❝মোহ মেঘের আলাপন ❞ লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো” [০৯]

0
355

❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[০৯]

-”আম্মু গ্রাম থেকে ফিরলে আবার বিয়ের কথা উঠবে। তখন গাঁইগুই না সুন্দর করে সম্মতি দিয়ে দিবে আর যেনো বলা না লাগে। আগামীকাল বাবার সঙ্গে গ্রামে যাবে তুমি। ততদিনে ত্যাড়া মনকে বোঝাও, প্রস্তুত করো, আমাকে চিরসখা রুপে গ্রহন করতে। আমি কয়েকদিনের জন্য সিলেট যাচ্ছি ফিরে এসে কোনো রকমের তালবাহানা শুনব না, প্রয়োজনে জোর পূর্বক বউ ঘরে তুলবো মনে থাকে যেনো।”

একথা বলে আদিত্য তাকে ছেড়ে দিলো। মেধা আর একদন্ত না দাঁড়িয়ে দৌড়ে চলে গেল নিজের কক্ষে। আদিত্য বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ওর আম্মুর সঙ্গে কথা বলে নিলো। ইঙ্গিত করে আমানের কথা জিজ্ঞাসা করতেও ভুললো না সে। তবে মেধা আদিত্যের ব্যবহারে এখনো হতবাক। সে বালিশে মুখ গুঁজে স্থির হয়ে বসে আছে। শরীরখানা মৃদুভাবে কাঁপছেও।
কি থেকে কী হয়ে গেল এখনো তার বোধগম্য হচ্ছে না। কত কথায় তো বলে আদিত্যকে কই কখনো তো….! এসব ভেবে
বেশ কিছুক্ষণ অনড় হয়ে বসে রইল মেধা। তারপর দরজাটা আঁটকে রুম অন্ধকার করে শুয়ে পড়লো। আর রুম থেকেও বের হলো না, খেলোও না। আদিত্যের বাবা যাতে ডাকতে না আসে তাই ফোন করে আহ্লাদী ভরা কন্ঠে জানিয়ে দিলো, সে খাবে না। সন্ধ্যা থেকে এটা ওটা খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেলেছে।
তার মেসেজ দেখে আদিত্যের বাবাও আর কিছু বললেন না।
কারণ উনি অবগত বলেও আর কাজ হবে না। তাই অহেতুক কথা না বাড়িয়ে ছেলেকে ডেকে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে চলে গেলেন। আদিত্যও আর মেধাকে আর ডাকল না; আর না তার খোঁজখবর নিলো। নিজের অভ্যাস মতো রাত জেগে অফিসের কাজ সেরে গভীর রাতে ঘুমাতে গেল। এর পরদিন সকালে, মেধা ফ্রেশ হয়ে একেবারে রেডি হয়ে নিচে নেমেছে।
আদিত্যের বাবার সঙ্গে সে এখন গ্রামে যাচ্ছে। মুখ থমথমে।
তখন বুয়া এসে খাবার দিলে সবটুকু খাবার সে খেলো।আজ
কোনো ধরনের তাল বাহানা দেখায় না। একটুপরেই আদিত্য এবং তার বাবার এসে বসল পাশের চেয়ারে। তবুও সে দৃষ্টি তুলে তাকালো না। বাবা ও ছেলে অফিস নিয়ে কথা বলছিল আর খাচ্ছিল। কীসব হিসাব- নিকাশের কথা মেধার মাথাতে ঢুকছিল না। তাই সে একমনে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলো।
যদিও উপস্থিত হয়েই আদিত্য মেধাকে খেয়াল করেছে, সেই সঙ্গে আবহাওয়া গরম আন্দাজও করেছে। তবে গতরাতে যা করেছে বা হয়েছে তা একটু বেশি করে ফেলেছে। সেও মানে,
এটা মোটেও উচিত হয় নি। তাছাড়া এত রয়ে সয়ে কী আর রোমাঞ্চ হয়?সে তো প্রথমদিকে অভিনয় করেই ভয় দেখাতে চেয়েছিল কিন্তু পরে ঘোর লেগে গেছে। অবাধ্য, নিয়ন্ত্রণহীন, নিষিদ্ধ এই ঘোর। তাছাড়া কী বা করার আছে?ভালোবাসার কথা বলতে পারে না, বোঝালেও বুঝে না, মান অভিমান তো বুঝেই না বরং দ্বিগুন ওর রাগকে বাড়িয়ে দেয়। অথচ পাগল এক প্রেমিক পুরুষকে আশা করে মেধা। চায় কেউ একজন
উন্মাদের মতো ভালোবাসুক তাকে। এক কথায় বেপরোয়া টাইপের প্রেমিক। আদিত্য নাকি এসবের সঙ্গে যায় না। তার মতো কাঠখোট্টা উন্মাদ প্রেমিক হতে পারবে না, কখনো না, কোনোদিনও না। অথচ সামান্য একটু রোমান্টিকতা দেখাতে মেয়ের কেঁদে কেটে একাকার অবস্থা। আবার আবদার করে রোমান্টিক প্রেমিকের! মানে এই মেয়েটা কী চায় সে নিজেও জানে না। পারে তো শুধু মুখে বড় বড় কথা বলতে।আর সেই কথা দিয়ে তাকে তীব্রভাবে আঘাত করতে। এসব কথা ভেবে আদিত্য পুনরায় মেধার পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সে বসে বসে আপনমনে সিদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়াচ্ছে। ডিমের কুসুম কোনোকালেই খায় না মেধা। এখনো সে ডিমের সাদা অংশ খেয়ে চুপ করে বসে আছে। মুখে রা শব্দ নেই। অন্যদিন হলে কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে দিতো। তখন আদিত্যের বাবা খাওয়া শেষ করে রেডি হতে নিজের কক্ষে গেলেন। এসেই মেধাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন।ওর বাবা প্রস্থান হতেই আদিত্য বলল,

