-“আমি আদিত্য ভাইকে বিয়ে করবো না বাবা। উনাকে স্বামী হিসেবে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি উনাদের নিষেধ করে দাও।”
উপরোক্ত কথাটা চিরকুটে লিখে মেধা বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। একরাশ অভিমান নিয়ে সারাদিন পেরিয়ে গেলেও সে বাসায় ফিরে নি। মেধার বাবা অফিস থেকে ফিরে চিরকুটটা
ড্রেসিং টেবিলের উপরে পেলেন। আর চিরকুট পড়েই চিন্তিত হয়ে মেয়েকে অনবরত কল করতে থাকলেন। না এই মেয়ে ফোনও সুইচ অফ করে রেখেছে৷ না জানি কোথাও গেছে কে জানে। এসব ভেবে উনি আর না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেলেন মেধার মামা বাড়ির উদ্দেশ্যে। উনার ধারণা মেধা সেখানেই গেছে। কারণ মন ভার হলে সে ছুটে চলে যায় মায়ের কাছে।
ঘন্টার পর ঘন্টা বসে গল্প করে সময় কাটায় মায়ের শিয়রে বসে। আজও হয়তো সেখানে গিয়ে তাই’ই করছে। বোধহয়
কতশত নালিশও দায়ের করেছে উনার বিরুদ্ধে। এসব ভেবে মলিন মুখে হাসলেন রেজাউল হক। তখন কিছু একটা ভেবে উনি কল করলেন মেধার বড় মামার কাছে। মনটা মানছে না দেখেই নিশ্চিন্ত হতে মূলত কলটা করলেন। দুই বারের বেলা মেধার বড় মামা রহমান খান কলটা রিসিভ করলেন। কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই উনি বললেন,
-”হুম এসেছে, এত রাতে তোমার আসার প্রয়োজন নেই।”
-” খেয়েছে কিছু?”
-”তা জেনে কি করবা? মেয়েটা বেশি খাচ্ছে বলেই তো বিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছো। যায় হোক, রাত বিরেতে আসার প্রয়োজন নেই। কাল আদিত্য গিয়ে দিয়ে আসবে।”
-”আদিত্য আপনাদের বাসায়?”
-”ছিল, তবে কাজ সেরে সকালেই চলে গেছে।”
-”ওহ আচ্ছা।”
তারপর রহমান কল কেটে দিলেন। রেজাউল হক ফোনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মেধার মা অর্থাৎ উনার সহধর্মিণী মারা গেছে সাড়ে সতেরো বছর হতে চলল। মেধাকে জন্ম দিতে গিয়েই উনি মারা গেছেন। তখন রেজাউল হক ছিলেন একজন বেকার পুরুষ। বাসা থেকে পালিয়ে সকলের অমতে বিয়ে করেছিলেন উনারা। উনাদের বিয়ের দুইমাস যেতে না যেতেই মেধার মা মিনা কনসিভ করে ফেলে। প্রথম তিনমাস কষ্টও করেন খুব। মেয়ের অবস্থা দেখে মেধার নানিরা মেনে নেন উনাদের। নিজের অফিসে কাজ দেন রেজাউল হককে। ধীরে ধীরে উনিও বিশ্বাস অর্জন করে নিজের জায়গা তৈরি করে নেন, সেই সঙ্গে বেকারত্ব থেকে মুক্তিও পান। ততদিনে মিনার আটমাস রানিং। দেখতে দেখতে সময় ঘনিয়ে আসে, ভয়ও বাড়তে থাকে। তারপর হঠাৎই একদিন পেইন ওঠাতে উনাকে হসপিটালে নিয়ে যান। কিন্তু অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের জন্য একপর্যায়ে মিনাও হাল ছেড়ে দেন। আর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সদ্য জন্মানো মেয়ের মুখটা দেখার পর পরেই।
তখন মেধার বড় মামা রহমান খান ছোট বোনের কবর দেন, শিউলি গাছের তলে। রেজাউল খানও মত বিরোধ করে নি।
এভাবে দিন গেল, মাস গেল, কষ্ট করে মেধাকে নিজের হাতে বড়ও করলেন তিনি। যদিও মিনার পরিবারকে উনি সবসময় পাশে পেয়েছেন। আর মেধাকে বড় করার পেছনে উনাদেরও অনেক অবদান রয়েছে। যেমন সীমা এঅবধি যথেষ্ট করেছে উনাদের জন্য। যা কখনো ভোলার মতো না।আর সীমা হচ্ছে আদিত্যের মা মিনার বড় বোন। সীমা অনেক বড় মুখ করেই আবদার করে বলেছে, মেধাকে উনি কাছ ছাড়া করবেন না। তাই আদিত্যের বউ বানিয়ে নিয়ে যাবেন নিজের কাছে।কিন্ত
