#হলুদ_বসন্ত #সূচনা_পর্ব

0
702

ফুলে সজ্জিত বিছানায় বধূবেশে আয়াত অপেক্ষা করছে তার এইডস আক্রান্ত স্বামীর জন্যে। সৎ মা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে জোরপূর্বক আজ তাকে ব্যবসায়ী আদ্রাফ ইসলামের সাথে তাকে বিয়ে দিয়ে দেন। আয়াত বারবার না করার পরও তার উপর রহম করেনি তার সৎমা। সদ্য এইচ.এস.সি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ প্রাপ্ত আয়াত যখন খুশিতে তার ফলাফল বাবাকে জানাতে এসেছিল, আপন মা সমতুল্য সৎমা তখন আয়াতের হাতে একটা বেনারসী শাড়ি ধরিয়ে দেয়। আয়াত অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তখন তার সৎমায়ের পানে।

কয়েক ঘন্টা পূর্বে……

হাতে একটা ফোন নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে আয়াত। বাবার রুমে গিয়ে হুইলচেয়ারে বসে থাকা বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফোনে আসা মেসেজটি দেখিয়ে উচ্ছ্বসিত মুখে বলে,

“বাবা দেখো আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি। তোমার ইচ্ছে পূরণে আরও একধাপ এগিয়ে গিয়েছি। এখন আমি মেডিকেলে এডমিশন টেস্ট দিব। দেখবে একদিন ডাক্তারের অ্যাপ্রোন গায়ে দিয়ে ডাক্তার হয়ে তোমাকে সুস্থ করে দিব।”

আয়াতের বাবা নাজিম রহমান অত্যন্ত খুশি হলেন। ছলছল নয়নে মেয়ের দিকে তাকালেন। কিন্তু মেয়েকে নিজের বুকে টেনে নিতে পারলেন না। মেয়ের মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দিতে পারলেন না। খুশিতে চিৎকার করে সবাইকে জানাতে পারলেন না আমার মেয়ে আজ আবার আমার আরেক স্বপ্ন পূরণ করেছে। পারবেন কিভাবে? তিনি যে প্যারালাইজড। মেয়ের দিকে তাকিয়ে মন ভরে শুধু মেয়ের আনন্দে উচ্ছাসে ভরা মুখটা দেখতে লাগলেন। পাশ থেকে আয়াতের সৎমা অনেকগুলো টাকা হাতে নিয়ে গুনতে গুনতে বললেন,

“হয়েছে তোর মেডিকেল। ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৫ পেয়ে উদ্ধার করে ফেলেছিস খুব। এমন ভাব যেন দুনিয়াতে জিপিএ ৫ প্রথম ওই পেয়েছে। আহা কি স্বপ্ন! মেডিকেলে পড়বে মেয়ে। বলি টাকা কি তোর মরা মা দিবেরে পোড়ামুখী? ”

চুপ করে ফেললো আয়াত। উচ্ছ্বসিত মুখে আবার বিষণ্নতা ছেয়ে গেল। সৎমা আয়াতকে তার কাছে ডেকে বললেন,
“এই এদিকে আয়, আমার সামনে বস।”

বাধ্য মেয়ে আয়াত মাথা নিচু করে তার সৎমায়ের সামনে আসে। বিছানায় বসতে গেলে তিনি গর্জে উঠেন। আয়াতকে ধমক দিয়ে বলেন,
“তোকে আমার বিছানায় বসতে বলেছি কি আমি? কোন সাহসে আমার বিছানার উপরে বসতে যাস তুই? নিচে বস!”

আয়াত বিনাবাক্যে মেঝেতে বসে পড়ে। দূর থেকে নিঃশব্দে মেয়ের কষ্ট দেখে অশ্রু ফেলতে থাকে এক অক্ষম পিতা। নিজের সব সম্পত্তি বিশ্বাস করে দ্বিতীয় স্ত্রীর নামে লিখে দিয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছেন তিনি। আয়াতের সৎমা আয়াতের হাতে একটা বেনারসী দিয়ে বলে,

” ঘন্টাখানেকের মধ্যে তৈরি হয়ে যা। আমিই তোকে ডাকতাম, কিন্তু তুই নিজেই যেহেতু আমার ঘরে এসে গেলি তাই আমারই একটু সহজ হয়ে গেল।”

আয়াত হাতে থাকা টকটকে লাল বেনারসির দিকে একবার তাকিয়ে পুনরায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো তার সৎমায়ের দিকে। প্রশ্ন করল,
“আমরা কি কোথাও যাচ্ছি মা? বেনারসী দিলে কেন আমায়?”

