#মউফুল(১) –মার্জিয়া হক।

0
547

#মউফুল(১)
–মার্জিয়া হক।

পাঁচ বছর বিয়ে হয়েছে মউফুলের। স্বামী জহিরুদ্দিন,ভ্যান চালায়। ওদের কোন বাচ্চা নেই। কার দোষে বাচ্চা হয় না জানে না কেউই কিন্তু সমাজের রীতি অনুযায়ী মউফুলের ঘাড়েই দোষটা পড়ে। তবে শাশুড়ি, ননদ কেউ সাথে না থাকায় সারাদিন উঠতে বসতে কথা শুনতে হয় না। স্বামীর এসব নিয়ে ম্যাথা ব্যাথা নাই । সকালে ভ্যান নিয়ে বের হয় সন্ধ্যায় ফিরে,মাঝে মাঝে মন না চাইলে কাজে যায়না। ঘরে তখন খাবার বাড়ন্ত হয়। মউফুল মানুষের বাসায় কাজ করতে চায় তাও দেবে না তাতে নাকি বাবুর প্রেস্টিজ চলে যায়। “পেটে নাই ভাত, পেট শুকায়ে থাক ” মউফুল গজগজ করে। জহির মদ খায় না তবে হাতে দুইটা পয়সা থাকলেই জুয়ায় বসে যায়। খাবার না থাকলে মুড়ি চিবিয়ে পানি খেয়ে থাকে। কোনদিন মাছ মাংস যদি কিনে, একা খায় না মউফুলের সাথে ভাগ করে খায়। যেদিন কাজে যায় ফেরার সময় হাতে দুইটা জিলাপি, গজা, নয় ঝুরি ভাজা নিয়ে আসে। গায়ে হাত তোলে না কখনও। বস্তির সবাই বলে স্বামী সোহাগিনী।

অনেক মহিলা সারাদিন লোকের বাড়ি কাজ করে রাতে যে খাবার নিয়ে ফেরে তার মাছটা, মাংসটা স্বামীর পেটে যায়। বেতনের টাকা এনে স্বামীকে দেয়, আর না দিলে চুরি করে নিয়ে পালিয়ে যায়, কয়দিন লাপাত্তা থাকার পর ফিরে এসে এমন ভাব ধরে যেন সকালেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এই ফিরল। বউয়ের টা খায়, সারাদিন ঘুমায় আবার এদিক সেদিক হলে বউকে পিটায়। বড় সুখ এই পুরুষগুলোর। বউ পিটানি খেয়েও নির্বিকার, তাওতো স্বামী ঘরে আসে, অন্য জায়গায় বিয়ে বসেনি, অন্য মেয়েছেলের ঘরে ঢুঁ দেয় নি। কেউ কেউ মাঝে মাঝে মাছ মাংসের টুকরাটা স্বামী আসার আগেই বাচ্চাকে খাইয়ে দেয়, মানা করে দেয় যেন না বলে বাপ কে। মউফুলের পাশের ঘরে ফারুকের মা থাকে। তিন বছরের ফারুককে খুব ভালোবাসে মউফুল। সে ও মউফুলের ন্যাওটা। ওর কাছে রেখে কাজে যায় ওর মা। ফারুকের শরীরের মিষ্টি আদর আদর গন্ধ খুব টানে মউফুলকে। ফারুককে দুপুর বেলায় বুকের কাছে নিয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে স্বপ্ন দেখে মউফুল,একটা ছোট্ট পরীর।

ফারুকের বাপটা খাটাস প্রকৃতির। একদিন ফারুকের বাপ একটা ডিম এনে ফারুকের মাকে রাঁধতে বলেছিল রাতে এসে খাবে। তিন বছরের ফারুক ডিম দেখে কান্না জুড়ে দেয় খাওয়ার জন্য। ফারুকের মা অর্ধেক ডিম ফারুককে দিয়ে বাকিটা ওর বাপের জন্য রেখেছিল। ছেলেকে অর্ধেক ডিম দেবার অপরাধে ফারুকের মা কে ওর বাপ এতই পিটায় যে রক্তারক্তি কান্ড ঘটে যায়। মাজেদা খালা ডাক্তারের কাছে নিলে সেলাই পড়ে কপালে আর ওষুধ একগাদা। সুস্থ হতে অনেক সময় লাগে। মেরে ধরে এগার দিন বাড়ি আসেনি ফারুকের বাপ। এরপর ফিরে এলে আবার স্বাভাবিক জীবন।