একথা শুনেই মেধা বেঁকে বসেছে। তার কথা আদিত্যকে সে বিয়ে করবে না, মানে করবে না। আদিত্য নাকি মানুষ না, সে
একটা জীবন্ত রোবট। যার ব্যবহার নাকি রোবটের মতোই।
মেয়ের এমন অভিযোগ শুনে উনি নিজেও খু্ব বুঝিয়েছেন। তবুও কাজ হয় নি। তার একই কথা ”তাকে বিয়ে করবই না।”
তারপর সকালে চিরকুট লিখে চলে এসেছে মামার বাড়িতে।
যদিও উনিও চান না মেধার এখনই বিয়ে দিতে। মেয়েটা সদ্য এসএসসি পাস করে কলেজে উঠেছে। ওর চেনাজানার গন্ডি বিস্তৃত করার এটাই মোক্ষম সময়। কিন্তু কিছু করার নেই, সে
বড় হয়েছে। অনেকের নজরেও পড়েছে। তাছাড়া ওর জন্যই প্রায় সময় অফিসের কাজ বাসাতেও সারতে হয়। রাতে দেরি হলে গেলে সীমা নয়তো অন্য কাউকে এসে থাকতে হয়। এত বড় বাসায় তাকে তো আর একা রাখাও যায় না। আর এখন উনার নিজের অফিসও হয়েছে, মেহনত করে টাকা-পয়সাও আয় করেছেন। এত কষ্টের পর নিজের অফিসে গাফিলতির করলে চলে? এজন্য উনি সীমা প্রস্তাব নিয়েও খুব ভাবছেন। উনি অবগত সীমার কাছে মেধা খুবই ভালো থাকবে, আদরে থাকবে। আর আদিত্য ছেলে হিসেবে বেশ ভালো। যদিও ওর ব্যবহার ভীষণ রুক্ষ। তারপরেও মনের দিকে দিয়ে ওর ধারে কাছেও কেউ ঘেঁষতে পারবে না। আর ওকে জামাতা হিসেবে গ্রহন করতে উনার আপত্তি নেই।রহমান খানের কথা অমান্য
করেই রেজাউল হক মেয়ের কাছে চলে আসলেন। তারপর গাড়ি পার্ক করে সোজা হাঁটা ধরলেন মেধার জন্য বরাদ্দকৃত রুমের দিকে। মেধা তখন রুম থেকে বের হচ্ছিল, হাতে বরই।
মুখেও আছে, গুঁড়ো মরিচ আর লবণ মিশিয়ে খাচ্ছিল সে।
হঠাৎ বাবার মুখোমুখি হওয়াতে মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল তার। মনেও পড়ে গেল মামনি বলা কথাগুলো। কর্ণকুহরে প্রতিধ্বণি হতে লাগল অপ্রিয় মানুষটাকে চিরসঙ্গী বানানোর তিক্ত প্রস্তাব। যাকে সে সহ্য করতেই পারেনা, পছন্দ তো দূর।
আজ সকালেই যেমন দেখা হয়েছিল আদিত্যের সঙ্গে তার। কিন্তু আদিত্য ভালো মন্দ জিজ্ঞাসা না করে তাকে বলল,
-“কলেজে না গিয়ে এখানে কী?”
এ কথা শুনে জবাব দেওয়ার ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও মেধা চট বলে ফেললো।
-”তাতে আপনার কি? আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই এসেছি।”
-”তোমার মধ্যে বড্ড আদবের অভাব।”
-”আপনি আমাকে বেয়া/দব বললেন!”
-”তো?”
তারপর তাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ফোনে কথা বলতে বলতে চলে গেছে আদিত্য। তাছাড়া যখনই দেখা হবে একটা করে খোঁচা মারবেই, মারবে। আর এই লোককে বিয়ে করবে সে? কখনো না!এসব ভেবে মেধার মুখ রাগে অভিমানে বেশ
থমথমে হয়ে উঠল। হঠাৎ বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁট ফুলিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। মেয়ের কান্ড দেখে রেজাউল মৃদু হাসলেন, মেয়ের কপালে চুমুও এঁকে দিলে স্নেহের সাথে।
তখন রহমান সাহেব হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসলেন। উনাকে এভাবে আসতে দেখে মেধা চোখ মুছে জিজ্ঞাসা করল,
-”কি হয়েছে মামা? তোমাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?”
-”সীমা নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমি সেখানেই যাচ্ছি মা, তুমি যাবে ?”
