#তোমাতেই_আমি
#পর্ব_০৯
#Tabassum_Kotha
সিদরাত এসে সবার সামনে মীরাকে জরিয়ে ধরলে অর্ণবের মাথায় যেনো আগুন জ্বলে উঠে। মীরার এতো কাছাকাছি কোনো ছেলেকে সে সহ্য করতে পারবে না। অর্ণবের ইচ্ছে করছে গিয়ে সিদরাতের মাথা ফাঁটিয়ে ফেলতে কিন্তু সে কিছুই করতে পারছে না। রাগে সাপের মতো ফুঁসছে আর ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে, রাগটা দমিয়ে ফেলার জন্য। সিদরাত মীরাকে ছেড়ে দিয়ে আবরাব খানের কাছে গিয়ে কুশলাদি বিনিময় করতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। অর্ণব রাগী লুকে মীরার দিকে তাকিয়ে আছে। যদিও মীরার সেদিকে খেয়াল নেই। মীরা হয়তো অফিসের কোনো ফাইল রুমে রেখে এসেছে।
— বাবা তোমরা ব্রেকফাস্ট করো আমি একটা ফাইল রুমে রেখে এসেছি নিয়ে আসছি।
— তুই কি অফিসে যাচ্ছিস? কয়েকদিন বাদেই বিয়ে আর তুই আজকে অফিস যাচ্ছিস!
— বিয়ে আছে বলে কি অফিসে যাবো না! এ কদিন অফিসে যেতে পারি নি তোমার কথা রাখতে গিয়ে,, এখন আমি বিজনেস নিয়ে একদম গাফলতি করতে পারবো না। আসছি।
মীরা সিড়ি বেয়ে উপরের ঘরে চলে যাচ্ছে আর অর্ণব নির্বাক হয়ে দেখছে। এতোখন আবরার আর মীরার মধ্যে হওয়া কথাগুলোর আগা মাথা সে কিছুই বোঝে নি। তবে ধারণা হয়েছে যে মীরার বিয়ের কথা চলছে। অর্ণবের কপাল বেয়ে চিকন ঘাম দিচ্ছে। মনে মনে দোআ করছে যাতে তার ধারণা ভুল হয়। সে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে মীরার পিছু নিলো।
রুমে এসে একটা জরুরি ফাইল খুঁজছিলাম তখন পিছন থেকে কেউ হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিলো। টাল সামলাতে না পেরে লোকটার বুকে পরে গেলাম। হঠাত করেই মনে হলো বুকের ধুকপুকানি টা বেড়ে গেলো। লোকটার শরীরের ঘ্রাণ বলে দিচ্ছে উনি অর্ণব। মুখ তুলে তার দিকে তাকাতে দেখলাম অর্ণবই দাড়িয়ে আছে। রক্তিম মুখোবয়ব নিয়ে আমার দিকে দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে। চোখ দুটি অসম্ভব লাল হয়ে আছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ রেগে আছে। অর্ণবের এই দৃষ্টি টা আমি বরারবই ভয় পাই। তার সাথে চোখ মেলাতে না পেরে দৃষ্টি নিচে নামিয়ে নিলাম। অর্ণব কর্কশ স্বরে বললেন,
— কার বিয়ের কথা বললেন মামা নিচে?
অর্ণবের এই প্রশ্নে কিছুক্ষণের জন্য আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আমি জানি অর্ণব আমার প্রতি দুর্বল হয়ে পরেছেন। এই অবস্থায় তাকে কিভাবে বলি আমার বিয়ের কথা! কিন্তু না বলেই বা কি হবে। নির্ধারিত দিনেই আমার বিয়ে হয়ে যাবে,, অন্যকারো সাথে।
— আমার বিয়ের কথা বলেছেন।
— কিহ! তোমার বিয়ে! মানে কি? তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?
— হ্যাঁ আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। কিন্তু এতে আপনি এতো অবাক হচ্ছেন কেনো?
