প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-৮)

0
400

#প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-৮)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

দুই হাটুর উপর দু’হাতের কনুই ভর দিয়ে, ঝুকে বসে মুখে দু’হাত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে অভীক। কাজটা করছি মিনিট পাঁচেক যাবত। কিন্তু সফল হচ্ছে না, ফলাফল শূন্যের কোঠায়। ভেতরে অনিয়ন্ত্রিত রাগের আগুনটা দাউদাউ করে জ্বলছে। সারা মুখে রক্তিম আভা ছড়ানো, চোখ জোড়া থেকে যেন আগুন বেরুচ্ছে, নাকের ডগা ফেঁপে উঠেছে। অভীকের এহেন রাগ থেকে ভয়ে সিটিয়ে গেছে তাহিয়া। সে অভীকের পাশেই সিএনজির অপর প্রান্তে বসে আছে। নিজের জেদ বজায় রেখে অভীকের কথা না শুনে একা একাই যাওয়া ধরেছিল। ক্যাম্পাস পেরিয়ে রাস্তায় নেমে গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। মিনিট দশেক গাড়ি পাওয়া গেল না। এক খালি রিক্সা পেয়ে উঠতে নিতেই পিছন থেকে গম্ভীর স্বর ভেসে এলো,

‘আমার ধৈর্যের পরীক্ষা না নিয়ে সিএনজিতে ওঠে বসো, তাহিয়া। কোন প্রকার দ্বিরুক্তি করলে আমার ধৈর্যের বাধ ভেঙে যাবে, তখন তা তোমার জন্য শুভকর হবে না। আমার রাগ সম্পর্কে তোমার ভালোই ধারণা আছে। ‘

পিছন ঘুরে দেখল অভীক একটা সিএনজির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ংকর রাগ মাখা চেহারা। তড়িৎ চোখ সরাল তাহিয়া। অভীকের আগুনলাল চেহারায় নিজের সর্বনাশ দেখল সে। ভীত ঢোক গিলল। অভীকের সামনে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না তার। মনে হচ্ছে, সামনে পেলে অভীক তাকে খুন করে ফেলবে। এত ভয়ংকরভাবে রেগে যেতে কখনোই দেখেনি তাহিয়া। ক্লাসে অভীক গম্ভীর থাকে, রেগে থাকে না। কখনো কেউ কথার অবাধ্য হলে চোখ মুখ স্বাভাবিক রেখেই গম্ভীর স্বরে ধমক দেয়। এখনকার মতো এত ভয়ংকর চেহারা বানায় না কখনো। তাহিয়ার ভাবনার মাঝে অভীক তাহিয়ার পাশে এসে ধমকে উঠল,

‘গাড়িতে উঠতে বলছি না? উঠো শিগগির!’

সেই প্রথম দিনের মতো অভীকের সিংহী গর্জনে অন্তরাত্মা, বহিরাত্মা দুটোই কেঁপে উঠল তাহিয়ার। দ্বিরুক্তি করার সাহস পেল না, ভয়ে ভয়ে উঠে বসল সিএনজিতে। অভীক চাপা শ্বাস ফেলে পেছনে এসে বসল। দু’জন সিটের দুই প্রান্তে। সিএনজি চলতে শুরু করেছে। অভীক গাল চেপে বসে আছে, একটা রা ও করছে না। ভুলটা এতক্ষণে ধরা পড়েছে তাহিয়ার চোখে।
স্যারের কথা অমান্য করে আসা উচিত হয়নি। এখন জেদের ফল পাচ্ছো তো! বেঁচে ফিরো এই জাঁদরেলের খপ্পর থেকে। নিজেকেই বকল সে। মনে মনে দোয়া পড়তে শুরু করল,

‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন। আল্লাহ, আজকের জন্য রক্ষা করো, আর জীবনেও এই জাঁদরেলের কথা অমান্য করব না। উঠতে বললে উঠব, বসতে বললে বসব। গাধার মতো দাঁড়িয়ে ঘুমাতে বললেও নির্দ্বিধায় দাঁড়িয়ে ঘুমাব। কখনো জেদ ধরে একা আসার কথা ভাববো না। প্রমিজ! প্লিজ, আল্লাহ! এই যাত্রায় জীবন নিয়ে বাড়ি ফিরতে দাও!’

মিনিট দশেক পার হওয়ার পর রাগ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলো অভীকের। এবার আর চুপ থাকতে পারল না সে। মুখ থেকে হাত সরিয়ে গম্ভীরমুখে বলল,

‘একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না, তাহিয়া?’

তাহিয়া ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বসে রইল, প্রতিত্তোর করল না। অভীক রাগমাখা গলায় বলল,
‘তুমি কি আদৌ জানো না, কী করতে যাচ্ছিলে তুমি? এই পদক্ষেপের কী পরিণাম হবে জেনেও, কীভাবে এত বড়ো ভুল করতে যাচ্ছিলে তুমি! ঠিক কী ভেবে তুমি একা যাচ্ছিলে, বলো আমায়? ব্রীজের উপর মদ্যপ বখাটে গুলো তোমায় একা পেয়ে ছেড়ে দিবে?’

তাহিয়া নিরুত্তর। অভীক ধমকে উঠল,
‘অ্যান্সার মি, ফাজিল!’

তাহিয়া কেঁপে উঠে জড় গলায় বলল,

‘আ..মি এত কথা ভাবিনি!’

ধমকে উঠল অভীক,

‘ভালো কথা মাথায় আসবে কেন তোমার? তোমার মাথায় আসবে তো শুধু, কিভাবে পড়ালেখায় ফাঁকি দিয়ে ফেইল করা যায়, কিভাবে ক্লাস ব্যাঙ্ক দিয়ে রং তামাশা করা যায়, আমাকে দেখে অস্বস্তির সাগরে কিভাবে ডুবে মরা যায়। ফাজিল! একটা বাচ্চা মেয়েও যতটা বুঝে, বিশ পেরিয়েও তুমি ততটাই অবুঝ। তোমার কিছু হলে আন্টিকে কি জবাব দিব, ভেবেই ভয়ে দমবন্ধ হয়ে আসছিল আমার। তোমার কি একটু ও ভয় করেনি?’

সিএনজি তখন ব্রীজ পেরুচ্ছিল। বাইরের তাকাতেই রেলিংয়ের উপর বসা একদল বখাটের দেখা মিলল, বোতল জাতীয় কিছু সবার হাতে।
অভীক সেদিকে ইশারা করে বলল,
‘ রিক্সায় বসে একা একটা মেয়ে ওদের ডিঙ্গিয়ে যেতে পারতে? আমি সাথে থেকে ও তোমার জন্য এটা অনিরাপদ স্থান মনে করছি, সেখানে তুমি একা যাওয়ার সাহস কিভাবে পাও! ভয়ডর নেই?’

বখাটেদের পরখ করেই আঁতকে উঠল তাহিয়া। মা ঠিকই বলেন, তার বিবেকবুদ্ধি নিচুস্তরের। সাত পাঁচ না ভেবে যা মনে আসে তা করাই ওর কাজ। কথাটার সত্যতা প্রমাণ পেল এখন। মিনমিনে স্বরে বলল,

‘স্যরি!’

অভীকের রাগ যেন কমার বদলে বেড়ে গেল,
‘ কাল সকালে শিরোনাম হওয়ার পর ‘স্যরি বললে সব ঠিক হয়ে যেত? একা পেয়ে বখাটেরা তোমাকে ডিনার বানাতে নিলে, স্যরি বললে তারা ছেড়ে দিত! পদক্ষেপ নেয়ার আগে ভাবা উচিত, বিপদ ঘটে গেলে তখন ‘স্যরি’টা মলম হয়ে আসবে না। বি ম্যাচিয়্যুর তাহিয়া!’

ভয়ে অন্তরাত্মা কাঁপছে তাহিয়ার। অভীকের ধমকাধমকিতে প্রাণভোমরা উড়ে যাওয়ার উপক্রম । পাণ্ডুবর্ণ হলো মুখ। উত্তর দিলেও, দোষ না দিলেও দোষ। কী করবে সে! দোয়া ইউনুস পড়ে ধীর স্বরে বলল,

‘স্যরি স্যার, আর হবে না এমন।’

স্বর থেকে রাগ সরিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিল অভীক,

‘ট্রাস্ট মি. শুধু স্যার হলে তোমার এত অবাধ্যতার পর আমি এখান তোমার সাথে থাকতাম না। ছাত্রীকে বাড়ি পৌঁছে দেয়া লেকচারারের দায়িত্ব নয়।’

তাহিয়ার ফোনটা বাজল তখন। মাহমুদা ফোন দিয়েছেন। মেয়ের খবর নেয়ার উদ্দেশ্য তার। ফোন রিসিভ করে কানে দিতেই শান্ত স্বর ভেসে এলো,
‘ অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে?’

অভীকের ভয়টা তখনো কাটেনি তাহিয়া। স্বর কাঁপছে। কাঁপা স্বরেই জবাব দিল,
‘ফিরছি।’

‘অভীক আছে পাশে?’
‘হু।’
‘রাস্তা থেকে বিদায় দিবি না ওকে, বাসায় নিয়ে আসবি। এখন ফোনটা ওকে দে।’

তাহিয়া ভীত ঢোক গিলল। ফোন অভীকের দিকে এগিয়ে দিল। হাত কাঁপছে থরথর।

তাহিয়ার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে অভীক ফোন হাতে নিল। কানে দিয়ে বিনম্র স্বরে সালাম দিল। উত্তর নিয়ে মাহমুদা বললেন,

‘ সব ঠিকঠাক? তাহিয়া কোন ঝামেলা করছে না তো!’

নিজের মেয়ের স্বভাব সম্পর্কে অজানা নয় মাহমুদার। এ মেয়ে সহজে অভীকের সাথে আসার পাত্রী নয়। তাহিয়ার কাঁপা স্বর শুনেই অঘটনের আঁচ করেছেন তিনি।

সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করল না অভীক। অভিযোগের সুরে বলল,
‘ এত রাতে একা আসতে ধরেছে। আমি নিয়ে যাব বলার পর ও থামেনি। বীর বেশে গাড়িতে উঠে যাচ্ছিল, তড়িঘড়ি এসে থামিয়েছি। এটাকে যদি ঝামেলার তালিকায় পাঠানো যায়, তবে করেছে ঝামেলা। গেলে কী হতো ভাবুন একবার!’

একা আসার কথা শুনেই আঁতকে উঠলেন মাহমুদা। ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন,
‘বেয়াদবটাকে কষে দুটো চড় বসা, সোজা হয়ে যাবে। কত বড়ো সাহস!’

অভীক গম্ভীরমুখে বলল,
‘ আমার বংশে কোন পুরুষ বউদের গায়ে হাত তুলে পুরুষত্ব দেখায় না। এর পরিপ্রেক্ষিতে বেঁচে গেছে। ‘

টুকটাক কথা বলে ফোন রাখলেন মাহমুদা। আনমনেই বললেন,
‘আমার মেয়ের স্বভাব সম্পর্কে জানা আছে বলেই ওর স্বামী হিসেবে তোকে বাছাই করেছি। বাবার আদর, শাসন পায়নি মেয়েটা, তাই বিগড়ে গেছে।
তোকে ছাড়া কাউকে ভয় পায়না সে, ওকে ঠিক করার জন্য তুই-ই যথেষ্ট। গায়ে গতরে বড়ো হয়েছে, মস্তিষ্ক ভরা এখনো বাচ্চামো। বাচ্চামো, জেদ, সব সরিয়ে ওর মাঝে ম্যাচুরিটি আনার দায়িত্ব তুই ভালোভাবে পালন করতে পারবে বলেই তুই আজ আমার মেয়ে জামাই। অভিভাবক হিসেবে শাসন করলেও স্বামী হিসেবে অত্যাচার করবি না, এই ভাবনা আমাকে নিশ্চিন্ত করেছে। বাবাহীন মেয়েটার ছায়া ছিল না, তার ভীষণ একটা ঢাল দরকার। যা ওকে সব কিছু থেকে আগলে রাখবে। আমার এর জন্য তোকেই ভরসাযোগ্য মনে হয়। বাবাহীন মেয়েটা ভালো থাকবে তোর কাছে। ‘

*

কথা শেষ করে ফোন ফেরত দিতে গিয়ে অভীক এক পলক চাইল তাহিয়ার রূপ-লাবণ্যে মুখ পানে। তাহিয়ার পরনে এখনো তার দেয়া কালো শাড়ি। খোঁপা গুলে চুল ছেড়ে দিয়েছে। বাতাসে উড়ছে। কপালে কালো টিপ, শুষ্ক ঠোঁটে জোড়া কাঁপছে, দু’গাল ভয় রক্তশূণ্য হয়ে আছে। সিএনজির ভেতর থাকা হলদে আলোয় স্পষ্ট ধরা পড়ছে তার ভীত ঢোক গিলাটা। শ্যামাঙ্গিনীকে চমৎকার লাগছে। অন্তর্ভেদী চাহনিতে পরখ করে দৃষ্টি সরাল। সে স্পষ্ট টের পাচ্ছে, তার তপ্ত মস্তিষ্ক শীতল হয়ে যাচ্ছে।

