#প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-৭)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
শাড়ির স্তুপের মাঝে বসে আছে তাহিয়া। কপালে চিন্তার ভাজ। নবীন বরণে কোন শাড়িটা পরে যাবে, এই ব্যাপারে সন্দিহান সে। র্যাম্প ওয়াকে ‘কৃষক বউ’ থিমের জন্য শাড়ি, আলতা, কুলা সব কেনা হয়েছে। কিন্তু এর বাইরে শাড়ি নেয়া হয়নি।
ইন্ডো সংস্কৃতির পোশাকে দাপিয়ে বেড়ানো তাহিয়ার গায়ে কালেভাদ্রে শাড়ি জড়ায়। শেষবার পরেছিল বছর খানেক আগে, তাও কলেজের নবীন বরণ উপলক্ষে। বারো হাতের শাড়িটা তাহিয়ার চঞ্চল চলাফেরায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় বলে শখ করে পরা হয় না।
ওর একটা বদ অভ্যাস হলো, যে কোন কাজ সময় থাকতে করবে না, শেষ সময়ে এসে হুলস্থুল কান্ড বাধাবে। এবার ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। হাতে কদিন সময় পেয়েও শাড়ি ঠিক করে রাখেনি। আজ অনুষ্ঠান। ঘন্টা কয়েক বাদে তৈরি হয়ে বেরুতে হবে, এখন সে শাড়ি বাছাই করতে বসেছে। মাহমুদার আলমারিতে শাড়ির সংখ্যা কম হলে ও পঞ্চাশ হবে। এর মাঝে জামদানী, তাঁত, টাঙ্গাইল, সিল্ক, কাতান সব ধরনের শাড়ি আছে। কালার গুলো ও বেশ। তাহিয়া কোনটা পরবে দ্বিধায় পড়ল।
মাহমুদার শরীর কিছুটা অসুস্থ। স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে আপাতত বাসাতেই অবস্থান করছেন। দিন দশেক বাদেই তার সার্জারি। অবস্থা কিছুটা খারাপ হওয়ায় সার্জারি দিন কয়েক আগেই ভর্তি করানোর পরামর্শ দিলেন চিকিৎসক। এটা তাহিয়াকে জানানো হয়নি। তাকে জানানো হয়েছে, সব ঠিকঠাক আছে। দশ দিন বাদেই সার্জারি করতে হবে। বর্তমানে তিনি বসার ঘরে বসে আছেন, রিনাকে সকালের নাস্তার ব্যাপারে বুঝাচ্ছেন। তাহিয়া বিছানায় বসে ডাকল,
‘মা, একটু এদিকে আসবে?’
মেয়ের ডাক পেয়ে ধীর পায়ে নিজের রুমের দিকে গেলেন। শাড়ির স্তুপ দেখে হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। তাহিয়া করুণ স্বরে বলল,
‘শাড়ি সিলেক্ট করতে পারছি না। কোনটা পরব, বলে দাও না?’
মাহমুদা দূর্বল পায়ে বিছানার এক কোণে গিয়ে বসলেন। সব শাড়িতে চোখ বুলিয়ে বললেন,
‘ওয়ারড্রবের সাইডের সিঙ্গেল ড্রয়ারে বড়ো একটা ডালা আছে। ওটা নিয়ে আয় তো! ‘
কাঠের ওয়ারড্রবটা আলমারির পাশেই। তাহিয়া বিছানা ছেড়ে ওয়ারড্রবের কাছে গেল। ড্রয়ার খুলে বড়ো সড়ো একটা ডালা চোখে পড়ল। ভ্রু কুঁচকে ঢালা হাতে নিল। বিছানার দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
‘এই ঢালা কোথা থেকে এলো মা?’