— তুমি অন্যকারো হতে পারো না মীরা। তুমি অন্য কারো বউ হবে এটা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। তোমার উপর শুধু আমার অধিকার, তোমার বিয়ে আমার সাথেই হবে।
— কি বলছেন এসব! মাথা ঠিক আছে আপনার! আপনার আর আমার মধ্যে তো এই ধরনের কোনো সম্পর্ক নেই।
— আমার PA হয়ে আমার অফিসে চাকরি নেওয়া, তোমার বাবার অসুখের জন্য আমার কাছে থেকে টাকা নেওয়া, আমার টাকা দেওয়ার শর্তে রাজী হওয়া সব নাটক ছিল আমি মানছি। খুব ভালো অভিনেত্রী তুমি। কিন্তু তোমার চোখে আমি আমার জন্য অনুভূতি দেখেছি। আর সেই অনুভূতিগুলো ভালোবাসা ছিল।
— আপনি ভুল ভাবছেন। আমি যা কিছু করেছি সবটাই নাটক ছিল। আর এসব করেছি বাবার জন্য। বাবা সত্যি হার্ট পেশেন্ট। তার ইচ্ছা পূরনের জন্যই আমিই এই নাটক টা করেছি।
— সবটাই কি নাটক ছিল? সব আবেগ গুলোও নাটক ছিল? সব অনুভূতি গুলো? তোমাকে এতো অত্যাচার করার পরেও তুমি আমাকে ছেড়ে যাও নি,, এর কারণও কি শুধু নাটক ছিল?
— হ্যাঁ। এর কারণও নাটকটাই ছিল। কারণ আমি বাবার কাছে ওয়াদা বদ্ধ ছিলাম। আপনার দেওয়া রক্ষিতা হয়ে থাকার শর্তেও বাবার মুখের দিকে তাকিয়েই রাজি হয়েছিলাম। ফুপি আম্মুর ছবি বুকে নিয়ে প্রতি রাতে বাবাকে কাঁদতে দেখেই নিজের সম্মাণ বাজি রেখে আপনার কাছে ছিলাম। আপনার শত অপমান-টর্চার সহ্য করেছি।
— মানছি সব নাটক ছিল। কিন্তু এতোদিনে কি একবারও আমার প্রতি দুর্বল হও নি? ভালোবাসতে পারো নি আমায়?
— হাহ আপনি বলছেন ভালোবাসার কথা! আপনার মতো একটা অমানুষকে কেউ কিভাবে ভালোবাসবে! সেদিন রাতে আমাকে চড় মেরে রক্তাত্ব করে অন্ধকার ঘরে আটকে দিয়ে ছিলেন। আপনি জানেন আমার ক্লাসট্রোফোবিয়া আছে। আমার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারতো। ভাগ্যিস শুধু অজ্ঞান হয়েছিলাম। কিন্তু আপনি এই কাজ কেনো করেছিলেন,, আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যই তো তাই না। লুক আপনি সাকসেসফুল। আমি কষ্ট পেয়েছি। আপনার প্রতি আমার যেটুকু দুর্বলতা ছিল সেটা সেদিনের পর থেকে শেষ হয়ে গেছে। নাও আই হেইট ইউ। আর এজন্য এই লুকোচুরি খেলার ইতি টেনেছি অন্তি আর সিদরাতের পালিয়ে বিয়ে করার নাটক করে। সিদরাত আর অন্তির কোনো সম্পর্ক নেই। সিদরাতের বাগ্দত্তা আমি। আমার আর সিদরাতের বিয়ে হবে কিছুদিনের মধ্যে।
— মীরা বিশ্বাস করো সেদিন আমি তোমার কাছে আমার আগের সব কাজের জন্য ক্ষমা চেয়ে প্রপোজ করতে এসেছিলাম। কিন্তু ঘরের ভিতর ওই ছেলেটাকে আর তোমাকে ওই অবস্থায় দেখে রাগ কন্ট্রোল করতে পারি নি।
— আই ডোন্ট ট্রাষ্ট ইউ। আর এমনিতেও আমার আর সিদরাতের বিয়ে ফাইনাল। তাই এসব বলে কোনো লাভ নেই।
— আই ডোন্ট কেয়ার মীরা তোমার বিয়ে কার সাথে ঠিক হয়েছে। আমি শুধু এটুকুই জানি কবুল তুমি আমার সাথেই পড়বে। মীরা শুধু অর্ণবের। #তোমাতেই_আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি। এখন তোমাকে হারিয়ে বাঁচবো কিভাবে!!
