#মউফুল(৮) —–মার্জিয়া হক।

0
215

#মউফুল(৮)
—–মার্জিয়া হক।

শুক্রবার ডাক্তার আপা দেখে বল্ল, আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে। আলট্রা করে দেখা গেল বাচ্চার বয়স দশ সপ্তাহ। খুব ভালো ব্যাবহার করল ডাক্তার আপা, বাচ্চার বুকের ধুকধুক শব্দও শুনিয়ে দিল। বেশী করে পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে, বিশ্রাম করতে হবে,হাসিখুশী থাকতে হবে বল্ল ডাক্তার আপা।পুষ্টিকর খাবার কি মউফুল এখন জানে। বাড়ি ফিরে জহির খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব শোনে। আপার বাড়ি কাজে যেতেও মানা করে। মউফুল বোঝায় এতটুকু কাজ করলে কিছু হবে না, ভারী কাজ না করলেই হলো।

আপা শাকসব্জী,মাছ খেতে খুব ভালোবাসে। প্রায়দিনই শাক আনে মউফুলকে খাওয়ায় নিজে খায়। প্রতিদিন রাতে মউফুলের জন্য একটুকরো মাছ বরাদ্দ। জহির আগে যে মাঝে মাঝে কাজ ফাঁকি দিত এখন একদমই দেয় না। পয়সা খেলাখেলি কবেই বন্ধ করেছে। প্রতিদিন অন্তত একটা ডিম মউফুল কে খেতেই হবে। নিজে বসে খাওয়ায় জহির। মউফুলের খুব কষ্ট হয় একাএকা খেতে, জহিরকেও বলে একটু খেতে।জহির বলে ” তোমারে খাওয়াইতেছিনা বউ আমার জুঁইফুলরে খাওয়াইতেছি” যেন ওরা জানেই জুঁইফুলই আসছে ঘরে।

আপা ওকে এমন যত্ন করে যেন বড়বোন তার। মউফুলও আপার জন্য প্রাণ দিতে পারে। কেমন করে যেন দুইটা সামাজিক ব্যবধানের মানুষ, আর্থিক স্বচ্ছলতার ব্যবধানের মানুষ এত কাছে চলে আসে। মউফুল দেখে সব শাকই ঢাকায় পাওয়া যায়। আপা একেক দিন একেকটা আনে।”আল্লারে, মানুষ এত শাক খাইতে পারে” মউফুল মনে মনে ভাবে। আপা একদিন কথায় কথায় বলে ঢাকায় সব শাক পাওয়া যায় কিন্তু কাঁটা সহ শাক হয় সেটা পাওয়া যায় না। মউফুল বোঝে আপা কাঁটা খুইরা শাকের কথা বলছে। আহারে আপা আগে বললে দেশের বাড়ি থেকে নিয়ে আসতো! এখন কতদিন যেতে পারবে না। মউফুল সবাইকে বলে রেখেছে এই শাক পেলে যেন এনে দেয়। আপাকে না খাওয়াতে পারলে মনে শান্তি নাই।
দিন পনের পর একজন খবর দিলো বস্তি আর গুদামের মাঝে যে ফাঁকা জায়গা, সেখানে কাঁটা শাক দেখেছে সে। পরদিন দুপুরে আপার বাসায় যাবার আগে মউফুল শাকের সন্ধানে যায়। মউফুল খুব খুশী হয় মনে মনে। শাক তুলে টাটকা টাটকা আপাকে রান্না করে দিবে। আপা কত খুশী হবে ভেবে মনে মনে পুলক অনুভব করে। চারিদিকটা বেশ শুনসান, মউফুল দ্রুত হাত চালায়। হঠাৎ ই পিছন থেকে কেউ এসে মুখ চেপে ধরে বেঁধে ফেলে ঘাড়ে তুলে নেয়। মউফুল হাত পা ছুঁড়ে কিন্তু কিছু করতে পারে না। ওকে গুদাম ঘরে মাটিতে ফেলে দেয় লোকটা। মুখ বাঁধা থাকলেও মউফুল বোঝে ওটা বসির। সংগে আরো তিনজন। এরা মদ খেয়ে মাতাল। লোকগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে মউফুলের উপর যন্ত্রনায় চিৎকার দিতে চায় মউফুল, মুখ বাঁধা থাকার জন্য শুধু গোঁগানী বের হয়। কিছুক্ষন পর মউফুলের মনে হলো জুঁইফুল ওকে ছেড়ে চলে গেল। তারপর অন্ধকার হয়ে যায় পৃথিবীটা।

সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে মউফুলকে পায় না জহির। ভাবে আপার বাড়ির কাজ শেষ হয়নি হয়তো। কিন্তু একটু পরই আপা ফোন দেয়। মউফুল কাজে আসেনি কেন জানতে,শরীর খারাপ কি না। জহিরের বুকটা ধ্বক করে ওঠে আপাকে বলে মউফুল বাড়ি নাই। সেতো কোথাও যায়না এসময়! আসেপাশের বাড়িতে খোঁজ করে কেউ বলতে পারে না।অনেকক্ষণ মউফুল কে কেউ দেখেনি। জহির খুঁজতে বের হয় সাথে আরো কয়েকজন প্রতিবেশি। আপাও চলে এসেছে। মউফুল যেন গায়েব। হঠাৎ কেউ একজন বল্ল, দুপুরে মউফুলকে গুদামের সামনে শাক তুলতে দেখেছে। খুব ভয় পেয়ে যায় জহির বসিরের কথা মনে পড়ে। সবাই গুদামের দিকে দৌড়ায়।বসিরের সাথে দেখা হলো।বল্ল,
–” কি খুঁজেন জহির বাই?”
— “আপনার ভাবীরে দেখছেন?”
— “না তো বাবী এইদিক আইব ক্যা?”
মিতার মনে হয় লোকটা সত্যি কথা বলছে না। ওর চেহারার মধ্যে কিছু একটা গোপন করার ভাব ফুটে উঠছে। মিতা এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করলে বসির ঘাবড়ে যায়।পালাতে গেলে সবাই ধরে ফেলে। বসিরের কথামত গুদাম ঘরে মউফুলকে পাওয়া যায়। রক্তের মধ্যে ভাসছে যেন সে। জহির দৌড়ে গিয়ে মউফুলকে বুকে জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। সবাই হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে থাকে। বসিরকে পিছমোড়া করে গাছের সাথে বাঁধা হয়েছে। হঠাৎ মনে হয় জহিরের বুকের সাথে লেগে থাকা মউফুলের বুকটা খুব আস্তে আস্তে ধুকধুক করছে। জহির চিৎকার করে বলে,” হে বাঁইচা আছে আপা” মিতা আপা হাত ধরে নাড়ি পরীক্ষা কর। খুব ধীরে চলছে। দৌড়াদৌড়ি করে জনসেবা ক্লিনিকে নেয়ে হয়। মাজেদা খালা দৌড়া দৌড়ি করে ভর্তি করে। ডাক্তার, নার্স সব হাজির করে ডাক্তার রা খুব একটা আশা দিতে পারে না। প্রচুর রক্ত চলে গেছে শরীর থেকে। বস্তির লোকজন,এনজিও র লোকজন সহ অনেক লোক রক্ত দিতে এসেছে। ক্লিনিকের চারিদিকে মানুষ আর মানুষ। বসিরকে থানায় দেয়া হয়েছে তার আগে আচ্ছামত ধোলাই দিয়েছে লোকজন। মউফুলের শরীরে রক্ত দেয়া হচ্ছে এবং আশার কথা, শরীর সে রক্ত গ্রহন করতে পারছে। শরীরের আঘাত তেমন মারাত্মক নয়। বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেছে। কয়েকদিন অজ্ঞান হয়ে আছে মউফুল। জহির সারাক্ষণ মাথার কাছে বসে, মিতা একটা ছেলেকে দায়িত্ব দিয়েছে জহিরের খাওয়া দাওয়া, দেখাশোনার জন্য। মিতা বুঝতে পেরেছে ওর জন্য শাক তুলতে যেয়ে এই পরিনতি। খুব কষ্ট আর অনুতাপ হয় ওর। অনেক সংস্থার সাথে যোগাযোগ করে আর্থিক সাহায্য এনেছে, নিজেও খরচ করছে। সবার দৃষ্টি কেড়েছে জহির। এমন একটা ঘটনার পরও কেমন আগলে রেখেছে বউকে। না খেয়ে না ঘুমিয়ে সারা দিনরাত বসে আছে পাশে।
মউফুলের যখন জ্ঞান ফিরলো, কতক্ষন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। জহির কাছে গিয়ে হাত ধরে ডাকল ” বউ বউরে।” হঠাৎ কেঁপে উঠলো। এরপর হিস্টিরিয়া রুগীর মত কাঁপতে থাকলো। নার্স ইঞ্জেকশন দেয়ার পর ঘুমিয়ে পড়ল। ডাক্তার মিতা আপার কাছে বল্লেন,শরীরের দিক দিয়ে মউফুল সুস্থ। মনের ভয়ংকর ট্রমা কাটতে অনেক সময় লাগবে। পনের দিন পর ঘরে ফিরলো মউফুল। যেন পাথরের মুর্তি! কারো সাথে কথা বলে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আপা জহিরকে কিছু টাকা দিয়েছে। কয়েকদিন কাজে না যেয়ে মউফুলের কাছে থাকতে। কখন কি করে বসে ভয় হয় তার।
জহির গোসল করায়, খাওয়ায়,চুল আঁচড়ে বেঁধে দেয়। মউফুল যেন এক মরা মানুষ! আপা কয়েকবার মনের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। কাউন্সিলিং, ওষুধ চলছে। ডাক্তার বলেছে এতবড় আঘাত সইতে সময় লাগবে। জহির যেন সব সময় সংগ দেয়। থানা থেকে এসে মউফুলের জবানবন্দি নিয়েছে।বসির পুলিশের কাছে সব স্বীকার করেছে।সংগের বাকি তিনজন ও ধরা পড়েছে।গুদামের মালিক ওদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছে। বস্তির লোকজন কয়েকদিন রাস্তা ঘিরে আন্দোলন করেছে শয়তানদের যেন সর্বোচ্চ সাজা হয়।
মউফুলের চিন্তা ভাবনা করার ক্ষমতা বাড়ছে।প্রথমেই মনে হয়েছে সে একটা নষ্ট মেয়ে। জহিরকে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে। প্রতিবেশীরা আসে কথা বলে বোঝায়। জহির সব সময় বোঝায় মউফুলের কোন দোষ নাই তাহলে সে এমন করছে কেন? যারা দোষ করেছে তাদের অনেক শাস্তি হবে। জহির গায়ে হাত দিতে গেলে মউফুল সরে সরে যায়, নিজেকে অপবিত্র মনে হয়। মানসিক ডাক্তার, মিতা আপা,প্রতিবেশীরা এবং সর্বোপরি জহিরের প্রাণপন চেষ্টায় মউফুল একটু একটু করে সুস্থ হয়ে ওঠে।আগে হলে এই ঘটনা বস্তিবাসী কিভাবে নিত কে জানে? মিতা আপার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আর বাচনভঙ্গি, বুঝাবার অপরিসীম ক্ষমতা,ধৈর্য এই দুই বছরে পালটে দিয়েছে সবার মানসিকতা।

