#হৃদমাঝারে রেখেছে তারে পর্ব-এক মাহবুবা বিথী

0
594

#ধারাবাহিক গল্প
#হৃদমাঝারে রেখেছে তারে
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী

আমার শ্বশুর মশাই আমার দেখা একজন সেরা প্রেমিক পুরুষ। দেখতেও ছিলেন নায়কের মতো আবার শাশুড়ীমাকেও নায়কের মতো ভালোবেসে গিয়েছেন। উনাকে দেখে মনে হতো বুকের গহীনে যেন ভালোবাসার অতলান্তিক গহ্বর ধারণ করে আছেন। সবসময় উনার দুচোখে আমার শাশুড়ী মায়ের জন্য মুগ্ধতা ঝরে পড়তো। আমি অবাক বিস্ময়ে প্রৌঢ়ত্বের দিকে ধাবিত হওয়া দুটো মানুষের স্বর্গীয় প্রেমটা অবলোকন করতাম।
আমার শ্বশুর শাশুড়ীর চার ছেলে। কিন্তু প্রতিটি ছেলেকে উনি মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলেছেন। আল্লাহপাকের রহমত ছিলো উনার উপর। একদিকে যেমন কেয়ারিং হাসব্যান্ড ছিলেন তেমনি অপরদিকে সফল পিতা ছিলেন। আমার শ্বশুর শাশুড়ী দুজনেই এক অপরের পরিপূরক ছিলেন। উনার বড় ছেলে জামান আর বড় বউ আয়েশা দুজনেই ডাক্তার। আমি মেজ ছেলের বউ। আমি সালেহা আর আমার স্বামী আরমান আমরা দুজনেই বুয়েট থেকে সদ্য কেমিকেল ইন্জিনিয়ারিং পাশ করেছি। আরমানের রেজাল্ট টপার থাকায় ও বুয়েটে প্রভাষক হিসাবে নিয়োগ পায়। আমি ইউনিলিভারে জয়েন করি। সেজ ছেলে রায়ান আর্মিতে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত। আমার বরের আগে রায়ান বিয়ে করে ফেলে। ওর বউ আর্মিতে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত। আর একদম ছোটো দেবর সেজান তখন ঢাকাভার্সিটি তে সিএসইতে পড়াশোনা করছে। আমি আমার বিয়ের পরের সময়টার কথা বলছি।
আমার বাবা আর শ্বশুর ছোটোবেলার বন্ধু ছিলেন। আমার বিয়ের পর উনি অবসরে গিয়েছেন। কল্যানপুরে নতুন বাজারের কাছে আমার শ্বশুরবাড়ি। পাঁচ কাঠা জমির উপর তিনতলা বাড়িটি খুবই সুন্দর। একতালায় আমাদের কিচেন ডাইনিং আর লিভিংরুম। একপাশে একটা গেস্টরুমও বানানো হয়েছে। দোতলায় আমার শ্বশুর শাশুড়ী আর ছোটো দেবর সেজান থাকে। তিনতলায় আমি আর আমার বর থাকি। আমার ভাসুর আর জা দুজনেই সরকারি ডাক্তার হওয়াতে উনাদের ঢাকার বাইরে সবসময় পোস্টিং হয়। বর্তমানে উনাদের গাজীপুরে পোস্টিং হয়েছে। ঈদ উৎসবে ভাই ভাবী ঢাকায় আসলে তিনতলায় আমার পাশের রুমে উনারা থাকেন। আমরা সবাই তখন একসাথে থাকি। তখন ক্যান্টনমেন্ট থেকে আমার দেবর আর জা চলে আসে। ওরা তখন দোতলায় থাকে। আর্মিতে কর্মরত বিধায় দেবর ক্যান্টনমেন্টেই থাকে।
