#প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-৫)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
অভীকের সাথে তাহিয়ার দেখা হলো বিয়ের দিন পাঁচেক বাদে। এ ক’টা দিন শামুকের ভেতর লুকানো মুক্তোর মতো, নিজেকে অভীকের থেকে আড়াল করে রেখেছে সে। অভীকের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে কলেজ অবধি যায় নি।
মেয়ের বিয়ের পর মাহমুদা নিশ্চিন্তমনে সার্জারি জন্য ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন । সার্জারির আগে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। কাল একটা পরীক্ষা করতে হয়েছে, আজ আরেকটা পরীক্ষা করতে হবে। মাহমুদার শরীরে অসুস্থতা ঝেকে বসায় তাকে একা ছাড়েনি তাহিয়া। নিজে সাথে গিয়েছে। মাকে তৈরি করে নিজেও তৈরি হয়ে নিল সে। কলিংবেলটা বেজে উঠল তখনই। দরজা খুলে দেখল, নীলিমা এসেছেন। তাহিয়াকে দেখে বিস্তৃত হাসলেন। তাহিয়া চঞ্চল গলায় বলল,
‘কেমন আছো আন্টি?’
নীলিমা ভেতরে ঢুকে পুত্রবধূকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
‘ বিয়ের পর একটা কল ও দিলি না। এখন সামনে পেয়ে খবর নিচ্ছিস?’ অভিমান জড়ানো ছিল নীলিমার স্বরে। তাহিয়া হেসে বলল,
‘এবার থেকে নিব। ‘
দরজা লাগিয়ে মাহমুদার ঘরে গেল দুজন। বান্ধবীকে দেখে চমকালেন মাহমুদা,
‘তুই হঠাৎ! আসার কথা বললি না যে?’
‘তোর বাসায় আসার আগে অনুমতি পত্র লাগবে না কি!’
রগড় করে বললেন নীলিমা। মাহমুদা হেসে বললেন,
‘আগে এক কথা ছিল, এখন বেয়ান হয়ে গিয়েছিস। তা, একা এসেছিস?’
‘ অভীক এসেছে সাথে।’
বান্ধবীর পাশে বসে বললেন নীলিমা। মাহমুদা দরজার দিকে চোখ ফেলে প্রশ্ন করলেন,
‘অভীক কোথায়, আসেনি?’
‘না, নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে বলল তোকে নিয়ে নামতে। একসাথে হাসপাতালে যাবে।’
কথাটা বলে আড়চোখে তাকালেন তাহিয়ার দিকে। ছেলে যে তাহিয়ার অস্বস্তির জন্য আসছে না তা নীলিমার অজানা নয়। এদিকে, নীলিমার কথায় তাহিয়া আঁতকে উঠল, স্যার যাবে তাদের সাথে! স্যার গেলে তো স্যারের সাথে তার দেখা হবে! আল্লাহ, এবার কী হবে? এত দিনের লুকোচুরি খেলা ভেস্তে গেল!
