#এক_জোড়া_নুপুর (৩)
স্কুলের বারান্দায় এসে রীতিমতো কাঁপছে নির্বা। একটু আগেই শুনেছে তরুণ গায়ক সিধান্ত হক আসবে। এই সময়ে প্রতিটি মেয়ের মনে ঝড় তুলে দেওয়া সিদ্ধান্ত হক! নির্বার এত আনন্দ হচ্ছে যে কথা বলতে পারছে না। তার ভেতরটা অনুভূতিতে ছেয়ে যাচ্ছে। অনুষ্ঠানে সেও একটি গান গাইবে। তার প্রিয় গায়কের সামনে গান গাইবে! ওর এই উত্তেজনার রেশ রইল শেষ ক্লাস অবধি। পুরো ক্লাসেই সিদ্ধান্তকে নিয়ে গল্প চলছিল। একেকজনের আয়োজনের শেষ নেই। কে কি করবে সেটা নিয়েই মেতে আছে। হেরা নিজেও অনুভূতিতে ভাসছে। সিদ্ধান্ত’র গান শোনার জন্য কত পাগলামি করে থাকে। আর সেই সিদ্ধান্ত আসবে! বাড়ি ফিরেই মায়ের ঘরে এল। আলমারি থেকে খুঁজে সবথেকে সুন্দর শাড়িগুলো বের করল। সুমিতা ঘরে এসে মেয়ের কান্ড দেখে হতবাক।
“শাড়ি বের করছিস কেন?”
“কাল অনুষ্ঠান আছে মা।”
“নতুন জামা না বানালি।”
“সেটা তো সুতি কাপড়ের।”
“তুই তো বানালি। গরমের মধ্যে আরাম লাগবে বললি।”
“হু।” বলেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল নির্বা। কোন শাড়ি তাকে মানাবে বুঝতে পারছে না। প্রতিটা শাড়ির ভাঁজ খুলে খুলে দেখছে। সব গুলোই সুন্দর। দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছে। মায়ের পানে তাকাল আশা নিয়ে। মা ভেঁজা কাপড় মেলে দিচ্ছেন।
“ও মা।”
“কি হলো?”
“কোন শাড়ি পরব?”
“যেটা ইচ্ছে পর। মানা করছে কে?”
“বুঝতে পারছি না। তুমি প্লিজ একটা চয়েজ করে দাও না।”
“পাগলি মেয়ে।”
সুমিতা শাড়ি গুলো দেখলেন। এগুলো ওনার বিয়েতে পাওয়া শাড়ি। কোনোটা একবার পরেছেন তো কোনোটা পরেন ই নি। তিনি খুব বেছে একটা নীল রঙের শাড়ি বের করলেন। মেয়ের শরীরে উপর দিয়ে বললেন, “এটাতে বেশ ভালো মানাবে।”
নির্বা শাড়ি উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ওর কোনো ব্লাউজ নেই। যে পাটকাঠির মতো শরীর এতে সুমিতার ব্লাউজ গুলো ওর লাগবে না। এই রাতের বেলা কার কাছে যাবে? একরাশ মন খারাপ হলো নির্বার। ওর মন খারাপ দেখে সুমিতার খারাপ লাগল। মেয়েটা সহসা শাড়ি পরার কথা বলে না। আজ যখন বলেছে তখন ব্লাউজ ই নেই! তিনি পুরনো জামাকাপড় ঘেটে একটা নীল রঙের ব্লাউজ বের করলেন। এটা ওনার বিয়ের সময়ের। তখন তো এত স্বাস্থ্য ছিল না। নির্বার ঢিলে হলেও অতোটা বাজে লাগছে না। সে ভীষণ খুশি হয়ে গেল। মা কে জড়িয়ে ধরল।
“আমার লক্ষী মা। কি যে ভালো তুমি।”
সুমিতা হাসলেন। তার মেয়েটা আসলেই পাগল। পরদিন সকাল থেকেই নির্বার সাজ শুরু হলো। বাবাকে দিয়ে কাচা ফুল এনেছে। শাড়ি আর গহনা পরে ফুলগুলো মাথায় গুজে নিল। এত সুন্দর লাগছে ওকে। সুমিতা মেয়ের কপালের এক পাশে কাজল লাগিয়ে দিলেন। বার বার প্রশংসা করতে লাগলেন। নির্বার লজ্জা লাগছে ভীষণ। ভেতরে ভেতরে সে উত্তেজিত। কখন আসবে সিদ্ধান্ত হক?
