❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[১২]
-”নব্যরুপে কাকে যেনো ভালোবাসবি বললি?”
-” তাকে।”
-”তাকে মানে কাকে?”
-”ওই যে আমার ব্যক্তিগত ত্যাড়া পুরুষ টাকে।”
একথা বলে লজ্জায় ডুবুডুবু হয়ে সে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিলো। তারপর ফ্রেশ হয়ে পোশাক বদলে আদিত্যের রুমের বাইরে ঢু মেরে একেবারে উঠানে গিয়ে দাঁড়াল। আহা, সকাল বেলার আবহাওয়াটা বেশ। শরীরের সঙ্গে মনপ্রাণও জুড়িয়ে যাচ্ছে। অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করছে সর্বাঙ্গ জুড়ে। এমনিতেও আজ ওর মন ভীষন চঞ্চল, প্রান্তবন্ত। এতদিনের
পুষে রাখা কথাগুলো অবশেষে বলতে পেরেছে মানুষটাকে।
সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ ভুলে নব্য রুপে নিজেকে উপস্থাপন করতে পেরেছে। এতেই যেন অসীম শান্তি! একথা ভেবে গতরাতের কথা স্মরণ হয়ে গেল তার। মুখে ফুটলো লাজুক হাসি। নেত্রে ভেসে উঠল প্রিয় মানুষটার মুখ। যার ঠোঁটে হাসি বিদ্যামান।
গতরাতে আদিত্যের রুম থেকে বেরিয়ে একটু ঘুমাতে পারে নি সে। ছটফট করেছে সারারাত। বিশেষ করে আদিত্যর ওই
প্রশ্বস্ত বুকে মাথা রাখার দৃশ্য ভেসে উঠেছে চোখের সম্মুখে।
যতবার চোখ বন্ধ করেছে ততবারই..! এখন এসব ভাবতেই
মেধার মুখশ্রী জুড়ে একরাশ লাজুকতা ভিড় জমালো। মনও কেন জানি চেঁচিয়ে পুরো পৃথিবীকে জানিয়ে দিতে চাইলো,” হ্যাঁ ওই মানুষটাকেই আমি ভীষণ ভালোবাসি! ভালোবাসি! ভালোবাসি!”
কিন্তু মনের ইচ্ছেকে আপাতত প্রশয় না দিয়ে সে আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো। পাখিদের কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে পাখিদের খুঁজল তবে দেখতে পেলো না। হয়তো পাতার আড়ালে লুকিয়ে ডাকাডাকি করছে। এতেই তাদের আনন্দ বোধহয়। তারপর সে কয়েক পা এগিয়ে কলপাড়ের দিকে গেল। গড়গড় শব্দ তুলে কল চেপে দুইহাতের আজলা ভরে পানি নিয়ে পান করলো। তখন সীমা বেগমের কন্ঠস্বর শোনা গেল। তিনি চেঁচিয়ে কাউকে কিছু আনতে বলছেন। সে
সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নারিকেল গাছটার নিচেই বসলো। এখান থেকে সূর্য দেখা যাচ্ছে। সূর্য কেবল তার রঙিম আভা ছড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে উঠছে। মেধা মনযোগ দিয়ে সূর্যের সৌন্দর্য টা উপভোগ করছিলো। আহা! মনোরোম সেই দৃশ্য।
তখন পাশ ফিরে দেখে আদিত্য ফোন কানে ধরে তার দিকেই আসছে। মেধা তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। অথচ মানুষটা একবারও তাকালো না ওর দিকে। ভাব এমন যেনো মেধাকে সে চেনেই না, দেখা তো দূর। ততক্ষণে আদিত্য কথা বলতে বলতে তার পাশ কাটিয়ে কিছুদূর চলে গেছে। গতরাতে ওর মনের কথা জানালো আর আজই অবহেলা। না এই অন্যায় সে সহ্য করবে না। ঠিক এজন্য কারো কাছে দূর্বলতা প্রকাশ
করতে নেই। দূর্বল প্রকাশ করলেই বিপদ। আপন মনে মনে
এসব ভেবে সে আদিত্যের পিছু পিছু হাঁটতে লাগল। আদিত্য
কথা বলতে বলতে আরো সামনে এগিয়ে গেল। রাস্তার দুই ধারে গাছ লাগানো। তার পাশে আবাদি জমি। সেখানে নানা
রকমের ফসল লাগানো। আদিত্যের পিছু পিছু এসব দেখতে দেখতেই হাঁটছিল মেধা। হঠাৎ আদিত্য কথা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল আর মেধা স্বজোরে বারি খেলো ওর পিঠে। নাকে খুব ব্যথা পেয়ে মেধা রেগে বলল,
-”আশ্চর্য! হঠাৎ খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে গেলেন কেন?”