মাজেদা খালা মধ্যবয়স্ক একজন নারী তার মধ্যে জন্মগত নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা আছে। কিছু পড়াশোনা জানে। বস্তির মেয়েদের সুখ দুঃখে পাশে থাকে সবসময়। তাই সবার সম্মানের মানুষ সে। অনেক বউ পিটানো বদমেজাজী স্বামীরাও তাকে ভয় খায়। মজেদা খালার গড়নও পুরুষালি, উঁচা, লম্বাচওড়া। স্বামী এক ছেলে সহ রেখে কোথায় লাপাত্তা। বস্তির বাইরে যে জনসেবা ক্লিনিক, তার আয়া।

মউফুলদের বস্তির পাশে এক ঝকঝকে দালান তার সাততলায় এক আপা এসেছে ভাড়া। বাড়িওলার কেমন আত্মীয় তাই বাসা পেয়েছে ৷ তা না হলে ঢাকা শহরে একলা মেয়েছেলে কিংবা পুরুষ মানুষের বাসা পাওয়া দুস্কর। জহির ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে গেলে মউফুল একচিলতে বারান্দায় এসে বসে। টুকটাক হাতের কাজ করে, মজুরী খুব কম তবু দুইটা পয়সা আসে হাতে। মাজেদা খালা ওদের বস্তির মেয়েদের এইসব কাজ জোগাড় করে দেয়। মউফুলের মাটির ব্যংক আছে, সেখানে টাকা জমায়। অনেক মেয়েরা অর্ধেক টাকা ঘরে আনে বাকিটা মাজেদা খালার কাছে রাখে।খালার ব্যাংক একাউন্ট আছে। একটা খাতায় আলাদা আলাদা নামে লিখা আছে কার কত টাকা। সাততালার আপা মাজেদাকে ধরেছে একটা কাজের মেয়ের জন্য,যেন বিশ্বাসী হয়। সে সারাদিন বাড়ি থাকেনা সকালে নাস্তা সেরে চলে যায়,দুপুরে অফিসে খাওয়া। তাই সন্ধ্যার মধ্যে সংসারের কাজ করে সামান্য একা মানুষের রান্না করে চলে আসবে। মাজেদা জহিরের অসম্মতির কথা জানে তাই জহিরের সাথে কথা বলে,বোঝায় একেবারে বস্তি লাগোয়া বাড়ি, অল্প কাজ, বেতন বেশী এ সুযোগ কাজে লাগানো উচিৎ। মাজেদা খালার কথা ফেলতে পারে না জহির, কাজে লেগে যায় মউফুল। আপার নাম মিতা। আপা বস্তিবাসী অসহায় নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করে। সবাই উনাকে এনজিও আপা বলে ডাকে। কেউ কেউ এঞ্জি আপাও বলে। উনী হাসি মুখেই জবাব দেন। এই বস্তিবাসী মানুষগুলোর জীবনমান উন্নয়নের উদ্দেশ্যেই এখানে আসা উনার।
উনী মাঝে মাঝে এসে বসেন এর তার ঘরের দাওয়ায়, তাদের জীবনের গল্প শোনেন। প্রায় বাড়ির মহিলারা সকালে কাজে যায় সন্ধ্যায় ফেরে। পুরুষগুলো কাজে গেলে যায় নয়তো বাঁধের উপর মাচায় বসে তাস খেলে। অল্পস্বল্প পয়সার ব্যাবহার ও হয় অর্থাৎ গরিবানা কায়দায় জুয়া আর কি।