উপস্থাপিকার দায়িত্বে আছে ক্লাস টেনের এক মেয়ে। সে আবার ভীষণ গুড স্টুডেন্ট। নির্বা মনে মনে বিরক্ত। মেয়েটা কিছুটা অহংকারী। বন্ধুদের সাথে বসে সেই কথাই বলছিল। হেরা তো নিচু শব্দে গা লি দিয়ে বসল। নির্বার ও ইচ্ছে হচ্ছে কিছু বলতে। তবে আজকের দিনটি খারাপ করতে চাচ্ছে না। কিছু সময় পর ফারিন আর তার দল এল। সামনের সিটে নির্বারা বসে আছে।
“সামনের সিট ছেড়ে বস তোরা।”
“আমরা তো পারফর্ম করব।”
“তো? আরও অতিথি আসবে না?”
“তাদের জন্যেও তো জায়গা আছে। আমরা তো দুজন বসেছি।”
“কথা না বলে পিছে যা।”
হেরা চরম খেপে গেল। নির্বা ওকে থামিয়ে দিল। পেছনে এসে ভয়ঙ্কর গা লি দিল হেরা। নির্বা সেদিকে মনোযোগ দিল না। ওর মন কেমন করছে। সে সময়টায় স্ট্রেজের পাশে শাহানকে দেখতে পেল। ছেলেটাও নীল রঙের পাঞ্জাবি পরেছে! নির্বার বুক ধুকপুক শুরু হয়ে গেল। নিজের অজান্তেই বার বার তাকাতে লাগল। একটা সময় বুঝতে পেয়ে ভীষণ লজ্জিত হলো। এদিকে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেছে। সম্ভবত কাছিয়ে এসেছে সিদ্ধান্তের গাড়ি। হেরা উঠে গিয়েছে। নির্বা উঠতে চেয়েও পারল না। ওর কেমন এক অনুভূতি হচ্ছে। সিদ্ধান্ত হক আসছে এ কথা যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না!
সিদ্ধান্ত স্কুল গেটে আসতেই ছেলেমেয়েরা উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ল। কোলাহলে ভরে গেল চারপাশ। নির্বা ভীড় ঠেলে গেল না। এমনিতেও ওর অস্থির লাগছে। কাছে গেলে নিশ্চিত মাথা ঘুরিয়ে পড়বে। উপস্থাপিকার দায়িত্বে থাকা ফারিন এমন ভাব করছে যেন সে বেশ বড়ো ব্যক্তি! সিদ্ধান্ত সাধারণত এ ধরণের অনুষ্ঠানে আসে না। সামনেই তার বাবার নির্বাচন। তাই আসতে হলো এক প্রকার বাধ্য হয়ে। উপভোগের চেষ্টা করছে সে। শুরুতেই হাল্কা কিছু বক্তব্য দেওয়া হলো। তারপর শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। হেরা হা হয়ে তাকিয়ে আছে। সিদ্ধান্ত ফর্মাল ড্রেস আপ পরতে পছন্দ করে। আজ ও তাই। এত সুন্দর লাগছে ওকে! সুন্দর আর স্মার্ট লুক। নির্বা গান গাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল মাথাটা ঘুরে যাবে। এত ভয় ইহজনমে হয় নি তার। মাত্র দু হাত দূরে সিদ্ধান্ত! ছেলেটা এত সময় ফোনে মগ্ন থাকলেও নির্বার গান শুরু হওয়ার পর থেকে গান শুনছে। মেয়েটি ভীষণ সুন্দর গায়। রূপ লাবণ্য ও তো কম নয়। কোনো রকম একাডেমিক সাহায্য ছাড়াই এত সুন্দর গাচ্ছে সে। গান শেষে এক সেকেন্ড ব্যয় করল না মেয়েটি। স্টেজ থেকে নেমে এল। সঙ্গে সঙ্গে করতালিতে ভেসে গেল চারপাশ। হেরা ওকে জড়িয়ে ধরল।
