#এক_জোড়া_নুপুর (৫)
জীবন নিয়ে বরাবরই ভাবনায় ডুবে থাকে নির্বা। আজও তেমনি। বাসে বসে পুরো অতীত ঘুরে এল সে। বাবা যখন ডাকলেন তখন বাস থেমে গেছে। নেমে এল ওরা। সেখান থেকে রিক্সা নিয়ে এল সিদ্ধান্তের অফিসে। ছেলেটা তরুণ গায়কদের মাঝে সেরা। কার্ড দেখাতেই দারোয়ান কল করলেন। ততক্ষণ বাইরেই দাঁড়াতে হলো। গরম লাগছে বেশ। নির্বা ঘেমে গেছে। বাবা পানি কিনলেন। সেটা মুখে দিয়েছে ওমনি সিদ্ধান্ত এসে হাজির। নির্বার শরীর কেঁপে উঠল। সিদ্ধান্ত সালাম দিল! এত বড় গায়ক অথচ ভদ্রতার কোনো কমতি নেই। জামাল তুষ্ট হলেন। ওদের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। সিদ্ধান্ত নিজে এসে রিসিভ করেছে বিষয়টা নির্বার মস্তিষ্ক অবধি গেঁথে রইল। শরীরটা কাঁপছে। সিদ্ধান্ত হেসে হেসে কথা বলছে। এদিকে নির্বা চুপ। সে শুধু দেখছে। খানিকবাদে নির্বার কণ্ঠ পরীক্ষা করতে নেওয়া হলো। ওর ভীষণ ভয় লাগছে।
“তুমি ভয় পাচ্ছ?”
“না।”
“অথচ তোমার শরীর কাঁপছে।”
“এমনি।”
লজ্জা পেল নির্বা। সিদ্ধান্ত মৃদু হাসল। সে ফোন বের করে কাউকে কল দিল। কিছু সময়ের মধ্যেই সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। নির্বার এবার খুব ভয় লাগছে। সিদ্ধান্ত ভরসার কণ্ঠে বলল।
“রিল্যাক্স। আমরা আমরাই তো।”
শান্ত হলো নির্বা। চোখ বন্ধ করে গান শুরু করল। ভেতরের যত অনুভূতি ছিল সব বের করে দিল যেন। হাত তালি শুনতে পেয়ে চোখ খুলল। সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। নির্বা মাথা নিচু করে ফেলল।
“গ্রেট। আমি বলেছিলাম না ওর ভয়েস শুনলে যে কেউ মাথা নামাতে বাধ্য হবে।”
“হুম সেটাই দেখছি।”
“তাহলে মিস্টার খান নেক্সট গানে কো সিঙ্গার হিসেবে নির্বা থাকবে রাইট?”
“একদম। এরই সাথে নতুন একটা গান ওর জন্য তোলা রইল। গানের জগৎটা আরেকটু বুঝতে শিখুক।”
“ওকে। থ্যাংক ইউ।”
মিস্টার খান চলে গেলেন। যাওয়ার পূর্বে আরো একবার নির্বার কণ্ঠের প্রশংসা করলেন। সবটা যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছে। নির্বা এক পলক তাকাল। সিদ্ধান্ত’র ছোট ছোট দুটি চোখ অবচেতনেই ভীষণ মায়ায় ফেলে দিল। কোনো মানুষ এত মায়ায় ভরা হয়?
নির্বার ছোট্ট মন আজকাল গানকে ভীষণ ভালোবাসতে শুরু করেছে। দিন রাত গানের প্রতি ছুটছে সে। সিদ্ধান্তর সাথে আজকাল যোগাযোগ হয়। মানুষটা নির্বাকে নানান ভাবে দীপ্ত করে দিয়েছে। গান নিয়ে কোনো সমস্যা হলেই তাকে কল করতে বলেছে। পড়াশোনা আর গানই হয়ে উঠেছে নির্বার জীবন। এদিকে শাহানের সাথে দেখা হয় না মাস খানেক। হেরার সাথেও আজকাল তেমন যোগাযোগ নেই। ক্লাসে কথা কম বলে সে। ক্লাস টাইমেই সব পড়া শেষ করে। এত ব্যস্ত নির্বা আগের মতো মিস করে না শাহানকে। তবে হুট করেই ভীষণ মন খারাপ হয়। যেমনটা হলো আজ। চাঁদের আলোয় পদ্মদিঘির জল দেখতে দেখতে শাহানের কথা মনে হলো। ছেলেটা কেমন আছে?