-”তোমার জন্যই তো দাঁড়ালাম।”
-”দাঁড়াতে বলেছি আমি?”
-”চোখ তো আকাশে নিয়ে হাঁটছো সামনে গোবর পড়ে আছে খেয়াল করেছো?”
-”তো? গোবর গোবরের জায়গায় আমি আমার জায়গায়।”
-”আমি না দাঁড়ালো গোবর গোবরের জায়গায় থাকলেও আপনি থাকতেন না আপনার জায়গায়। আপনার চরণখানা থাকতো দুগন্ধযুক্ত গোবরের মধ্যে। তখন ভালো হতো না?”
আদিত্যের কথা শুনে মেধা সামনে তাকিয়ে জিহবাতে কামড় দিলো। সত্যি সত্যিই গোবর পড়ে আছে মাঝরাস্তায়। তবুও সে নিজের ভুল স্বীকার না করে তেজ দেখিয়ে বলল,
-” দেখেছি আমি। আর পা দিলে দিতাম আপনার কি হুম?”
-”ওহ আচ্ছা।”
একথা বলে আদিত্য তাকে হেঁচকা টানে নিজের কাছে টেনে দিলো এক ধাক্কা দিলো। মেধা গোবরের উপরে পড়ার আগে দ্রুত ধরেও নিলো। তাৎক্ষণিক পুনরায় ছাড়তে গেলে মেধা
চেঁচিয়ে বলল,
-”এই না, না, প্লিজ ছাড়বেন না। ”
-”বেচারা গোবর তোমার আলিঙ্গন চাচ্ছে। ”
-”গোবরের কথা না ভেবে নিজের কথাও বলতে পারতেন। ”
-”বললে কী হতো শুনি?”
-”কাজে করেই নাহয় দেখাতাম কি করতাম?”
-”এই যে মায়াবিনী মেয়ে আপনি আমার থেকে দূরে দূরে থাকবেন। অন্তত আমার বউ হওয়ার আগ পর্যন্ত, বুঝলেন?”
-”কেন শুনি?”
আদিত্য একথার উত্তর না দিয়ে বাসার পথে হাঁটতে লাগল।
মেধা দৌড়ে এসে তার সঙ্গে হাঁটতে লাগল। দু’জনে টুকটাক গল্প করতে করতেই যাচ্ছিল। হঠাৎ মেধা বলে উঠলো,
-”আচ্ছা আমান ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলেন না কেন? জানেন ভাইয়া আপনাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। আপনি ইগনোর করে দেখে ভাইয়া চুপিচুপি কাঁদে, কষ্ট পায়।”
-”এসব কথা এখন থাক।”
-”না আমি জানতে চাই। ”
-”মেধা জেদ কোরো না।”
-”গতরাত থেকে না আমি আপনার গফ? আমাদের না এখন চুটিয়ে প্রেম করার কথা? অথচ আপনি আমাকে বকছেন?”
-”বকলাম কখন? শুধু জেদ করতে নিষেধ করলাম।”
-“করে উদ্ধার করলেন। এবার বলুন আমান ভাইয়া কী দোষ করেছে যে, আপনি ভাইয়ার সঙ্গে এমন রুড বিহেভ করেন, হুম?”
পুরো কথা সম্পূর্ণ হতেই আদিত্য প্যান্টের পকেটে দুই হাত গুঁজে মেধার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। কিছু বলার আগেই সেখানে দৌড়ে এসে উপস্থিত হলো সাথী। দৌড়ে আসায় সে হাঁপিয়ে গেছে। হাঁ করে বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ওর এভাবে আসায় মেধা কথার তাল অন্য দিকে ঘুরিয়ে বলল,
-”এভাবে দৌড়ে এলে যে কিছু হয়েছে?”
-”সূচি আপু তোমাকে এক্ষুণি যেতে বলেছে খুব দরকার। ”
-”কেন?”