শাসনের পর্বটা বোধহয় একটু বেশিই লম্বা হয়ে গেছে। মেয়েটা ভয় পেয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে স্বর থেকে রাগ সরিয়ে শান্ত গলায় বলল,
‘লাঞ্চের পর কিছু খেয়েছিলে?’

অভীকের কথায় নেতিবাচক মাথা নাড়াল তাহিয়া। অভীক রাস্তা দেখে নিল। সুনসান এলাকা ছেড়ে জনবহুল এলাকায় চলে এসেছে। হাজার মানুষের চলাফেরা এখানে। কোমল গলায় বলল,

‘ সময় তো কম হলো না, ক্ষিধে পেয়েছে নিশ্চয়ই! সামনে একটা রেস্টুরেন্টে আছে। গাড়ি থামাতে বলি?ডিনারটা সেরে নাও।’

তাহিয়া ভ্রু কুঁচকাল। একটু আগে না গলা দিয়ে আগুন বেরুচ্ছিল, এখন বরফ বেরুচ্ছে! আশ্চর্য! এই মানুষটা তার ভাবনার বাইরে। ধমক দিয়ে আবার নরম নরম কথা বলছে। এসবে তার মন গলবে না। সে মাথা নাড়ল। আপাতত বাড়ি যাওয়াই তার মূখ্য উদ্দেশ্য। অভীক অবাক হলো না, উত্তরটা তার জানাই ছিল। তবুও সৌজন্যমূলক জিজ্ঞেস করেছে। মাহমুদা বিয়ে ঠিক হওয়ার আগেই তাহিয়ার অভিভাবকত্ব তার উপর তুলে দিয়েছেন। অভিভাবক হিসেবে স্ত্রীর খেয়াল রাখা তার দায়িত্ব। সে জোর করল না। সোজা হয়ে বসে তাহিয়ার দিকে তাকাল। তাহিয়ার মাথাটা সোজা হলেও দৃষ্টি বাইরের দিকে। তাহিয়ার দিকে পূর্নদৃষ্টি মেলে বলল,

‘তুমি যে আজ আমার দেয়া শাড়ি পরেছো, এবং তা যে আমি পরখ করেছি। এটা কিন্তু আমি বলিনি, বা কোন প্রকার মন্তব্য করিনি। তবুও আমার সাথে থাকতে এত অস্বস্তিবোধ করছো কেন?’

আকস্মিক লজ্জা এসে হানা দিল তাহিয়ার মাঝে। চোখ মুখ খিচে বাইরের দিকে ঘুরে গেল। এখনো বলার বাকি রেখেছে কিছু! এই ভয়েই লোকটার সাথে আসতে চায়নি সে। বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে তাহিয়া হাঁসফাঁশ করে উঠল। তৎক্ষনাৎ কিছু বলল না অভীক। শুধু নিঃশব্দে হেসে গেল। খানিক বাদে কপাল চুলকে বলল,
‘শুনো? একটা কথা জানার দরকার। ‘

তাহিয়া মাথা সোজা করল, তবে তাকাল না। মৃদুস্বরে বলল,
‘বলুন!’

পরবর্তী কথা বলার আগে অভীক টাইয়ের নাটটা ঢিলে করল। তারপর ইতস্ততভাবে বলল,
‘ জাহাঙ্গীর স্যার বিয়ের উপহার হিসেবে হানিমুন প্যাকেজ দেয়ার পরিকল্পনা এঁটেছেন। আমাকে মতামত জানতে চাইলে আমি আমার তরফ থেকে নিষেধ করেছি। স্যার সরাসরি তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলেন। তোমার অস্বস্তির কথা ভেবে আমি নিষেধ করেছি। এখন স্যার বেশ জোর করছেন তোমাকে জিজ্ঞেস করে মতামত জানাতে। তোমার ইতিবাচক মতামত থাকলে স্যার টিকেট কনফার্ম করবেন।’

থামল অভীক। হালকা কেশে বলল, ‘ তুমি কি হানিমুনে যেতে ইচ্ছুক?’

