❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[১৪]
ঘড়িতে এখন রাত আটটা বিশ। দিনের আলোর অস্তিত্ব মুছে এখন নিকষ কালো রাতের রাজত্ব।চারদিকে ঘুটঘুটে আঁধার
। বাসা ভর্তি মেহমান। বিয়ের আয়োজনে হই-হট্টগোল হচ্ছে পুরো বাসা জুড়ে। গ্রামের অনেকেই তা দেখতেও এসেছেন। ভিড় করে অবাক নয়নে দেখছেন শহরের কায়দার কনে কে কীভাবে সাজানো হয়। কত রকমের বাহারি ডিজাইনে ডালা
তৈরি করা হয়। আহা, কি সুন্দর দেখতে! বউয়ের সঙ্গে সঙ্গে সেজেছে বাসাসহ তার বোনরাও। বাদ যায় নি কনের খালা, ফুপিরাও। সবার পরনেই নতুন ঝকঝকে পোশাক। মুখভর্তি হাসি, গা ভর্তি গয়না।সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রাণখোলা হাসি।
গান বাজছে, ছোট বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে।কিছু মহিলারা ভিড় করেছে সূচির আশেপাশে। তাদের মধ্যে চলছে সেলফি তোলার হুটোপুটি। কয়েকজন বসেছে সূচির শশুড় শাশুড়ির
জন্য কেমন রংয়ের পোশাক পাঠাবে সেটা ঠিক করতে। এক কথায় এখন আনন্দমুখর তাদের বাসার পরিবেশ। তন্মধ্যেই মেধা মুখ গোমরা করে বসে আছে। মেজাজ ভীষণ খারাপ। এর জন্য দায়ী অবশ্যই আদিত্য।ওই লোক এমন কাজ করে
না রেগেও পারে না। অদূরে তার মুখের সামনেই বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে আছেন সীমা বেগম। উনার এক হাতে কালো রঙের খুব সুন্দর টপস্ আর সাদা স্কার্ট। তখন আদিত্যের দেওয়া শপিং ব্যাগ থেকে এগুলোই পেয়েছে। অর্থাৎ মেধাকে শাড়ি অথবা থ্রি পিচ পরতে নিষেধ করে নিত্যদিনের মতোই টপস্
আর স্কার্ট পরতে বলেছে। তাছাড়া কারো হলুদের অনুষ্ঠানে কেউ স্কার্ট পড়ে ঘুরে? একথা আদিত্যদের মাথায় আসলো কীভাবে? নাকি এই তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার ফল! আদিত্যের পছন্দের উপর সীমা বেগমেরও যথেষ্ট ভরসা ছিলো। কিন্তু এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে উনার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।উনি এতদিন ভুল
জানতেন। এইদিকে মেধাও জেদ ধরে বসে আছে। এই ড্রেস নাকি সে পরবেই না। কোথায় ভেবেছিলো আজকে হুর পরী সেজে আদিত্যের মাথাটা ঘুরিয়ে দিবে। প্রেমটা জমিয়ে ক্ষীর করে ফেলবে। কিন্তু না, তাকে স্কার্ট পরে কচি বালিকা সেজে থাকতে হবে। সবাই দেখলে কী বা বলেবে? তাছাড়া একদিন শাড়ি পরে ড্রেনে পরেছিল বলে কি বারবার পড়বে?এ কেমন কথা? আজ যত বাঁধা আসুক শাড়ি সে পরবেই পরবে। আর অক্ষত অবস্থা থেকে আদিত্যকে দেখিয়ে দিবে। মোদ্দাকথা, আদিত্য এখন তার প্রেমিক। আর প্রেমিক হবে রোমান্টিকের গোডাউন। হুটহাট করে যখন যখন আদুরে আদুরে আবদার করে বসবে। আর সে তার আবদার না রাখার ভান করে পরে পূরণ করবে। তবেই না প্রেম জমবে। কিন্তু না এই লোক কিছু বোঝে না। সে শুধু জানে ফাইলে ঘাটতে আর বিনা কারণে
তাকে ভুল বুঝতে, বকতে।ওহ হো সে আবার রোমান্টিকতার মানে বোঝে অন্যভাবে। ফাজিল, বদ লোক একটা। এতক্ষণ বুঝিয়েও মেধাকে গোঁ ধরে বসে থাকতে দেখে সীমা বেগম
উঠে বেরিয়ে গেলেন। মিনিট দশেক পরেই একটা শাড়ি নিয়ে ফিরে এলেন। তখন মেধা শাড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল,
-”এটা কার? তুমি কোথায় পেলে?”