-” চোখ, মুখ, ফোলা কেন তোমার?”

-”বাতাস দিয়ে ফুলিয়েছি, সুন্দর লাগছে না?”

-” হুম আর হ্যাঁ ওখানে গিয়ে কিন্তু ….!”

-”ওখানে গিয়ে হ্যাংলামি করবো না। ছেলেদের থেকে দূরে থাকবো। একা বাসার বাইরে বের হবো না। আপনার আম্মুর আঁচল ধরে থাকবো। আর প্রতি ঘন্টায় কল করে আপনাকে
সব জানাবো, ঠিক আছে না?”

-”হুম।”

-”আর কিছু বলবেন?”

-” না, কেন?”

-”অনন্তকাল বসে থাকা সম্ভব নয় না তাই উঠবো আমি।”

মেধার কথা শুনে আদিত্য ওর খাওয়া থামিয়ে মেধার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অভিমানে টইটম্বুর তার মুখ। একরাশ অভিযোগ চোখের চাহনিতে। রাগে এখনো দৃষ্টি তুলে তাকায়
নি তার দিকে। হাতের মুঠোয় ওড়নার অংশ শক্ত করে চেপে ধরে শান্তভাবে বসে আছে। কথার ভাঁজে ভাঁজে রাগ মিশ্রিত অভিমানগুলো ঝরে ঝরে পড়ছে। তা দেখে আদিত্যের হাসি পেলো, হাসলোও। তবে তার হাসিটুকু ঠোঁটের কোণে অদৃশ্য
হয়ে গেল। এইটুকু পুঁচকে মেয়ের আবার রাগও আছে৷ তার থেকে জবাব না পেয়ে মেধা ততক্ষণে উঠে বেসিনে হাত ধুয়ে
ড্রয়িংরুমে বসেছে। রাগে তার পুরো শরীর রি রি করছে। এর কারণও ওই আদিত্যই। এইতো বছর খানিক আগে আদিত্য
সব কাজিনদের মতোই তাকেও ‘তুই’ করে সম্বোধন করতো।
কিন্তু হঠাৎ তার সম্বোধনে পরিবর্তন এসেছে। ‘তুই’ থেকে এক লাফে ‘তুমি’ তে স্থির হয়েছে। যে কারণে কাজিনদের পঁচানি তাকে সহ্য করতে হয়। তাকে দেখলেই কাজিনরা জোঁট হয়ে
চেঁচিয়ে বলে, “এই যে আদিত্য ভাইয়ের ‘তুমি’ প্রেম কতদূর এগোলো, হুম হুম?”
যার সঙ্গেই দেখা হোক সবাই আদিত্যকে জড়িয়ে মজা নেয়।
এই নিয়ে অভিযোগ দিলেও কাজ হয় না। বরং ওদের উস্কে দিয়ে আদিত্যের মা সর্ব সম্মুখে ঘোষণা দিয়েছেন, “খবরদার বলছি কেউ আর মজা নিবি না। বরং ওদেরকে একান্তে প্রেম করার সুযোগ করে দিবি।”
উনার কথায় ওরা আরো সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে তাই বলে মজা নেয়। কেউ কেউ তো ওদের বিয়ে, বাসর, বাচ্চার অবধি চলে গেছে। যেসব কথা মুখে আনাও পা/প। এসব তার পছন্দ না।
