প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-১২) আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

0
365

#প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-১২)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

মনের কোণে কিয়ৎ শূন্যতা, শ্যামবর্ণের মুখে জায়গা করে নিয়েছে বিষন্নতা। অস্থির চোখ জোড়ার দৃষ্টি জানালা ভেদ করে নিচ তলায় গেটের কাছে গিয়ে ঠেকেছে। জানালার কাছে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে তাহিয়া। এক হাতে জানালার হালকা গোলাপী পর্দা খামচে ধরে আছে, অন্য হাতের মুঠোয় ফোন ধরা। ফোনটা বিকট শব্দে বেজে যাচ্ছে অনবরত। অথচ ফোন তোলার কোন লক্ষণ তাহিয়ার মাঝে দেখা যাচ্ছে না। সে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে তার নব প্রেমপুরুষকে দেখায় মগ্ধ। ওই যে নিচে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা লেমন কালার টি-শার্ট পরা হলদেটে যুবককে দেখা যাচ্ছে, এই যুবকের মাঝেই তার যত ধ্যানমন, এর অনুপস্থিতিই ওঁর মনের শূন্যতার কারণ। কানে ফোন চেপে তার বাসার দিকেই তাকিয়ে আছে যুবকটি। কপালে চিন্তার ভাজ। তাহিয়া কথা দিয়ে এসেছিল, বাসায় এসে তাকে জানাবে। অথচ মিনিট পনেরো হয়ে গেছে সে এখনো যোগাযোগ করেনি, এ কারণে চিন্তার ভাজ উঠেছে যুবকের কপালে।

বিষন্নতা ঠেলে আকস্মিক হেসে উঠল তাহিয়া। ফোনটা সামনে এনে তাকাল ফোনের স্ক্রিনে। ‘জাঁদরেল’ লেখা নামটায় চোখ বুলাতেই মুখ টিপে হাসল। তারপর আবার তাকাল নিচে। বিড়বিড় করে বলল,

‘আমি ফোন দেয়া মাত্রই আপনি চলে যাবেন। আবার কবে দেখা পাব তার ঠিক নেই। নতুন নতুন প্রেমে পড়লে প্রেমপুরুষ শুধু দেখতে ইচ্ছে করে, আমারও করবে নিশ্চয়ই। তাই এখন অনেকক্ষণ দেখে নিব, যখন আপনাকে দেখার ইচ্ছে হবে তখন এখনকার আপনাকে স্মরণে এনে দেখে নিব। আমার দেখার তৃষ্ণা মিটলে আপনাকে যেতে বলব। তখন আপনি যাবেন, এর আগে নয়। এটা আপনার শাস্তি। কিসের জানেন? আমাকে প্রেমে পড়তে বাধ্য করার শাস্তি। ‘

ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে তাকিয়ে রইল অভীকের পানে। মিনিট পাঁচেক পরে অভীকের ফোন তুলল। প্রায় সাথে সাথে অভীকের গম্ভীর স্বর ভেসে এলো,

‘ পাঁচ তলা বেয়ে উঠতে এতক্ষণ লাগে? বাসায় গিয়ে ফোন দিতে বলেছি, কথাটা শুনো নি? ফোন দিলে না কেন? আমাকে চিন্তায় না ফেললে তোমার শান্তি লাগে না? ফাজিল মেয়ে!’

তাহিয়া ঠোঁট চেপে হাসল। তারপর স্বরে মলিনতা টেনে বলল,
‘আপনাকে জানানোর কথা মাথা থেকে সরে গিয়েছিল। স্যরি! ‘

‘ফাজলামো ছাড়া বাকি সব তো মাথা থেকে সরবেই তোমার। ফোন রাখো, ফাজিল!’ গমগমে গলায় বলে নিজেই ফোন রাখল অভীক। রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে রাস্তায় নামল। জানালা দিয়ে অভীককে আর দেখা যাচ্ছে না। তাহিয়া দৌড়ে বারান্দায় গেল। দৃষ্টির অগোচর হওয়ার আগ অবধি দেখে গেল। অভীক দৃষ্টি সীমার বাইরে যেতেই নিজেকেই নিজে বলল,
‘ একদিনেই প্রেম কাবু করেছে তোকে! কী সব পাগলামো করছিস! প্রেমে পড়লি তো পড়লি, তাও স্বামীর! বাহ্! ‘

পরদিন সকাল সকাল অভীকের কল এলো। রিসিভ করতেই বলল,
‘ কলেজে গিয়েছো?’

