#চন্দ্রাবতীর_রাতে #সৌরভে_সুবাসিনী(moon) #পর্বঃ৯

0
264

#চন্দ্রাবতীর_রাতে
#সৌরভে_সুবাসিনী(moon)
#পর্বঃ৯

ইশরাকদের গাড়ি যখন গ্রাম ছেড়ে শহরের রাস্তায় তখন এশার আজান পড়েছে। ঘন্টাখানেকের পথ পাড়ি দিয়ে বাসায় পৌঁছে ক্লান্ত শরীর বিছানায় সবে মাত্র গা এলিয়েছে ইশরাক।পায়ের জুতো অবধি খুলেনি।
কখনো সখনো দেহের ক্লান্তি থেকে মনের ক্লান্তি মানুষকে অবসন্নতায় ঘিরে বসে। আজ ইশরাকের মন ভীষণ ক্লান্ত। আয়েত্রীকে এতটা ভালো লেগে যাবে বুঝে উঠতে পারেনি ইশরাক। আজ দুপুরে যখন ও বাড়ি পৌঁছে সবে মাত্র বসেছে ঠিক তখন কাউকে বেশ খোঁজাখুঁজি শুরু হয়েছে। যার মাধ্যমে বিয়ের কথা এগুচ্ছে, ইশরাকের ফুপু বললেন,
ও বাড়ির একটা মেয়েকে পাচ্ছে না।মেয়েটা অসুস্থ। ইশরাক ভেবেছিলো হয়তো বাচ্চা মেয়ে। আসার সময় নদীর পাড়ের রাস্তা হয়ে এসেছে। কেনো যেনো মনে হয়, হয়তো বাচ্চা মেয়ে নদীর পাড়ে খেলতে গিয়েছে!
কারণ বাচ্চাদের পানির প্রতি আলাদা টান থাকে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে যখন নদীর পাড়ের দিকে যাচ্ছিলো,
দূর থেকে দেখতে পায় একটা কালো থ্রিপিস পড়া মেয়ে বসে আছে।
নদীর পাড়ের বালি রোদে চিকচিক করছে, শুধু মাত্র মেয়ের হাত দুটো দেখে বুঝতে পারে মেয়েটা রোদের তাপদাহে পুড়ে যাচ্ছে।
তখনি তাকে পাশ কাটিয়ে দেখতে আসা কনের খালু, যে ভদ্রলোকের মেয়ে হারিয়েছে উনি মোটামুটি দৌড়ে সেই মেয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
ইশরাক পিছু পিছু ঢাল বরাবর নেমে যায়।
যখন মেয়েটাকে ভদ্রলোক হাতের বাহু ধরে দাঁড় করায়,
প্রথম যা নজরে আসে তা হলো
রোদের তাপে লাল হয়ে যাওয়া দুটো গাল। টলমলে চোখ, আর নাক টান দেওয়ার ভঙ্গি।
বুঝতে অসুবিধে হয় না এই সেই হারিয়ে যাওয়া মেয়ে। এত বড় মেয়েকে পাচ্ছে না বলে বাবা-ভাইয়ের এত চিন্তার কারণ ইশরাক বুঝে উঠতে পারলো না।বিশ বছরের বেশি হবে তৎক্ষনাৎ মনে পড়লো এই মেয়ে তো অসুস্থ! তাই হয়তো সবার এত চিন্তা।
ভদ্রলোক মেয়েকে পেয়ে কিংবা এই বয়সে দৌড়ে যাওয়ায় বেশ হাপিয়ে উঠেছে। ভাবভঙ্গি তাই প্রকাশ করছে তাই ইশরাক হাত বাড়িয়ে মেয়েটার ডান হাত ধরেছে। মেয়ের বাবাও কিছু বলেনি কেনোনা কোন একটা কারণে,
হয়তো উনি মাথার উপর জ্বলন্ত সূর্য এবং বালির উত্তাপে মেয়েকে নদীর পাড়ে রাখতে চাইছে না।

এই দেখাই কাল হলো ইশরাকের। মানস্পটে বারংবার আঘাত করছে ওই গাল,টলমলে চোখ কিংবা নাক টান দেওয়ার ভঙ্গি। তারপর যখন খাবার পরিবেশন করছিলো তখনের আয়েত্রীর নাক,কপালের বিন্দু বিন্দু পানি ভালো লাগাতে বাধ্য করেছে।
তবুও হয়তো নিজেকে সামলে নিয়েছিলো কিন্তু যখন ওর দুষ্টুমিগুলো সামনে এলো ইশরাক তখন পা পিছলে পড়েই গেলো আয়েত্রী নামক মহা সমুদ্রে।