ওই মানুষটাকেই তো পছন্দ না। কিন্তু মূল ঘটনা হচ্ছে, গ্রামে গিয়ে কাজিনরা আবার তাকে ধরবে। তারা জেনে গেছে গত রাতে আদিত্য আর সে বাসা ছিল। এখন মনগড়া কতকিছুই
না ভেবে সবগুলো মিলে মেসেজ করছে। তবে একপক্ষে খুব ভালো হয়েছে আদিত্য যাচ্ছে না। তাছাড়া গতরাতে আদিত্য যা করেছে এজন্য মাফ করবে না সে।প্রেমিক পুরুষ না হোক
তাকে অনন্ত ভালো মানুষ ভাবতো।কিন্তু গতরাতে তার সমস্ত ধারণা বদলে দিয়েছে। আদিত্যের দিকে তাকিয়ে মেধা এসব ভাবছিলো। হঠাৎ আদিত্যের সঙ্গে তার চোখাচোখি হওয়াতে
দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। তখন আদিত্যের বাবা চলে আসায়
বিদায় নিয়ে উনারা চলে গেলেন। আদিত্যও ওর কাজ সেরে
সেও বেরিয়ে পড়ল সিলেটের উদ্দেশ্যে।

যথাসময়ে মেধা গ্রামে পৌঁছে কাজিনদের নিয়ে মেতে আছে।
তার দুরন্তপনাও বেড়ে গেছে অতি মাত্রায়। বিয়ের অজুহাতে শহরের মানুষ দেখতে গ্রামের কিছু মানুষও এসেছেন। তারা
সীমা বেগম এবং বড় মামীর সঙ্গে গল্পে মেতেছেন। বড় মামী মেয়ের শশুড়বাড়ির সুনাম ছড়াতে ব্যস্ত। মনমতো পাত্র পেয়ে উনারা বেজায় খুশি। যদিও এই সুপাত্রটি মেয়ে নিজেই খুজেঁ নিয়েছে। ওদিকে নতুন বউকে সূচীকে ঘিরে ধরেছে মেধাসহ রিমি, মিমি, ও সাথী। বোনদের মধ্যে সূচী’ই হচ্ছে সবার বড়।
এখন তারা সূচীর মুখ আর হাত বেঁধে রেখে হবু দুলাভাইয়ের সঙ্গে চ্যাট করছে। কত রং ঢংয়ের আলাপও চলছে তাদের মধ্যে। হবু দুলাভাইকে বোকা বানিয়ে উচ্চ শব্দে হেসে উঠছে কখনো কখনো। সূচি শুধু অসহায় চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে, বোনদের কান্ডকারখানা। এমন বোন থাকলে শত্রুর প্রয়োজন হয় না। তখন সীমা বেগম হঠাৎ রুমে এসে তাদের ধমকে কাজ ধরিয়ে দিয়েছেন। কাজ হচ্ছে মটরশুঁটির খোঁসা
ছাড়ানো। ধমক থেকে বাঁচতে বোনটা মিলে খোঁসা ছাড়াতেও বসে গেছে। তবে মটরশুঁটির দানাগুলো পেটে চালান করছে বেশি, সঙ্গে আছে তাদের খুনশুঁটি। সূচি ফোন পেয়ে সেই যে রুমে দরজা আঁটকেছে এখনো খুলে নি। তখন রিমি ইশারায় সিমিকে কিছু বুঝিয়ে মেধাকে বলল,

-”এই মেধা বল না কাল কি কি করলি?”