মিতা অবাক হয় জহিরকে দেখে। এইরকম একটা ঘটনা ঘটলে অনেক শিক্ষিত মানুষই বউকে ত্যাগ করত। সেখানে প্রায় অশিক্ষিত, গ্রামের খুব সাধারণ ছেলে কিভাবে বউয়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে, সেবাযত্ন করে সারিয়ে তুলছে। শুধু ভালোবাসা মানুষকে এত উদার করে?? এমনি করে ভালোবাসতে কয়টা মানুষ পারে?? জহিরের মত মানুষের কাছ থেকে সমাজের অনেক কিছু শেখার আছে। মনে মনে জহিরের জন্য একধরনের শ্রদ্ধা বোধ করে মিতা।শুধু মিতা নয়, বস্তির নারী পুরুষ সবাই জহিরকে এখন শ্রদ্ধার চোখে দেখে। মউফুলের ব্যবহার, সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলা,কারো বিপদে সাহায্য করার জন্য ওকে সবাই খুব ভালোবাসতো। মিতা আপা সবাইকে বারবার বলে দিয়েছে মউফুলের সামনে যেন সেদিনের কথা কেউ ভুলেও না তোলে।

মাস ছয়েক কেটে গেছে….
মউফুল শরীরে, মনে অনেকটাই সুস্থ। গত দুইমাস থেকে জহির আবার কাজে যায়। প্রথমদিন কাজে যাবার আগে নিজের মাথায় মউফুলের হাত রেখে কসম কাটিয়েছে যেন সে উলটা পাল্ট কিছু না করে তাহলে জহিরও নিজেকে শেষ করে দেবে। প্রথম কয়েকদিন কাজে মন বসাতে পারত না। দুরুদুরু বুকে বাড়ি ফিরত।আস্তে আস্তে ভয় কমেছে। গত দুইমাস থেকে আপাও ডেকে নিয়েছে কাজে। কাজের মধ্যে থাকলে সব ভুলে থাকতে পারবে।