এসব ভাবতে ভাবতে তন্দ্রা এসে যাচ্ছিলো, ঠিক তখন ইশরাক নিজের বুকের উপর কিছু একটা অনুভব করে। চোখ না মেলেই বুঝতে পারে ছোট ছোট হাত বুলিয়ে দিচ্ছে গাল। হাত বাড়িয়ে বুকে জড়িয়ে নিতেই উচ্চস্বরে কেঁদে উঠে আট মাসের ছোট্ট ভাগ্নে উৎসাহ।
ইলিয়ানা দৌড়ে এসে তার ছেলেকে নিজের কোলে নিতে নিতে বলল,

“ছোট ভাই! উঠে ফ্রেশ হয়ে ঘুমাও না। কতবার বলেছি তোমাদের আর্মি ম্যানদের শরীরে এইটুকুন বাচ্চাদের এভাবে চেপে ধরবে না। আমার ছেলের হইছেও কপাল! বাপ-মামারা সব গুলার শরীর এমন পাথরের যে তাদের কাছে বাচ্চারে দিতেই আমার ভয় লাগে। ”

নিজের সাথে নিজে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে যায় ইলিয়ানা। বেচারি স্বামীর উপর ভীষণ ক্ষেপে আছে। ভদ্রলোক মিশনে গিয়েছেন, তখন উৎসাহ পেটে ছিলো। এখন উৎসাহের বয়স আট মাস, তবুও বাবাকে দেখার ভাগ্য হয়নি। খুব দ্রুত ফিরে আসবে এটাই আশা করছে সবাই।
ফ্রেশ হয়ে বের হতে না হতেই ইলিয়ানা এসে ইশরাকের হাত ধরে ড্রয়িংরুমে নিয়ে যায়। সবার দৃষ্টি সামনে রাখা ল্যাপটপে।

বুঝতে অসুবিধে হলো না এটা আয়েত্রীদের বাড়ি।
দুয়ারে কাঠের টুলে বসে আছে প্রত্যাশা।
বাকী চার বোন বৃত্তাকারে প্রতীর চার পাশে ঘুরছে, দুহাতে পড়া কাঁচের চুড়ি নির্দিষ্ট সময় পরপর বাজিয়ে কিছু বলছে। ইস্তিয়াক কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে,

“মা! ওরা কি করছে? ”

“উফ ভাই কথা বলিস না তো, ওরা বিয়ের গীত গাইছে।”

মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করলে শুনতে পায় চারবোনের কন্ঠে বিয়ের গীত,

লীলা বালী লীলা বালী ভর যুবতী সই গো,
কি দিয়া সাজাইমু তোরে?
মাথা চাইয়া সিন্থি দিমু ঝাঝরি লাগাইয়া সই গো,কি দিয়া সাজাইমু তোরে?নাক চাইয়া নাকফুল দিমু মতিয়া লাগাইয়া সই গো,
কি দিয়া সাজাইমু তোরে?কান চাইয়া কানপাশা দিমু পান্না লাগাইয়া সই গো,
কি দিয়া সাজাইমু তোরে?
গলা চাইয়া নেকলেচ দিমু সুনা লাগাইয়া সই গো, কি দিয়া সাজাইমু তোরে?আংগুল চাইয়া আংটি দিমু পান্না লাগাইয়া সই গো,
কি দিয়া সাজাইমু তোরে?শরীল চাইয়া শাড়ি দিমু ঝাঝর লাগাইয়া সই গো,কি দিয়া সাজাইমু তোরে?

বিয়ের এমন রীতিনীতি শুধু শুনেছিলো এমনটা দেখে অভিভূত হয়ে পড়ে সবাই৷ ভাগ্যিস এখন কল দিয়েছিলো ইলিয়ানা৷ না হলে হয়তো এই মূহুর্ত মিস করে যেত।

বেশ গভীররাতে প্রতী ইস্তিয়াকের সাথে কথা বলছিলো। জড়তা কি কয়েকঘন্টায় কাটে? তবুও চেষ্টা করছে এই আর কি। তবে ইস্তিয়াক কৌশলে জিজ্ঞেস করছে আয়েত্রী কি অসুখ। প্রতীও বিচক্ষণতার সঙ্গে এড়িয়ে যাচ্ছে। আকাশে এক বিশাল থালার মতন চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। আয়েত্রী বিছানায় শুয়ে পা দুলাচ্ছে সাথে আনার চিবুচ্ছে।
আনার চিবুতে চিবুতে প্রতীর উদ্দেশ্যে বলল,

