#সুখের_খোঁজে২
(বড় গল্প)
পর্ব ২
বড়মামা আর মেঝোমামা সংজ্ঞাহীন মা কে নিয়ে রওয়ানা দেন হাসপাতালের পথে আর ছোটমামা আমাকে নিয়ে চলেন এয়ারপোর্টের দিকে। ছোটবোন শায়লা আর শর্মীও আমার সাথে যাওয়ার কথা থাকলেও মায়ের হঠাৎ অসুস্থতায় আমিই ওদের মায়ের কাছে থাকতে বলি। একেতো মেয়ে তার ওপর নানা পদের আকাজ করার ঘটনা থাকায় বাবা আমার ব্যাপারে পরবর্তীতে শায়লার ব্যাপারে খুব একটা সচেতন ছিলেন না। আমি লম্বা সময়ের জন্য চলে যাচ্ছি তাই দায়িত্বের অংশ হিসেবে এক দিনের জন্য দেখা করতে এসে কাজে চলে গিয়েছেন গতকাল রাতেই। বাবা নামের দায়িত্ব পালন করতেই বুঝিবা বেশ কিছু টাকাও দিয়েছেন হাতে বিদেশ বিভূয়ে লাগতে পারে ভেবে। টাকাটা অবশ্য আমি মায়ের কাছে দিয়ে দেই মায়ের লাগবে ভেবে।
তখনকার সময়ে ঢাকা শহর এতোটা ব্যস্ত ছিলনা। ছিলনা গাড়ী ঘোড়ার বিপুল সমারোহ। পাশাপাশি এগুতে থাকা মায়ের গাড়ি আর আমার গাড়ির গতিপথ আলাদা হয়ে যেতেই আমি ডুকরে কেঁদে উঠি। সেই প্রথম আমি যেন জীবনের কঠিন বাস্তব দুটো দিকের দেখা একসাথে পেলাম।সেই প্রথম আমার মনে হয় আত্মীয় পরিজনবিহীন এক অজানা পৃথিবীর পথে আমি যাচ্ছি যার সম্পর্কে আমার আদতে কোন ধারনাই নেই। নাখালপাড়া থেকে এয়ারপোর্ট পৌঁছতে খুবই কম সময় লাগে। তখন এয়ারপোর্টে এতো পাহারার কড়াকড়ি ছিলনা।ছোটমামা সহ আমি বসে রইলাম লম্বা সময় বোর্ডিং পাসের জন্য। অবশেষে বোর্ডিংপাস নিয়ে মামাকে জড়িয়ে আরো একপ্রস্থ কান্নাকাটি সেরে দাঁড়াই ইমিগ্রেশনের লাইনে।
ইমিগ্রেশনের লাইনে আমার সামনে আর একজন তখন এমন সময় পেছনে পরিচিত গলায় লায়লা নাম শুনে সামনে না এগিয়ে থমকে দাঁড়াই। নিশ্চয়ই মা আমাকে বিদায় দিতে চলে এসেছে এয়ারপোর্ট ভেবে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি বড়মামা অঝোর ধারায় কাঁদছেন। কেউ আমায় কিছু বলে দেয়নি। কিন্তু আমি বুঝে যাই আমি আমার সবচেয়ে কাছের মানুষকে হারিয়ে ফেলেছি এক জীবনের তরে। আমি আসলে মায়ের মৃতমুখ দেখেই ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম। এ কি প্রহসন জীবন আমাকে নিয়ে করলো? আমি জীবনের কোন পথে হাঁটবো এখন? ইমিগ্রেশন অফিসারের দিকে এক পলক তাকিয়ে হাতের ব্যাগ আর পাসপোর্ট নিয়ে ঘুরে দাঁড়াই।
না আমার সেদিন হাওয়াই জাহাজে চেপে আলোকিত দুবাই শহরের দিকে যাওয়া হয়নি। বরং ফিরে এসেছি আমার প্রিয়জনকে শেষ বিদায় জানাতে। মায়ের লাশ পিছু ফেলে নিজের সংসারকে প্রাধান্য দেয়ার মতো স্বার্থপর হতে পারিনি সেদিন। আমাদের পেছনে সারাদিন ব্যস্ত থাকা মায়ের যে নিজের বলে কোন জীবন ছিলনা তা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানতো? কিন্তু হায় আমারো যে জানা ছিলনা তখন জীবন আমার জন্য কি বিভীষিকাময় ভবিষ্যত সাজিয়ে রেখেছে? আর যদি জানতামও এরকম কিছু সামনের দিনে ঘটবে তাও কি পারতাম সেদিন মামাবাড়ি ফিরে না এসে প্লেনে চাপতে?
