#তোমার রাঙা উঠানে
#writer:Alo Rahman
#part:7
.
.
.
আমি শুভ্র ভাইকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ছাদের একপাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।শুভ্র ভাই আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন।বললেন,
“আলো,প্লিজ বল।চুপ করে থাকিস না।”
.
উনার আকুলতা ভরা কন্ঠ আমার বুকে গিয়ে বিঁধলো।কিন্তু এখন আমার দূর্বল হলে চলবে না।আমি নিজেকে যথাসাধ্য শান্ত রেখে উত্তর দিলাম,
“এতবছর পর এই প্রশ্নের মানে কি,শুভ্র ভাই?”
.
“মানে আছে,আলো।মানে আছে।তুই শুধু একবার আমাকে বল।”
.
“শুভ্র ভাই,এখন এসব কথার কোনো…কোনো মানে হয় না।আপনি ভুলে যাচ্ছেন দুদিন পর আমার এনগেজমেন্ট।”
.
আমি চলে আসছিলাম।শুভ্র ভাই আমার পথ আটকে দাঁড়িয়ে বললেন,
“এভাবে চলে যাবি না,আলো।বল।তোকে বলতেই হবে।”
.
আমি হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠলাম,
“কি বলবো আমি?কি বলবো?যা বলার সেটা তো আট বছর আগেই বলে দিয়েছি।সেদিন তো আপনি এভাবে জানতে চান নি,শুভ্র ভাই।সেদিন আপনি আমার অনুভূতিগুলো হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।সব ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলেছিলেন।তাহলে এতবছর পর আবার কেন জানতে এসেছেন?”
.
“আলো,আমি মানছি আমি তোর সাথে নিষ্ঠুরতা করেছিলাম।কিন্তু তার পিছনে কারণ ছিল।আমি আসলে তোর….”
.
আমি উনাকে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে বললাম,
“থামুন আপনি।আমি কিচ্ছু জানতে চাই না।আমি এই আট বছরে নিজেকে একটু একটু করে গুছিয়ে নিয়েছি,শুভ্র ভাই।দয়া করে আমাকে আর এলোমেলো করে দেবেন না।প্লিজ,আমাকে একটু দয়া করুন।”
.
আমি দৌড়ে শুভ্র ভাইয়ের সামনে থেকে চলে এলাম।ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলাম।আজ আমি অনেক কাঁদবো,অনেক।
.
.
.
.
সাত সকালে ঘুম থেকে উঠেই রান্নাঘরে এসেছি।আজও উদ্দেশ্য হলো নাস্তা বানানো।আমি সর্বান্তকরনে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছি।কাল রাতের ঘটনাটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছি।
রান্না করছিলাম।বিন্তি আর ফুল মা আমাকে সাহায্য করছিল।
হঠাৎ রান্নাঘরে শুভ্র ভাই এলেন।ফুল মাকে বললেন,
“মা,চা দাও।”
.
ফুল মা আমাকে বললেন,
“আলো,একটু চা বানিয়ে দে না মা।”
.
শুভ্র ভাই বলে উঠলেন,
“ও কেন,মা?তুমি বানাও না।”
.
“কি আশ্চর্য শুভ্র,ও বানালে কি সমস্যা?”
.
শুভ্র ভাই কিছু বললেন না।ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করছিলেন।বিন্তি আমাকে বলল,
“আপা,আপনের দেখি বররে রান্না কইরা খাওয়ানের খুব শখ।রোজই রান্নাঘরে চইলা আসেন রান্না শিখতে।”
.
শুভ্র ভাই বলে উঠলেন,
“রান্না শিখে কি লাভ,বিন্তি?বিয়েটা হয় কিনা তাই দেখ আগে।”
.
ফুল মা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
“এসব কি বলছিস?বিয়েটা হয় কিনা মানে?বিয়ে হবে না কেন?”
.
“মা,ভবিষ্যতে কি হবে সেটা তো আগে থেকে বলা যায় না।ধরো,এমন কিছু ঘটলো যাতে ওর এই বিয়েটা ভেঙে গেল।”
.
“এসব বাজে কথা বলবি না,শুভ্র।যা এখান থেকে।”
.
উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“এই যে ঢঙীকন্যা,দেখিস।আজ যেন এনগেজমেন্ট রিং কেনার পর তোকে আবার মাঝ রাস্তায় ফেলে রেখে না যায়।আমি কিন্তু আজ তোকে উদ্ধার করতে যেতে পারবো না।”
.
কথাটা বলে উনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।আমি উনার কোনো কথার মানে বুঝতে পারছি না।আমার মনে হচ্ছে,শুভ্র ভাই আমার প্রেমে পরেছে।আর এই বিয়েটা হোক সেটা উনি চাইছেন না।কিন্তু আমার মনে হওয়া যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে সেটা উনি স্পষ্ট করে বলছেন না কেন?কি চাইছেন উনি?অদ্ভুত!