আয়াতের সৎমা আরেক বান্ডেল টাকা হাতে নিয়ে গুনতে শুরু করেছিলেন। আয়াতের প্রশ্ন তার কাযে বাধা দিল। বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলেন না। উত্তর দিলেন,
“আমরা কোথাও যাচ্ছি না। যাচ্ছিস তুই, তোর শশুড়বাড়িতে। আজ তোর বিয়ে। খুব বড়লোকের সাথেই রে। বিয়ের পর বাকী জীবন পায়ের উপর পা তুলে কাটাবি, আর আমার জন্যে দুয়া করবি, ধন্যবাদ দিবি।”

থমকে গেল আয়াত কথাটা শুনে। তার বিয়ে! বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। সে তো বিয়ে করতে চায় না এখন।
উঠে দাঁড়ালো আয়াত। বলল,
“আমি কোনো বিয়ে করব না মা। আমি পড়তে চাই, আমি আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।”

আয়াতের সৎ মা ভেংচি কেটে বললেন,
“উফফ কি শখ! বাপের শখ পূরণ করবে। তোর বাবা যেদিন থেকে অসাঢ় হয়ে গিয়েছে, সেদিন থেকে সব স্বপ্নও তার হারিয়ে গেছে। কথা বাড়াবি না তো। আমায় রাগাবি না। ১ঘন্টার মধ্যে রেডি হয়ে নে।”

আয়াত হুট করে তার সৎ মায়ের পা ধরে নিল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“মা আমি বিয়ে করব না। করব না আমি।”

আয়াতের সৎ মা তার গালে সজোরে একটা চর বসালেন। বললেন,
“ঐ মেয়ে এতো গুলো যে টাকা পেয়েছি এখন সব ফিরিয়ে দেব নাকি? তোর চেয়ে টাকাগুলোর অনেক বেশি মূল্য। এতোদিন তোকে পেলেপুলে বড় করেছি, তার একটু তো রহম কর।”

আয়াত চোখ মুছে উঠে দাড়ালো। জোর গলায় বলল,
” পারবনা তোমায় রহম করতে। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। আমায় আর পালতে হবে না তোমাদের।

আয়াতের সৎমা শান্ত গলায় বলল,
“তোর বাপের উপর তো রহম করবি নাকি? তোর বাবার কসম লাগে তুই বিয়ে করবি। আর কোনো ঝামেলা করবিনা। তুই যদি বিয়ে না করিস তাহলে আমি এই বুড়োকে মেরে ফেলব। তোর বাপকে মারতে আমার বেশি সময় লাগবেনা তা কিন্তু তুই জানিস আয়াত।”

নাজিম রহমান তার স্ত্রীর ঘৃণা চোখে দিকে তাকালেন। থমকে যায় আয়াত। কান্না করাও বন্ধ করে দেয় সে। কালবিলম্ব না করে আয়াত বেনারসি শাড়িটা হাতে করে নিয়ে যায়। সৎমা রাহেলা আয়াতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা পৈশাচিক হাসি দেয়।

বর্তমানে…

আজ ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো চিন্তা করতে করতে চোখ লেগে এসেছিল একটু আয়াতের। হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের সে। কারো পদধ্বনি পেয়ে সে ধরফরিয়ে উঠে। তাকিয়ে দেখে একজন যুবক থেকে ২-৩ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে তার বেশভূষা যাচাই করে আয়াত বুঝতে পারলো যে সেই যুবকই তার স্বামী আদ্রাফ। আদ্রাফ বলল,
“মাফ করবে আমায়, আমি তোমায় ভয় পাইয়ে দিলাম।”