#মউফুল(২)
–মার্জিয়া হক।

মউফুলের শুধু আপার বাসায় কাজ। একটা মানুষের কাজ শেষ করতে কত আর সময় লাগে! আপার পাখির আহার একবার রাঁধলে তিনবার সেই খাবারে চলে যায়। প্রায়ই মউফুল কে খাবার ধরে দেয়। ঘরে জিনিস বলতে কিছুই নাই। খাট, আলমারীর মত একটা জিনিস তার সাথেই আয়না একটা ফ্রিজ আর একটা টেবিল। অল্প কিছু হাঁড়িকুঁড়ি। একটা টিভি পর্যন্ত নাই। লটপট না কি বলে,সেটা নিয়ে সারাদিন কি সব করে। মউফুল সকাল আটটার মধ্যে চলে যায় গিয়ে নাস্তা বানায়। চারটা রুটি,ভাজি,কোনদিন হালুয়া। আপা আগে দুধের মধ্যে কি সব গুলে গুলে খেত, মউফুল ই রুটির কথা বলে। আপা খুশি ই হয়। বলে বানানোর আলিস্যিতে খাওয়া হয় না অনেকদিন। মউফুলের জন্য বরাদ্দ রুটি দুইটা সে ঘরে নিয়ে আসে জহির খায়। আপার বাড়িতে চা দিয়ে একটা বিস্কুট খায় তাতেই চলে যায় ওর। আপা অফিস যায় মউফুল বাড়ি ফিরে আসে। সংসারের কাজ সারে, বস্তির ঘরটুকু সাজিয়ে গুজিয়ে রাখে।বাচ্চা কাচ্চা নাই আগোছালো করার কেউ নাই। মউফুলের খুব সখ একটা মেয়ের। সারাদিন গুটগুট করে হাঁটবে। মা মা করে আঁচল ধরে ঘুরবে। কিন্তু আল্লাহ দেয় না। ডাক্তার দেখানো বিলাসিতা ওদের কাছে। এতদিনেও স্বামী যে ঘরে আর একটা বউ তোলে নি এই বা কম কিসে?

আপা মানুষটা খুব ভালো।
আপা সপ্তাহে এক দুইদিন কয়েকঘরের মহিলাদের সাথে কথা বলে, কি কি কাগজে লিখে। সন্ধ্যার পরও আসে অনেকক্ষণ কথা বলে সাথে মউফুল কে নেয়। মাঝে মাঝে পুরুষদের সাথেও কথা বলে। মাস দুয়েক চলে গেছে এসব কাজে।

একদিন বস্তিতে একটা ঘর ভাড়া নিলেন উনারা, ওখানে নাকি সন্ধ্যার পর বয়স্কদের পড়াশোনা করানো হবে। দিনে বাচ্চাদের ক্লাস, প্রাথমিক চিকিৎসা, পরিবার পরিকল্পনা সেবা,পুষ্টি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে জ্ঞান দেয়া হবে।
আরো কিছু ছেলেমেয়ে আসলো এবার, ওরা নাকি ইউনিভার্সিটিতে পরে সন্ধ্যার ক্লাস ওরাই নিবে। সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো,যারা পড়তে যাবে তাদের খাবার ফ্রি। ক্লাস শেষে ওদের হাতে প্যাকেট ধরিয়ে দেয়া হবে।
বেশ সাজ সাজ রব পড়ে গেল বস্তিতে।

প্রথমদিন নাম লিখা হলো, অনেক নাম উঠল খাতায়। বই খাতা পেন্সিল, সব নতুন নতুন। মহিলারা সারাদিন কাজ শেষে পড়তে এসে ঢুলে,পুরুষেরা প্রথম প্রথম ক্লাস করলেও আস্তে আস্তে কেটে পড়ে। পড়াতে আসা মেয়েগুলা কেমন জিন্সের প্যান্ট পড়ে,ফতুয়া,শার্ট পড়ে তাই নিয়ে সমালোচনা করে। কেউ কেউ সতর্ক দৃষ্টি রাখে, সত্যিই কি ওদের উদ্দেশ্য বস্তির মানুষের উন্নয়ন নাকি আড়ালে অন্য উদ্দেশ্য আছে। বস্তিতে বিভিন্ন ব্যাবসা চলে রাতের অন্ধকারে। অনেক বড়বড় কেউকেটা লোকজন জড়িত এসবের সাথে।

বড় পর্দা টাংগিয়ে সিনামা দেখিয়ে কতকিছু শেখানো হয়! মউফুলের খুব ভালো লাগে এসব। কত ভালো ভালো কথা বলে এরা! পরিষ্কার থাকলে কত রোগ হয়না।কি খাওয়া ভালো কি ভালো না। মউফুলের মাথা পরিষ্কার তাড়াতাড়ি ধরে ফেলতে পারে সবকিছু। অবসর টুকু ও এদের সাথে কাটায়। হাতে হাতে এটা সেটা করে দেয়। কি সুন্দর করে কথা বলে এরা!