-”ব্লাউজটা পরে আয়, আমি শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছি।”
-”আগে বলো এটা কার?”
-”তোর, আদিত্য এনে দিলো।”
-”এখন? তবে কি শাড়ি আনতে বাইরে গিয়েছিলো?”
-“হুম।”
-”তোমার জন্য আনে নি?”
-”এনেছে।”
মেধার মুখে হাসি দেখে সীমা বেগম হেসে ওকে শাড়ি পরাতে
লাগলেন। খুব সুন্দর করে পরিয়ে দিলেন শাড়িটা। তারপর
হালকা সাজিয়ে দিয়ে চুলের খোঁপায় বেলি ফুলের গাঁজরা গুঁজে দিতে দিতে বললেন,
-” মাশাল্লাহ, আমার মেয়েটাকে খুব সুন্দর লাগছে। যা গিয়ে আদিত্যকে দেখিয়ে আয়।”
-”উমম, উনাকে কেন দেখাতে যাবো? পারবো না দেখাতে।”
একথা বলে মেধা মুখ ভেংচি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল।
ওকে যেতে দেখে সীমা বেগম হাসলেন। তারপর উনি নিজে গেলেন রেডি হতে। মেধা আদিত্যের রুমে উঁকিঝুকি মেরে না পেয়ে পা বাড়াতেই দেখে আদিত্য ফোনে কথা বলতে বলতে রুমে ঢুকছে। তাকে দেখেও আদিত্য প্রতিক্রিয়া দেখালো না, বরং কল কেটে দরজা আঁটকে ওয়াশরুমে চলে গেল। মিনিট
পাঁচেক পরেই হাত, মুখ, ধুয়ে বেরিয়ে এলো।পরনের টি-শার্ট বদলে আরেকটা টি শার্ট পরেছে। যদিও সে বরাবরই সুদর্শন, পরিপাটি। আদিত্য হাত মুখ মুছে আড়চোখে একবার মেধার দিকে তাকালো। মেধা তার দিকেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে গিলে খাবে তাকে। তখন আদিত্য বলল,
-”কিছু বলবে?”
-”রেডি হচ্ছেন না কেন?”
-”তুমি এত সেজেছো কেন?”
-”আপনাকে পটাতে।”
মেধার সোজাসাপ্টা জবাবে আদিত্য ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো।
তারপর কয়েক পা এগিয়ে এসে মেধার চোখে চোখ রাখল। মুগ্ধ নয়নের দেখলো প্রিয় মুখটি। অতঃপর মেধাকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চুপ হয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। এভাবে সময় গড়াতে লাগল। নড়াচড়া নেই, বাক্য বিনিময় নেই, শুধু একে অন্যকে অনুভব করছে তারা। তখন মেধা আদিত্যের বুকে মুখ গুঁজে বললো,
-”আপনি এমন কেন আদিত্য ভাই?”
-”কেমন?”
-”আপনি কি সত্যি আমায় ভালোবাসেন? নাকি ভালোবাসার অভিনয় করছেন? আচ্ছা আমার কেন মনে হয় যা করছেন সব লোক দেখানো? আমি নাহয় অভিমান থেকে দূরে দূরে থাকতাম। এখন সবটা গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি, তবে?”
-”মন ভালো নেই আমার।”
-”কিছু হয়েছে? বলুন আমায়।”
-”তেমন কিছু না।”
-”ভালোবাসি আদিত্য ভাই, ভীষণ ভালোবাসি।”
মেধার কথা শুনে আদিত্য তাকে ছেড়ে দিলো। দুই গালে হাত রেখে চোখে চোখ রাখল। মেধার চোখে অসীম ভালোবাসার ছাপ।আদিত্য পূর্বের মতো নিশ্চুপ থেকে মেধার ওষ্ঠে নিজের ওষ্ঠ ছুঁইয়ি কপালে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।মেধাকে না
সরতে দিলো আর না নিজে সরলো। এহেন মুহূর্তে আদিত্যের নীরাবতা মেধার মনে ভয়ের সৃষ্টি করলো। সে পুনরায় বাঁধন মুক্ত হতে ব্যর্থ হয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বললো,
-”কি সমস্যা বলছেন না কেন?”