মাথা নিচু করে ফেললো আয়াত। মনে মনে বকতে লাগলো আদ্রাফকে। তার জীবন নষ্ট করে ফেলেছে লোকটা। হঠাৎ মনে পড়ল তার কিছু মহলার কথপোকথন যারা বলছিল আদ্রাফ এইডস আক্রান্ত। শরীর শিউরে উঠলো ভয়ে। আদ্রাফ যদি এখন স্বামীর অধিকার খাটায় তাহলে তো এইচআইভি ভাইরাস তো তার দেহেও প্রবেশ করবে।
আয়াত আদ্রাফকে তার থেকে দূরে থাকতে বলার জন্যে উদ্যত হলো। কিন্তু আয়াতের মুখ থেকে কিছু বের হওয়ার আগেই আদ্রাফ বলল,
“তোমাকে হয়তো জানানো হয়নি আমি এইডস আক্রান্ত। চিন্তা নেই তাই আমি তোমাকে স্পর্শ করব না। এটা তোমার একার রুম, আপনি আপনার রুমে থাকবেন আর আমি আমার রুমে। আর আপনি আমার রুমে প্রবেশ করবেন না প্লিজ। অন্তত বেঁচে থাকতে ইচ্ছে থাকলেও প্রবেশ করবেন না।”

আয়াত ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। তবে লোকটা তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখবে শুনে শান্তি পেল। তবুও কনফর্ম হওয়ার জন্যে আদ্রাফকে প্রশ্ন করল,
“সত্যি তো?”

“হুম।”

আয়াত চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ কি চিন্তা করে প্রশ্ন করল,
“আমি আপনার কিছু রিলেটিভের কথা শুনেছিলাম। তার বলাবলি করছিল আপনি এইডস আক্রান্ত। এতো টাকা দিয়ে আমাকে বিয়ে করলেন কেন আপনি?”

আদ্রাফ উত্তর দিল, “এর পেছনে ২টা উদ্দেশ্য। প্রথমত আমার জীবনের শেষ সময়টুকুতে একজন দয়ালু ভালো বন্ধু পাওয়া। আর দ্বিতীয়ত আমার দাদীর শেষ বয়সে নাতিবউ এর মুখ দেখার ইচ্ছে পূরণ করা। তাই ভাবলাম বিয়ে করে ফেলি।”

“আর সাথে একটা মেয়ের জীবনটা নষ্ট করি তাইতো?”

আদ্রাফ হেসে বলল, ” না না, তোমার জীবন নষ্ট হবেনা। আমার তো কেউ নাই আমার দাদী ছাড়া, দাদীরও বয়স হয়েছে, পরিবারে এখন তুমি ছাড়া আর কেউ নাই। তাই আমার মৃত্যুর পর সব সম্পত্তি তোমার।”

চুপ করে গেল আয়াত। আদ্রাফকে এখন কি বলা উচিত তা ভেবে পাচ্ছেনা সে। আদ্রাফ বললো,
“আর কিছু ভেবো না। বেঁচে থাকলে কাল তোমার সাথে দেখা হবে ইনশাআল্লাহ। ফ্রেশ হিয়ে নামাজ পড়ে খেয়ে নাও। রেস্ট নিয়ে এরপর ঘুমিয়ে পড়। তোমার রুমের দুই রুম পরে আমার রুম। কোনো কিছু লাগলে আমায় কল দিও, আমি সার্ভেন্টদের কাউকে পাঠিয়ে দিব। আর হ্যাঁ আমার রুমে প্রবেশ করতে যেও না আবার। আমার থেকে সবার মতো একটু দূরেই থেকো। চাই না আমার থেকে কারো এই মরণ রোগ যাতে ছড়ায়। তবে আমার একটা বন্ধু পাওয়ার খুব আশা জীবনের এই শেষ কয়েকদিনের জন্য। দূরে থেকেই প্লিজ আমার বন্ধু হয়ে থেকো। শুভরাত্রি।”