যাইহোক আমি বিয়ের পর থেকে শ্বশুর বাড়িতে থাকা শুরু করি। আমার শ্বশুর এজিতে সিনিয়র একাউন্টস অফিসার পদে কর্মরত ছিলেন। খুবই নিয়মতান্ত্রিক মানুষ। আর আমার শাশুড়ী ছিলেন শাবানা টাইপ মানুষ। এক বাক্যে বলা যায় স্বামীর বাধ্যগত স্ত্রী। উনার এই বাধ্যগত থাকার কারণে শ্বশুর উনাকে চোখে হারাতো। দুজনের প্রেম ছিলো দেখার মতো। আমার শ্বশুর যখনি বাইরে থেকে বাসায় ফিরতেন সবসময় শাশুড়ী মায়ের জন্য উনি হাতে করে একটা বেলি ফুলের মালা নিয়ে আসতেন।আমার শাশুড়ীর বেলি ফুল খুব পছন্দ। শ্বশুর মশাই ক্লান্ত হয়ে ফিরলে আমার শাশুড়ী ফলের জুস বানিয়ে উনাকে দিতেন। ভিজে গামছা দিয়ে শ্বশুরের শরীর মুছে দিতেন। অপরদিকে শাশুড়ী যখন রান্না করতেন শ্বশুরও উনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন। মাঝে মাঝে পাখা দিয়ে উনি আমার শাশুড়ীকে বাতাস করতেন। আবার শাশুড়ী কাপড় ধুয়ে রাখলে শ্বশুর সেই কাপড়গুলো ছাদে মেলে দিতেন। আমার শ্বশুর সেলাই মেশিন চালাতে জানতেন। ছুটির দিন নিজের পাঞ্জাবীর কোনো জায়গায় সেলাই খুলে গেলে সেগুলো সেলাই করতেন পাশাপাশি শাশুড়ী মায়ের কাজও করে দিতেন। যেমন আমার শাশুড়ী মা ঝালরওয়ালা বালিশের কভার পছন্দ করতেন। শ্বশুর সেগুলো নিজ হাতে বানিয়ে দিতেন। আমার শাশুড়ী মায়ের কাছে গল্প শুনেছি উনি অনেক আগে থেকেই ছুটির দিনে এই কাজগুলো করতেন। আমার শাশুড়ী মা ছুটির দিনে রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আর শ্বশুর ঘর পরিস্কার করা বাচ্চাদের কাপড় ধোয়া, বাজার করা ছেলেদের ছেড়া জামাকাপড় মেশিনে সেলাই করে দিতেন। উনি সেসময় যে বেতন পেতেন ছেলেদের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে সংসারের সব দায়িত্ব করে হাতে খুব একটা টাকা পয়সা থাকতো না। তাই বিলাসিতার প্রশ্নই আসে না। এমনকি উনারা কাজের সহকারী রাখতে পারতেন না। এ নিয়ে শাশুড়ী মায়েরও কোনো অভিযোগ থাকতো না। তবে ছেলেরা বড় হওয়ার পর ঘরে স্থায়ী কাজের খালা রাখা শুরু করলেন। ততদিনে শাশুড়ী মায়ের বয়স বেড়েছে। আগের মতো পেরে উঠতেন না। তারপরও আমার বিয়ের পর শাশুড়ী মাকে দেখতাম শ্বশুরের শার্ট প্যান্ট মাঝে মাঝে বাসায় ইস্ত্রি করতেন। আমার কাছে উনাদের দেখে মনে হতো যেমন দেবা তেমনি দেবী।
যাইহোক আমিও সেসময় উনাদের সাথে মেয়ের মতই থাকতাম। উনাদের নিজের মেয়ে ছিলো না বিধায় আমাকে মেয়ের মতই ভালোবাসতেন। সাধারণত সবার ক্ষেত্রেই নতুন জায়গায় গিয়ে নিজেকে মানিয়ে নিতে একটু সমস্যা হয়। কিন্তু আমার মানিয়ে নিতে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু উনাদের কারনে আমার রাতে ঘুম হতো না। কারন উনারা খুব নামাজী ছিলেন। এগারোটার মধ্যে ডিনার করে ঘুমিয়ে পড়তেন। আর আমার ঘুমাতে যেতে রাত বারোটা বেজে যেতো। আবার খুব ভোরে মানে ফজরের আযান দেওয়ার সাথে সাথে উঠতে হতো। ওদিকে রাত দুটােয় উঠে আমার শাশুড়ী কিচেনে গিয়ে শ্বশুরের জন্য নাস্তা বানাতেন। কোনোদিন পরোটা ডিমভাজি কোনো দুধ সেমাইয়ের সাথে মুড়ি দিয়ে আমার শ্বশুর নাস্তা করতেন। তাহাজ্জুদের নামাজ শেষ করার পর উনার প্রচন্ড ক্ষুধা লাগতো। দুজনে একসাথে নামাজ শেষ করে ফজরের নামাজ পড়ে নাস্তা খেতেন। আমিও ফজরের নামাজ পড়ে চা বানিয়ে দিতাম। তারপর চায়ের মগ হাতে নিয়ে দুজনে ছাদে গিয়ে হাঁটতেন। ভোরের বাতাস গায়ে মেখে রুমে এসে দুজনে ঘুমিয়ে পড়তেন।