তাহিয়া তখন কলেজের জন্য তৈরি হচ্ছিল। সে জবাব দিল,
‘একটু পর বেরুবো।’
‘ আজ একদম ক্লাস ব্যাঙ্ক দিবে না, আমার ক্লাসে যেন তোমায় দেখি। ‘
অভীকের স্বরে শাসনসূচক। তাহিয়া খানিক ভাবল। তারপর ধীর স্বরে বলল,
‘আচ্ছা।’

যান্ত্রিক যোগাযোগ বিছিন্ন করল অভীক। ফোন রাখার পর তাহিয়া বাঁকা হাসল,
‘এতদিন খুব চাইতেন আমার যেন জড়তা কেটে যায়। আপনার চাওয়া পূরণ হয়েছে, আমার জড়তা কাটতে শুরু করেছে। কথায় কথায় আমাকে ফাজিল বলেন, না? জড়তার জন্য তো আমি ফাজলামো শুরুই করিনি। এবার মূল ফাজিলের সংজ্ঞা বুঝতে পারবেন । আমি আসছি মশাই।’

*
রুটিন অনুযায়ী আজ দ্বিতীয় বর্ষের তৃতীয় ক্লাসটা অভীকের । বিষয়, ‘পলিটিক্যাল অরগানাইজেশান এন্ড দ্যা পলিটিক্যাল সিস্টেম অব ইউএসএ এন্ড ইউকে’। বই আর মার্কার কলম হাতে অফিসরুম থেকে বেরুলো সে। দুইরুম বাদেই সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাসরুম। ক্লাসের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই ভেতরে থাকা শ’খানেক ছাত্রছাত্রী উঠে দাঁড়াল। রুমের সামনের দিকে সিমেন্টের হাটুসমান উচ্চতার মঞ্চ, মঞ্চের মাঝামাঝিতে সেগুন কাঠের লেকচার টেবিল রাখা। অভীক লেকচার টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বসার ইঙ্গিত করল। সবাই বসে পড়ল। লেকচার দেয়ার আগে সামনের দিকে চোখ বুলাতেই মেয়েদের সারির চতুর্থ টেবিলে দৃষ্টি আটকাল। চোখে চশমা, কপালে টিপ, পনিটেইল বাধা চুল, গায়ে এপ্রণ, গলায় তামাটে বর্ণের স্কার্ফ প্যাঁচানো মেয়েটাকে দেখে অবাক হলো অভীক। তার ক্লাসে শ্যাম তরুণী উপস্থিতিটা অপ্রত্যাশিত একবারেই। বাহ্! ফাজিলটার সুমতি হয়েছে দেখি। আজ সকালে সৌজন্যমূলক আসতে বলেছে। মেয়েটাকে পড়ার ব্যাপারে গাইড করা তার দায়িত্ব। সে নিজের দায়িত্ব পালন করেছে মাত্র। তার ধারণা ছিল, তাহিয়া আসবে না। অন্তত তার ক্লাসে তো না-ই। কিন্তু তার ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে এসেছে। সুমতি হয়েছে না কি অন্য কোন কারণ! যা পাজি মেয়ে, একে বিশ্বাস করা যাবে না। নিশ্চয়ই কোন কুবুদ্ধি পাকিয়ে বসে আছে।

তাহিয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ সরাল অভীক। গম্ভীর ভঙ্গিমায় লেকচার দেয়ায় মন দিল। কিছুক্ষণ পর তাহিয়ার দিকে আবার তাকাতেই দেখল, তাহিয়া টেবিলে হাত ভাজ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। স্থির দৃষ্টি, চোখে চশমা নেই, চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে আছে, ঠোঁটের কোণে হাসির মৃদু হাসি। অভীক অবাক হলো, মেয়েটা তো তার চোখে চোখ রাখে না, এভাবে তাকানো তো দূরে থাক। তবে আজ এভাবে তাকিয়ে আছে কেন!