ডিপার্টমেন্ট হেড অবধি পৌঁছে গেছে বিয়ের কথা! অবাক হলো তাহিয়া। অভীকের এহেন বিষয়ে কথা বলায় লজ্জার মাত্রা ও বাড়ল। হতবাক হয়ে প্রশ্ন করল,
‘স্যার বিয়ের কথা জানেন!’

জড়তা কাটিয়ে হেসে উঠল অভীক। ওর হাসির শব্দ কানে যেতেই আড়চোখে তাকাল তাহিয়া। অভীকের এই প্রাণবন্ত হাসিটা ইতঃপূর্বে দেখার সুযোগ মিলেনি ওর। মানুষটা হাসতে ও জানে! হাসিটা বেশ, হাসলে মানুষটাকে সুন্দর দেখায়। তবে এমন রাশভারি চেহারা নিয়ে ঘুরে কেন! লোকটা কি জানে না? যাদের হাসি সুন্দর, তাদের সবসময় হাসতে হয়। তড়িৎ চোখ ফিরিয়ে নিল তাহিয়া। হৃদপিণ্ড লাফাচ্ছে। ভয়ে না কি অন্য অনুভূতিতে!

অভীক হেসে বলল,
‘আপনার অবগতির জন্য জানানো হচ্ছে যে, আপনার বিয়েতে বরপক্ষের একজন সাক্ষী ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। যিনি কি না বরের ঘনিষ্ঠ গুরুজন হিসেবে বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন।’

অভীকের রগড় মেশানো কথায় হতবাক হয়ে গেল তাহিয়া। বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করল,
‘বিয়েতে স্যার উপস্থিত ছিলেন! আমার সাথে দেখা হলো না কেন!’

অভীক রগড় বজায় রেখেই বলল,
‘ আপনি আপনার বেডরুমে কাঁপা-কাঁপি, ঘামাঘামিতে ব্যস্ত ছিলেন বলে আমার পক্ষীয় অতিথিরা আপনার সাথে দেখা না করেই ফিরে গেছেন। তবে স্যার দোয়া দিয়ে গেছেন আমাকে, আমি ফরওয়ার্ড করে দিয়েছি।’

জীবনে প্রথমবার বিয়ে করছি, তাও অনাকাঙ্ক্ষিত একজনকে। অস্বস্তি তো হবেই। তাই বলে সে নিয়ে ঠাট্টা করতে হবে! সোজাসাপটা উত্তর দিলেই তো হয়। কলেজে তো স্যার মেপে মেপে কথা বলেন। কিছু জিজ্ঞেস করলে, নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের মতো এক কথায় উত্তর দেন। কিন্তু বিয়ের পর থেকে আমার একটা কথার উত্তরে হাজার টা কথা শুনিয়ে দেন। বদ লোক একটা! এমন ভাবনার বিচরণ তাহিয়ার মাথায়।

তাহিয়াকে রাগ রাগ ভঙ্গিমায় ফোঁসফোঁস করতে দেখে অভীক মূল কথায় ফিরে গেল,
‘স্যারকে কি নিষেধ করে দিব?’

এই অস্বস্তিপূর্ণ মনে অভীকের সাথে হানিমুনে যাওয়া সম্ভব নয় তাহিয়ার পক্ষে। সে ইতিবাচক মাথা নাড়াল। অভীক বলল,
‘ঠিক আছে, আমি স্যারকে নিষেধ করে দিব।’

বাকি পথ কথা হলো না। সিএনজি গন্তব্যে এসে দাঁড়ালে নেমে পড়ল দু’জন। ভাড়া মিটিয়ে অভীক সময় দেখল। এগারোটা বাজতে চলেছে। তাহিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,

‘ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গিয়েছি। আপু ফোন দিয়ে বলল, তুমি একটা জিনিস দিবে আমায়, কী যেন পাওনা টাওনা। যাওয়ার সময় নিয়ে যেতে বলল। আমি চলে যাচ্ছি। কী দিবে দিয়ে দাও? ‘

হাত বাড়াল অভীক। পাওনার কথা শুনে সকালের কথা মনে পড়ল তাহিয়ার। কথা এতদূর অবধি এসে যাবে ভাবেনি সে! লজ্জায় মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম। স্যার কি জানে না, এই পাওনা যে হাতে দেয়া যায় না? জানে না বোধহয়, জানলে হাত বাড়াতো না। গেটের পাশে পিলারে আটকানো লাইটের ক্ষীণ আলোয় তাহিয়ার ইতস্ততভাব দেখে অভীক ভ্রু কুঁচকাল,

