো ছাত্রী। নির্বাও তেমনি। দু বোনের মাঝে একটা লড়াই চলে সর্বদা। আজ নির্বা চুপচাপ। নিশু পড়া বন্ধ করে বোনের দিকে তাকিয়ে রইল। মতিগতি বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করল।
“বুবু কি হয়েছে?”
“কিছু না। তুই পড়।”
পুনরায় পড়তে লাগল নিশু। এদিকে নির্বা কল্পনায় চলে গেল বহুদূর। সেই কল্পনায় এক রাজপুত্র এল। যার মুখের আদল শাহানের মতো! ধড়মড়িয়ে উঠল সে। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। মা দুধ গরম করে আনলেন। সবে সুস্থ হয়েছে মেয়েটা। আদুরে হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
“শরীর খারাপ লাগছে মা?”
“না। তবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”
“সমস্যা নেই। ভোরে ডেকে দিব তখন পড়ে নিস।”
“হু।”
দুধ শেষ করে নির্বা বসে রইল। ভেতরটা কেমন অশান্ত হয়ে গেছে। শাহানের মুখটা কেন দেখতে পেল?
“মা একটু শুনবে।”
“হুম বল।”
“মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে?”
“আচ্ছা। এদিকে আয়।”
মায়ের কোলে মাথা রাখল নির্বা। মা আদুরে হাতে হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন। নির্বার দুটি চোখে ইষৎ ঘুম নেমে এসেছে। সাথে দেখতে পাচ্ছে শাহানের মুখ। মানুষটা বার বার ওর কল্পনায় কেন আসে?
প্রথম দিকে নির্বা ভেবেছিল শাহান কেবল ওর মোহ। একটা ভালো লাগা কাজ করে। কিন্তু দিন যত যাচ্ছিল ততই অশান্ত হয়ে পড়ছিল। হেরার সাথে ওর সম্পর্কটা ভালো। ক্লাসে বেশ গল্পে মেতে থাকে দুজনা। কখনো তার ভাইকে নিয়ে প্রশ্ন করা হয়নি। আজ ও হতো না যদি না বান্ধবীদের মুখে শাহানের নামটা শুনত। কান খাড়া করে রইল সে।
“শাহান ভাই এর গার্লফ্রেন্ড আছে?”
“আমি কি করে বলব?”
“কেন তোর ভাই তুই জানিস না?”
“আমায় বলবে?”
“একমাত্র বোনকে বলবে না?”
“ভাইয়ার সাথে আমার তেমন সম্পর্ক নয়।”
“ও আচ্ছা। কিন্তু তোর ভাইয়ের উপর অনেকেই ক্রাশ।”
হেরা হাসল। এদিকে নির্বার অসহ্য লাগছে। সে চেয়েও পারছে না অন্যদিকে মনোযোগ দিতে। হেরা গল্প শেষে নির্বার পাশে এসে বসল। নির্বা অঙ্ক করতে করতে বলল,”চুমকি কি বলছিল রে?”
“ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা সেটাই জানতে চাচ্ছিল।”
“তুই কি বললি?”
“আমি আবার কি বলব। আমি কি জানি নাকি। তাছাড়া ভাইয়া বেশির ভাগ সময় থাকে শহরে। থাকলে থাকতেও পারে।”
নির্বার এবার মন খারাপ হয়ে গেল। কেন হলো সে জানে না। যুবক ছেলে,গার্লফ্রেন্ড থাকতেই পারে। কিন্তু তার কেন এত মন খারাপ হয়?
এক সপ্তাহ পরের ঘটনা। বৃষ্টির জল মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরছে নির্বা। ওদের এলাকায় গাড়ি খুব কম চলে। বৃষ্টির সময় তো পাওয়াই যায় না। স্কুল ছুটি হলো চারটায়। এরপর কোচিং করতে গিয়েছিল। এখন প্রায় ছয়টা বাজতে চলেছে। এদিকে ছাতাটাও ঠিক ঠাক কাজ করছে না। বৃষ্টির কারণে এক পাশ বাঁকা হয়ে গেছে। নির্বা এই সময়টায় খুবই বিরক্ত বোধ করছে। বৃষ্টি আসার ও সময় পেল না! কাঁচা রাস্তার উপর কিছুদিন আগেই ইট বিছানো হয়েছে। পাশের কাদামাটি সব রাস্তায় উঠে এসেছে। পথচারীর পাশাপাশি গরু ছাগল ও পথ চলে এই রাস্তা দিয়ে। তাই কিনা এই অবস্থা! নির্বা দ্রুতই চলছিল। সে সময়েই একটি কণ্ঠ শুনতে পেল।
“এই পিচ্চি, আস্তে চলো পড়ে যাবে তো।”
কথাটা শেষ হতে না হতে পড়ে গেল নির্বা। শাহান ভ্রু কুটি করে তাকাল। এত লজ্জা লাগছে মেয়েটির। সে ভেবেছিল হাত বাড়িয়ে দিবে ছেলেটা। অথচ তেমন কিছুই হলো না। সে নিজ থেকেই উঠে দাঁড়াল।
“বড়ো অদ্ভুত তো তুমি। বলতে না বলতে পড়ে গেল।”
উত্তর দিতে পারল না নির্বা। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁদায় মেখে গেছে। শাহান ঠোঁট কামড়ে হাসছে। এদিকে নির্বার ইচ্ছা করছে মাটির নিচে চলে যেতে। যত বিপদ এই মানুষটার সামনেই কেন ঘটে?
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি