#তোমার রাঙা উঠানে
#writer:Alo Rahman
#part:6
.
.
.
আজ মা-বাবার মৃত্যুবার্ষিকী।সকাল থেকেই নিজের ঘরের বারান্দায় বসে আছি।প্রতি বছর এই দিনটায় আমি একা একা বসে থাকি।আমার কিছুই ভালো লাগে না।এই সেই দিন যে দিনটা আমার কাছ থেকে আমার শৈশব কেড়ে নিয়েছিল।আমার শিশুকালের সব শখ,আহ্লাদ হারিয়ে গিয়েছিল।কেন এমন হলো?আমার কি আর পাঁচজনের মতো মা বাবার সাথে জেদ করার অধিকার ছিল না?আমার মাঝে মাঝে ভাবতে ইচ্ছা করে সবকিছুই শুধু স্বপ্ন।আমি ঘুম ভেঙে দেখবো আমার মা-বাবা আমার পাশেই আছে।আর আমি এখনও সেই ক্লাস ওয়ানের বাচ্চা।
দুচোখ বন্ধ করে বসে আছি।চোখ থেকে পানি ঝরছে।চোখের সামনে ভাসছে মা আর বাবার সেই হাসিমুখ।আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।মা-বাবা থাকলে আমাকে কখনো এতিম শব্দটা শুনতে হতো না।এতিম বলে সব মুখ বুজে মেনে নিতে হতো না।নিজের কথাগুলো বলার মতো উপায় থাকতো আমার।
চোখ বুজে এসবই ভাবছিলাম।হঠাৎ মাথায় কারোর স্পর্শ পেয়ে চোখ খুললাম।শুভ্র ভাই আমার পাশে এসে বসেছেন।আমি চোখ মুছে বললাম,
“শুভ্র ভাই,আপনি কিছু বলবেন?”
.
শুভ্র ভাই বললেন,
“সকাল থেকে যে না খেয়ে বসে আছিস।খাবি না?”
.
“খেতে ইচ্ছা করছে না,শুভ্র ভাই।”
.
“কাঁদতে ইচ্ছা করছে?”
.
আমি না সূচক মাথা নাড়লাম।শুভ্র ভাই আবার বললেন,
“খুব বেশি কান্না পেলে সেটা আটকে রাখা উচিত না।”
.
“আমার কান্না আসে না,শুভ্র ভাই।”
.
“আচ্ছা,ঠিক আছে।বেরোতে হবে তো।অনাথ আশ্রমে যাবি না?”
.
“হুম।”
.
“রেডি হ।আমরা নিচে অপেক্ষা করছি।”
.
শুভ্র ভাই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।এটা শুভ্র ভাই ছোট থেকেই করছেন।আমাকে যতই বকাবকি করুন,যতই ধমক দিন না কেন,আজকের দিনে উনি কখনো আমার সাথে রাগারাগি করেন না।
.
আমি উঠে দাঁড়ালাম।কোনোরকমে জামা বদলে নিচে নেমে এলাম।ফুল মা আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন।আমার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলেন।আমার চুল বেঁধে দিতে দিতে বললেন,
“আমার মেয়েটা যে সকালে কিছু খায় নি সে খেয়াল কারো আছে?বিন্তি,খাবার নিয়ে আয় তো।”
.
আমি বাধা দিয়ে বললাম,
“না,ফুল মা।আমি খাব না।”
.
“তাহলে তো আমারও খাওয়া হবে না।আমিও যে না খেয়ে বসে আছি সেটাও তো কেউ খেয়াল করে নি।কেন করবে?আমি তো আর তার নিজের মা না।”
.
ফুল মার কথাটা বুকে গিয়ে বিঁধল আমার।ফুল মা না খেয়ে আছে।আর আমি স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের কথা ভাবছি।এতটা স্বার্থপর আমি কি করে হতে পারি?
আমি হঠাৎ ফুল মাকে জড়িয়ে ধরলাম।কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
“সরি,ফুল মা।ভুল হয়ে গেছে।”
.
ফুল মায়ের চোখেও পানি।উনি চোখ মুছতে মুছতে বললেন,
“হয়েছে হয়েছে।ঢং করতে হবে না।”
.