তাহিয়ার চিন্তিত চেহারায় অস্বস্তির মাত্রা ঢেলে পরবর্তী কথা বললেন মাহমুদা,
‘ বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি প্রথম এলো অভীক। তাও কি না বাসায় না এসে চলে যাবে? এটা কেমন কথা! তাহিয়া? যা তো, নিচে গিয়ে অভীককে ডেকে নিয়ে আয়।’
তাহিয়া ভড়কাল। আগে একটা সম্পর্ক ছিল, এখন তাদের মাঝে নতুন একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। মনের শত অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হয়, অভীক তার স্বামী। ‘অভীক’ নামটার মাঝেই হাজার ভয়, অস্বস্তির বাস। এখন লজ্জা ও যোগ হয়েছে। সব ঠেলে অভীকের মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছে বা সাহস কোনটাই তাহিয়ার নেই। তাই যথাসম্ভব নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। দিন পাঁচেক এ ভাবনা মোতাবেক চলছে, আজই কেন ভাবনার গুটি বদলে গেল! তাহিয়া দ্বিরুক্তি করতে চাইল। মেয়ের মনের ভাব বুঝে মাহমুহা কড়া স্বরে বললেন,
‘ ছেলেটা নিচে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছে, স্ত্রী হিসেবে তোর দায়িত্ব ওকে বাসায় এনে, চা নাস্তা করানো। শুধু বিয়ে করলেই তো হবে না, নিজের দায়-দায়িত্ব ও পালন করতে হবে। যা, ডেকে নিয়ে আয়! কোন হেরফের চাচ্ছি না আমি। যা।’
মাহমুদার স্বরটা দৃঢ় হলে কপালে চিন্তার সরু ভাজ স্পষ্ট দেখতে পেল তাহিয়া। মাকে পরখ করেই আর দ্বিরুক্তি করল না, অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাসা থেকে বের হলো। চার তলার সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে দোয়া করল,
‘আল্লাহ, একটু সাহস দাও। নার্ভাসনেস কমিয়ে দাও, স্যারের সামনে গেলে স্বাভাবিক রেখো। কাঁপা-কাঁপি ঘামাঘামি থেকে রক্ষা কোরো। ‘
এ যাত্রায় তাহিয়ার দোয়া কবুল হলো না বোধহয়। নিচে যেতেই গেটের কাছে হালকা নীল ফুলওভার- কালো প্যান্ট পরিহিত অভীককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে
কাঁপা-কাঁপি, ঘামাঘামি, বাকরুদ্ধ, শ্বাসকষ্ট সব শুরু হলো। দুরুদুরু বুকে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তার দিকে পিঠ করে অভীক ফোনে কথা বলছে। তাহিয়া তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টায় কিছু বলতে চাইল, বাকরুদ্ধতার কারণে স্বর বেরুলো না। দৃষ্টি নত রেখে হাত কচলাতে লাগল। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পিছু ঘুরল অভীক। তাহিয়াকে দেখে ভ্রু কুঁচকাল। অপ্রত্যাশিত চেহারা দেখে খানিকটা অবাকের সাথে বলল,
‘তুমি!’
অভীক তাহিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। লজ্জার সাগরে ডুবে মরার উপক্রম তাহিয়ার। মুখ দিয়ে উত্তর না দিয়ে মাথা নাড়ল কেবল, নিশ্চিত করল সে। অভীক ফোন কেটে বলল,
‘কিছু বলবে?’
এবারও মাথা নাড়িয়ে ইতিবাচক সায় জানাল তাহিয়া।
‘বলো।’ অভীকের কোমল স্বর শোনা গেল। উত্তরে ভয়, অস্বস্তিতে কথা গুলিয়ে তাহিয়া বলল,
‘আসসালামু আলাইকুম স্যার।’
অনেকটা জড়ানো শুনাল তাহিয়ার কথা। অভীক পকেটে হাত গুজে ভ্রু নাড়িয়ে খানিকটা টেনে বলল,
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। তুমি সালাম দিতে নিচে নেমে এসেছো?’
শেষ প্রশ্নটা রগড় মেশানো ছিল, না তাকিয়ে ও স্পষ্ট টের পেল তাহিয়া। হাত মোচড়ামুচড়ি করতে করতে ভীত সন্ত্রস্ত স্বরে বলল,
‘মা বাসায় যেতে বলেছে?’