বহু দিন পর ফেসবুক লগ ইন করল মেয়েটি। অনেকগুলো ম্যাসেজ এসেছে। এর মধ্যে পহেলা ফাল্গুন ২০১৬ এর শুভেচ্ছা ম্যাসেজের সংখ্যা বেশি। নির্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সব ডিঙিয়ে সে এল শাহানের আইডিতে। ছেলেটা একটিভ নয়। প্রোফাইলে কিছু নতুন ছবি আপলোড দিয়েছে। সেই কালচে হওয়া ঠোঁট আরো কালচে হয়ে গেছে। জোড় ভ্রু যুগল যেন মায়ার সাগর। মসৃণ গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ভালো লাগায় নির্বা সিক্ত হয়ে গেল। শাহানের প্রোফাইলে সবুজ আলো জ্বলতেই সে লিখল।
“কেমন আছেন আপনি?”
সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লে আসল না। তবে যখন রিপ্লে এল তখন রাতের খাবারের জন্য মায়ের ডাক পড়ল। নির্বা হতাশ হলো। ডাটা অফ করে খাবার খেতে এল। খেতে খেতে জামাল বললেন, “তোর জন্য গানের টিচার রাখলে কেমন হয়?”
“প্রয়োজন নেই বাবা।”
“কিন্তু সিদ্ধান্ত যে বলেছিল।”
“বলেছিল অসুবিধা হলে রাখতে। আমি ইউটিউব এর সাহায্যে ভালোই তো করছি।”
“ঠিক আছে। আমি তো অতোশত বুঝি না। তবে দরকার হলে বলবি।”
“ঠিক আছে বাবা।”
সুমিতা মেয়ের প্লেটে আরেক টুকরো মাছ দিলেন। নির্বার খেতে ইচ্ছে করছে না।
“আবার কেন দিলে মা?”
“শরীরে এত প্রেসার নিচ্ছিস। না খেলে চলবে?”
“এক টুকরোই এনাফ। আমি অতো খেতে পারি না।”
মাছের টুকরোটা নিশুর প্লেটে তুলে দিল নির্বা। নিশু খুশি হয়ে বলল, “থ্যাংক ইউ বুবু।”
সুমিতা হতাশ হলেন। ছোট মেয়েটা যতটুকু মাছ খায় তার এক ভাগও খায় না নির্বা। দিনকে দিন শুকনো পাটকাঠির মতো হয়ে যাচ্ছে। গান আর পড়াশোনায় শেষ করে পুরো দিন। এমন করলে শরীর ঠিক থাকবে?
পহেলা বৈশাখের জামা কিনতে এসে ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটল। শাহান বাইকে হেলান দিয়ে সিগারেট খাচ্ছে। নির্বা পাশেই ফুচকা খাচ্ছিল। আচমকা চোখাচোখি হলো দুজনের। মেয়েটি আর একটা ফুচকাও মুখে তুলতে পারল না। এদিকে শাহানের হেলদোল নেই। সে আপন মনে সিগারেট শেষ করছে। কিছু সময় পর তার বন্ধু এল। প্যাকেট দেখে নিয়ে তারা চলে গেল। নির্বার এত মন খারাপ হলো। শাহান তাকে দেখেও কিছু বলল না কেন? অন্তত কেমন আছে সেটা তো বলাই যেত। সেই দুঃখে বাসায় ফিরে ভাত খেল না সে। এমনকি রাতেও না খেয়ে রইল। মা এত করে বললেন কাজ হলো না। নানান অজুহাতে শুয়ে রইল। পরদিন স্কুলে যেতেই হেরার সাথে দেখা। সারারাতের বিষণ্ণ মুখটা ধরে ফেলল হেরা।
“কি হয়েছে গায়িকার?”