বিন্তি খাবারের প্লেটটা এগিয়ে দিলো।ফুল মা আমাকে খাইয়ে দিতে শুরু করলেন।আমার চোখ ভিজে আসছে আবার।এই মানুষগুলো না থাকলে আমার কি হতো কে জানে!?
.
আমরা অনাথ আশ্রমে গিয়ে পৌঁছালাম দুপুর বেলা।ফুল বাবা একটা মিলাদের ব্যবস্থা করেছিলেন।সেটা শেষ হওয়ার পর সব বাচ্চাদের খাওয়ানোর পালা।
সবাই হৈহল্লা করে খেতে বসছে।আমি এক কোণে বসে সেটা দেখছি।শুভ্র ভাই আমার পাশে এসে বসলেন।আমি একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে ফেললাম।শুভ্র ভাই জিঙ্গেস করলেন,
“তুই ঠিক আছিস?”
.
“হ্যাঁ।”
.
“মন কি একটু ভালো হয়েছে?”
.
আমি ছোট করে উত্তর দিলাম,
“হুম।”
.
“ঠিক তো?”
.
আমি এবার উনার দিকে তাকালাম।বললাম,
“আপনি এতো চিন্তা করছেন কেন?”
.
“চিন্তা না করে উপায় আছে?যেদিন থেকে তুই আমাদের বাড়িতে এসেছিস সবাইকে শুধু চিন্তায়ই ফেলছিস।”
.
আমি হাসলাম।
“আর তো মাত্র কটাদিন।তারপর আর কাউকে চিন্তায় ফেলবো না।”
.
আমার চোখে আবার পানি আসতে চাইছে।কিন্তু আমি সেটা দমিয়ে রেখেছি।কারণ শুভ্র ভাইয়ের সামনে আমি কাঁদতে চাই না।
একটা বাচ্চা মেয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো।আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“আপু,তোমরা খুব ভালো।আমাদের এতো আদর করে কেউ কখনো খাওয়ায় না।আমাদের মা-বাবা নেই তো।”
.
আমি হেসে বললাম,
“আমারও নেই।”
.
বাচ্চা মেয়েটি অবাক হয়ে বলল,
“তাহলে তুমি আমাদের এখানে কেন থাকো না?”
.
“কারণ আমার ফুল মা আছে।”
.
“ইশ!আমার যদি ফুল মা থাকতো!”
.
বাচ্চাটার কথা শুনে আমার আরও মন খারাপ হয়ে গেল।সত্যিই তো।এই বাচ্চাগুলোর জীবন তো আমার থেকেও কষ্টের।কিন্তু তবুও ওরা হাসিমুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে।তাহলে আমি কেন পারবো না?আমিও পারবো,নিশ্চয়ই পারবো।
.
অনাথ আশ্রম থেকে বেরিয়েছি বিকেলের দিকে।সবাই বাড়ির দিকে গেলেও আমি আর শুভ্র ভাই এসেছি নদীর পাড়ে।উনি আমাকে কেন এখানে নিয়ে এসেছেন বুঝতে পারছি না।আমি ভ্রু কুঁচকে উনার দিকে তাকিয়ে আছি।উনার আচরণ কেমন যেন সন্দেহজনক মনে হচ্ছে।উনি কোনো কথাও বলছেন না।চুপচাপ দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে আছেন।পাশে যে আরেকটা মানুষ আছে সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই।
আমি হুট করে বলে উঠলাম,
“নদীর দিকে কেন তাকিয়ে আছেন?আমার দিকে তাকান।দেখুন আমি কত সুন্দর।”
.
শুভ্র ভাই নিঃশব্দে হাসলেন।আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তুই সুন্দর এই ধারণা তোর কিভাবে হলো?”
.
“ওহ্!হ্যাঁ।আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমি পেত্নি সুন্দরী।”
.
শুভ্র ভাই এবার শব্দ করে হাসলেন।আমি বললাম,
“আমরা এখানে এসেছি কেন?”
.
“ঘুরতে।”
.
“পেত্নির সাথে ঘুরতে আসার কারণ?”
.
শুভ্র ভাই সে প্রশ্নের উত্তর দিলেন না।আবার চুপ হয়ে গেলেন।কিছুক্ষণ পর বললেন,
“আলো,ছেলেটাকে পছন্দ না হলে বিয়েটা করিস না।আমি জানি তোর ছেলেটাকে পছন্দ হয় নি।”
.