মউফুলের পড়াশোনার খুব ইচ্ছা ছিল। ছোটতে গ্রামের স্কুলে অ, আ, ই, ঈ পর্যন্ত শিখেছিল। বাপ ছিল ঘরামী, একদিন ঘর ছাইতে ছাইতে চাল থেকে পড়ে যায়, ঠাঁ ঠাঁ রোদ ছিল সেদিন। পড়ে গিয়ে বেহুঁস হলো আর তাকালো না।
মা ওকে নিয়ে নানার বাড়ি চলে এলো। নানী আর ছোট মামা বাড়িতে থাকে অন্য মামাদের আলাদা সংসার। মামার কাঁচা তরকারীর ব্যাবসা কোনদিন বেচাবিক্রি হয় কোন দিন হয় না। মা পাড়ার বড় বাড়িতে কাজে লাগলো, প্রচুর জোতজমি তাদের। সারাবছর কিছু না কিছু ফসল উঠে কত কত লোক কাজ করে, কিন্তু বিপত্তি বাধল তখনই যখন বড়বাড়ির বড় মানুষের নজর পড়ল মায়ের উপর। ওই বাড়ির কাজ ছাড়তে হলো তাকে। সব দোষ মায়ের চব্বিশ বছর বয়েসের। তার উপর আবার স্বামী নাই।ষোল বছর বয়েসে বিয়ে হয়েছিল মায়ের, একবছর পরই মউফুল হয়। গরীব হলেও বাপ মানুষটা ভালো ছিল। মাকে ভালোবাসত, মউফুলকে আদর করে জানের টুকরা বলে ডাকত। বাপ কাজ থেকে ফিরলেই ঘাম গায়েই মউফুল বাপের ঘাড়ে উঠে বসত। মা হৈ হৈ করে উঠত একটু জুড়াক মানুষটা। তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে ঘাম মুছিয়ে দিত। কিছুক্ষন মেয়ের সাথে হুটোপুটি করে বাপ বেটিতে নাইতে যেত।এক খাবলা সরিষার তেল মেয়ের মাথায় আর তার মাথায় দিত।কানের ফুঁটা, নাকের ফুঁটা, নাভিতে তেল দিয়ে গোসলে বেরত। এতে নাকি ঠান্ডা লাগে না। মউফুল খুব বাপ ন্যাওটা ছিল।কি ভীষণ খাটতে পারত মানুষটা! পুকুরে মউফুলকে ছুঁড়ে দিয়ে আবার ধরে ফেলত।সাঁতার শিখিয়ে ছিল গুল্টি থাকতেই। গোসল থেকে ফেরার পর রান্না ঘরের দাওয়ায় পাটি পেড়ে দুইটা কাঁসার থালা রাখত মা। থালা দুটো মউফুলের মায়ের বিয়েতে নানার দেয়া। একটা অনেক বড় একটা ছোট। দুইটা কাঁসার গ্লাস একটা বড় একটা ছোট। বাপের থালায় পাহাড় সমান উঁচু ভাত। চুড়াটা গর্ত করে ডাল দিত মা। ভাতের পাশে আলু ভর্তা,লাউয়ের তরকারী,বিলাতি কুমড়ার তরকারী। কখনো কুঁচোমাছের চচ্চড়ি। গাছের লেবু চিপে সড়াৎ সড়াৎ শব্দ করে খেত বাপ। মউফুল বায়না ধরত বাপের মত ঊচু করে ভাত নিবে সে আর অমনি চুড়ার উপর গর্ত করে ডাল দিয়ে সড়াৎ সড়াৎ করে খাবে। তার একমুঠো ভাতে যে এটা করা সম্ভব না বুঝতেই চাইত না, গলা ছেড়ে কাঁদত।বাপ কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে বলত, আমার থালায় খা। মউফুল বাপের কোলের কাছে বসে মুরগীর মত খুঁটে খেত। মাঝে মাঝে ছোট ছোট নলা বাপ মুখে তুলে দিত। সব কিছু কেমন ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ে। খুব মনে পড়ে বাপের জন্য মায়ের চোখে মায়া। কি সুন্দর একটা সংসার ছিল তাদের! কেন সুখ সবার কপালে থাকে না? বাপের ইচ্ছা ছিল মেয়েকে পড়াশোনা শিখাবে নিজেদের মত মুর্খ রাখবে না। সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল।
(রিপোস্ট)
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here