.
নাস্তার টেবিলে বসে আছি।ফুল বাবা আমাকে বললেন,
“আলো,বলছি যে কাল তোর ফুল মার সাথে গিয়ে এনগেজমেন্টের কেনাকাটা সেরে ফেলিস।”
.
“ঠিক আছে,ফুল বাবা।”
.
দাদীমনি বললেন,
“আজ বিকালে কি স্বপন তোকে নিতে আসবে?”
.
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।দাদীমনি বললেন,
“ছেলেটা বোধহয় খুব দায়িত্ববান।তাই না,আলো?”
.
শুভ্র ভাই বলে উঠলেন,
“হ্যাঁ,দাদীমনি।খুব দায়িত্ববান।এতটাই দায়িত্ববান যে রাতের বেলা নিজের হবু বউকে রাস্তায় একা ফেলে চলে যায়।তাহলেই বোঝ?কতটা দায়িত্ববান?”
.
কথা শেষ করে শুভ্র ভাই উঠে গেলেন।ফুল বাবা জিঙ্গেস করলেন,
“কিরে আলো?স্বপন তোকে একা ফেলে চলে গিয়েছিল?”
.
“না মানে,উনার জরুরি কল এসেছিল তাই চলে যেতে হয়েছিল।”
.
ফুল বাবা ভাবুক হয়ে পরলেন।উনার কপালে চিন্তার ভাঁজ পরলো।
.
.
.
.
বিকালবেলা নিজের ঘর গোছাচ্ছিলাম।ফুল মা ছুটে এসে বললেন,
“আলো,তুই এখনও রেডি হস নি কেন?স্বপন তো এসে গেছে।”
.
“এখনই রেডি হচ্ছি।”
.
“তাড়াতাড়ি কর,মা।এক কাজ কর,গোলাপি জামদানিটা পর।”
.
আমি শাড়িটা বের করলাম।ফুল মা বললেন,
“আমার ঝুমকা জোড়া পরবি,আলো?নিয়ে আসবো?”
.
“নিয়ে এসো।”
.
আমি আজও খুব যত্ন করে সাজলাম।আজ চুল খোলা রাখিনি।চুলে খোঁপা বেঁধেছি।আমি রেডি হয়ে নিচে নেমে গেলাম।দেখলাম স্বপন সাহেব ফুল বাবার সাথে গল্প করছিলেন।আমাকে নামতে দেখে উঠে দাঁড়ালেন।ফুল বাবাকে বলবেন,
“তাহলে যাই,আংকেল।ইতোমধ্যেই দেরি হয়ে গেছে।”
.
“ঠিক আছে,সাবধানে যেও।”
.
আমরা বেরিয়ে এলাম।স্বপন সাহেবের বিশাল গাড়িতে উঠে বসলাম।গাড়ির পিছনে অনেক জায়গা।কিন্তু স্বপন সাহেব বসেছেন আমার গা ঘেঁষে।আমার ভীষণ অস্বস্তি লাগছে।আমি প্রাণপণে সেটা দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছি।একবার ইচ্ছা হলো মুখের উপর উনাকে সরে বসতে বলি।কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে।তাই বললাম না।
আমি অস্বস্তি কমানোর জন্য অন্যদিকে মন দেওয়ার চেষ্টা করলাম।মুখে হাসি টানার চেষ্টা করে বললাম,
“আপনার আজ কোনো জরুরি কাজ নেই তো?”
.
“আপাতত নেই।তবে হঠাৎ কাজ পরে যেতে পারে।”
.
“কাজ পরে গেলে কি আবার আমাকে একা ফেলে চলে যাবেন?”
.
“যদি যেতে হয় তাহলে যাবো।শোনো আলো,সব পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখতে হবে তোমাকে।একা একা চলাফেরা করার অভ্যাস থাকা ভালো।”
.
আমি কিছু বললাম না।স্বপন সাহেব জিঙ্গেস করলেন,
“তুমি গোল্ড রিং কিনতে চাও?নাকি ডায়মন্ড?”
.
স্বপন সাহেব কথা বলতে বলতে উনার একটা হাত আমার হাতের উপর তুলে দিয়েছেন।আমার প্রচুর বিরক্ত লাগছে এবার।
আমি কোনোমতে বললাম,
“আপনার যা ইচ্ছা।”
.
দোকানের সামনে এসে গাড়ি থেকে নামতেই হাফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি।মনে হচ্ছে,এতক্ষণ আমি বন্দী কারাগারে দম বন্ধ হয়ে পরেছিলাম।
দোকানে গিয়ে স্বপন সাহেব আমাকে আংটি পছন্দ করতে বললেন।আমার গয়নার প্রতি তেমন আগ্রহ কোনোকালেই ছিল না।তবুও একটা আংটি আমি পছন্দ করলাম।স্বপন সাহেব আংটিটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন।তারপর মুখ ভোঁতা করে বললেন,
“এটা তো অনেক কমদামী আংটি।এটা পছন্দ হলো তোমার?”