আমি উনার কথায় চমকে উঠলাম।আমার যে লোকটাকে পছন্দ হয়নি সেটা উনি কিভাবে জানলেন?
শুভ্র ভাই আবার বললেন,
“আলো,বাবাকে বল তুই এই বিয়েতে রাজি না।”
.
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলিলাম,
“সেটা সম্ভব নয়,শুভ্র ভাই।আমি ফুল বাবাকে কষ্ট দিতে পারবো না।এতখানি স্বার্থপর আমি হতে পারি না।”
.
“বাবা কষ্ট কেন পাবেন?তোর কাউকে পছন্দ থাকতেই পারে।”
.
“কিন্তু এই বিয়েতে অমত করে আমার লাভও তো কিছু হবে না,শুভ্র ভাই।”
.
“তোর কি সত্যিই কাউকে পছন্দ নেই,আলো?”
.
উনার প্রশ্নটা শুনে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।গলার কাছে কিছু একটা শক্ত হয়ে জট পাকিয়ে গেছে মনে হচ্ছে।চিৎকার করে না কাঁদলে এটা ঠিক হবে না।
আমার উত্তর না পেয়ে উনি আবার প্রশ্ন করলেন,
“কিরে?কথা বলছিস না কেন?”
.
আমি কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম,
“আছে।”
.
“তাহলে বাবাকে সেটা বলছিস না কেন?”
.
“কারণ ফুল বাবাকে বলে কোনো লাভ নেই।আমি যাকে চাই,সে হয়তো আমাকে চায় না।যে আমাকে চায় না তার কথা আমি ফুল বাবাকে কিভাবে বলবো?আর কিই বা বলবো?হ্যাঁ,আমি চাইলে এই বিয়েতে না করে দিতে পারি।কিন্তু তাতে লাভ?এই ছেলেটাকে না করলে,ফুল বাবা আমার জন্য আরেকজন ছেলে ঠিক করবে।আমাকে কাউকে না কাউকে বিয়ে করতেই হবে।যাকে আমি চাই তাকে তো আমি পাবো না,তাই না?তাহলে শুধু শুধু ফুল বাবাকে কষ্ট কেন দেব?”
.
“তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস,আলো।কিন্তু একটু একটু বোকাই আছিস।”
.
“বাড়ি চলুন,শুভ্র ভাই।আমার এখানে ভালো লাগছে না।”
.
কথাটা বলেই আমি হাঁটতে শুরু করলাম।শুভ্র ভাই আমার পিছু পিছু আসতে শুরু করলেন।আমার সব কেমন যেন এলোমেলো লাগছে!গুছিয়ে নিতে চাইছি।কিন্তু ফের অগোছালো হয়ে পরছে।
.
.
.
.
বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।আমি ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে ঢুকেছি।আমার রান্নাঘরে যাওয়ার কোনো দরকার ছিল না।কিন্তু তবুও এসেছি নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য।আমি রান্নাঘরে ঢুকেই চা বানাতে শুরু করলাম।বিন্তি রাতের জন্য রান্না করছিল।আমাকে বলল,
“আপা,আপনের কিছু লাগলে আমারে কন।”
.
“না,বিন্তি।তুই রান্না করছিস কর।”
.
“আপা,আপনে আজকাল মাঝে মধ্যেই রান্নাঘরে আসেন যে।”
.
“রান্না শিখতে আসি।বরকে খাওয়ানোর জন্য রান্না শিখতে হবে না?”
.
বিন্তি আমার কথা শুনে মুখ টিপে হাসলো।আমি চা বানিয়ে ড্রয়িং রুমে এলাম।ফুল বাবাকে চা দিয়ে আমি সেখানে বসে পরলাম।ফুল মা কোথা থেকে দৌড়ে এসে বললেন,
“আলো, স্বপন ফোন করেছিল।ও কাল তোকে নিয়ে এনগেজমেন্ট রিং কিনতে যেতে চায়।”
.
“এনগেজমেন্ট!?”
.
ফুল বাবা বললেন,
“হ্যাঁ,মা।দুদিন পর তোর এনগেজমেন্ট আয়োজন করছি।তোর কি কোনো আপত্তি আছে?”