-”কাল দুপুরে ঘুমিয়ে উঠেছি সেই সন্ধ্যায়।”

-”তারপর সন্ধ্যা থেকে কি করলি?”

-”তেমন কিছু করি নি টিভি দেখেই সময় পার করেছি।”

-”বললেই হবে না? প্রেমিকের বাসায় থাকছিস তাও আবার বাসা ফাঁকা।”

-”আদিত্য ভাইকে তোমরা জানো না, সে কেমন? সে আবার করবে রোমান্স?”

-”ঠিক বলেছিস। এই আদিত্য ভাইটা না আসলেই নিরামিষ।”

কথার মোড় ঘুরাতে পেরে মেধা নিঃশব্দে হাফ ছাড়ল। তখন সাথী মন বেজার করে বলল,

-”সেদিন আদিত্য ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো। ভালো মন্দ জিজ্ঞাসা তো করলোই না বরং তার ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে বলল,”
বাসায় যা, ভদ্রঘরের মেয়েরা মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে খিলখিল করে না।” তারপর আইসক্রিম কেনার টাকা দিয়ে চলে গেল।”

তখন সূচি ওর রুমের দরজা খুলে জামা কাপড় নিতে নিতে বললো,

-”তাহলে শোন, আদিত্য ভাই হচ্ছে নারিকেলের মতো। তাকে বাইরে থেকে দেখতে যতটা শক্ত তার ভেতরটা ততটাই নরম।
আর ওর নরম মনের আভাস পেতে হলে তাকে জানতে হবে, বুঝতে হবে। তবেই বুঝবি সে আসলে কোন ধাতুর তৈরি।”

সূচির এই কথাটা মেধার মনে ধরলো। কিন্তু গতরাতের কথা স্মরণ হতেই মেজাজ বিগড়ে গেল। তবে কাউকে বুঝতে না দিয়ে অন্য কথার টাল টানলো। তার সঙ্গে যুক্ত হলো রিমি ও সাথী। দু’এক কথা বলতে বলতে শুরুও হয়ে গেল বোনেদের সঙ্গে খুনশুঁটি।আর এভাবে দুষ্টুমি খুনশুটি করে ওরা কাটিয়ে দিলো অনেকটা সময়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেহমানরাও বাসায় এসে বিয়ের আমেজ দ্বিগুন করে দিয়েছে। সবাই কত মজা করছে। হঠাৎ কেন জানি ভালো লাগছে না মেধার। মন কু-ডাকছে। তাই তার বাবাকে ফোন করে কথা বললো সময় নিয়ে। তবুও মন শান্ত হলো না বরং অশান্তি বেড়ে গেল। খুব করে কাঁদতেও ইচ্ছে করছে । মনে হচ্ছে খারাপ কিছু ঘটবে।
সে বাসার ভেতরে গিয়ে সবাইকে দেখে নিলো। এখানে তার বাবা আর আদিত্য বাদে সবাই উপস্থিত আছে। বাবার সঙ্গে কথা বললো এখন শুধু বাকি আছে আদিত্য। সে ঠিক আছে তো? তার সিলেটে যাওয়ার কথা না? সে কী সহি সালামতে পৌছেছে? আদিত্যের কথা ভাবনায় আসতেই তার মন বড্ড বেশিই অশান্ত হয়ে উঠল। সে সীমা বেগমের কাছে ছুটে গেল
আদিত্যের খোঁজ নিতে। সীমা বেগম এত ব্যস্ততার মাঝে এই নিয়েও মজা করলেন, হাসলেন। মেধা এখন মজা সহ্য হলো না। সে ধীর পায়ে বেরিয়ে এলো বাসায় থেকে। পুনরায় গিয়ে বসলো গাছটার নিচে। তারপর নত মস্তকে তাকিয়ে রইলো তার হাতের ফোনটার দিকে। মন বলছে একবার ফোন করে আদিত্যের খোঁজ নিতে কিন্তু বিবেক বলছে উল্টো কথা। সে
যাকে সহ্যই করতে পারে না তার জন্য উতলা হওয়াও মানায় না। তার যা ইচ্ছে হোক ওর কি!

To be continue……….!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here