‘তোর শ্বশুর বাড়ি থেকে।’ শান্ত স্বরে উত্তর দিলেন মাহমুদা। তাহিয়া বিস্ময়মাখা চোখে তাকাল। মাহমুদা বললেন,
‘তাড়াহুড়ায় বিয়ে হওয়ায় শাড়ি গয়না দেয়া হয়নি তোকে। তাই নীলিমা এক গাদা শাড়ি, গহনা কিনে নিয়ে এসেছে কাল। তোকে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম।খুলে দেখ। ‘
মায়ের চোখে আগ্রহ দেখে দ্বিরুক্তি করল না তাহিয়া। বিছানায় বসে ডালার উপর র্যাপিং পেপার খুলল। চারটা শাড়ি আর দুটো জুয়েলারি বক্স বেরিয়ে এলো। মাহমুদা জুয়েলারি বক্স খুলে দেখলেন, ভেতরে সোনার গহনা। তাহিয়া শাড়ি উলটে পালটে দেখল, একটা লাল কাঞ্চিপুরাম, একটা লেভেন্ডার কালার জর্জেট শাড়ি, একটা হালকা গোলাপি কাতান, আরেকটা কালো জামদানী। মাহমুদা জুয়েলারি থেকে চোখ সরিয়ে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘এখান থেকে একটা শাড়ি পর। ‘
‘নবীন বরণ অনুষ্ঠানে আমি বউদের মতো এসব ভারি শাড়ি পরে যাব?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল তাহিয়া। শাড়ি নেড়েচেড়ে মাহমুদা বললেন,
‘কালো জামদানীটা পর, ওটা হালকা, সুন্দর আছে। তোকে ভালো মানাবে।’
তাহিয়ার ও মনে হলো শাড়িটা পরা যায়। দেখতে ভালোই লাগছে। সে সায় জানাল। এ পর্যায়ে মাহমুদাকে প্রাণবন্ত দেখাল। তিনি আকস্মিক চঞ্চল হয়ে উঠলেন। উৎফুল্লতার সাথে বললেন,
‘আজ শাড়িটা আমি পরিয়ে দিই?’
তাহিয়া খুশি হলো। হেসে বলল,
‘ দিবে? দাও।’
অতঃপর মাহমুদা অনন্যচিত্তে মেয়েকে শাড়ি পরিয়ে দিলেন, চুলে খোঁপা করে দিলেন। তুহিনকে পাঠালেন গাজরা আনতে। তাহিয়া এবার সাজতে বসল। মাহমুদা বিছানায় বসে বলে গেলেন, চোখে গাঢ় করে কাজল পর, কপালে টিপ পর, হাতে কালো রেশমি চুড়ি পর, গলায় এই ছোকারটা পর, ঠোঁটে ম্যাট লিপস্টিক পর। মায়ের নির্দেশ মোতাবেক সাজল তাহিয়া। আজকের দিনটা মায়ের নামে উৎসর্গ। আজ মা যাই বলবেন তাই করবে সে। তাহিয়ার সাজ শেষ হতে হতে তুহিন এলো গাজরা নিয়ে।
মাহমুদা তাহিয়ার খোঁপায় গাজরা গুজে দিলেন। সাজগোজের পর্বকে সমাপ্তি ঘোষণা করার পর মেয়ের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালেন । বিড়বিড় করে দোয়া পড়ে মেয়ের মুখে ফুঁ দিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বললেন,
‘চমৎকার লাগছে তোকে। কারো নজর না লেগে যায়!’
তাহিয়া ভ্রু কুঁচকে নিজেকে আয়নায় দেখল। এতটাও খারাপ লাগছে না। মাহমুদা নীলিমাকে ভিডিও কল দিলেন। দু’জন মিলে ফিসফিসিয়ে গোপন আলাপ সেরে নিলেন। দুই বন্ধবীর আলাপ শেষ হওয়ার পর মাহমুদা তাহিয়ার হাতে ফোন ধরিয়ে দিলেন,
‘নীলিমা কথা বলবে তোর সাথে।’
বিস্ময়ের সাথেই সালাম দিল তাহিয়া। সালামের উত্তর নিয়ে নীলিমা খুশিতে ডগমগ হয়ে বললেন,
‘তাহিয়া, ভীষণ মিষ্টি লাগছে তোকে।’
তাহিয়া লাজুক হাসল। অতঃপর কৃতজ্ঞ সুরে বলল,
‘শাড়িটা ভীষণ সুন্দর। ধন্যবাদ আন্টি। ‘
‘পছন্দ হয়েছে তোর!’