বড়মামাই বাদলকে ফোনে জানান সব কথা। আমি কান্নার জন্য কোন কথাই বাদলকে বলতে পারিনি। তবে সেই ছিল বাদলের সাথে আমার শেষ কথা। তারপর বাদলের পরপর দুটো চিঠি আসে। একটাতে লেখা থাকে আমার সাথে জীবন চালানোর অপারগতার কথা আর দ্বিতীয়টা ছিল ডিভোর্সের চিঠি। মায়ের মৃত্যুর কারণে দুবাই যেতে পারিনি এটা জেনেও বাদল এমন কিভাবে করলো ভেবে ওকে কত যে গালাগাল দিয়েছি। তবে জীবনের এ প্রান্তে এসে মনে হয় বাদলের একচেটিয়া দোষও বোধহয় দেয়া যায়না। লোকমুখে শোনা আমার সাথে সংসার করবে বলে গাদা গাদা সাংসারিক জিনিস কিনে সব গুছিয়ে রাখা, দীর্ঘদিন ধরে সংসার শুরু করার পরিকল্পনা সব ভেস্তে যায় সেদিন আমার মামাবাড়ি ফিরে যাওয়াতে। মানুষ আসলে কতবারই আর প্রত্যাশার অপ্রাপ্তি মেনে নিতে পারে? বাদলও তো রক্তমাংসের মানুষ। আমার জন্য ছাড় দিতে দিতে নিজের জীবনই যে শেষের পথে চলে যাচ্ছিল তাই বোধহয় এই কঠোর সিদ্ধান্তে আসা।
মায়ের কুলখানির আয়োজন মূলত করে মামারাই। বাবা পুরো খরচ দিলেও কোথায় যেন তার অনুপস্থিতি ছিল পুরোদমে। মা বাবার সম্পর্কের শীতলতার কথা জানলেও তার শেকড় আদতে কতোটা গভীরে বাবার নির্লিপ্ততা আমাকে সেটা যেন সেদিন কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দেয়। যেন শুধু টাকা দিয়ে দায়িত্ব পালন করেই শেষ। ইতিমধ্যে বাদলের প্রথম চিঠি পেয়েও আমি জবাব দেইনা। মনে করি মায়ের সবকিছু শেষ হলে তারপর কথা বলবো তার সাথে। না তার আর প্রয়োজন হয়নি। বাদল মোহরানা বাবদ আমার প্রাপ্য টাকা পাঠিয়ে দেয় এরই মধ্যে। তার পরপরই চলে আসে ডিভোর্সের কাগজ। সদ্য মা কে হারানোর শোক, বিয়ে ভেঙে যাওয়া এতো কিছুর চাপে আমি তখন ভঙ্গুরপ্রায়।
ফিরে যাই বাবার বাসায়। কিন্তু স্বস্তি মেলেনা সেখানেও। আমাদের গ্রামে দাদাবাড়ির পাশেই বাবা নিজের জন্য ঘর করছিলেন অনেকদিন থেকেই। আমাদের মামার বাসায় দীর্ঘ সময়ের উপস্থিতিতে চাকুরীসূত্রে পাওয়া শহরের বাসার আসবাবপত্র দিন দিন করে জায়গা করে নিতে থাকে গ্রামে নিজেদের বাড়িতে। এক রাতে এ বিষয়ে কথা ওঠায় বাবা জানায় এই বাড়ি উনি ছেড়ে দেবেন দুমাসের মধ্যে। ওনার চাকুরী বাকী আছে আর দুবছর মত। উনি গ্রাম থেকেই সেটা চালিয়ে নেবেন। শর্মীও ততদিনে পড়ালেখার জন্য হোস্টেলে উঠে গেছে। কাজেই শহরের বাড়ির কোন প্রয়োজন আর তার নেই। আমি যেখানেই থাকি তার আপত্তি নেই এটাও জানালেন।
গ্রামে কিছুদিন থেকে ভাল না লাগায় ফিরে আসি মামার বাসায়। মা বেঁচে থাকার সময় যতোটা ভালবাসা আর যত্ন আমাদের হতো মামাবাড়িতে তার অবর্তমানে কোথায় যেন একটা ঘাটতি চোখে পরে। হয়তো বাস্তবতার চশমা তখনো চোখে সেঁটে বসেনি দেখে আমার প্রত্যাশাটুকু তখনো আগের মতোই ছিল। কিন্তু আমার উপস্থিতি তাদের বাড়িতে তখন নানা পদের বিড়ম্বনার কারণ হতে শুরু করলো। এক রাতে শুনে ফেলি দুই মামী বসে আলোচনা করছেন আমার কারণে তার মেয়েদের ভবিষ্যত নষ্ট হতে পারে। কি অপমান! অথচ মামাতো বোনেরা বয়সে আমার চেয়ে অনেকই ছোট। পরদিন সকালেই কাউকে কিছু না বলে চলে আসি গ্রামে বাবার বাসায়।