চোখ ফিরিয়ে খানিক বাদে আবার তাকাল, এবার মাথায় ঘোমটা টেনেছে, দৃষ্টি এখনো তার দিকে। কেমন অন্যরকম দৃষ্টি, গভীর, অর্থবহ। এই দৃষ্টি তাকে অপ্রস্তুত করে দিল। ফাজিল মেয়েটা ওকে বিভ্রান্তি করার পরিকল্পনা এঁটেছে! নিশ্চয়ই তার উপর জমে থাকা রাখের প্রতিশোধ নিচ্ছে। অভীক ভ্রু কুঁচকাল। ইচ্ছে করছে, একটা ধমক দিতে। কিন্তু সেটাও করা যাবে না। কারণ ছাড়া ধমক দেয়া বেমানান। মেয়েটার দৃষ্টি সে ছাড়া কেউ দেখছে না। অভীক কথা থামিয়ে দিল। বইয়ের দিকে তাকিয়ে গম্ভীরমুখে বিড়বিড়াল,
‘ফাজিল! ‘

গলা ঝেড়ে আবার পড়ানো শুরু করল। এবার সামনে তাকাচ্ছেনা, বইয়ের দিকে তাকিয়েই আলোচনা করছে। ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল পড়ার ব্যাপারে প্রশ্ন করল। নাম, মৌমিতা। সে বসেছে তাহিয়ার সামনের টেবিলটায়। মৌমিতার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মেয়েদের সারিতে তাকাতে হলো। তাহিয়ার চঞ্চল চাহনিতে গিয়ে আবার দৃষ্টি আটকাল। চোখাচোখি হতেই তাহিয়া চমৎকার হাসল, দু’পাটি দাঁত দৃশ্যমান হলো কিন্তু হাসির শব্দ হলো না। অভীকের উদ্দেশ্যে তাহিয়ার প্রথম দেয়া চমৎকার হাসিটা পরখ করে আবার ভ্রু কুঁচকাল অভীক। মেয়েটার মাথায় আজ কিসের ভূত চেপেছে কে জানে? তাকে এলোমেলো করার ভাবনায় নেমেছে, সফল ও হচ্ছে বোধহয়। অর্ধাঙ্গিনী থেকে বিনা বিজ্ঞপ্তিতে আগত অদ্ভুত আচরণে অভীকের কেমন যেন অনুভূতি হলো, সেই অনুভূতিতে মিশে আছে অস্বস্তি, মনের অশান্তি ভাব।
অভীক মনে মনে বলল,
‘এমন ফাজিল মেয়ে আমি আমার জীবনে দুটো দেখিনি। একজনই দেখেছি, ভাগ্যগুণে তাকেই আমার স্ত্রী হতে হলো। কী চমৎকার কান্ডকারখানা! পুরো নাজেহাল। ‘

চাপা শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে মৌমিতার প্রশ্নের উত্তর দিল অভীক। । মেয়েদের সারি থেকে চোখ সরানোর আগে তাহিয়ার দিকে কঠিন দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে ভুলল না।

অভীককে অস্বস্তিতে ফেলার চেষ্টায় সফল হয়ে ভেতরটা আন্দোলিত হয়ে গিয়েছিল তাহিয়া। সেই আনন্দে ভাড়া পড়ল অভীকে চাহনিতে। লোকটা পেশাগত ভঙ্গিতে কিভাবে তাকাল, ভয়ে ভিতরটা কেঁপে উঠল। তাহিয়া উপলব্ধি করতে পারল, লেকচারার অভীকের জন্য তার মনে জমানো ভয়ে ভাটা পড়েনি। যা পড়েছে তা হলো স্বামীর ভুমিকায় থাকা অভীকের জন্য।

ক্লাস শেষে অভীক যেতেই সব ছাত্র-ছাত্রী ব্যাগপত্র গুছিয়ে বের হতে ধরল। আজ আর ক্লাস নেই। তাহিয়া হাফ ছেড়ে বেরিয়ে এলো। মীরা, শৈলী আছে সাথে।
ক্লাসের বাইরে এসে মীরা লম্বা শ্বাস ফেলল,
‘ভাই, এতক্ষণ জান আটকে ছিল। এই জাঁদরেল যতক্ষণ ক্লাসে থাকে ভয়ে দম আটকে আসে। মনে হয়, ক্লাসে নয় মর্গে বসে আছি।’

শৈলী সায় জানাল,
‘মৌমিতার প্রশ্নের উত্তর দিতে যখন টিচার মঞ্চের এ কোণে এলো। বিশ্বাস কর, আমার মনে হচ্ছিল এক্ষুনি আমাকে সিংহী ধমক দিবে। কিভাবে যেন তাকাচ্ছিল। পুরোটা সময় আমি দোয়া পড়েছি। একটা মানুষ এতটা গম্ভীর রাগী কিভাবে হতে পারে, মাথায় আসেনা। ‘

দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল তাহিয়া। সে মনে মনে বলল,
‘কলেজের বাইরে একদিন বাসায় গিয়ে দেখিস, বিস্ময়ে জ্ঞান হারাবি। সেই মানুষটার মাঝে গম্ভীরতা নেই একবারেই। কেমন কোমলপ্রাণ! হায়! একদিনেই আমি মুগ্ধ।’

মীরা বলে গেল,
‘আমার কী মনে হয়, জানিস? আমার অভিশাপ কাজে দিবে না। স্যারের বউ স্যারকে ঠিক করতে পারবেনা। বেচারি হয়তো ধমক টমক খেয়ে নিজেই দিনে পাঁচবার জ্ঞান হারায়! বেচারির মনে হবে, সংসারে নয় চিড়িয়াখানায় সিংহের খাচার পাশে বসে আছে সে। এই সিংহকে, গর্জন দেয়া বেচারির পক্ষে সম্ভব হবে না। হবে না আমাদের প্রতিশোধ নেয়া।’ হতাশা ছেয়ে গেল মীরার মুখে।

শৈলী ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
‘গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার আগ অবধি এ ভয় পেছু ছাড়বে না। এভাবে মর্গের পরিবেশে ডোমের ক্লাস করে যেতে হবে। ‘

মীরা ব্যাঙ্গাত্মক গলায় বলল,
‘ আমি মানত করেছিলাম, স্যার ধমক দেয়া ছেড়ে দিয়ে যদি একদিন আমার সাথে হেসে কথা বলে, তবে আমি মসজিদে পাঁচশো টাকার জিলাপি বিতরণ করব। টাকাটা মাটির ব্যাংকে রেখে দিয়েছি। এখনো আছে। স্যার ঠিক হবে না, আমার পাঁচশো টাকার জিলাপিও কেনা হবে না। হাহ্!’

শৈলী বলল, ‘ ওসব আশা টাসা বাদ দিয়ে টাকাটা খরচ করে নে। স্যারের হাসির উপর ১৪৪ধারা জারি করা হয়েছে। ধারা ভেঙে স্যার হাসবেন না।’

মীরা আকস্মিক ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, ‘ আল্লাহ, আমার মতো নিরীহ মেয়েকে ধমক দেয়ার অপরাধে স্যারের বউয়ের রান্না খারাপ করে দাও। যে রান্না খেয়ে ছোটো ঘর, বড়ো ঘরে দৌড়াদৌড়ি করা লাগুক স্যারকে। যেদিন এই সংবাদ শুনব সেদিন স্যারের হাসি দেখার আশা বাদ দিয়ে টাকা খরচ করে ফেলব। প্রমিজ!’