-”আগামীকাল খুব ভোরে আমরা ঢাকায় ফিরে যাবো।”
-”কেন?”
-”গিয়ে জানতে পারবে।”
এইটুকু বলে আদিত্য মেধাকে সেভাবেই জড়িয়ে রাখল ওর বুকের মাঝে। মেধাও চুপটি করে সেভাবেই রইল। তার আর বাইরে যাওয়া হলো না। কাউকে দেখানোও হলো না সাজটা। বাইরে তখনো সবাই হুই-হুল্লোড়ে ব্যস্ত। গানও বাজছে দ্বিগুন শব্দে। আদিত্য আর দাঁড়িয়ে না থেকে মেধাকে নিয়েই শুয়ে পড়লো। মেধার হাতের ফোন বন্ধ করে ছুঁড়ে মারলো অপর দিকে। আর তার ফোন থেকে মেসেজ করে জানিয়ে দিলো সীমা বেগমকে। আদিত্যের বুকে মাথা রেখে মেধা প্রশান্তিতে চোখ বুঝে নিলো।মনযোগ দিয়ে শুনতে লাগল আদিত্যেদের বুকের ধুকপুকানি। সেভাবে থাকতে থাকতেই মেধা ঘুমিয়ে পড়লো। অথচ আদিত্য টেনশনে চোখের পাতা এক করতে পারলো না। সারারাত নির্ঘুমেই কেটে গেল তার। পরেরদিন নতুন এক সকালের সঞ্জার হলো। আজ সূচির বিয়ের দিন।
সকাল থেকেই চলছে তাড়াহুড়ো। বাজারের দিকে যাবে বলে
সত্যটা শুধুমাত্র বড় মামাকে জানিয়ে আদিত্য সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। সকলের মুখটা থমথমে দেখে মেধা কাউকে কিছু বলার সাহস পেলো না।আদিত্য আর সীমা বেগম যা যা
বললো ভদ্র মেয়ের মতো সে তাই করলো।ঘন্টা পেরিয়ে ঠিক
বিকালের দিকে তারা মেধাদের বাসায় পৌঁছালো। এতবার করে জিজ্ঞাসা করলো এই বাসায় কেন? কিন্তু কেউ জবাব দিলো না। অদৃশ্য এক ভয়ে মেধা কুঁকড়ে গেল। তার শরীরও থরথর করে কাঁপতে লাগল। বাসাতে অনেক মানুষের আনা
গোনা। ওকে দেখে অনেকেই করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কেউ বা নিঃশব্দে কাঁদছে। মেধা দৌড়ে গেল বাসার ভেতরে।
আর ওদের ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। রোজোয়ান চৌধুরীর লাশ বাসার ড্রয়িংরুমে। অদূরেই বসে আছে আমান। আরো কয়েকজন আছে তাদের সে চিনে না।
মেধা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বাবার মুখের দিকে। পাশে দাঁড়িয়ে সীমা বেগম কাঁদছে। আদিত্য মায়াভরা দৃষ্টিতে মুখ পানে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ মেধা সেন্স হারিয়ে লুটে পড়লো মেঝেতে। আদিত্য জলদি তাকে ধরে জড়িয়ে নিলো বুকের সাথে। তারপর পানি ছিটিয়ে, তেল মালিশ করেও ওর সেন্স ফিরলো না তার। সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ওকে নিয়ে। কান্না কাটির রোল পড়ে গেল। আদিত্য সময় ব্যয় না করে মেধাকে নিয়ে ছুটলো হসপিটালে। এর প্রায় ঘন্টা খানিক পর, ডাক্তার জানালেন, মাইনর হার্ট এ্যার্টাক করেছে মেধা। আগ বাড়িয়ে কিছু বলাও যাচ্ছে না। সেদিন আর মেধার জ্ঞান ফিরলো না।
আদিত্য কড়া পাহারায় মেধাকে রেখে রোজোয়ান চৌধুরীর দাফন কার্য সম্পূর্ণ করলো। তারপর সীমা বেগমকে বাকিটা সামলে নিতে বলে ছুটলো হসপিটালের পথে।
এই ঘটনার তিনদিন পর মেধার জ্ঞান ফিরলো। সে সর্বপ্রথম চোখ খুলে একটা কথায় জিজ্ঞাসা করলো,
-”আ আম আমার বাবার কি হয়েছিলো?”
To be continue…!!