.
আমি মৃদু হেসে বললাম,
“না।”
.
“আমি জানতাম তুই আপত্তি করবি না।সেই ভরসাতেই ওদের সাথে কথা বলেছি।”
.
ফুল মা বললেন,
“তাহলে কাল বিকেলে যাবি তো?”
.
“হ্যাঁ,যাব।”
.
শুভ্র ভাই বলে উঠলেন,
“বিয়ের আগে ছেলে মেয়ের এতো ঘোরাঘুরি মোটেই ভালো না,মা।”
.
“কেন?ভালো না বলছিস কেন?বিয়ের আগে ওরা একজন আরেকজনকে জেনে নেবে না?”
.
আমি এবার উঠে দাঁড়ালাম।এসব কথাবার্তা আমার ভালো লাগছে না।আমি সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছিলাম।হঠাৎ মনে হলো আমার পিছু পিছু কেউ আসছে।আমি পিছনে ফিরে দেখলাম ফুল মা আসছেন।
আমি জিঙ্গেস করলাম,
“কিছু বলবে,ফুল মা?”
.
ফুল মা আমার কাছে এসে বললেন,
“আলো,তুই এই বিয়েতে মন থেকে রাজি তো?”
.
“হ্যাঁ,ফুল মা।আমি মন থেকে রাজি।”
.
“কিন্তু আমার সেরকম মনে হচ্ছে না।তোর মুখ দেখে মনে হয় তুই এই বিয়েতে খুশি না।”
.
“না,ফুল মা।তুমি অযথা চিন্তা করছ।”
.
“আমরা তোর উপর কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি না তো রে,মা?”
.
“না,ফুল মা।এসব কি বলছ?তুমি শুধু শুধু এতো ভাবছ।আমি মন থেকে রাজি।”
.
“আচ্ছা,ঠিক আছে।”
.
ফুল মা আমাকে আদর করে দিয়ে চলে গেলেন।আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।সব মায়েরাই বুঝি এমন হয়।সন্তানের মুখ দেখেই সব বুঝে ফেলেন।
.
.
আমি নিজের ঘরে বসে চুল আঁচড়াচ্ছি।হঠাৎ কোথা থেকে শুভ্র ভাই চলে এলেন।আর এসেই আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাকে টানতে টানতে ছাদে নিয়ে গেলেন।
আমি শুভ্র ভাইয়ের হাত ছাড়িয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে বললাম,
“এসব কি,শুভ্র ভাই?আপনি আমাকে ছাদে নিয়ে এলেন কেন?”
.
“তোর সাথে আমার কথা আছে।”
.
“শুনেন শুভ্র ভাই,আপনি এভাবে যখন তখন আমার হাত ধরবেন না।আমি এখন বড় হয়ে গেছি।”
.
শুভ্র ভাই এবার আমার দুই বাহু চেপে ধরলেন।দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
“আমি হাত ধরলে সমস্যা?আর ওই স্বপন সরকার গা ঘেঁষে বসলে তো কোনো সমস্যা হয় না।”
.
আমি অবাক হলাম।স্বপন সাহেব আমার গা ঘেঁষে বসেছিলেন সেটা উনি কি করে জানলেন?আমি তো বলি নি।
কিন্তু আমার অবাক হওয়ার ব্যাপারটা আমি শুভ্র ভাইকে বুঝতে দিলাম না।স্বাভাবিকভাবে বললাম,
“কি আশ্চর্য!উনি তো আমার হবু বর।”
.
শুভ্র ভাই ধমক দিয়ে বললেন,
“চুপ।অনেক হয়েছে এসব।এবার আমাকে সোজাসুজি একটা কথা বল তো।”
.
“কি কথা?”
.
শুভ্র ভাই আমার চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় বললেন,
“তুই কি আমাকে এখনও ভালোবাসিস,আলো?”
.
আমি কেঁপে উঠলাম উনার প্রশ্ন শুনে।আমার হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে।দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পাচ্ছি না।আমার চোখে পানি আসতে চাইছে।এতগুলো বছর পর এই প্রশ্নের মানে কি?শুভ্র ভাই আসলে কি চাইছেন?আমাকে কেন এভাবে দূর্বল করে দিচ্ছেন উনি?
.
#চলবে…….