— উফফ আপনার এসব কথা আমি সহ্য করতে পারছি না। আপনি প্লিজ যান এখান থেকে।
মীরা একটু দূরে সরে যেতেই অর্ণব মীরার চুলের মুঠি টেনে ধরে পিছন থেকে টেনে নিজের কাছ আনে। রাগে অর্ণবের চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। কিছুদিন আগের অর্ণব হলে এতোক্ষণে হয়তো ভয়ংকর কিছু করে ফেলতো। দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে অর্ণব বলে,
— অর্ণব চৌধুরী যা চায় তা পেয়েই স্বস্তির নিশ্বাস নেয়। আর তুমি তো আমার ভালোবাসা। তোমাকে এতো সহজে কিভাবে অন্যকারো হতে দেই বলো। তোমাকে আমার করে পেতে যদি দুনিয়া উল্টে ফেলতে হয় সেটাই করবো।
— আহ ছাড়ুন আমাকে। এই আপনার ভালোবাসার নমুনা! আপনি আবারও আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন।
— আমার ভালোবাসার আদরে তোমাকে মুড়িয়ে নেবো, কিন্তু তার আগে যে আমার জিদের আগুনে নিজেকে ঝলসাতে হবে তোমার।
— আপনি একটা সাইকো!
— এতোদিন পরে বুঝতে পারলে!
অর্ণব আমার গালে গলায় নাক ঘসছে। অর্ণবের স্পর্শে বারবার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে আমার। উনার গরম নিশ্বাস শরীরে পরায় কেমন একটা শিহরণ কাজ করছে। সবকিছু কেমন ঘোরের মতো লাগছে। উনার শরীরের ঘ্রাণটাও কেমন মাদকতায় ভরিয়ে তুলছে চারপাশ। সবচেয়ে বেশি পাগল করছে উনার নেশা জরানো কন্ঠ।
— তুমি আমার জীবনে এক নতুন সূর্যোদয়ের মতো এসেছো মীরা। আমার সব অন্ধকার ধুয়ে মুছে দিয়েছো। #তোমাতেই_আমি জীবনের সব রং খুঁজে পেয়েছি। জানি না তোমার সেই ভয়ার্ত মুখটায় কি ছিল,, প্রথম দিন দেখেই তোমার দিকে ঝুঁকে পরেছিলাম। জানি না তোমার সব আবেগী আবদার কেনো তোমার কথা ভাবতে জোর করতো। তোমার বাচ্চামোগুলো আমার মনে সুখের সঞ্চার করে। তোমার মাঝে হারিয়ে আমি আমাকে খুঁজে পেতে চাই। এতো বছরের কষ্টের ঔষধ হিসেবে আমার তোমাকে চাই। তোমাকে ভালোবাসি, আজীবন তোমাকে ভালোবাসতে চাই। তোমার মাধ্যমে আমি ভালো থাকতে চাই।
অর্ণব এতোক্ষণ মীরার ঘারে মুখ ঠেকিয়েই কথা গুলো বলছিল। মুখ তুলতেই সে দেখলো মীরা চোখ বন্ধ করে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে দাড়িয়ে আছে। হয়তো নিজেকে কন্ট্রোল করছে অর্ণবের দিকে ঝুঁকে পরার থেকে। মীরার অবস্থা বুঝতে পেরে অর্ণব একটা মুচকি হাসি দিয়ে মীরার ঠোঁট জোরা নিজের ঠোঁট দিয়ে দখল করে নেয়।
চোখমুখ খিচে ধরে রেখেছিলাম তখন অর্ণব আমার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট বসিয়ে দিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি পুরোই বেকুব বনে গেছি। এটা কি হলো হঠাত। এই বদ লোকটা এটা কি করলো। নিজেকে অর্ণবের বাহুডোর থেকে ছুটানোর জন্য ধস্তাধস্তি করছি কিন্তু তার শক্তির সাথে পেরে উঠছি না। যতোই ছুটার চেষ্টা করছি উনি আমাকে আরও শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিচ্ছেন। ক্রমশ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছি আমি। অর্ণবের মধ্যে কি এমন মাদকতা আছে যা আমাকে তার দিকে এভাবে টানছে। এভাবে তার আসক্ত হওয়া আমার ঠিক হচ্ছে না। আমি অন্য কারো হবু বউ!! নিজের ভুল টা বুঝতে সময় লেগেছে আমার। আমি কিছুতেই অর্ণবের ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিতে পারবো না। সিদরাতকে ধোঁকা দিতে পারবো না। অর্ণবের হাতের বাঁধন একটু আলগা হতেই তাকে ধাক্কা দিয়ে নিজের কাছে থেকে সরিয়ে দিলাম।