এতক্ষণ নিজের রাগকে বহু কষ্টে সংবরণ করেছে তাহিয়া। কিন্তু এ পর্যায়ে ব্যর্থ হলো। মীরার বদদোয়া কবুল হলে অভীকের কী অবস্থা হবে ভেবেই এক প্রকার চেঁচিয়ে বলল,

‘স্যারের সম্পর্কে আর একটাও বাজে কথা বলবি না। যা অভিশাপ দিয়েছিস এক্ষুনি ফিরিয়ে নে। স্যার মোটেও খারাপ মানুষ নয়, বরং চমৎকার মানুষ।’ ‘

শৈলী ভ্রু কুঁচকাল, ‘ ”স্যার চমৎকার মানুষ!” তাও তুই বলছিস! ‘

মীরা বিস্ময়ের সাথে বলল, ‘তুই কদিন পুরনো পান্তা ভাত ভিজিয়ে খেয়েছিস না কি? আজ উলটো গান গাইছিস ! দু’দিন আগেও তো স্যারকে কত অভিশাপ দিলি। আজ কী হলো!’

তাহিয়া লম্বা শ্বাস ফেলে বলল, ‘কিছু হয়নি। তবে একটা কথা স্পষ্ট বলি, স্যারকে আর কখনো এমন অভিশাপ দিবি না। স্যার এত খারাপ না। কলেজের বাইরে স্যার প্রাণবন্ত।’
থেমে বলল, ‘আর বউকে একদম ধমক দেন না। তার পাশে থাকলে বউয়ের মোটেও চিড়িয়াখানায় আছে বলে মনে হয়না। না জেনে বাজে বকবি না।’

সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসেছে তারা। এখন গ্যালারির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাহিয়ার কথায় তার দুই বান্ধবী থেমে গেল। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। মীরা সন্দিহান স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘ তুই স্যারের বউকে চিনিস?’

‘হ্যাঁ। অনেক ভালো করে চিনি। ‘ ধীরে উত্তর দিল তাহিয়া। শৈলী কৌতুহলী হয়ে বলল,
‘কে? আমরা কি চিনি?’

‘হ্যাঁ, তোরাও চিনিস। ‘

এবার মীরার চোখে ও কৌতুহলের আভা দেখা গেল, ‘কে?’

তাহিয়ার চোখে মুখে কেমন লজ্জা ভাব ফুটে উঠল। ধীর স্বরে উত্তর দিল, ‘আমি।’

মীরা বিশ্বাস করল না, ‘ স্যারের বউ, তাও তুই! পাগল না কি! কৌতুকটা ভালো ছিল। আরেকটা বল। ‘

গেটের বাইরে ভেলপুরিওয়ালা বসেছে। ভেলপুরি দেখেই জিবে পানি চলে এলো তাহিয়ার। এখন না খেলেই নয়। ও সেদিকে পা বাড়িয়ে বলল,
‘ আমার যা বলে দিয়েছি। বিশ্বাস করবি কি করবি না তোদের ব্যাপার। ‘

তাহিয়া পায়ে পায়ে এগিয়ে গেটের বাইরে চলে গেল। তিনজনের জন্য ভেলপুরি কিনে গ্যালারিতে গিয়ে বসল। খানিক বাদেই মীরা আর শৈলী উপস্থিত হলো সেখানে। অদ্ভুত মুখভঙ্গিমায় তাহিয়ার দুইপাশে বসে পড়ল। দুজনের হাতে কাগজ মোড়ানো ভেলপুরি তুলে দিল তাহিয়া। তারপর নিজের হাতে থাকা ভেলপুরি নির্বিঘ্নে খেতে লাগল। তার নির্বিকার ভাবভঙ্গি পরখ করে শৈলী বলল,

‘ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। তুই, স্যার কিভাবে!’

‘আমি কী করতে পারি?’ দায়সারা ভাব তাহিয়ার। মীরা খানিক ভাবল।
তারপর বলল,

‘তুই স্যারকে ফোন দিবি এখন। স্যারের কথা শুনে আমরা বুঝতে পারব ঘটনা সত্য কি মিথ্যা!’