অবাক হলেন নীলিমা। আশা করেন নি বোধহয়।
তাহিয়া উৎফুল্ল হয়ে বলল,
‘ভীষণ! এত সুন্দর শাড়ি উপহার দেয়ার জন্য একটা ‘টাইট হাগ’ প্রাপ্য তোমার। দেখা হলেই ‘টাইট হাগ’ দিয়ে দিব। ‘
নীলিমা আনন্দে বিমোহিত হলেন। তৎক্ষনাৎ পরবর্তী কথাটা বললেন না। কিছুটা সময় নিয়ে বললেন,
‘ বাকি শাড়িগুলো আমি কিনলেও এই শাড়িটা অভীক কিনেছে, ওর পছন্দমাফিক। আজ কলেজে দেখা হলে যা দেয়ার ওকে দিয়ে দিস।’
মিটমিটে হেসে ফোন ছাড়লেন নীলিমা। পুত্রবধূ সাথে ছেলে সম্পর্কিত ব্যাপারে এতটা খোলাসাভাবে কথা বলা যায় না। কেমন অস্বস্তি লাগে!
ফোন কানে দিয়েই কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বসে রইল তাহিয়া। স্যার কিনেছে শাড়ি, তাও তার জন্য! এখন এই শাড়ি পরে কলেজ যাবে কিভাবে! যদি স্যারের মুখোমুখি হয়, তবে! অভীক তার দেয়া শাড়ি পরাকে যদি অন্যভাবে নেন? লজ্জায় লাল হলো তাহিয়ার দু’গাল। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘মা, এই শাড়িটায় শরীর চুলকাচ্ছে। চেঞ্জ করে নিই?’
তার মনের ভাব ধরতে পেরে মাহমুদা চোখ রাঙালেন,
‘ খুলে যেহেতু ফেলবি আমাকে দিয়ে পরালি কেন! ‘
থেমে অভিমানী সুরে বললেন,
‘যা ইচ্ছে তাই কর। আমার মতামতকে প্রাধান্য যেহেতু দিবিই না, তাহলে জিজ্ঞেস করছিস কেন? আমি বলা কে? আমার কথা কোন দাম আছে? শুধু শুধু বলে কথা খরচ করা ছাড়া কিছুই হবে না।’
মায়ের রাগ, অভিমানের মাত্রা দেখে শাড়ি খোলার সাহস হলো না তাহিয়ার। মনে মনে দোয়া করলে, অভীকের সাথে যেন দেখা না হয়। সিদ্ধান্ত নিল, পারফরম্যান্সের নিদিষ্ট সময়ের আগেই শাড়ি বদলে বাঙালি শাড়ি পরবে। আর চেঞ্জ করবে না।
অতিব শীতল স্বরে বলল, ‘তুমি আমার মা। এই মুহুর্তে তোমার কথা সবচেয়ে দামি। যাও, শাড়ি বদলাব না। এভাবেই কলেজ যাব। এবার খুশি হয়ে একটু হাসো তো দেখি!’
রাগের আভা সরে গিয়ে উৎফুল্লতা ফিরে এলো মাহমুদার মুখে। প্রসন্ন হাসলেন। ব্যাগ হাতে নিয়ে বসার ঘরে এলো তাহিয়া।
বসার ঘরের মেঝে ঝাড়ু দিচ্ছিল রিনা। তাহিয়াকে দেখেই গেয়ে উঠল,
‘ আপনারে দেইখ্যা এইবারে আমার দিলে বাত্তি জইল্যা উঠতাছে, আপা!’
তাহিয়া রেগে বলল,
‘তোর এই বাত্তির পাল্লায় পড়ে ওদিন হাসপাতালে আমার রুহের বাত্তি নিভে যেতে ধরেছিল। আর একদিন এসব কথা বলবি, তোর রেহাই নেই, রিনা!’
শাসিয়ে রিনাকে থামানো গেল না। সে রসাত্মক গলায় বলল,
‘আইজকা আপনারে একবারে পরীর লাহান লাগতাছে আপা! দুলাভাই দেখলে আইজকা কাইত হইয়্যা পইড়া যাইব। মাডিত শুইয়্যা বুকেত হাত দিয়া গান ধরবো,
পড়ে না চোখের পলক,
কী তোমার রূপে ঝলক,
দোহাই লাগে মুখটি তোমার, একটু আঁচলে ঢাকো,
আমি জ্ঞান হারাব, মরেই যাব। বাঁচাতে পারবেনা কেউ।’
গুনগুনিয়ে উঠল রিনা । চমকে গেল তাহিয়া। অভীক সত্যিই এমন করবে না কি! এই লোকটা তার দিকে তাকালেই লজ্জায় মাটিতে মিশে যায়, সেখানে সে যদি এমন কিছু বলে তবে আজ মরণ হবে বোধহয়। লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লা।
তাহিয়ার নিরবতার মাঝে তুহিন এলো বসার রুমে।
সোফায় বসে ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে বলল,
‘অভীক ভাইয়া ওর রূপে বিমোহিত হয়ে জ্ঞান হারাবে না, ওকে দেখে জ্ঞান হারাবে। যা বিশ্রী লাগছে! দেখেই ভয় লাগছে। এতটা ভয় বোধহয় ভূতের ছবি দেখেও লাগে না।’
লজ্জা সংবরণ করে চোখ রাঙাল তাহিয়া।
‘তুই একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখবি, তুই শ্বাস নিতে পারছিস না। ঘটনাস্থল পরখ করে বুঝতে পারবি, মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে আমি তোর গলা টিপে ধরেছি। সেদিন হাজার আকুতি জানালে ও আমি তোকে ছাড়ব না মনে রাখিস। ছক্কা মেরে অক্কা পাইয়ে দিব। সেই দিনটা খুব নিকটে তোর।’
‘আমি তোকে ছেড়ে দিব ভেবেছিস! ভূত হয়ে ঘাড় মটকাব তোর। তখন অভীক ভাই ‘বউ বউ’ করে কান্না করলে ও শুনব না।’ বাঁকা হেসে বলল তুহিন।
রিনা ঝাড়ু মেঝেতে ফেলে তুহিনের দিকে এক হাত বাড়িয়ে বলল,
‘না, চৌধুরী সাহেব, না! আপনি এমনটা করতে পারেন না! নদীকে সাগরের কাছ থেকে আলাদা করতে পারেন না। আপনি কি জানেন না, নদীকে ছাড়া সাগর নিঃস্ব? নদীকে ছাড়া সাগর বাঁচবে না, মরে যাবে। এমনটা করবেন না চৌধুরী সাহেব, আপনার পায়ে পড়ি।’
কান্নাভঙ্গিতে তুহিনের পায়ের কাছে ঝুকল রিনা। তড়িৎ সরে গিয়ে রাগে কিড়মিড় করে উঠল তুহিন,
‘ তাহিয়া আপুকে মারার সিদ্ধান্ত বাতিল। আমি মরে সবার আগে তোর ঘাড় মটকাব, এটা নিশ্চিত। তোর এই সস্তা ডায়লগ শুনতে শুনতে কানে পঁচে যাচ্ছে। আর একদিন শুধু তোকে দেখি বাংলা সিনেমা দেখতে, তবে দেখিস তোর একদিন কী আমার একদিন!’
তেড়ে এলো তুহিন। বিপরীতে রিনা বিস্ময়ের ভান করে বলল,
‘এটা তুমি বলতে পারলে রাজু! এই কথা বলার আগে তোমার কি একটু ও বুক কাঁপল না! এই কথা শোনার আগে আমার মরণ হলো না কেন!’
একবার রাজু, একবার চৌধুরী সাহেব, আবার কি সাগর- নদী! তুহিন মাথা চেপে চিৎকার দিল,
‘মা? এই বেয়াদবকে আমার সামনে থেকে যেতে বলো, আর কয়েক মিনিট থাকলে ও আমার হাতে খুন হয়ে যাবে। আজই বিদায় করো ওকে। অসহ্য!’
হনহন করে রেগে চলে গেল তুহিন। তাহিয়া ক্ষিপ্ত হয়ে টিভির রিমোট হাত নিয়ে বলল,
‘আজ থেকে তোর টিভি দেখা বন্ধ। রিমোট পাবি না আর। ‘
”আব হামছে হামারি জিন্দেগী মাংলেতে, হাম আপকো খুশি খুশিতে দে দেতে। পার, আব নে তো হামসে হামারা গুরুর চিনলিয়া!’
করুণ গলায় বলল রিনা। বাংলাদেশ পেরিয়ে ভারত চলে গেছে এবার! আল্লাহ রক্ষা করো। অতিষ্ঠ হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল তাহিয়া।
★
কলেজে যাওয়ার পর অডিটোরিয়াম রুমের সামনে দেখা হলো তাহিয়ার জন্য অপেক্ষারত মীরা, শৈলীর সাথে। তাহিয়াকে দেখে মীরা হেসে বলল,
‘তাহুরানী, আজ সুন্দর লাগছে তো তোকে!’
শৈলী বলল,
‘শাড়িটা সুন্দর, কোথা থেকে নিলি?’
সঠিক উত্তর দিতে পারল না তাহিয়া। কথা ঘুরিয়ে বলল,
‘অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে?’
‘হ্যাঁ, এখন আলোচনার পর্ব চলছে। ‘ উত্তর দিল মীরা।
তাহিয়া সামনের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
‘গরম লাগছে, চল ভেতরে বসি।’
তিন বান্ধবী ভেতরে গেল। অডিটোরিয়ামের ভেতরে ডুকতেই তাহিয়ার চোখ পড়ল মঞ্চের শিক্ষক সারিতে বসে থাকা অভীকের দিকে। অস্বস্তি হানা দিল তার মাঝে। অভীকের দৃষ্টি নিচের দিকে, তা পরখ করে তাহিয়া দ্রুত বেগে মাঝের দিকে খালি চেয়ারে বসে পড়ল। মীরা শৈলী গিয়ে বসল দু’পাশে। দু’জন নানান কথা বলছে। তাহিয়ার দৃষ্টি অভীকের উপর নিবদ্ধ। সাদা শার্টের উপর কালো ব্লেজার সুট পরেছে, সাথে কালো টাই। হাতে ডায়াল ঘড়ি। চুলগুলো জেল দিয়ে আচড়ানো। উপবৃত্তাকার চোয়ালে কদিনের না কাটা দাঁড়ি, হলদেটে চেহারায় গম্ভীরর্য ভাব। ইতঃপূর্বে অভীককে সেভাবে পরখ করা হয়নি। আজ অন্তর্ভেদী চোখে পরখ করে তাহিয়ার মনে হলো, লোকটা সুদর্শন।
.
শিক্ষক সারিতে বসে আছে অভীক। গভীর মনোযোগ দিয়ে বক্তব্য শুনছে অভীক। একজন ফটোগ্রাফার অনবরত ছবি তুলে যাচ্ছে, তার পাশে দাঁড়িয়ে একজন ভিডিওম্যান ক্যামরা হাতে ভিডিও করছেন চারদিক ঘুরে ঘুরে, কখনো আবার এক জায়গায় দাঁড়িয়ে জুম করে দেখাচ্ছেন। ক্যামরায় ধারণকৃত ভিডিও সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে মঞ্চের পাশে লাগানো বড়ো প্রজেক্টরে। এক পর্যায়ে ভিডিওম্যান ক্যামরা তাক করলেন মাঝের দিকে। তাহিয়া, মীরা এবং শৈলীর সাথে গল্প গুজবে মগ্ন তখন, কথা বলার ফাঁকে চাপা হাসিতে মেতে উঠতে দেখা যাচ্ছে। চারদিকের খেয়াল নেই তার। অমনোযোগী তিন তরুণীর হাস্যজ্বল মুহুর্তকে ফোকাস নিলেন লোকটা। প্রজেক্টরে ভেসে উঠল তাদের উচ্ছ্বসিত চেহারা। চারদিক চোখ বুলাতে গিয়ে প্রজেক্টরে চোখ গেল অভীকের। কালো শাড়ি পরিহিত শ্যামবতী মেয়েটা তার দৃষ্টি আটকে রাখল সেকেন্ড দুয়েক। তাহিয়া! ফাজিল মেয়েটা এসেছে তবে! চোখ সরাল সে, খানিক বাদে আবার তাকাল। মেয়েটা প্রাণবন্ত হাসছে। ফারদিন স্যার শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে উপদেশমূলক বক্তব্য রাখছেন। কত গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য! অথচ মেয়েটার এদিকে কোন মনোযোগই নেই। অভীক বিড়বিড় করল,
‘ফাজিল!’
প্রজেক্টর থেকে চোখ সরিয়ে দর্শক সারিতে তাকাল, ফাজিল মেয়েটা বসেছে কোথায়? এত মেয়ের মাঝে দৃষ্টিগোচর হলো না। অভীকের পাশে বসেছেন ডিপার্টমেন্টে হেড জাহাঙ্গীর আলম। আকস্মিক তিনি অভীকের কাছ ঘেঁষে গলা খাঁকারি দিয়ে ধীর স্বরে বললেন,
‘দর্শক সারির সামনে থেকে দশ নাম্বার লাইনে। ‘
অভীক পাশ ফিরে জানতে চাইল, ‘কী স্যার?’
স্মিত হেসে জাহাঙ্গীর সাহেব বললেন, ‘ইয়োর লেডি।’
আকস্মিক অভীক থতমত খেল। স্যার বুঝতে পারলেন কিভাবে! বিব্রত হয়ে টাইয়ের নাট নেড়ে গলা খাঁকারি দিল। জাহাঙ্গীর সাহেব মৃদুস্বরে হেসে সরে বসলেন। অভীক নড়েচড়ে বসে সামনে তাকাল। দর্শক সারিতে চোখ বুলাল আবার। স্যারের কথা মাফিক দশ নাম্বার লাইনেই দেখা মিলল। তাহিয়া তখনো খোশগল্পে মত্ত। তাকে অন্তর্ভেদী চাহনিতে পরখ করে অভীক ভ্রু কুঁচকাল। জাহাঙ্গীর সাহেবের কথা কানে বেজে ওঠল। সে বিড়বিড়াল,
‘মাই লেডি!’
আকস্মিক থেমে গেল, চমকাল সে। শব্দদুটো কেমন যেন অনুভূতির জন্মদায়ক!
*
‘এখন একক নৃত্য নিয়ে আসছে সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী তাহিয়া তারান্নুম।’ উপস্থাপকের বলা কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়াল অভীক। পাশে বসা জাহাঙ্গীর সাহেব প্রশ্ন করলেন,
‘কোথাও যাচ্ছো?’
‘একটা কল এসেছে, কথা বলে আসি।’
ধীর স্বরে জবাব দিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল অভীক। সাউন্ড বক্সে গান বেজে উঠল,
‘ওহে শ্যাম, তোমাকে আমি নয়নে নয়নে রাখবো, অন্য কেউ রে না আমি চাইতে দিব….
মেকাপ রুম থেকে মঞ্চে আসার সময় দর্শক সারিতে চোখ বুলাল তাহিয়া। মঞ্চে পারফরম্যান্সের সময় শিক্ষকরা দর্শক সারির প্রথম লাইনে বসানো সোফায় বসেন। প্রথম লাইনে অভীক ছাড়া ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের সব শিক্ষক বসে আছেন। অভীককে না দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল তাহিয়া। নিঃসঙ্কোচে গানের তালে তালে নৃত্য শুরু করল, মনের মাধুরি মিশিয়ে দিল নাচে। নাচ শেষে করতালিতে ভাসল সে। প্রসন্ন হেসে আবার মেকাপ রুমে ফিরে গেল। এবার র্যাম্প ওয়াকের জন্য গেটআপ নিতে হবে। এখন মাগরিবের আযান দিচ্ছে। আযানের পর একটা দলীয় নৃত্য, তারপর র্যাম্প ওয়াক। হাতে আনুমানিক ঘন্টাখানেক সময় আছে। কাজে লেগে পড়ল সে।
অভীক ফিরল ঘন্টা দেড়েক পর। দর্শক সারির পেছনের দিকে এসে দাঁড়াল। মঞ্চে র্যাম্প ওয়াক চলছে, সবার মাঝে কাঙ্খিত চেহারাটাও পাওয়া গেল। লাল-হলুদ মিশেলের টাঙ্গাইল শাড়ি, গ্রামীণ নিয়মে প্যাচ করে পরেছে। দুই সিথি করে বিনুনি বেধে, মাথার উপরে ঘোমটা টেনেছে। আলতা রাঙা হাতে রেশমি চুড়ি। পায়ে আলতা পরেছে। ডান হাতে শোভা পাচ্ছে কুলা। ধানের গোছা আর কাচি হাতে কৃষক সেজে থাকা সায়িদকে চোখ পড়ল । সায়িদ আগে এসে কাচি দিয়ে ধান কাটার ভান করল, খানিক বাদে তাহিয়া এসে কুলা দিয়ে ধান ঝরার ভান করল। সম্মুখে এসে দুজনে চোখ চোখ রেখে হাসল, তারপর ফিরে গেল। সবটা পরখ করে অভীক মনে মনে বলল,
‘পড়ালেখা আর কমনসেন্স ছাড়া সব আয়ত্ত আছে দেখি!’
.
অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত ন’টা বেজে গেল। সবাই যখন বাড়ির পথ ধরেছে তখন তাহিয়া মেকাপ রুমে চেঞ্জ করতে ব্যস্ত। টাঙাইল শাড়িটায় অস্বস্তি লাগছে। কিভাবে প্যাঁচ দিয়ে পরিয়েছে মীরা, দম আটকে আসছে। তাই ভাবল, আগের গেট আপ নিবে। তারপর নিশ্চিন্তমনে বাড়ি যাবে। চেঞ্জ করে বেরিয়ে দেখল পুরো ক্যাম্পাস খালি। একটা মেয়েও নেই। অডিটোরিয়াম রুমে সিনিয়র ভাইয়েরা গোছগাছ করছে। তড়িঘড়ি করে বাড়ির পথে রওনা হলো। অভীকের কল এলো তখন। নাম্বার না দেখেই রিসিভ করল তাহিয়া। হ্যালো বলতেই অপাশ থেকে গম্ভীর স্বর ভেসে এলো,
‘দশ মিনিট অপেক্ষা করো। আমি আসছি। ‘
অভীকের দেয়া শাড়ির পরে অভীকের মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছে বা সাহস কোনটাই নেই তাহিয়ার। বাড়তি লজ্জায় পড়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে ধীর স্বরে বলল,
‘আমি যেতে পারব।’
‘তুমি যে পথ দিয়ে যাও, ওই পথ রাতের বেলা মেয়েদের জন্য সেফ নয়। একা যেও না। আমি ডিপার্টমেন্টে একটা কাজে আটকে গেছি। শেষ করেই আসছি। কয়েকটা মিনিট অপেক্ষা করো।’
স্বর নরম হয়ে এলো অভীকের। তাহিয়া অভীকের কথাকে প্রাধান্য না দিয়ে হাটা ধরল। ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় ভেদ করে এ দৃশ্য দেখে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো অভীকের। স্বরে কিছুটা রাগ মিশিয়ে বলল,
‘ ফাজিল মেয়ে, তুমি কি বুঝতে পারছো না? একা যাওয়া তোমার জন্য কতটা অনিরাপদ! অধিকার থাকা সত্ত্বেও আমি যা করিনি, অধিকার না থাকা সত্ত্বেও বখাটেরা তা করার জন্য উৎ পেতে থাকে। সুযোগটা নিজে করে দিও না! চুপচাপ দাঁড়াও আমি আসছি।’
কথা ঠেঙিয়ে কথা চলতে থাকল। জাহাঙ্গীর সাহেব থেকে অনুমতি নিয়ে দ্রুত পায়ে নিচে এলো অভীক। চোয়াল শক্ত, আগুল লাল চোখ। আজ তাহিয়ার রক্ষে নেই।
চলবে..
গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।