এতক্ষণে তাহিয়ার আগমনের কারণ ধরতে পারল সে। তাহিয়ার নিচে আসার পেছনে যে তার মা এবং শ্বাশুড়ির হাত আছে, তাও আন্দাজ করতে সময় লাগল না তার। সে তাহিয়ার অস্থিরমাখা চেহারার দিকে তাকিয়ে ধীর স্বরে বলল,
‘আমি বাসায় গেলে আবার মায়ের মেয়ে ভয়, নার্ভাসে জ্ঞান হারাবে না তো? ব্যাপারটা সুনিশ্চিত হওয়া ছাড়া বাসায় যাওয়া অনুচিত হবে বোধহয়।’
তাহিয়ার বলতে ইচ্ছে করল, ‘আপনি প্লিজ আসবেন না! আমি আশেপাশে থাকলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে, ভয়ে হাটু কাঁপে। মনে হয়, এই বুঝি প্রাণ ভোমরা উড়ে গেল। আমাকে এসব কষ্ট থেকে রেহাই দিতে হলেও আপনার না আসা উচিত।’ কিন্তু মনের ভাব মুখ অবধি আনতে পারল না। অভীককে না নিয়ে একা বাসায় গেলে মা কষ্ট পাবেন, এই মুহুর্তে মাকে কষ্ট দেয়ার বিন্দুমাত্র উদ্দেশ্য তার নেই। অনেকটা মায়ের জন্য ও তাকে নেতিবাচক মাথা নাড়াতে হলো।
‘আর ইউ শিওর? তোমার অবস্থা দেখে কিন্তু অন্য কিছু মনে হচ্ছে। তোমার অস্বস্তি বাড়াতে চাচ্ছি না আমি। তুমি বরং বাসায় চলে যাও, আন্টিকে কিছু একটা বুঝিয়ে দিব আমি। ‘ অর্ধাঙ্গিনীকে সহজ করতে বলল অভীক। কিন্তু অর্ধাঙ্গিনী তো সহজ হওয়ার নয়। সে জড় স্বরে বলল,
‘আপনি না গেলে মা কষ্ট পাবেন।’
অভীক ফিরতি বলল,
‘একটু সহজ হওয়ার চেষ্টা করো। তোমার অস্বস্তিবোধ দেখে আমার অস্বস্তি হচ্ছে। তুমি আমাকে যতটা ভয় পাচ্ছো, আমি ওতটাও ভয়ানক নই। তোমার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপে যে কোন সময় তুমি জ্ঞান হারাবে। তখন তোমার অবস্থার ইফেক্ট পড়বে আন্টির উপর। এই মুহুর্তে উনি বাড়তি চাপ নিলে খারাপ কিছু হতে পারে। তাই বলছি, বাসায় চলে যাও। আন্টিকে কল দিয়ে বলে দিচ্ছি আমি। ‘
অভীক ভেবেছে এরপর তাহিয়া চলে যাবে। কিন্তু গেল না, ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। অভীক সবে ফোন বের করে কল দিতে নিয়েছে। তাহিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকাল,
‘ দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
‘ মা কষ্ট পাবেন, আসুন।’ মিনমিনে স্বরে ছোটো করে উত্তর দিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়াল তাহিয়া। অভীক খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পেছু নিল তার।
দুজন উপরে উঠছিল। তাহিয়া আগে হাটছে, অভীক তার থেকে কয়েক সিড়ি পিছনে। আকস্মিক অভীক জিজ্ঞেস করল,
‘কলেজ যাচ্ছো না কেন? ‘
তাহিয়া থেমে গেল ঠিকই, কিন্তু উত্তর দিল না। অভীক ধীর স্বরে বলল,
‘ফার্স্ট ইয়ারের নবীন বরণ অনুষ্ঠান, দিন চারেক বাদে। একক নৃত্য, আর র্যাম্প ওয়াকে তোমার নাম দেখলাম। রিহার্সাল শুরু হয়ে গেছে। কাল থেকে গিয়ে জয়েন করবে। ঠিক আছে?’
অভীকের কথা অবাক হলো তাহিয়া। নবীন বরণ অনুষ্ঠানে সে তো নাম দেয় নি, তবে কে দিল? নিশ্চয়ই মীরা দিয়েছে। গতবার অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশের পর মীরা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলল, ‘তুই তো চমৎকার ডান্স করিস! পরের বছর ও দিবি কিন্তু!’ মীরার প্রতি রাগ হলো তাহিয়ার। আগ বাড়িয়ে নাম দেয়ার কী দরকার ছিল, এখন স্যারের সামনে পারফরম্যান্স করবে কিভাবে! ভুলবাল স্টেপ দিয়ে সবার হাসির পাত্র হবে নিশ্চিত! মীরার উপর যখন ইচ্ছেমাফিক রাগ ঝাড়ছিল তখন অভীকের স্বর কানে এলো,
‘ নবীন বরণের আয়োজন কমিটির একজন সদস্য আমি। সেদিন অনেক কাজ থাকবে আমার, তোমার পারফরম্যান্স দেখার সুযোগ হবে না। সো, বি ইজি! নিজের মতো উপভোগ করো।’
অভীক তার ভাব ধরতে পারায় লজ্জা পেল তাহিয়া। তবে স্বস্তি ও পেল। স্যার না থাকলে নিশ্চিন্ত, নির্দ্বিধায় পারফরম্যান্স করতে পারবে। যাক, এমনটা হলে ভালোই! চোয়ালে কৃতজ্ঞতা মাখিয়ে, মাথা নাড়াল তাহিয়া।
বাকি পথ কথা হলো না। বাসায় পৌঁছাতেই তাহিয়া এক প্রকার ছুটে পালাল। রুমে গিয়েই দরজা বন্ধ করে হাফ ছাড়ল। অভীক ঠোঁট চেপে হাসল কেবল।
★
রুমে প্রবেশ করার মিনিট দশেক বাদেই মাহমুদা ডাকলেন তাহিয়াকে। অভীকের জন্য নাস্তা তৈরিতে রিনাকে সাহায্য করতে রান্নাঘরে পাঠালেন মেয়েকে। কাজের মেয়ে রিনা রান্নাঘরে চিকেন পাকোড়া বানাতে ব্যস্ত। তাহিয়াকে দেখেই এক গাল হেসে রিনা বলল,
‘ আপা, দুলাভাই কিন্তু দেখতে একবারে বাংলা ছবির নায়কের মতো। দুলাভাইরে দেইখ্যা আমার দিলের বাত্তি জোইল্যা উঠছে।’
রিনার কথায় তাহিয়া মুখ বাঁকাল। বিরুক্তিভরা স্বরে বলল,
‘দুলাভাইয়ের একটা ধমক খেলে, দিলের বাত্তি চিরতরে ফিউজ হয়ে যাবে। সেই সাথে ‘দিল’ এলাকার বিদ্যুৎ ও বিচ্ছিন্ন হবে। বাজে কথা বাদ দিয়ে, তাড়াতাড়ি নাস্তা বানিয়ে দে। মায়ের দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
রিনা কাজে মন দিল। পাকোড়া তেলে ছেড়ে দিয়ে আনমনে গান ধরল,
‘ দুলাভাই দুলাভাই,
ও আমার দুলাভাই, চলো না সিনেমা দেখিতে যাই। সিনেমার নাম না কি তোমাকে চাই দুলাভাই। ‘ এ অবধি গেয়ে থামল। তাহিয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
‘আপা, দুলাভাইরে দেইখ্যা এই গানডাই মনে আইতাছে। আইচ্ছা, দুলাভাই কি আমারে সিনেমা দেখাইতে লোইয়্যা যাইব?’
রিনা বাংলা ছায়াছবির অন্ধ ভক্ত। ভাত ছাড়তে পারবে, কিন্তু ছবি দেখা ছাড়তে পারবে না। দুপুরে ভাত খাওয়ার পর বসার ঘরটাকে সিনেমা হল বানিয়ে দেয়। বাংলাদেশের প্রায় সব ছবি তার দেখা, সংলাপ গুলো তার মুখস্থ। ছবি দেখে সংলাপগুলো প্রয়োগ করে তাহিয়াদের উপর। এ নিয়ে মাহমুদা হারহামেশাই বকাবকি করেন তাকে। তুহিনকে বলতে গেলে রেগে কটা কথা শুনিয়ে দেয়। দুজনের মাঝে বনিবনা নেই তেমন একটা।
তাহিয়ার মাথায় আকস্মিক একটা বুদ্ধি এলো। পরিকল্পনা মাফিক কাজ হলে অভীকের মুখভঙ্গি কেমন হবে ভাবতেই তাহিয়া হেসে উঠল। ঠোঁট চেপে হাসি আটকে বলল,
‘ তুই বসার ঘরে গিয়ে বলবি, দুলাভাই আপনারে একবারে বাংলা ছবির ‘কাবিলা’র মতো লাগে দেখতে। তারপর একটু আগে যে গানটা গেয়েছিলি, ওই গানটা গাইবি। তারপর উনাকে জিজ্ঞেস করবি, আমারে সিনেমা দেখিতে নিয়ে যাবে, দুলাভাই? আমার বিশ্বাস উনি, ‘না’ করবে না।’
গ্রামের সহজসরল ষোড়শী কন্যা রিনা, তাহিয়ার কথা সহজেই বিশ্বাস করে নিল। উৎফুল্লতার সাথে মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘আইচ্ছা। আমার মেলা দিনের শক, হলে বইস্যা সাকিব খানের সিনেমা দেখুম। এইবার পূরণ হইব তাইলে।’
তাহিয়া হাসি আটকে বিড়বিড়াল, ‘ হলে নয়, স্যার তোকে মর্গে পাঠাবে।’
নাস্তা বানানো প্রায় শেষ। চা বানিয়ে ট্রেতে সাজিয়ে দিল রিনা। তাহিয়া ট্রে হাতে নিয়ে বলল,
‘আমি যাওয়ার ঠিক পাঁচ মিনিট পর আসবি। ঠিক আছে?’
রিনা সায় জানাল। তাহিয়া নাস্তাভরতি ট্রে হাতে ধীর পায়ে ড্রয়িংরুমের দরজায় এসে দাঁড়াল তাহিয়া। এতক্ষণ অবধি রিনার কথায় মনটা উৎফুল্ল থাকলেও, পর্দার ফাঁকে ভেতরে সোফায় বসা অভীককে দেখে উৎফুল্লতা উবে গেল। লজ্জা, দ্বিধা, অস্বস্তি, ভয় এসে হানা দিল। হৃদপিন্ডের ধুকপুকানির বেড়ে গেল। সব মাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করল তাহিয়া। ধীর পায়ে এগুলো সেন্টার টেবিলের দিকে। হাত কাঁপছে, কাঁপছে ট্রে, ট্রেতে থাকা কাপ পিরিচ, কাপে থাকা চা। কাঁপা হাতে ট্রে সেন্টার টেবিলে রাখল। রান্নাঘরে পাঠানোর আগে মাহমুদা বলেছিলেন,
‘নাস্তা দিয়ে সাথে সাথে চলে আসবি না। অভীকের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিবি। তারপর ওখানে বসে, ওর খাওয়া শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করবি।’
মায়ের নির্দেশ মোতাবেক একটা চায়ের কাপ তুলে অভীকের দিকে বাড়িয়ে দিল।
অভীক ফোন দেখছিল, সামনে চায়ের কাপ দেখে ফোন রেখে তাহিয়ার দিকে তাকাল। ভীত-সঙ্কোচ মাখা তাহিয়ার চেহারা পরখ করে নজর সরাল। তাকাল কাঁপুনি দিয়ে ওঠা হাতে, তারপর নড়তে থাকা চায়ের কাপে। সবটা পরখ করে চায়ের কাপ হাতে নিল অভীক। কোন রা করল না। নতমস্তকে মেঝেতে চোখ রেখে পাকোড়ার প্লেট বাড়িয়ে দিল তাহিয়া। অভীক শান্ত স্বরে বলল,
‘আমি চায়ে চুবিয়ে পাকোড়া খাই না।’
তাহিয়া চোখ মুখ খিচে ফেলল। চায়ের পরে বিস্কুটের প্লেট দেয়ার কথা। সব গুলিয়ে ফেলছে সে। হুলস্থুল হয়ে পাকোড়ার প্লেট রেখে বিস্কুটের পিরিচ হাতে নিল। হাতটা তখনো কাঁপছে ঠকঠক করে। অভীক ভ্রু কুঁচকাল, এত নার্ভাস কেন মেয়েটা! সে বলল,
‘ তোমার হাবভাবে মনে হচ্ছে, আমি চা নয়, তোমাকে খেতে যাচ্ছি!’
কথাটা বলেই থতমত খেল অভীক। কথাটা অন্য ট্র্যাকে চলে গেছে। জড়তা কমানোর বদলে তাহিয়ার জড়তার মাত্রা বেড়ে গেল।
অভীকের কথায় তাহিয়ার হকচকিয়ে গেল। বেখেয়ালে হাত থেকে বিস্কুটের প্লেট পড়ে গেল। মনে মনে কয়েকটা কথা শুনাল অভীককে। লোকটা কী বদ!