“কিছু হয় নি রে।”
“মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। যেন কত কাল ঘুম হয় নি।”
“এমনি। অনেক রাত অবধি গানের প্র্যাকটিস করেছি কিনা।”
“আচ্ছা আয় আইসক্রিম খাব।”
আইসক্রিমের কথাটা বলতেই শাহানের কথা স্মরণ হলো। নির্বার কান্না পাচ্ছে। মানুষটার সাথে দেখা হলো অথচ কথা হলো না। ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। এত যন্ত্রণা কেন হচ্ছে?
খুব আর্জেন্ট দেশের বাহিরে যাচ্ছে সিদ্ধান্ত। তার সর্বোচ্চ প্রাইভেট নাম্বারটা এখন দেওয়া সম্ভব নয়। যেহেতু দেশের বাহিরে দীর্ঘদিনের জন্য যাবে তাই নির্বাকে কল দিল। মেয়েটা মন খারাপ করে বসে ছিল। সিদ্ধান্তর কল পেয়ে চট করেই রিসিভ করল।
“নির্বা?”
“জী।”
“কেমন আছ তুমি?”
“ভালো আছি। আপনি?”
“ভালো। শোনো একটা কথা বলার জন্য কল করেছি।”
“হুম?”
“আর্জেন্ট শো এর জন্য দেশের বাহিরে যাচ্ছি। তাই কোনো কিছুর জানার হলে আমার অফিসে কল কোরো। কেউ না কেউ সাহায্য করে দিবে।”
“ঠিক আছে।”
“খেয়েছ?”
“না। একটু পর খাব।”
“আচ্ছা। মন দিয়ে গান করবে। গুড লাক।”
“থ্যাংক ইউ।”
সিদ্ধান্ত’র কল রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ল নির্বা। এখন তার মন ভালো হয়ে গেছে। সিদ্ধান্তর মতো মানুষের সাথে কখনো কথা হবে সে ভাবনাতেও আনে নি। ভাগ্য বুঝি একেই বলে?
দেখতে দেখতে নির্বার পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। প্রচন্ড চাপ। এস এস সি পরীক্ষার জন্য জোরাল প্রস্তুতি চলছে। সিদ্ধান্ত’র কড়া নির্দেশ গানের জন্য পড়াশোনা নষ্ট করা যাবে না। নতুবা গানে সাহায্য করবে না। সেটা ভেবে নির্বা হাসল। সিদ্ধান্ত’র থেকে অনেক কিছু শিখেছে সে। প্রথম পরীক্ষাটা সহজ হওয়ায় বন্ধুরা বেশ আমোদ করছিল। নির্বার হাতেও সময় রয়েছে। পরীক্ষা চলাকালীন সে গানের প্র্যাকটিস করে না। বন্ধুরা ওকে পেয়ে বেশ খুশি হলো। সবাই একসাথে ঝাল মুড়ি খেতে এল। অর্ডার দিয়েই নির্বা বলল, “মামা বেশি করে ঝাল দিবেন।”
“ঝাল খাইতে পারবেন মামা? একবার তো চিল্লাচিল্লি করছিলেন।”
হেসে ফেলল নির্বা। দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে গেল। এখানেই তো শাহানের সাথে তার প্রথম দেখা। ছেলেটা পানি এনে দিয়েছিল। আজ যদি ঝাল লাগে তবে কে পানি এনে দিবে? বিষয়টা ভেবে জল চলে এল চোখে। নির্বা ভাঙা গলায় ঝাল কমাতে বলল। বন্ধুদের সাথে আড্ডা শেষে বাড়ি ফিরছিল। চোখের সামনে ভেসে উঠছিল পুরনো সবকিছু। এক বৃষ্টির দিনে শাহানের নিকট লজ্জায় পড়তে হয়েছিল। ভুল নিশানায় গুলতি ছুড়ে দৌড়ানোর সময় শাহানের উপরে পড়া। আরো কত শত স্মৃতি। নির্বার দু চোখ ভরে উঠল নোনা জলে। সে হাতের তালুতে চোখ মুছল। হুট করে এত কান্না পায় কেন?
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি