❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[২১]
-”মেধাকে কিডন্যাপ কেন করেছিস? কোন স্বার্থে করেছিস? আর জানতে চাই না। ইচ্ছে হলে মেরে লা’শ ভাসিয়ে দিস নয়তো মেরে গুম করে দিস। আর খোঁজ নিবো না, জানতেও চাইব না। সেই সঙ্গে এটাও ভুলে যাস আদিত্য তোর কাছে মৃত। আর তুই নিজের হাতে তোর ভাইকে মে’রে ফেলেছিস।”
-”শুনবে না কেন করেছি? ”
-”ইচ্ছে নেই।”
আদিত্য তার কথা শেষ করে চলে যাচ্ছিল। তার কিছু বলার নেই। কী বা বলবে খুঁজেই পাচ্ছে না। ভীষণ এলোমেলো সে।
একদিকে মেধা অন্যদিকে ভাইয়ের প্রতারণা। এসব মিলিয়ে বুক সহ্যহীনভাবে জ্বলছে, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। হওয়াটাই বুঝি স্বাভাবিক! কারণ বুকের স্থান দেওয়া মানুষগুলো যখন বুকে আঘাত করে তখন ভীষণ লাগে।এতটা লাগে যা বলে প্রকাশ করার মতো না। ঠিক যেভাবে আমান তাকে দিয়েছে। তার’ই চোখের সামনে থেকে মেধাকে নিয়ে গিয়ে আঁটকে রেখেছে।
যেটা ছিলো ওর কল্পনাতীত। অহেতুক কষ্ট দিচ্ছে ওদেরকে। মনগড়া কথার ছলে মিথ্যাের উপর মিথ্যে বলে ধোঁকা দিয়ে গেছে প্রতিনিয়ত।যেটা সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে ওকে। এমনকি স্বার্থের বশে ভালো মন্দের তফাৎ দেখে নি আমান।
একবারো ভাবি মা ও ভাইয়ের কথা। ভাবে নি তিলতিল করে গড়া ওদের পরিবারের সন্মানের কথা। তার বিবেক বাঁধে নি এতিম মেয়েটার সঙ্গে এমন কিছু করতে। সেও তো ভাই বলে বিশ্বাস করে তার সঙ্গে গিয়েছিলো। অথচ আমান…..! আজ একথা বলতেই হচ্ছে, আমান সত্যিই না ভালো ভাই, আর না ভালো ছেলে, আর না ভালো একজন মানুষ। সবদিক থেকে সে শূন্যের কোঠায়। সেই সঙ্গে বিশ্বাসেরও যোগ্য না। এসব ভেবে আদিত্য আমানের কথা উপেক্ষা করে চোখ মুছে পা বাড়াতেই শুনতে পেলো,
-”দেড় কোটি টাকা ঋণ করে ফেলেছি আমি। ঠিকই শুনেছো দেড় কোটি টাকা!”
একথা শুনতেই আদিত্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। সে হতবাক হয়ে ঘুরে তাকালো আমানের দিকে। আমান ততক্ষণে উঠে মেঝেতে হেলান দিয়ে বসেছে। তার দৃষ্টি সামনে পড়ে থাকা কাঁচের দিকে। আদিত্যের চোখের দিকে তাকানোর সাহস ওর নেই। তাই দৃষ্টি নত করেই বলতে লাগল,
-”এত টাকার ঋণ থেকে মুক্তির পথ জানা নেই আমার। দিনে দিনে এতগুলো টাকা ঋণ করে ফেলেছি। এই টাকার জন্যই নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।উঠতে বসতে
পাওনাদারীদের কথা শুনতে হচ্ছে। ‘আমি নেশাখোর ‘একথা মানতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই আমার। নেহাৎ মজার ছলে এক কী দু’দিন নেশা করতাম আগে।কিন্তু এটা কীভাবে যেনো খুব
প্রিয় হয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়লাম এতে। এ
নেশারঝোঁক ধীরে তীব্রমাত্রায় বাড়তে থাকলো। পূর্বে হাজার
টাকার নেশাতে হতো এখন সেটা লাখ টাকায় নেমেছে। নেশা
খোর নেশা নিবেই, এটা চিন্তা করে যার থেকে নিতাম দ্বিগুন দাম নিতো আমার থেকে। নেশা উঠলে কাটা মুরগির মতো ছটফট করতাম তখন মাথা কাজ করতো না। তার নিধারিত
দামেই রাজি হয়ে যেতাম। কখনো কখনো বাবা মায়ের সঙ্গে অশান্তি করে, টাকা চুরি করেও, নেশা করতে হয়েছে। বাধ্য হয়েছি করেছি। যখন তুমি নেশার কথা জেনে গেলে তখন আমার হাতে আর কিছু করার ছিলো না। তোমার কথা না শুনাতে তুমি কথা বলা বন্ধ করে দিলে। বন্ধুরা একথা জেনে বুদ্ধি দিলো একনেশা কাটাতে আরেক নেশার সাহায্য নিতে। পরে মেয়ে…! তুমি এটাও জেনে গেলে। আমার মুখ দেখাও বন্ধ করে দিলে। কিন্তু আমি সত্যি বলছি ভাইয়া, আমি বহু বার চেষ্টা করেছি। তবে ব্যর্থ হয়েছি। তাছাড়া, ‘ ভালো হয়ে যাবো’ বললেই তো আর একটা নেশাখোর ভালো হতে পারে না। হঠাৎ নেশা ছাড়া তার পক্ষে সম্ভবও হয়ে ওঠে না। কারণ যখন নেশা উঠে তখন আমি নিজের মধ্যে থাকি না। মাথাতে কাজ করে না। সবকিছু তুচ্ছ মনে হয়। মনে হয়, যে কোনো মূল্যে আমার নেশাদ্রব্য চাই-ই চাই। নেশায় জীবন। আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। আর বাকিতে খেতে খেতে এত টাকা ঋণ হয়ে গেছে৷ এখন টাকা না দিলে সেটাও আর দিচ্ছে না। তুমি আর বাবা এমনি এমনি তো আর টাকা আমাকে দিতে না। অশান্তি করে যা পেতাম তাতেও কাজে আসতো না। তাই
মেধাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে মোটা অঙ্কের কিছু টাকা হাতাতে চেয়েছিলাম। যদিও মেধার ক্ষতির চিন্তা ভাবনাতেও ছিলো না আমার। আমারও তো বোন হয় তাই না? তাছাড়া এই কাজ বাইরের কারোর সঙ্গে করতে গেলে খুব রিক্স হয়ে যেতো। পুলিশের ঝামেলা পোহাতে হতো। এসব ভেবে চিন্তে বন্ধুরা বললো মেধাকে কিডন্যাপ করা সবচেয়ে ভালো হবে। টাকা হাতে পেয়ে গেলে পরে তোমাকে জানালে তুমিও মেনে নিবে। আমিও তো জানি তুমি আমাকে খুব ভালোবাসে। তাই এই কথা ভালো ভেবে ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
-”ভালোবাসার মূল্য এত দারুণভাবে শোধ করলি?”
-”ভাইয়া কষ্ট পেও না। আর কখনো এমন করবো না। বিশ্বাস করো, নিরুপমা হয়ে একাজ করতে বাধ্য হয়েছি। প্লিজ মাফ করো আমাকে। তোমার পায়ে পড়ি ভাইয়া, বাঁচাও আমাকে।
বাঁচতে চাই আমি। আমি, আমি এক্ষুণি তুষারকে বলে দিচ্ছি মেধাকে বাসায় পৌঁছে দিতে। তুমি চিন্তা কোরো না, মেধা এই ঠিক আধাঘন্টার মধ্যে বাসায় পৌঁছে যাবে।”
-”তাই?”
-”মেধা আমার বন্ধুর বাসায় আছে। দাঁড়াও ফোন দিচ্ছি।”
-”তোর কি মনে হয়? তোর বন্ধুর বাসায় থাকলে এখানে আর এক মুহূর্ত থাকতাম আমি?”
-” ম মানে?”
-” মানে তোর বিশ্বস্ত বন্ধু তোর উপরে উল্টো চাল চেলেছে।
সে মেধাকে নিয়ে ঢাকার বাইরে চলে গেছে। তোর বিশ্বাসের ধার সে ধারে নি। এত কথা জানি না, শুধু জানি যদি আমার মেধার শরীরে সামান্য একটু আচঁড় লাগে তোদের কাউকেই আস্ত রাখবো না আমি, কাউকে না।”
-”ভাইয়া তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। ভ ভাইয়া …!”