তাহিয়া খাওয়া থামিয়ে ভাবল। স্যারকে মীরার অভিশাপ থেকে বাঁচাতে হলেও বিয়ের কথা বিশ্বাস করাতে হবে। সে ফোন বের করে স্যারের নাম্বারে ফোন দিল। কয়েকবার রিং হতেই রিসিভ হলো। স্পিকারে রাখল ফোন। অপাশ থেকে শান্ত, কোমল পুরুষালি স্বর ভেসে এলো,
‘ হঠাৎ কল দিলে! সব ঠিক আছে?’

তাহিয়া ইতঃপূর্বে নিজ থেকে কল দেয়নি অভীককে। তাই বিস্ময় ছুঁয়েছিল ওঁকে।

স্বরটা চিনতে ভুল হলো না মীরা শৈলীর। তাহিয়াকে ‘তুমি’ সম্বোধন করতে শুনে ঘটনার সত্যতা পেল ওরা। হতভম্ব হয়ে গেল তারা।

তাহিয়া ধীর স্বরে উত্তর দিল,
‘সব ঠিক আছে। এমনিই কল দিয়েছি।’

‘এমনি! তোমার মাথায় চলছেটা কী বলোতো? সকাল থেকে উদ্ভট আচরণ করছো। আর ক্লাসে ওভাবে তাকিয়ে ছিলে কেন? আমি তখন তোমার শিক্ষকের ভূমিকায় ছিলাম, স্বামী নয়। ফাজিল!’

নিজের মতো বলে গেল অভীক। তাহিয়া দুই বান্ধবীর দিকে তাকাল। তারা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বসে আছে। স্পিকার অফ করে তাহিয়া বলল,
‘আর করব না এমন।’

অপাশ থেকে তৎক্ষনাৎ উত্তর এলো। খানিক বাদে ছোটো করে উত্তর দিল,
‘মনে থাকে যেন। ‘

ফোন রাখার পর দুই বান্ধবীকে পরখ করে মুখ টিপে হাসল তাহিয়া। তারপর বলল,
‘আমি সম্পর্কে তোদের শিক্ষকের স্ত্রী হই। সম্মান দিয়ে কথা বলবি। চাইলে ‘ম্যাম’ ও ডাকতে পারিস। আমি কিছু মনে করব না। তবে হ্যাঁ, আমার সামনে স্যারকে কোন গালি বা অভিশাপ দিলে আমি অনেক কিছু মনে করব। সেই মনের ভাবনা বশত চুল টুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে পারি, সেই সাথে স্যারকে জানিয়ে দিতেও পারি। তাই পরেরবার আমার সামনে স্যারকে অভিশাপ দেয়ার আগে হাজারবার ভাববী। সামনে কী, পিছনে ও দিতে পারবি না। আমি সহ্য করব না। মনে রাখিস। ‘

মীরার মনে হলো, এটাই পৃথিবীর নবম আশ্চর্য। বিস্ময়ের মাত্রা এতটাই যে তার হাত থেকে ভেলপুরি পড়ে গেল। শৈলী বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তাহিয়া বান্ধবীদেরকে বিস্ময়ের সাগরে ডুবিয়ে উঠে দাঁড়াল। বাসায় যেতে হবে, মা একা বাসায়। বিস্ময় কাটিয়ে উঠলে এরা বাসায় গিয়ে হানা দিবে, পুরো ঘটনা জানার জন্য।

ক্যাম্পাস ধরে হাটতে হাটতে তাহিয়া স্মিত হাসল। লোকটা তার এত খেয়াল রাখে, স্বামীর সব দায়িত্ব পালন করে। সবার কথা থেকে ওকে আগলে রাখতে কত কী করল, এবার তার পালা। সেও লোকটাকে সবার অভিশাপ থেকে বাঁচাবে।


মাহমুদাকে আজও ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে পরীক্ষার জন্য। তাহিয়া নিয়ে এসেছে মাকে । অভীক এসেছে হাসপাতালে। মাহমুদাকে পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়ার পর রিসিপশনে বসে মায়ের অপেক্ষা করছিল তাহিয়া। অভীক গিয়ে বসল পাশে। কোমল গলায় বলল,
‘আন্টি তোমায় নিয়ে চিন্তিত তাহিয়া। উনাকে চিন্তামুক্ত করো। উনাকে বুঝাও যে, বিয়ে কোন ছেলেখেলা নয়, যে চাইলাম ভেঙে গেল। বিয়েটা শক্ত বন্ধন, আমি তুমি আটকেছি এই বন্ধনে। বিয়েটা অপ্রত্যাশিতভাবে অনাঙ্ক্ষিত মানুষের সাথে হয়েছে বলেই আমরা এখনো পুরোপুরিভাবে সহজ হতে পারিনি। তবে পারব না যে এমন নও, সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা দু’জন দুজনকে মানতে শুরু করব। তবে ছাড়াছাড়ির কথা ভাবব না। আমার যথাসাধ্য চেষ্টা থাকবে, তোমাকে সুখী করার। আন্টিকে বলবে, চিন্তা না করতে। আমরা সম্পর্কটাকে নিজেদের মতো গুছিয়ে নিব। তুমি বেশি বেশি সময় দিও। ক্লাস ছাড়া বাকি সময়টা বাসায়, আন্টির সাথেই কাটাও। আর আন্টির শরীর একটু খারাপ দেখলে সাথে সাথে আমায় জানাবে। ঠিক আছে?’

তাহিয়া মাথা নাড়াল। অপারেশনের আগে আর কলেজে যাবে না বলেও সিদ্ধান্ত নিল। কিছুক্ষণ নিরবতা বিরাজ করল দুজনার মাঝে। অভীক পকেট থেকে একটা খাম বের করল। তাহিয়ার দিকে খামটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘নাও।’

খামটা পরখ করে প্রশ্ন করল তাহিয়া,
‘কী এখানে?’

‘তোমার হাতখরচের জন্য সামান্য কিছু টাকা।’ আলতো স্বরে বলল অভীক। তাহিয়া অবাক হয়ে বলল,
‘এটা কেন? মা দেয় তো!’

‘আমার নামে ‘কবুল’ বলার পর তোমার সব দায়িত্ব আমার উপর এসে গেছে। এখন তোমাকে চালানোর দায়ভার আন্টির নয়, আমার। তাই আমি চাইছি না, এর পর থেকে তোমার কোন আর্থিক প্রয়োজনে আন্টির সাহায্য নেয়া লাগুক। ‘

থামল অভীক। খামটা তাহিয়ার হাতে দিয়ে বলল,
‘কলেজ আসো, বান্ধবীদের নিয়ে ঘুরাফিরা করো। অনেক খরচ লাগে। তুমি ছোটো মানুষ, এত টাকা পাবে কোথায়? টাকা গুলো রাখো, সৎপথে খরচ করো। এই টাকার হিসেব দিতে হবে না আমাকে। আর কোন প্রয়োজন হলে আমাকে বলবে। লজ্জায় বা দ্বিধায় কোন ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখবে না, নির্দ্বিধায় বলবে। তোমার ইচ্ছেগুলো তোমার জন্য মঙ্গলকর হওয়ার সম্ভাবনা দেখলে, আমি যেভাবে হোক পূরণ করব।’

অভীকের গলাতে কী শীতল আভা ছিল? যার পরিপ্রেক্ষিতে তাহিয়ার মনটা কেমন শীতলতায় ভরে গেল! ভেতরটায় আনন্দে নেচে উঠছে। টাকার জন্য নয়, কথা গুলোর জন্য। কী সুন্দর কথা বলে লোকটা! তার উচ্চারিত শব্দগুলোতে মগ্ধতা মেশানো থাকে, তাহিয়ার হৃদয়টা ছুঁয়ে যায়।

খামের দিকে তাকিয়ে তাহিয়া বিড়বিড়াল,
‘আপনার এতটা ভালো হওয়া উচিত হচ্ছে না, একদমই না। আমার যে এখন আপনাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে! ভরা মজলিসের দিকে চোখ রেখে নিজের ইচ্ছেকে শাসাতে হচ্ছে। এতে কতটা কষ্ট জানেন! ‘