.
“দামে কি যায় আসে?এটা দেখতে তো বেশ সুন্দর।”
.
“দামে অবশ্যই যায় আসে।তুমি স্বপন সরকারের বউ হতে চলেছ,আলো।এখন এত সস্তার জিনিস পছন্দ করলে চলবে না।আমার তো একটা প্রেস্টিজের ব্যাপার আছে।”
.
আমি চুপ করে গেলাম।স্বপন সাহেব অনেক দামী একটা আংটি কিনলেন।দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম।আবার স্বপন সাহেবের সাথে গাড়িতে যেতে হবে।কথাটা ভাবতেই আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।আবার এতটা রাস্তা কি করে সহ্য করবো এই লোকটাকে?
গাড়ির দিকে এগোতেই কোথা থেকে যেন শুভ্র ভাই এসে সামনে দাঁড়ালেন।আমি বিস্ময় নিয়ে বললাম,
“শুভ্র ভাই!আপনি!?”
.
“আমার সাথে চল।”
.
“কোথায়?”
.
“কোথায় আবার?বাড়ি।”
.
স্বপন সাহেব বললেন,
“শুভ্র সাহেব,আমি আলোকে বাড়িতেই পৌঁছে দিতেই যাচ্ছি।আপনি চাইলে আমাদের সাথে আসতে পারেন।”
.
শুভ্র ভাই হাসিমুখে বললেন,
“না,ধন্যবাদ।আমি আপনার গাড়িতে যাব না।আর আলোও যাবে না।”
.
স্বপন সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“আলো যাবে কিনা সেটা আপনি ঠিক করে দেবেন?আলো তাই করবে যেটা আমি বলবো।আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন ওর সাথে আমার সম্পর্কটা কি।”
.
“সম্পর্ক এখনো হয় নি।আগে হোক।তারপর ও আপনার কথা শুনবে।”
.
কথাটা বলে শুভ্র ভাই আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে গেলেন।আমি পিছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারছি স্বপন সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন।
.
.
.
রিকশায় পাশাপাশি বসে আছি আমি আর শুভ্র ভাই।রিকশা বেশ জোরে চলছে।বাতাসের তীব্রতায় আমার ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে।আমি গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলাম,
“এসব আসলে হচ্ছেটা কি?”
.
শুভ্র ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কোনসব?”
.
“এই যে,আপনি আমাকে ওভাবে নিয়ে এলেন।স্বপন সাহেব কি ভাবলেন বলুন তো?”
.
“যা খুশি ভাবুক,আমার তাতে কিছু যায় আসে না।”
.
“শুভ্র ভাই,আপনি আসলে কি চাইছেন?”
.
“কি আবার চাইবো?তোর বিয়ে দিয়ে তোকে বিদায় করতে চাইছি।”
.
আমি আবার দ্বিধায় পরে গেলাম।আশ্চর্য মানুষ শুভ্র ভাই।উনার কোন কথা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা সেটা আমি ধরতে পারছি না।কাল রাতের কথা আর এইমাত্র বলা কথার মধ্যে কোনো মিল পাচ্ছি না।উনি এতো কনফিউশন কেন তৈরি করছেন কে জানে!
.
বাড়িতে ঢুকেই দেখলাম সবাই থমথমে মুখে বসে আছে।মনে হচ্ছে সাংঘাতিক কিছু হয়েছে।কিন্তু এইটুকু সময়ের মধ্যে কি এমন হলো আমি সেটাই বুঝতে পারছি না।
ফুল বাবা গম্ভীর মুখে বললেন,
“আমার সামনে বস তোরা দুজন।”
.
আমি আর শুভ্র ভাই একজন আরেকজনের দিকে একবার তাকালাম।তারপর ফুল বাবার সামনে বসলাম।ফুল বাবা বললেন,
“এসব আমি কি শুনলাম,শুভ্র?”
.
শুভ্র ভাই বললেন,
“তুমি কি শুনেছ সেটা না বললে কিভাবে বুঝব,বাবা?”
.
“তুমি আলোকে কোথায় পেলে,শুভ্র?”
.
“ও যেখানে গিয়েছিল সেখানে পেয়েছি।”
.
“তুমি সেখানে কেন গিয়েছিলে?”
.
“আলোকে নিতে গিয়েছিলাম।”
.
“বেশ,সেটা মেনে নিলাম।কিন্তু তুমি নাকি স্বপনকে অপমান করেছ?”
.
আমি এবার বিস্ফারিত চোখে ফুল বাবার দিকে তাকালাম।এই স্বপন নামক লোকটা তো খুব সাংঘাতিক।ফুল বাবাকে ফোন করে এসব বলেছে!?
.
#চলবে…….