আমান কথা শেষ করতেই আদিত্য দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো।
ভুলেও আর পিছু ফিরে তাকালো না। কথা বলা তো দূর। ওর
যাওয়া দেখে আমান তাকে ডাকতেই থাকলো। তবে আদিত্য পিছু ফিরেও তাকালো না। সীমা বেগম থম মেরে ড্রয়িংরুমেই
বসে ছিলেন। উনি সব সত্য আদিত্যের মুখে শুনতে চান। কী হয়েছে, সবটা জানা জরুরি। আদিত্যকে নামতে দেখে উনি কিছু জিজ্ঞাসা করতে উদ্যত হলেন, তার আগেই আদিত্যের ফোনে কল আসলো। আদিত্য কলটা রিসিভ করে চুপ থেকে
অপর পাশের ব্যক্তির কথা শুনে দৌড়ে বেরিয়ে পড়লো। ওর যাওয়া দেখে সীমা বেগম হতবাক তাকিয়ে রইলেন। ওদিকে
আমান ফোন হাতে নিয়ে তুষারকে কল দিতেই আছে। কিন্তু সে যতবারই কল দিচ্ছে ফোন সুইচ অফ বলছে। তার মানে আদিত্য যা বলছে সব সত্যি? তবে তুষার মেধাকে নিয়ে…? আমান আর ভাবতে পারলো না। সে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। এখন তার নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃণা হচ্ছে। তুষার এমনিতেই মেয়েবাজ ছেলে। যদি মেধার ক্ষতি করে ফেলে? একথা ভেবে আমানের মাথাটা ভনভন করে ঘুরতে লাগলো।
চোখের পাতায় ভেসে উঠলো মেধার মায়াবী মুখশ্রী। কানে বেজে উঠলো তার খিলখিল করে হাসার শব্দ। আমান আর ভাবতে পারলো না বহুকষ্টে উঠে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে।
বিপদের সময় ভীষণ দীর্ঘ হয়। হাতে ঠেলেও যেনো পার করা যায় না। ঘড়ির কাঁটা চলতে চলতে রাত পেরিয়ে গেছে। কিন্তু
এখনো কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। সীমা বেগম ছেলেদের ফেরার অপেক্ষায় ড্রয়িংরুমেই বসে আছেন। নেত্র জোড়ায় জলে টইটম্বুর। মলিন মুখ। আদিত্যের বাবা বার বার বলেও উনাকে রুমে নিয়ে যেতে পারেন নি। এটাও বোঝাতে পারেন নি, উনি অসুস্থ। এমন করলে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বেন।
এভাবে ভোর হলো, সকাল হলো, ধীরে ধীরে বেলাও গড়াতে
থাকলো। কাজের বুয়া এসে সকল কাজ সেরে, নাস্তা বানিয়ে চলেও গেল। নাস্তা পড়ে রইলো টেবিলের উপরেই। না আছে কারো খাওয়া ইচ্ছে আর না কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার তাড়াহুড়ো।
সীমা বেগম সোফাতে বসে নিজের ভাবনার মগ্ন। তখন মনে হলো বাসায় কারো গাড়ি ঢুকেছে। উনি চটজলদি উঠে দ্রুত দরজার কাছে দাঁড়াতেই কেউ হামলে পড়লো উনার বুকের উপর। মেধাকে দেখে উনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। খুব শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে পরক্ষণেই মেধার মুখে একের পর এক দিতে থাকলেন স্নেহের পরশ। আদিত্যের বাবা বের হয়ে এই দৃশ্য দেখে এগিয়ে এলেন। ছলছল নেত্রে তাকিয়ে মেধার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তখন আদিত্য উনাদের পাশ কাটিয়ে উপরে চলে গেল। না টু শব্দ করলো আর না কাউকে কিছু বলার সুযোগটুকু দিলো। সীমা বেগম মেধাকে বসিয়ে পানি নিয়ে নিয়ে আসতেই আদিত্যকে নিচে নামতে দেখা গেল। তার হাতে কালো রঙের একটা ফাইল। আদিত্য নিচে নেমে সরাসরি ওর মায়ের হাতে ফাইলটা দিয়ে বলল,
-”আমি মেধাকে নিয়ে চলে যাচ্ছি। আর এক মুহূর্ত থাকাও আমার পক্ষে সময় নয়। এই ফাইলটা আমানকে দিয়ে দিও, আসছি।”
সীমা বেগম প্রত্যুত্তরে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলেন না। আদিত্য মেধার হাতটা শক্ত ধরে ধরে হাঁটতে গেলে মেধা চট করে দাঁড়িয়ে গেল। না বোধক মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ যাবে না সে। তখন আদিত্য তার মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
-”যদি এই মুহূর্তে আমার সঙ্গে না যাও তবে চিরতরে হারাবে আমায়। এবার সিদ্ধান্ত তোমার।”
To be continue………..!!