-”অবশ্যই যাবো, চলো।”
তারপর উনারা গেলেন আদিত্যদের বাসায়। বাসায় তখন থমথমে অবস্থা বিরাশ করছে। ড্রয়িংরুমে আদিত্যের বাবা চিন্তিত মুখে বসে আছেন। চারদিকে জিনিসপত্র এলোমেলো করে রাখা। তখন উনার থেকে জানা গেল, আদিত্যের ছোট ভাই আমান বাসায় অশান্তি শুরু করেছে। রোজ রোজ তার মোটা অংকের টাকা চায়। না দিলেই শুরু করে ভাংচুর। সে আজও খুব ঝামেলা করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। কারণ আদিত্য আসার সময় হয়ে গেছে। আদিত্য এখনো জানে না এসব। জানলে কী হবে কে জানে। আর ছেলের এমন জঘন্য ব্যবহারে সীমার প্রেশার হাই হয়ে গেছে। উনি নিজেও খেয়াল করে মাথায় পানি ঢালতে গিয়ে ওয়াশরুম পড়ে মাথায় চোট পেয়েছেন। চারটা সেলাই পড়েছে। তবে এখনো প্রেশার কমে নি বরং বেড়েছে। পরে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। পুরো ঘটনা না শুনে মেধা দৌড়ে গিয়ে একবার মামনিকে দেখেও এসেছে। বেশিক্ষণ দাঁড়ায় মামনির ঘুমের
সমস্যা হবে ভেবে। তবে নিচেও নামে নি। সে এখন দাঁড়িয়ে রয়েছে আদিত্যের রুমের সামনে। আদিত্য রুমে নেই জেনেই এসেছে সে। আদিত্যের উপর এখনো ভীষণ রেগেও আছে। তাই কিছু একটা করবে যাতে আদিত্যের রাগ তার জিনিস দিয়েই মিটানো যায়। এসব ভেবে মেধা চারটা টি-শার্টের পিঠ বরাবরই মার্কার কলম দিয়ে লিখল, ” আমি বলদ।”
তখন পেছন থেকে কেউ ওর হাতটা টেনে স্বর্ণের একটা রিং খুলে নিলো। মেধা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে দেখে স্বয়ং আদিত্য দাঁড়িয়ে আছে। মুখভঙ্গি স্বাভাবিক। তবে রিং খুলে নেওয়ার কারণ জানতে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তবে আদিত্য
কিছু না বলে ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। সময় নিয়ে বের হয়ে দেখে মেধা সেখানে সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। তবে রুমের বেহাল দশা। এবারও আদিত্য কথা না বলে দরজাটা
লাগিয়ে মাথা মুছতে থাকল। ভাবখানা এমন যেনো সেছাড়া রুমে আর কেউ নেই। তখন মেধা বিরক্ত হয়ে বলল,
-”আমার রিং ফেরত দেন, বাসায় যাবো। ”
-‘চারটা র্টি শার্টের দাম পরিশোধ করে তারপর নিয়ে যেও।”
-”পারব না।”
-”আমিও ফেরত দিবো না।”
-“গফকে রিং গিফ্ট করবেন বললেই হয় নতুনটা দিতাম।”
-”আমার এতটাও খারাপ সময় আসে নি যে, এই সেকেলে মার্কা রিং আমার গফকে গিফ্ট করবো। এখন ঝটপট রুম
গুছিয়ে ফেলো নয়তো কি হবে কাজে করে দেখাবো।”
-”আচ্ছা তবে আমার একটা আবদার রাখতে হবে, রাজি?”
-”শুনি।”
-”আমাদের বিয়ের কথাবার্তা চলছে এটা জানেন নিশ্চয়ই। আপনি বিয়েতে না করে দেন।”
-”কেন?”
-”এতকথা বলতে পারব না। আপনি শুধু মামনিকে বলবেন এই বিয়ে করবেন না, আপনার গফ আছে।”
আদিত্য চুলগুলো ঠিক করতে করতে মেধার কথা শুনল।তারপর বেশ কয়েকটা ফাইল হাতে নিয়ে রি-চেক করে সাইন করতে থাকল পরপর। ফোনে দু’একবার কথাও বলে নিলো। মেধা ততক্ষণে রুম গুছিয়েও ফেলেছে। মুখভর্তি হাসি তার। সে ধরে নিয়েছে তার কথা আদিত্য রাখবে। কারণ আদিত্যও তাকে অপছন্দ করে, খোঁচা মারে, অহেতুক কথাও শোনায়।
পছন্দের মানুষকে তো আর খোঁচা মারে না কেউ, তিক্ত কথা শুনে আঘাতও করে না। বরং এসব করে অতি অপছন্দের মানুষদের সাথে। এর দ্বারা স্পষ্ট সেও ওর অপছন্দের মানুষ।
এসব ভাবনায় ডুবে মেধা কাজ সেরে বের হতে যাবে তখন আদিত্য বলল,
-” বিয়েতে নাকচ করার কারণ জানিয়ে যাও।”
-”আপনি আমার চাহিদার বিরুদ্ধে আদিত্য ভাই।”
চলবে….!!
(বি:দ্র:- রেসপন্সের উপর নির্ভর করবে পরবর্তী পার্টি)
❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখক: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[০১]