‘কী দিবে দাও! আমার আবার বাসায় ফিরতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

না পেরে কথা ঘুরাল তাহিয়া। মৃদুস্বরে বলল,
‘ বাসায় চলুন। মা আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন।’

থামকাল অভীক। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। আকস্মিক হেসে উঠল। সে হাসির চমৎকার শব্দ হলো। তাহিয়া আড়চোখে তাকাল। তড়িৎ দৃষ্টি নামাল, ভীষণ জ্বালাচ্ছে হাসিটা। ভ্রু কুঁচকাল। অভীকের হাসির কারণ ধরতে পারছে না সে। অভীক হাসি থামাল। ঠোঁট কামড়ে আলতো স্বরে বলল,

‘এত অবুঝ হলে হবে? বড়ো হয়েছো, বিয়ে হয়েছে। এখন কথা বলার আগে পরে ভাবতে হবে তো, না কি! তোমার অবুঝপনাকে আমি গম্ভীরভাবে নিয়ে নিলে তো তুমিই সইতে পারবে না।’

এবারও অভীকের কথার সারমর্ম ধরতে পারল না তাহিয়া। দৃষ্টি অবনত রেখেই বলল,
‘মানে!’

অভীক মনে মনে বিরক্ত হলো। মেয়েটা এত অবুঝ কেন! সব কথা বুঝিয়ে দিতে হয়। বিরক্ত সরিয়ে ধীর স্বরে বলল,
‘একসাথে থাকতে হবে বলে হানিমুনে যেতে চাইছো না, অথচ ওই অবেলায় বাসায় যেতে বলেছো! এখন বাসায় যাওয়ার মানে বুঝো?’

তাহিয়ার মিনিট খানেক সময় লাগল অভীকের কথার মানে বুঝতে। সারমর্ম বোধগম্য হতেই চোখ মুখ খিচে ধরল। অভীক হেসে বলল,
‘কিছু ব্যাপারে আন্টির মতামতের চেয়ে তোমার মতামত অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তোমার একান্ত মতামত, যাতে থাকবে না কোন চাপ, দ্বিধা, অস্বস্তি, ভয়। আমি সেই মতামতের অপেক্ষায় থাকব।’
থেমে বলল,
‘আর একটু সহজ হও, একটু মানুষিকভাবে বড়ো হও। এখন বাসায় যাও।’

‘টিউবলাইব’ খ্যাত মস্তিষ্কের অধিকারী তাহিয়ার এই কথার সারমর্ম বোধগম্য হলো না। সারমর্ম বের করতে করতে বিল্ডিংয়ের দিকে পা বাড়াল। বিল্ডিং সামনে খালি জায়গা, আশপাশের কোন মানুষ নেই। আজকাল এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যায় মানুষ! না কি সন্ধ্যা হলেই ঘরে ঢুকে পড়ে। কেমন ভূতড়ে জায়গা লাগছে অন্ধকারে। গেটে দারোয়ান ও নেই। গেটের কাছে পিলারে একটা লাইট জ্বালানো, সেটার আলো বিল্ডিং অবধি যাচ্ছে না। চারদিক চোখ বুলিয়ে অভীক বলল,
‘ভয় পাবে? আমি বাসা অবধি দিয়ে আসব?’

থেমে গেল তাহিয়া। পিছনে না ফিরে মাথা নাড়ল । অভীক বলল,
‘ফোনের ফ্ল্যাশ অন করো। আমি দাঁড়িয়ে আছি। বাসায় গিয়ে কল দিবে।’

তাহিয়া ফ্ল্যাশ অন করে পা বাড়াল। তাহিয়ার পক্ষ থেকে বার্তা আসা না অবধি গেটেই দাঁড়িয়ে রইল অভীক। বাসায় গিয়ে ম্যাসেজ করল তাহিয়া। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাড়ির পথে রওনা হলো অভীক।

চলবে….

অশান্ত মনে লিখেছি। খাপছাড়া লেখা আর অগণিত ভুল, ফলাফলের খাতায় পড়তে পারে। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কোন ভুল পেলে ইনবক্সে বলবেন, আমি ঠিক করে নিব। ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here