হাসপাতাল থেকে ফেরার পরদিনই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন মাহমুদা। ঘড়ির কাটায় তখন রাত একটা। তাহিয়া মায়ের পাশে ঘুমিয়েছে। আকস্মিক গোঙানির শব্দে ঘুম ছুটে গেল তার। মায়ের কথা মনে পড়তেই পাশে তাকাল। নীল রঙা লাইটটা মৃদু আলো দিয়ে যাচ্ছে সারা রুমে। সেই আলোতে দেখতে পেল, মাহমুদা বুকে হাত দিয়ে কেমন যেন ছটফট করছেন। ঘুম উবে গেল তাহিয়ার চোখ থেকে। তড়িৎ উঠে বসে বেডসাইড ল্যাম্প জ্বালাল। মায়ের পাশে গিয়ে উদ্ধিগ্ন হয়ে বলল,
‘মা, কী হয়েছে তোমার? এমন করছো কেন?’

উত্তর দেয়ার অবস্থায় নেই মাহমুদা। বুকে অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে, চোখ মুখ খিচে আছেন। মুখ দিয়ে কেমন আওয়াজ করছেন। তাহিয়া কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে চেয়ে রইল সেকেন্ড দশেক। তারপর কেঁদে উঠল। ‘মা, মা’ করে ডাকতে লাগল শুধু।

ঘটনার আকস্মিকতায় হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে গেল যেন। এই মুহুর্তে ওঁর করণীয় কী, সেই ভাবনা মন-মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে না। তার কান্নাকাটিতে পাশের রুমে ঘুমিয়ে থাকা তুহিনের ঘুম ভেঙে গেল। বিপদের সঙ্কেত পেয়ে দৌড়ে এলো। মায়ের এহেন অবস্থা দেখে আঁতকে উঠল। কিছুক্ষণ নির্বাক চেয়ে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। অস্থির গলায় মাকে ডাকল কয়েকবার। তারপর ভাঙা গলায় বলল,
‘আপু, মাকে হাসপাতালে নিতে হবে । ‘

তাহিয়ার মস্তিষ্ক এতক্ষণে সচল হলো কিছুটা। এত রাতে গাড়ি পাওয়া যাবে? একা একা কীভাবে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। ভয়ে শ্বাস আটকে আসছে। দোয়া পড়তে লাগল সে। দোয়া পড়ার মাঝে অভীকের কথা মাথায় এলো। ‘উনি ফোন দিতে বলেছে’ কথাটা আওড়িয়ে হুলস্থুল হয়ে ফোন হাতে নিল। কাঁপা হাতে অভীককে ফোন দিল। প্রথমবার ধরল না। বোধহয় ঘুমে আছন্ন। আরেকবার দিল। এবার কয়েকবার রিং হতেই রিসিভ হলো। অভীকের ঘুমঘুম ভাবের স্বরটা ভেসে এলো,
‘ হ্যালো।’

নাম্বার না দেখেই রিসিভ করেছে সে। তাহিয়া ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। কিছু বলতে পারল না। অভীকের ঘুম উবে গেল। ফোনটা মুখের সামনে এনে চোখ বুলাল। ‘তাহিয়া’ নামটা দেখে তড়িৎ উঠে বসল। উদ্ধিগ্ন হয়ে বলল,
‘ তুমি ঠিক আছো? আন্টি ঠিক আছেন?’

তাহিয়া ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলল, ‘মা…

আর বলতে পারল না। অভীক তৎক্ষনাৎ বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,
‘কী হয়েছে আন্টির?’
‘মা কেমন যেন করছেন।’

অভীক হলদেটে টি-শার্ট আর কালো ট্রাইজার পরা ছিল। ওয়ালেট পকেটে নিয়ে চেঞ্জ না করেই বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে বলল,
‘আমি আসছি। ফোনটা তুহিনকে দাও।’ ছেলেটা একটু ম্যাচিয়্যুর আছে। অল্পতে ভেঙে পড়ে না। তাহিয়া একটু বেশিই আবেগী।

তুহিনকে ফোন দিল তাহিয়া। অভীক তুহিনের সাথে কথা বলল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here