বাবার বাড়িতে যে কি দারুন বিস্ময় আমার অপেক্ষায় ছিল তা জানলে বোধহয় পথ পাল্টে অন্যপথে যেতাম। অবশ্য কোন পথই বা আমার জন্য খোলা ছিল আর? বাবার পাশে আমার চেয়ে বয়সে খানিক বড় একজন মহিলা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বাবা পরিচয় করিয়ে দেন আমার নতুন মা বলে। মায়ের মৃত্যুর মাস তিনেকের মধ্যেই যে বাবা আরেক বিয়ে করে ফেলতে পারেন তা কেন যেন আমি বা আমার বোনরা কেউই ভাবিনি। শর্মী বোধহয় কিছু আগেই বুঝতে পেরেছিল তাই ও ছুটিছাটাতেও বাড়িতে তেমন আসতে চাইতো না। আর শায়লা, নিজের জীবনের ঘূর্ণিপাকে এমনই আটকে গিয়েছিল যে পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনার সাধ্যই ছিল না তাকে অন্য কিছু ভাবতে দেয়ার।
রাগে দুঃখে হতাশায় কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তিনদিন কোনরকমে বাবার বাসায় থেকে বেরিয়ে আসি আবার। কোথায় যাবো, কি করবো কিছুই না জেনেও পথে পা রাখি একাকী। মায়ের জায়গায় অন্য কাউকে মেনে নেয়া আমার জন্য অসম্ভব ছিল। আমার গমন পথের দিকে তাকিয়েও বাবা কোন কথাই বলেন না। আসলে উনি নিজেও বুঝি চাইছিলেননা আর আমাদের বোঝা টানতে। বরং নিজের এতোদিনের বয়ে চলা অযাচিত ভারী সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে একটা নতুন স্বস্তির জীবন চাইছিলেন।
শায়লার নিজের পছন্দের বিয়ে, তার শ্বশুরবাড়ির অবস্থা ভালো কাজেই ও ভালো আছে বলেই ভেবেছিলাম। কিন্তু ওর বাসায় উঠে বুঝতে পারলাম কি এক অবিশ্বাস্য কঠিন সম্পর্কের বোঝা সে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ওর স্বামী রফিকের বাবার অনেক থাকলেও নিজের দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় প্রায় সব ব্যবসাতেই রফিকের সাফল্য শূন্যের কোঠায়। আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে ঘরে নিত্যকলহ আর অশান্তির দাবানলে যেন বোনটা রোজ পুড়ছে। নিজ পছন্দে বিয়ে, সংসারে বাবা মায়ের অশান্তি সব মিলিয়ে সে কারো কাছেই মুখ খোলেনি কোনদিন। শুধু দিন কাটিয়ে যাচ্ছে নিজের বাচ্চাগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে।
আমার উপস্থিতিতে শায়লার ঘরের অশান্তির ঘনঘটা কিছুদিন বন্ধ রাখে রফিক। কিন্তু যখন বুঝতে পারে থাকার জায়গার অভাবে আমি তাদের ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভুতের মতো চেপে বসেছি মুখোশ খুলে সহসাই আগের রূপে ফিরে আসে সে, যদিও আমি প্রায়ই ওর ঘরে বাজার করে দিতাম। এমনকি ওদের বাসার খাবারও খুব একটা খেতামনা। শুধু একটু মাথা গোঁজার ঠাইয়ের বিনিময়ে রফিকের কথার অত্যাচারও মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু কতদিন সম্ভব এভাবে?
যে পড়াশোনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে জীবন পার করতে চেয়েছিলাম তার অভাব যেন আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল রোজ। পড়াশোনাটা ঠিক থাকলেতো অন্তত একটা কিছু করে খেতে পারতাম। শুধু কিছু জমানো টাকা দিয়ে জীবন কতদিন চালানো সম্ভব? কতদিনই বা শায়লা আমার জন্য কথার অত্যাচার সহ্য করবে?
#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস
চলবে..
পর্ব ১
https://www.facebook.com/groups/canvasbd/permalink/2441422515902927/