“এই দুলাভাই এর সাথে কথা বলবো। দে তো! ”

প্রতী মুচকি হেসে ফোন এগিয়ে দিয়ে পাশে বসে। আয়েত্রী কথা বলা শুরু করে।এদিকে একটা অফিসিয়াল দরকারে ইশরাক সবে মাত্র এসেছে ভাইয়ের রুমে।ফোনে ব্যস্ত দেখে চলে যাচ্ছিলো ঠিক তখন ইস্তিয়াক ইশারায় আসতে বলে ফোন লাউড স্পিকার মুডে রাখে….

” আচ্ছা বলুন তো! আমি আপনার কয় নাম্বার শালী?আল্লাহ্! দেখেছেন, আপনার কি ভাগ্য? চার চারটে শালী পাচ্ছেন। যাকে বলে রাজ কপাল।”

“হ্যাঁ তা তো অবশ্যই! এখন কেমন আছো তুমি? আরো ব্লিডিং হয়েছিলো? ”

“ওটা নতুন কিছু না।পনেরো বছর যাবত হচ্ছে, থামছে এসব বাদ দিন।”

“কি এমন রোগ তোমার যে এমন হয়?”

“জানি না।তবে এটা জানি আমার মৃত্যুতে শেষ হবে সব।”

জীবন হচ্ছে স্বপ্ন এবং মৃত্যু বাস্তবতা। তবুও আমরা মৃত্যুকে বড্ড ভয় পাই। চোখের সামনে অনেক লাশ দেখেছে,দেখেছে আহাজারি তবুও আয়েত্রীর কথা শূলের মতন বিধলো ঠিক মস্তিকের নিউরনে। ঝাঝালো গলায় ইশরাক উত্তর দিলো,

” এক থাপ্পড়ে ২৮ টা দাঁত ফেলে দেবো। আরেক বার এসব বললে।”

বিস্ময়ময় কন্ঠে আয়েত্রী জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি জানলেন কিভাবে আমার দাঁত ২৮ টা? ”

“আক্কেল দাঁত উঠলে তো আক্কেল থাকতো। আক্কেল নাই তাইতো এসব বলছো…”

“ওয়েট আপনি ইস্তি ভাইয়া না! আপনি কে? ”

দুই ভাই একই সময় বললেন,
“হু ইজ ইস্তি?”
“ইস্তিয়াক – ছোট করে ইস্তি। যেমন প্রত্যাশা -প্রতী। ”

ভারী কন্ঠে ইশরাক জবাব দেয়,

“হুম! আমি ইশরাক। বাই দি ওয়ে আমার নামের শর্ট ফ্রমের দরকার নেই।”

“আমি দুলাভাইয়ের সাথে জরুরি কথা বলবো ফোনটা তাকে দিন কচি বেয়াই মশাই।”

“বুড়ি বেয়ান আগে আমাকে বলুন কি দরকার।”

“আসলে আমি বাসর খাট নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু মনে হচ্ছে ভাইয়া না আপনাকে বলাই ঠিক হবে।নিজের বাসর খাট তো আর নিজে সাজানো যায় না।আপনিই তো সাজাবে। তাই না?আচ্ছা বাসর খাট কি দিয়ে সাজাবেন? শুনেন, প্রতীর কিন্তু রজনীগন্ধায় ভিষণ বিরক্তি।আচ্ছা আপনাদের বাসায় মশারী আছে তো? এক কাজ করতে পারেন পুরো মশারীতে বেলি ফুলের মালার আবরণ দিবেন। দশটা বেলির পর একটা রঙীন গোলাপ। বিভিন্ন রঙের গোলাপ। তবে মশারী কিন্তু মাস্ট। ”

আয়েত্রীর কথা শুনে দুই ভাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। বিয়ের খাটে মশারী কে টানায়? তাছাড়া আয়েত্রী এতটা অবলীলায় কিভাবে বলছে?মেয়ের কি লজ্জা করছে না? ”

” আপনার ফোন নাম্বার টা দিন।”

ইশরাকের কথায় আয়েত্রী বলল,
“কেনো?”