অর্ণব প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। হয়তো জানতে চায় এভাবে কেনো সরিয়ে দিলাম। কেনো যেনো আমার চোখের পানি বাঁধ মানছে না। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এভাবে কান্না পাওয়ার কারণ কি আমি বুঝতে পারছি না কিন্তু আমার বুক ফেঁটে যাচ্ছে কষ্টে।
— কি মনে করেন নিজেকে আপনি? কে অধিকার দিয়েছে আপনাকে আমার এতোটা কাছে আসার? আপনি বোঝেন না আপনার আমার এতো কাছে আসা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়? আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না আপনি আমার এতো কাছে এলে। কেনো আপনি বুঝতে চান না। আপনার সাথে আপনার বাড়িতে ছিলাম বলে আপনি যা খুশি করেছেন। কিন্তু এখন আমি আমার বাড়িতে। এখন আর আমি আপনার কেনা গোলাম নই। আপনার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে আমাকে ইউজ করতে পারবেন না আপনি। আমি চাইলে এখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে আপনাকে কিনতে পারি এতো টাকা আছে আমার। তাই আমাকে দুর্বল মনে করার ভুল করবেন না।
— তুমি দুর্বল মীরা। আমার প্রতি দুর্বল। তুমি আমাকে ভালোবাসো।
— না আমি আপনাকে ভালোবাসি না।
— সব কথা মুখে বলতে হয় না মীরা। তোমার চোখের পানি বলে দিচ্ছে তুমি আমাকে ভালোবাসো।
— না না আমি তোমাকে ভালোবাসি না। আমি কাউকে ভালোবাসি না। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। আমি অন্য কারো হবু স্ত্রী। আমার ভালোবাসার কোনো অধিকার নেই। কোনো অধিকার নেই। (কান্নায় ভেঙে পরে)
অর্ণব কিছুক্ষণ মীরার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে একটু ম্লান হাসে। সে জানে মীরা তাকে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু নিজেকে বেঁধে রেখেছে অর্ণবের কাছে থেকে। হয়তো সিদরাতের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়াতেই এমন করছে। ঠকাতে চাচ্ছে না সিদরাত কে। কষ্ট দিতে চায় না তার বাবাকে। কিন্তু অর্ণব এতো সহজে হেরে যাবে না। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে যাবে সে। অর্ণব মীরার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে মীরা উঠে এসে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়।
আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি অর্ণব। সত্যি ভালোবেসে ফেলেছি। কিভাবে নিজেকে সামলাতাম বলুন! আমার জীবনের প্রথম পুরুষ আপনি যে আমার এতোটা কাছে এসেছেন। আপনার নিশ্বাসের শব্দও আমার কাছে পরিচিত এখন। ইচ্ছে করে আপনার মাঝে নিজেকে বিলীন করে নেই। কিন্তু আমি কিভাবে বলবো আপনাকে ভালোবাসি! এতোগুলো বছর ধরে বাবা কষ্ট পেয়েছে ফুপি আম্মুর পালিয়ে বিয়ে করার জন্য। এখন যদি আমিও সিদরাতের সাথে বিয়ে ভেঙে আমার পছন্দকে প্রাধান্য দেই তাহলে বাবা সেই কষ্টটা আবারও পাবেন। আমি কি করবো বলুন! বাবার খুশির সামনে আমার ভালোবাসা তো আমাকে বিসর্জন দিতেই হবে!!
চলবে..