তাহিয়ার ভাবভঙ্গি দেখে অভীক কেশে উঠল। নড়েচড়ে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিল। তাহিয়া অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়াল। এমতাবস্থায় বসার ঘরে প্রবেশ করল রিনা। অভীকে দেখে প্রসন্ন হেসে বলল,
‘দুলাভাই, ভালা আছেন?’
অভীক ধীর স্বরে বলল, ‘আছি। ‘
রিনা নিজ থেকেই বলল, ‘দুলাভাই আপনাকে একবারে বাংলা ছবির কাবিলার মতো লাগে। একবারে দিলে বাত্তি জ্বইল্যা উঠে’
কোন এক টং দোকানে বসে চা চুমুক দেয়ার ফাঁকে কাবিলার ছবি দেখেছিল অভীক, তাও কৈশোরে। বেশভূষায় উদ্ভট , আচার ব্যবহার আর চেহারাটাও অদ্ভুত ধরণের। অভিনয় সব নেতিবাচক। খুন খারাবি, রেইপ, সব করে। এমন একজনের সাথে মেয়েটা কিভাবে তাকে মিলাল! তারপর আবার কী সব মন্তব্য করছে। মেয়েটা আদৌ জানে সে কী বলছে? প্রশ্নবোধক চাহনি তাকাল অভীক।
তাহিয়ার ইশারায় রিনা নিচে ভেঙে পড়া বিস্কুট আর পিরিচ কুড়ে নিচ্ছে। আকস্মিক গেয়ে উঠল,
‘দুলাভাই দুলাভাই,
ও আমার দুলাভাই, চলো না সিনেমা দেখিতে যাই। সিনেমার নাম না কি তোমাকে চাই দুলাভাই।’ এ টুকু গেয়ে অভীকের দিয়ে তাকিয়ে বলল,
‘দুলাভাই আমারে সিনেমা দেখিতে নিয়া যাইবা?’
চায়ে চুমুক দিচ্ছিল অভীক। আকস্মিক রিনার কথায় বিষম খেল। মুখে নেয়া চা নাকে মুখে উঠে একাকার। বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে হাঁসফাঁস করে উঠল অভীক। চোয়াল শক্ত হলো তার, ইচ্ছে করল তার বিখ্যাত ‘ধমক’ উপহার দিতে। নেহাৎ শ্বশুর বাসায় এসেছে বলে ইচ্ছেদের দমিয়ে রাখল, নয়তো তার ধমকে এতক্ষণ বসার ঘরের দেয়ালে কম্পন ধরতো এতক্ষণে।
তার দিকে পানি বাড়িয়ে দিয়ে রিনা বলল,
‘ আমার বহুদিনের শখ, হলে গিয়া ছবি দেখমু। আমারে ‘তোমাকে চাই দুলাভাই’ ছবিখানা দেখাইতে নিয়া যাইবেন, দুলাভাই?’
অভীক হতভম্ব হয়ে বসে রইল। এতটা বিব্রতকর পরিস্থিতি ইতঃপূর্বে পড়েনি। সে তাহিয়ার দিকে তাকাল। তাহিয়া তার দিকে পিঠ করে বসে আছে। শরীর হেলছে, বোধহয় হাসছে। মেয়েটা মজা লুপে নিচ্ছে!
তাহিয়া মুখে হাত দিয়ে নিঃশব্দে হেসে যাচ্ছে। পেট ফেটে হাসি আসছে তার। হাসিদের আটকে রাখা দায় হয়ে পড়লে দৌড়ে বাইরে চলে গেল। বসার ঘর পেরিয়ে ডাইনিং স্পেচে আসতেই খিলখিলিয়ে হেসে দিল। তার হাসির শব্দ কানে যেতেই অভীক গম্ভীরমুখে বিড়বিড় করল,
‘ ফাযিল মেয়ে! দ্বিতীয়বার সামনে আসো শুধু। ‘
চলবে…