মউফুলের ইদানিং মনে হয় এই শরীরটা ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়েছে শকুনেরা। এই শরীর, শরিরের মানুষটাকে আবার আগের মত ভালোবাসতে পারবে জহির? জহির যে এত যত্ন করছে তার,তা কি ভালোবেসে নাকি কর্তব্যে?? কিছুদিন থেকে ভাবনা গুলো কুড়েকুড়ে খাচ্ছে মন। শান্তি পাচ্ছে না কিছুতেই।
একদিন কাজে যায়নি জহির তুমুল বৃষ্টি বাইরে। জহির বলে ” বউরে খুব কাঁচা মরিচ পিঁয়াজ ডইলা খিঁচুড়ি খাইতে মন চাইতেছে। মউফুল খিঁচুড়ি চাপিয়ে উদাস হয়ে বসে থাকে দাওয়ায়। এই রকম ঝুম বৃষ্টিতে গ্রামের বাড়িতে প্রায় সবাই ঘরের বাইরে আসতো। কত মজা করে পুকুরে ঝাঁপ দিত। পুকুর উপচে যেয়ে মাছেরা মাঠের পানিতে চলে আসত, সবাই হই হই করে মাছ ধরত! মাছ ধরার চেয়ে ঝাঁপাঝাঁপি বেশী হতো।
খিঁচুরির সাথে ডিমভাজা আর বেগুনের চাক ভাজা করেছে সে। কাঁচামরিচ আর মোটা মোটা চাকা করে পেঁয়াজ কেটে এনেছে। সাথে সরিষার তেলের বোতল। জহির গোসল করতে যেতে গিয়ে আবার ফিরে এসে মউফুল কে ধরে নিয়ে বৃষ্টি তে নামে, কিছুক্ষণ গোসল করে ফেরে। জহিরের খুবই ক্ষুধা লেগেছে , তাড়াতাড়ি খাবার দিতে বলে। মউফুল খাবার দিয়ে কাপড়গুলো কাচতে যাচ্ছিল। জহির হাতধরে পাশে বসায়। লোকমা তুলে মুখে দেয়। মউফুলের চোখ গড়িয়ে পানি নামে। ” কান্দিস না বউ।খাওনের সুমায় কান্দা উচিত না।” থালাবাসন মাজার জন্য যেতে চাইলেও পরে করতে বলে। আসলে এই কয়মাস মউফুল তাকে এড়িয়ে চলছে। তার সামনে স্বাভাবিক হতে পারছেনা।এটা নিয়ে কথা বলার জন্যই বৃষ্টির বাহানায় বাইরে যায় নি সে। খাওয়ার পর মউফুলকে পাশে নিয়ে বসে জিজ্ঞাসা করে, কি সমস্যা হচ্ছে মউফুলের, সে কেন তাকে এড়িয়ে চলে। এমনি ঘোর বরষায়,এমন মন উদাস করা দিনে কথারা বের হয়ে আসে মন থেকে। ” এমন দিনে তারে বলা যায়…” মউফুলো বল্ল তার জমানো কথা। এইযে এতগুলো মানুষ তার তার শরির ছিন্নভিন্ন করলো,এই শরীরকে কি আর ভালোবাসতে পারবে জহির? এ জীবনে কি আর স্বভাবিক হবে ওদের জীবন। মউফুলকে ছুঁলে ওর কি মনে হবে না?? সেই কথাগুলো?? জহির বলে,” বউ শরীর কি অপবিত্র হয়? অপবিত্র হয় মন। তুমি যদি স্বেচ্ছায় এমন কিছু ঘটাইতা তাইলে আমি তোমারে মানতে পারতাম না। কিন্তু এইহানে তোমার তো কুন দোষ নাই। হুদাই কি সব আবলতাবল ভাবতাছ,??আমার কাছে আইসা বসতো, তাকাও আমার চোখের দিক” মউফুল কাছে সরে আসে জহিরের তাকায় পরিপুর্ণ ভাবে। সে চোখে প্রথম রাতের মতই দেখতে পাচ্ছে দিঘীর জলের মত টলটলে স্বচ্ছ ভালোবাসা।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here