“এ যাবতকালের বেস্ট গান ছিল তোর।”
নির্বা তখনো কাঁপছে। সে মঞ্চের পেছনে একটা চেয়ার নিয়ে বসল। বুকের ভেতর এখনো শব্দ হচ্ছে। হাতুড়ি পে টা নোর শব্দ।
বন্ধুদের সাথে ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ ই শাহানকে দেখতে পেল নির্বা। ছেলেটা ফোনে কথা বলছে। তাও হেসে হেসে। নির্বার সন্দেহ হলো। পিছু নিল সে। শাহান খুব আস্তে কথা বলছে। কিছুই শুনতে পেল না। মন খারাপ করে আইসক্রিমের দোকানে এল। সেখানে এসে ঘটল আরেক বিপত্তি। নির্বা আইসক্রিম নিবে তখুনি একটা ছেলে এসে অনেকগুলো আইসক্রিমের অর্ডার দিল। দেখতে দেখতে সব আইসক্রিম শেষ হয়ে গেল। নির্বার মুখটা ছোট হয়ে গেছে। গরমে হাপাচ্ছে সে। সে অনুরোধ করল।
“মামা দেখুন না আর আইসক্রিম আছে কি না।”
“শেষ হয়ে গেল তো।”
“একটাও নেই?”
“না।”
এবার নির্বার কান্না পেল। ছেলেটা বিল দেওয়ার জন্য শাহানকে ডাকল।
“আইসক্রিম নিয়েছিস?”
“হুম ভাই। একেবারে খাপে খাপ হয়েছে।”
“ঠিক আছে।”
বিল মিটানোর সময় নির্বাকে দেখল শাহান। দোকানদার বলছে, “মামুনি একটু আগে আসবে না? তাইলে তো আইসক্রিম পাইতা।”
“ঠিক আছে মামা। এখন আর কি করার।”
নির্বা বেরিয়ে যাচ্ছিল। শাহান প্যাকেট থেকে একটা আইসক্রিম এগিয়ে দিল।
“নাও।”
শীতল হয়ে এল নির্বার বুক। সে শাহানকে দেখতে পায় নি। মাত্রই দেখেছে।
“কি হলো?”
“না না আমার লাগবে না।”
“মাত্রই তো বলছিলে।”
“পরে খেয়ে নিব।”
“চুপচাপ নাও।”
আদেশের কণ্ঠটা শুনে ভরকে গেল নির্বা। শাহান বিল মিটিয়ে চলে গেল। সে পথে তাকিয়ে নির্বার ইচ্ছে করল ম রে যেতে। বুকের ভেতর এমন লাগছে কেন?
আইসক্রিম নিয়ে ফিরে আসতে আসতে সিদ্ধান্তর গান শুরু হয়ে গেল। সে মাত্র একটা গান গাইবে। দর্শক সারি থেকে নানান ধরণের শব্দ আসছে। হেরা বলল, “কই ছিলি?”
“দোকানে।”
“একদম ঠিক সময় আসছিস। নাইলে মিস করতি গান টা।”
“হুম।”
সিদ্ধান্ত চার মিনিটের একটা গান গাইল। তারপর মাইক হাতে নিয়ে বলল, “তোমাদের এখানেই তো গুণী শিল্পী আছে। দারুণ গাইল সে। আমার গান কি পছন্দ হলো?”
লজ্জা পেল নির্বা। অনুষ্ঠানে সেই একমাত্র গান গেয়েছে। সকলেই বুঝল কথাটা। নির্বার সুখে ভাসতে লাগল। তার প্রিয় গায়ক তাকে নোটিশ করেছে! তার গান ভালো লেগেছে। এর থেকে আনন্দের আর কিই বা হতে পারে?
চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি