#তোমাতেই_আমি
#পর্ব_০৭
#Tabassum_Kotha
হসপিটালে মীরার হাত ধরে বসে আছে অর্ণব। অন্ধকারে একা থাকায় ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল মীরা। ডাক্তার চেকআপ করে মেডিসিন দিয়ে দিয়েছে। অর্ণব ধীরে ধীরে মীরার চুলে বিলি কেটে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তার দুচোখের কোনায় পানি টলমল করছে। এই পানির মধ্যে অপরাধবোধ আর মীরাকে ফিরে পাওয়ার সুখ মেশানো আছে। অতীতের ক্ষত টা ভুলা সম্ভব নয় তার জন্য কিন্তু নতুন ভাবে সব শুরু করতে চায় সে।
🍁
চোখ মেলতেই নিজেকে হসপিটালে আবিষ্কার করতেই খানিকটা অবাক হলাম। তবে জানতাম এমন কিছু একটা হবে। একা অন্ধকার আবদ্ধ ঘরে ভীষণ ভয় করে আমার। এর আগেও একবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। তারপর থেকে অবশ্য যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করে চলি। মাথাটা একটু উঁচু করতেই দেখলাম অর্ণব আমার মাথার কাছে বসে আছেন। অর্ণব আমার হাত তার হাতের ভিতরে নিয়ে বসে আছেন। এই মুহূর্তে নিজের হাত তার হাতের মুঠোয় দেখে কোনো অনুভূতি আসছে না। উল্টো একরাশ ঘৃণা এসে ভর করছে মনে। তার মতো একটা অমানুষকে নিজের কাছে কিছুতেই মানতে পারছি না আমি। ডাক্তার এসে আমাকে দেখে গেলেন। অর্ণবকে দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু বলতে চায় আমাকে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার কোনো কথা শুনার ইচ্ছা আমার হচ্ছে না।
.
.
.
.
আমার অবস্থা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এলে অর্ণব আমাকে নিয়ে বাসায় চলে এলেন। হয়তো কোনো জরুরি ফোন এসেছিল তার। তাই এতো তাড়াহুড়া করলেন। হসপিটাল বেড থেকে নামতেই অর্ণব আমাকে কোলে তুলে নিলেন। যদিও এর কোনো প্রয়োজন ছিল না, পায়ে যথেষ্ট শক্তি ছিল আমার হেটে যাওয়ার মতো। উনাকে কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে রইলাম। কেনো যেনো কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না। সারা রাস্তা উনার সাথে একটা কথাও আমি বলি নি। আসলে ইচ্ছে হয় নি বলার। হঠাৎ এতো বেশি ঘৃণা কোথা থেকে এলো তার প্রতি কে জানে! এটাকি আমার ঘৃণা, নাকি অন্য কিছু!
বাড়িতে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামার আগেই অর্ণব অপর পাশে এসে আমাকে আবারো কোলে তুলে নিলেন।
— কি করছেন নামান আমাকে। আবার কেনো কোলে তুললেন! আমি এতোটাও দুর্বল হয়ে পরি নি যে হেটে ভিতরে যেতে পারবো না।
— তোমার অনুমতি নিয়ে আমি কাজ করবো ভাবলে কি করে?
আমি আর কথা বাড়ালাম না। জানি লাভ নেই। করবে সেটাই যা তার মনে চাইবে। অর্ণব আর আমি বাড়ির ভিতর ঢুকতেই অন্তিকে দেখলাম, তার সাথে একটা ছেলেও ছিল। অন্তিকে আমি শেষ দেখেছিলাম অর্ণবের অফিসে আর তারপর আজকে। লাল বেনারসি শাড়ি পরে আছে অন্তি। দেখে মনে হচ্ছে সে নতুন বউ। অন্তিকে এই রূপে দেখে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন অর্ণব। আমাকে নামিয়ে সোফায় বসিয়ে দিয়ে তিনি অন্তির দিকে এগিয়ে গেলেন তার মনে উদয় হওয়া প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে।
— এসব কি অন্তু?
— যা দেখছো তাই সত্যি ভাইয়া!
— কি বলতে চাইছিস তুই?
— আমি আর সিদরাত পালিয়ে বিয়ে করে নিয়েছি ভাইয়া। বাবাকে এখনও বলি নি। তোমাকেই সবার আগে জানালাম।
অর্ণব অন্তির ওপর রাগ সামলাতে না পেরে স্বজোরে একটা চড় বসিয়ে দেয় অন্তির গালে। চড়টা এতোটাই জোরে ছিল যে সেই শব্দে কেঁপে উঠে মীরা। আর অন্তি ছিটকে মেঝেতে পরে যায়। এই মুহূর্তে হিংস্রতা ফুঁটে উঠেছে অর্ণবের চোখে মুখে।
— তুই এটা কিভাবে করতে পারলি অন্তু? শেষ পর্যন্ত কি না তুই সিদরাত মাহমুদকে বিয়ে করলি তাও পালিয়ে। তুই জানিস বাবা কতোটা হার্ট হবে এটা জানার পর।
— তুমি তো তাকে বাবা মানোই না ভাইয়া তাহলে আজ কেনো বাবার প্রতি তোমার এতো ভালোবাসা আসছে?
— জাষ্ট শাট আপ অন্তি ডোন্ট গিভ মি লেইম এক্সকিউজ। সিদরাত মাহমুদ আমাদের বিজনেস রাইভাল আর তুই কি না তার সাথেই ছিঃ!
— ভাইয়া সিদরাত তোমাদের শত্রু হলেও আমি ভালোবাসি তাকে।
— তুই নিজের ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে আমাদের সম্মাণ ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিস অন্তি। একটাবার ভেবে দেখ বাবা জানতে পারলে তার কি অবস্থা হবে?
অন্তি আর অর্ণবের কথার মাঝে মীরা কথা বলে উঠলো,
— আপনার বাবারও সেই একই অবস্থা হবে যা আপনার নানার হয়েছিল। কিন্তু তফাতটা হলো আপনার মা বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছিল। হাজারটা মানুষের সামনে জানা জানি হয়েছিল যে কনে বিয়ের দিন প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়েছে।
মীরার কথায় রক্তচক্ষু নিয়ে অর্ণব মীরার দিকে তাকায়। মীরা কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে শুরু করলো।
— আমি বলছি না আপনার মা খারাপ ছিল। আমি বলছি যেই পরিস্থিতিতে আজ আপনি আর আপনার বাবা আছেন একি পরিস্থিতিতে তখন আমার দাদাভাই আর বাবা ছিল। অবশ্য তাদের পরিস্থিতি টা আরো গুরতর ছিল।
অর্ণব কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো। প্রচন্ড রাগের মধ্যেও হঠাত অনেক চিন্তা এসে ভর করলো অর্ণবের মাথায়। মীরা আবার বলতে শুরু করলো,
— সেদিন ফুপি আম্মুর পালিয়ে যাওয়াতে অপমানে বোঝা সহ্য করতে না পেরে দাদাভাই হার্ট অ্যাটাক করে। আপনি নিজের বিবেক থেকে বলুন তো নিজের বাবাকে হারানোর পর আপনার মামা যেটা করেছে সেটা কি অন্যায় ছিল? হয়তো সেদিন ফুপি আম্মুকে অপমানের মাত্রা টা একটু বেশি ছিল কিন্তু মনের রাগ টা যুক্তিযুক্ত ছিল।
কিছুক্ষণ থেমে মীরা আবার বলতে শুরু করে,
— বাবাও বুঝতে পারে নি সেদিন তার বলা কথাগুলোর জন্য ফুপি আম্মু আত্মহত্যা করবে। আপনার ঘৃণার ভিত্তি আছে অর্ণব, ফুপি আম্মুর মৃত্যুর জন্য কোনো না কোনো ভাবে আমার বাবা দায়ী। কিন্তু আপনার প্রতিশোধটা ভিত্তিহীন। বিশ্বাস করুন যা হয়েছে সেটা কেউ চায় নি।
অর্ণব মীরার কথাগুলো একদন্ড ভেবে ধপ করে সোফায় বসে পরলো। সিদরাত নামের ছেলেটি এখনও মূর্তির ন্যায় দাড়িয়ে সব দেখছে। অন্তি বধু বেসে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। মীরা ল্যান্ড লাইন থেকে কাউকে ফোন করলো। অর্ণব এখনও আগের মতোই বসে আছে। তার দুচোখ গড়িয়ে পানি পরছে। এই পানি গুলোর কারণ তার জানা নেই। হয়তো উনিশ বছর আগের ভুল ধারণা টা তার ভেঙে গেছে। শিশু মনে ধারণ করা মায়ের মৃত্যুর চিত্র যেনো ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। মীরার চোখের ইশারায় অন্তি উপরের ঘরে চলে গেলো। আর সিদরাত সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো।
অর্ণবের দুচোখ বেয়ে শ্রাবণের ধারা ঝরে যাচ্ছে। যেদিন মীরার বাবা হঠাত অসুস্থ হয়ে পরে সেই হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিল তাকে। আর সেদিন মামার মুখটা দেখতেই এতো বছরের কষ্ট গুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল তার মনে। মামা যেমন তার মা কে কলঙ্কিনী উপাধি দিয়েছিল সেও একই ভাবে প্রতিশোধের নেশায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই তো মীরাকে কষ্ট দিয়ে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। কিন্তু সে তো ভেবে দেখে নি তার প্রতিশোধটা সম্পূর্ণই ভিত্তিহীন ছিল। সে তার নানা-মামার দিকটা কখনই ভেবে দেখে নি। তবে কি সেও অপরাধী! এতোগুলো বছর সে তার মায়ের মৃত্যুর জন্য তার মামাকে ঘৃণা করে এসেছে। মীরার মাধ্যমে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে। হ্যাঁ সে অন্যায় করেছে। সে অপরাধী। মীরা কি তাকে ক্ষমা করে সব ভুলে যেতে পারবে! মীরা কি তাকে আপন করে নেবে?
অর্ণবের ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে মীরা তার কাঁধে হাত রাখতেই অর্ণব আচমকা মীরার কোমড় জরিয়ে ধরে।
অর্ণবের আচমকা জরিয়ে ধরায় অনেকটা হকচিয়ে গেলাম। কাঁধে হাত রাখার উদ্দেশ্য ছিল অর্ণবকে সান্ত্বনা দেওয়া। তার ভুল ধারণা টা ভাঙা অনেক দরকার ছিল। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো আমার পেটের দিকটা ভিজে যাচ্ছে। খেয়াল করতেই দেখলাম অর্ণব কাঁদছেন। কিছুক্ষণ আগেই এই মানুষটার উপর আমার ভীষণ ঘৃণা হচ্ছিল কিন্তু তার চোখের পানিতে সব যেনো কেমন গুলিয়ে গেলো আমার। বুকের বা পাশে কেমন চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। অর্ণব কান্নার মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে। তার কম্পন যেনো আমাকে আরও বেশি অস্বস্থিতে ফেলে দিচ্ছে। ক্রমশ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি আমি। না আর এভাবে থাকা যাবে না। অর্ণবের উপর আসা এই নিষিদ্ধ আবেগকে আমি প্রশ্রয় দিতে পারবো না।যেই উদ্দেশ্যে আমি এখানে এসেছিলাম সেই উদ্দেশ্য সফলের পথে আছে। এখন আমার দুর্বল হওয়া চলবে না।
অর্ণবের কাছে থেকে নিজেকে সরিয়ে অর্ণবের কাছে বসে পরলাম আমি। কান্না করার কারণে তার চোখ দুটো ফুলে গেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মানুষটার স্কিন বেশ সেনসিটিভ। একটুতেই কেমন লাল হয়ে গেছে মুখটা। ইচ্ছে করছে লাল হওয়া গাল দুটোয় একটু ঠোঁট ছুইয়ে দেই। ছিঃ ছিঃ এসব আমি কি ভাবছি! আমি অর্ণবকে নিয়ে এসব ভাবতে পারি না। আমার সেই অধিকার নেই।
আমায় ভাবনার জগত বের করিয়ে অর্ণব বলে উঠলেন,
— অনেক ছোট ছিলাম যখন আম্মু মারা যায়। একা দরজার বাইরে দাড়িয়ে শুধু দেখেছিলাম আম্মুর ঝুলন্ত লাশ টা। আব্বু আম্মুর জন্য আর্তনাদ করছিল। কিন্তু একবার আমার কাছে এসে আমাকে বুকে জরিয়ে নেয় নি। সেই থেকে শুরু হয় আমার একা থাকার যাত্রা। আম্মু ছেড়ে চলে যাওয়ায় একা হয়ে পরি আমি। আর বাবা থাকতেও যেনো পর হয়ে যায়। মাসের পর মাস বাবার চেহারাটাও দেখতে পারতাম না। একাকিত্ব আমাকে জাঁকড়ে নেয়। মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পরি। আর এই সব কষ্টের জন্য মামাকেই দায়ী করি। তোমাকে দেখে ভেবেছিলাম তোমাকে কষ্ট দিয়ে এতো বছরের কষ্ট গুলো ধুয়ে মুছে ফেলবো। কিন্তু কতো বড় বোকা ছিলাম আমি দেখো। অন্যকে কষ্ট দিয়ে নিজের সুখ খুঁজতে গিয়েছিলাম আমি।
অর্ণবের কথাগুলো আমার বুকে তীরের মতো বিধছে। কেনো যেনো তার কষ্টগুলো আমাকেও কাঁদাচ্ছে। সত্যি চোখ দিয়ে পানি পরছে। আচ্ছা এসবের কারণ কি? অর্ণবের কষ্টে আমার কষ্ট কেনো হচ্ছে!!
চলবে..