“ভাইয়ার কথায় ডিস্টার্ব হচ্ছে। বরং আমরা আলাদা এ বিষয়ে আলোচনা করে নিচ্ছি। ”

কথা শেষেই ভাইয়ের দিকে ফিরে চোখ টিপে ইশারা করলো।ইস্তিয়াক হেসে পিঠে চাপড় মেরে সম্মতি জানায়।

“কিন্তু আমার তো ফোন নেই।”
“নাম্বার না দিলে না দেবেন। মিথ্যে বলছেন কেনো?”

এবার প্রতী বলল,

“সত্যি ওর ফোন নেই। কাল সন্ধ্যেবেলায় ওর সকল ব্যবহার্য জিনিসপত্র জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আপনাকে আমি নাম্বার দিচ্ছি। ওটাতে কল দিন। ”

ইশরাক, ইস্তিয়াক কথা ঘাটালো না।কারণ খুব দ্রুত প্রতী নিজে থেকেই সবটা বলবে এমনটা ওদের বিশ্বাস।
নাম্বার নিয়ে ইশরাক চলে যায়, এদিকে কল আসে আয়েত্রীর হাতে থাকা ফোনে।

“বাসর খাটে মশারী থাকে না মিস.আয়েত্রী। ”

“বাহ্ রে! বাসর বলে কি আর মশা কামড়ানো বাদ দেবে? এমনিতেই চারিদিকে যে হারে ডেংগু হচ্ছে।তাছাড়া প্রতী মশারী ছাড়া ঘুমায় না। পিচ্চি বেয়াই। ”

“গুনে গুনে ছয় বছরের বড় আমি তোমার।”

ঘড়িতে জানান দিচ্ছে রাত একটা বেজেছে। ইশরাকের শেষ কথা আয়েত্রীর কান অবধি পৌঁছেছে কি না বুঝা যাচ্ছে না।
নিভু নিভু কন্ঠে আয়েত্রী বলল,

“আমি রাখছি। বড্ড ক্লান্ত লাগছে।”

পুরো আকাশে কোথাও মেঘের আনাগোনা নেই। নদীর পাড়ে হাতের বা দিকে বাঁশের মাচানে বসে শাওন সবে মাত্র পানিতে পা ডুবিয়েছে। পরিবেশ ভুতুড়ে হলেও বেশ লাগে একা একা বসতে।
বর্ষায় এখানটায় বসে মাছ ধরে অনেকে।
সিগারেটের নেশা কোন কালে ছিলো না। কিন্তু ইদানীং এক অদ্ভুত নেশায় ধরেছে। আয়েত্রীর নেশায়।
এ নেশায় মেয়ের জীবন শেষ করে দিতে পারে তবুও কিছুই হচ্ছে না।গতরাতে আয়েত্রী আসেনি। আজ আসবে বলে মনে হচ্ছে না।

“এই ঠান্ডায় পায়ে পানি? জমে যাবেন তো?”

আয়েত্রীর কন্ঠশুনে মৃদু হেসে শাওন জবাব দেয়,

” অশরীরীরা জমে যায় বুঝি?”
“ভয় দেখাচ্ছেন? ”
“ভয় পাচ্ছেন?”
“না! আফটার অল আ’ম আ ব্রেভ উইমেন…”
“কংগ্রেস! ”

আয়েত্রীর ইচ্ছে হচ্ছিলো শাওনের হাত স্পর্শ করে স্বপ্নের কথাটা বলতে। কিন্তু পারলো না।
হঠাৎ মনে হচ্ছে কেউ একজন তার পিঠ বরাবর সূচালো কিছু দিয়ে অনবরত আঘাত করছে, পেটের সবকিছু বাহিরে চলে আসছে। কয়েক মূহুর্তে নাক মুখ দিয়ে রক্ত চলে এসেছে। অথচ শাওন যেনো নির্বাক। তার চোখেমুখে বেদনার ছাপ স্পষ্ট।
শুধু বিরবির করে শাওন বলল,

“বলেছিলাম আয়েত্রী এখানে আসবেন না।চোখে দেখা সব সত্য হয় না।আমি আমি নই। যে আমাকে আপনি খুঁজে এখানে এসেছেন সে এখানে আসে নি আজ।”

আয়েত্রীর চোখের সামনে হঠাৎ করে শাওন মিলিয়ে যাচ্ছিলো। নিভু নিভু চোখে আয়েত্রী শুধু দেখলো শাওন মিলিয়ে যাচ্ছে নদীর পানির উপরের কুয়াশায়।

চলবে
#ছবিয়ালঃমাহমুদা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here