-”জানি না। ”
-”ওকে চল।”
একথা বলে মেধা আদিত্যের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করে প্রস্থান করলো। আর আদিত্য ধীর গতিতে হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগল সেদিনের কথা। আদিত্য বরাবরই নিশ্চুপ থাকতে পছন্দ করে আর আমান চটচটে। আর পাঁচটা বড় ভাইয়ের মতো সে আমানকে বলে না এটা করবে না, সেটা করবে না।
তবে সুযোগ মোতাবেক ভালো মন্দের তফাতটা বুঝিয়ে দেয়।
কিন্তু আমানটা শুধরানোর ছেলে নয়৷ বরং ওর নামে দিনকে দিন অভিযোগ আসতেই আছে। আর প্রতিটা অভিযোগই মেয়ে ঘটিত। প্রথমবার এমন কিছু কুৎসিত অভিযোগ শুনে
সে আমানকে একাকি ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিলো,
-”তুমি নিষিদ্ধ পল্লিতে যাওয়া কবে ছাড়বে?”
-”না মানে ভাইয়া আসলেই…!”
-”এসব তোমার থেকে আমি আশা করি নি আমান।”
-”বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে…!”
-”সস্তা অজুহাত হয়ে গেলো না এটা?”
-” আ আমি আ..!”
-”ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করে নাও। বড় ভাই হয়ে এসব বলতে আমার রুচিতে বাঁধে। ”
-”সরি ভাইয়া এমন আর হবে না।”
এরপরেও আমান নিজেকে শুধরায় নি। বড় ছোট অনেকেই ওকে জানাতো আমান মেয়েবাজ। তাকে মাঝেমধ্যেই নিষিদ্ধ পল্লির আশেপাশে দেখা যায়। কিছু বুঝাতে গেলেই হাতাহাতি করতে আসে। বেশ কয়েকজনকে মেরেছোও। নেশাও করে আজকাল। আর নেশার টাকা না থাকলে বাবা- মায়ের সঙ্গে অশান্তি সৃষ্টি করে। এই সবকিছু জানে সে। আমানকে আরো একটা সুযোগ দিচ্ছে শুধরানোর। এরপর যখন পুনরায় ওর মুখোমুখি হবে তখন নাহয়…! এসব ভাবতে ভাবতেই বাসায় পৌঁছে নিজের বরাদ্দকৃত রুমে চলে গেল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাসায় সাড়া শোরগোলও বেড়েছে। আজ গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠান। এর একটুপরেই আদিত্য সকালের নাস্তা সেরে বড় মামার সঙ্গে বাজারে যাওয়ার কথা জানাল। বড় মামা বারণ
করলেও শুনলো না।ওর যাওয়ার কথা শুনে মেধা চটজলদি একটা লিস্ট করে ধরিয়ে দিলো। আর বলে দিলো এসব তার চাই-ই চাই। যদি না আনে তবে সে কলুষিত পুরুষ মানুষ। এ কথা শুনে আদিত্য ভ্রু কঁচকে কিছু বলার আগেই মেধা ভৌ দৌড়। তারপর আদিত্য মামার সঙ্গে বেরিয়ে গেলে একজন প্রতিবেশী বলল,
-”সীমা আপা একটা কথা কই কিন্তু মনে কইরেন না।”
-”কি কথা ভাবি?”
-“আপনার ছুডু বইনের মাইয়া দেহি আপনার পোলার লগে চিপক্কাইয়া থাহে সব সুময়। দুনো ডায় জুয়ান পোলা মাইয়া। কখন কী অঘটন ঘইট্টা যায় কওন তো যায় না।হেগোরে এত্তু চুখে চুখে রাইখেন।”
-”চিপকে থাকে মানে?”
সীমা বেগমকে গম্ভীর হতে দেখে মহিলা সুযোগ পেলেন। অতঃপর গলা খাদে এনে বললেন,
-”একটু আগেই দেখলাম আপনার পোলা হেতিরে জড়াইয়া ধইরা গোবরে ফেলবার লাইগ্গা মশকরা করতাছে। হেতিও দেহি, আপনার পোলার কলার ধইরা নখরা করতাছে। ছিঃ! লজ্জা শরমের বালাই নাই।”
-”ওহ।”
সীমা বেগম আর কথা বাড়ালেন না দেখে মহিলা অসুন্তুষ্টই হলেন যেনো। তাই আরো একটুখানি উস্কে দিতে গেলে সীমা বেগম এবার হেসে বললেন,
-”ওদের বিয়ে আগে থেকেই ঠিক করা আছে। আর সতেরো দিন পর ওদের বিয়ে। ওদের দু’জনকে এই হাতে বড় করেছি আমি। তাই জানি ওরা সীমাবদ্ধতা লঙ্ঘন করবে না।”
To be continue……..!!