আমার বর ও ভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে নিতাে। তারপর দুজনে স্যান্ডউইচ আর কফি খেয়ে বুয়েটে রওয়ানা হতাম। আমরা বাসা থেকে বের হওয়ার সময় উনাদের ঘুম ভেঙ্গে ডাকতাম না। কেননা রাতে তো উনারা তেমন ঘুমান না। কাজের খালাকে বলে বের হয়ে যেতাম।

আরমান আমাকে আমার অফিসে নামিয়ে দিয়ে ও বুয়েটে চলে যেতো। আমার শ্বশুর যেমন রোমান্টিক পুরুষ ছিলেন সে তুলনায় আমার বর ছিলো খুবই কাঠখোট্টা। তার কাছে এগুলো আদিখ্যেতা মনে হতো। আমি আবার খুব রোমান্টিক। আমি আমার শাশুড়ী মায়ের কাছে শুনেছি যবে থেকে বউ হয়ে এবাড়িতে এসেছেন উনারা সবসময় একসাথে খাওয়া দাওয়া করতেন। যখন আমার শ্বশুর অফিস করতেন বাসায় ফিরতে উনার পাঁচটা বেজে যেতো। তারপর আমার শ্বশুর আর শাশুড়ী মা একসাথে লাঞ্চ করতেন। আমি একদিন আমার শাশুড়ী মাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
—–মা আপনি যে বাবার সাথে এতো দেরী করে লাঞ্চ করতেন আপনার ক্ষিদে লাগতো না?
—–কি জানি,আমার কোনো অনুভব হতো না। শুধু মনে হতো ঐ মানুষটা আমার সংসারটার জন্য এতো কষ্ট করে উপার্জন করে। আর আমি উনার মুখে খাবার তুলে না দিয়ে নিজে কি করে খাই? তবে বাচ্চাদের খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতাম। তবে এটা নিয়ে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। কারণ তখন আমি আর আমার বড় জা একসাথে থাকতাম। আমার শাশুড়ী আমাদের সাথেই থাকতো। তোমার শ্বশুরের এসব আচরণ তাদের কাছে বাড়াবাড়ি মনে হতো। আর আমাকে শুনতে হতো স্বামীর আহ্লাদে বেশী খাওয়ার জন্য আমি আমার স্বামীর সাথে খেতে বসতে পছন্দ করি। যাইহোক যতদিন আমরা একসাথে ছিলাম ওদের এসব কথা গায়ে মাখতাম না।
উনাদের প্রেম দেখে আমারও খুব ইচ্ছে হতো আরমান আমাকে এভাবে ফিল করুক। কিন্তু কথায় আছে না যার নয়এ কিছু হয় না তার নব্বইতেও কিছু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তারপরও এক পূর্নিমায় বরকে নিয়ে ছাদে বসে জোৎস্নায় ভিজতে চাইলাম। উনি কিছুক্ষণ বসে থেকে আমায় বললো,
—— আগামিকাল আমার ক্লাসের লেকচার সিট এখনও তৈরী হয়নি। শুধু শুধু ছাদে বসে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।
ওর কথাগুলো শোনার পর অভিমানে আমার নেত্রদ্বয় জলে ভিজে উঠলো। ওকে কোনোকিছু না দুমদাম ছাদ থেকে নেমে এলাম। অথচ আমি আমার শ্বশুর আর শাশুড়ীমাকে এরকম চাঁদনী রাতে ছাদে বসে গুনগুন করে গান গাইতে দেখেছি। আমি তিনতলায় থাকি বিধায় উনারা কখন ছাদে উঠেন আমি বুঝতে পারি। তাই একদিন কৌতুহল বশত ছাদে গিয়ে আড়ালে লুকিয়ে দেখি উনারা এমন ঘনিষ্টভাবে বসে আছেন দুজনকে দেখে মনে হতো সদ্য যৌবনে প্রেমে পড়া দুটো নরনারী।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here