আদ্রাফ চলে গেল। আয়াত তার যাওয়ার দিকে কিছুক্ষন চেয়ে রইল। অতঃপর ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিল। সার্ভেন্ট এসে খাবার দিয়ে গেলে খাবার খেয়ে নিল। সারাদিন কিছু আর পেটে পড়েনি, তাউ বড্ড খিদেও পেয়েছিল তার। খাওয়া শেষে আয়েশে ঘুমিয়ে পড়ল।
.
.
.
আজানের ধ্বনিতে ঘুম ভেঙে গেল আয়াতের। শোয়া থেকে উঠে বসে চোখ কচলায় কিছুক্ষন সে। বিসমিল্লাহ পড়ে বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে অজু করে নেয় সে। নামাজ পড়ে নিজের বাবার জন্যে দুয়া করে, মৃত মায়ের পরকালীন জীবনে শান্তির জন্যে দুয়া করে। কিছুক্ষণ কুরআন তিলাওয়াত করে সে। রুমে থাকা বারান্দার দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় সে। ভোরের শীতল হাওয়া এক অনন্য অনুভূতির পরশ দিয়ে যায়ম হলুদ বসন্তের আগমনী সুঘ্রাণ নাকে এসে লাগে আয়াতের। বড় একটা শ্বাস ফালায় সে। প্রতিটা শ্বাস প্রশ্বাস নতুন উদ্যমে জীবন পরিচালনার প্রেরণা দেয়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাগানের দিকে চোখ বুলিয়ে নিল। বাগানে একটা মানুষের অবয়ব দেখতে পেল। দেখল সে মানুষটি ইশারা করে কিছু বলছে তাকে। ভালো করে দেখে বুঝতে পারলো আদ্রাফ তাকে ইশারা করছে। আদ্রাফ জোরে ডাক দিয়ে বলল,
“এখানে এসে পড় আয়াত!”

আয়াতের কান পর্যন্ত আদ্রাফের কন্ঠ পৌছিয়েছে কিনা তা নিশ্চিত না আদ্রাফ। আয়াত বারান্দা থেকে চলে গেল এটা দেখতে পেল। ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বাগানে হাঁটতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর এক মেয়েলি কণ্ঠ শোনা গেল। প্রশ্ন করল?

“ডেকেছেন কেন আমায়?”

মুচকি হাসলো আদ্রাফ। আয়াত এসেছে তাই ভেবে খুশি হলো। পিছনে ঘুরে নীল কামিজ পরিহিতা অপ্সরীকে দেখতে পেল। ভোরের কুয়াশায় আয়াত যেন দ্বিগুন স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। আদ্রাফ আয়াতকে প্রশ্ন করল,
“গল্প করবে আমার সাথে?”

আয়াত কোনো উত্তর দিল না। আদ্রাফও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“চলো বসি ওখানে।”

আদ্রাফ বাগানে রাখা ৪টা চেয়ারের একটায় বসল। আয়াত পিছন পিছন গিয়ে তার পাশের চেয়ারটায় বসতে গেল। কিন্তু আদ্রাফ বাধা দিয়ে বলল,
“আমার থেকে একটু দূরেই বস তাহলেই হয়তো ভালো হবে। সবারই একটা আশংকা থাকে তো রোগটা নিয়ে। তুমি আমার বরাবর সামনের চেয়ারটায় বস। ডোন্ট মাইন্ড প্লিজ।”

আয়াত এবারও কিছু বলল না। আদ্রাফের কথামতো সামনের চেয়ারটায় বসল। আদ্রাফ বলল,
“এভাবে চুপ করে থেকো না। আচ্ছা বলো চা খাবে নাকি কফি?”

আয়াতের কফি বরাবরই একটু বেশি পছন্দ। আয়াত নিচু স্বরে বলল, “কফি।”

আদ্রাফ একজন সার্ভেন্টকে কল দিয়ে ২কাপ কফি আনতে বলল। তারপর আবার আয়াতকে বলল,
” আমার সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে প্রশ্ন করতে পারো।”

আয়াত ভেবে পেল না কি বলবে। শেষে আদ্রাফকে প্রশ্ন করল,
“আপনার এই রোগটি হলো কিভাবে?”

#চলবে

#হলুদ_বসন্ত
#সূচনা_পর্ব
#Eshika_Khanom

[ভুলত্রুটি মাফ করবেন। এইডস রোগটি নিয়ে যা জানা আছে সেটা নিয়েই লিখব। আর গল্পটা মূলত একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিয়ে। তাই কেমন লাগলো জানাবেন প্লিজ। আসসালামু আলাইকুম। ]

চাইলে আড্ডা দিতে অথবা গল্প নিয়ে কোনো কথা থাকলে জয়েন হতে পারেন
গ্রুপ লিংকঃ
https://www.facebook.com/groups/312149847432703/?ref=share

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here