“চলে এসো! এখানে আর এক মুহুর্তও নয়।” সারফারাজ তার স্বদ্য বিয়ে করা নববধূর উদ্দেশ্যে কাঠ কাঠ কন্ঠে কথাগুলো বলেই নববধূর নরম হাতখানা নিজের হাতের ভাজে শক্ত করে ধরে পা বাড়ালো রাস্তায় অপেক্ষায়মান গাড়ির দিকে।
দু পা বাড়াতেই বিয়ে বাড়ির জন সমাগমের মাঝ থেকে পুরুষালি তেজস্বী কন্ঠে বলে উঠলো, “আরেহ্ কোথায় যাচ্ছো? এভাবে মেয়ে নিয়ে অনুমতি ব্যতীত নিয়ে যেতে পারো না! ভদ্রতা, সভ্যতার ও একটা ব্যপার আছে। এটা ভদ্রলোকের সমাজ। তোমার মধ্যে ভদ্রতা না থাকতে পারে কিন্তু আমাদের আছে। মেয়ের বাবার অনুমতি না নিয়ে এক পা ও আগাবে না!”
সারফারাজ হাঁটা থামিয়ে পিছন ঘুরে তাকালো। ওষ্ঠদ্বয়ে হাসির রেখা ফুটিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বরে বলল, “আপনি কে? কি হন?”
“আমি অন্বেষার বড় চাচা।”
সারফারাজ তার নববধূর নরম হাতখানা ছেড়ে দিল। পাশে থাকা ফাঁকা চেয়ারে নিজে আয়েশ করে বসলো। পাশেরটাই অন্বেষাকে ঠাস করে বসিয়ে দিল।
ভদ্রলোক ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কিছু বলছেন না। ভরা বিয়ে বাড়ির মানুষ আগ্রহ ভরা নয়নে তাকিয়ে আছে সারফারাজের দিকে। বিয়ে বাড়ির মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সারফারাজ। নিরবতার অবসান ঘটিয়ে সারফারাজ অন্বেষার বড় চাচাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কোথায় ছিল আপনার ভদ্রতা, সভ্যতা? বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় যখন অতটুকু মেয়েটার ওপর ওর সৎ মা, অনান্য মহিলাগুলো চড়াও হয়ে যা নয় তা বলে গালি দিচ্ছিল তখন কোথায় ছিলেন আপনি? পাত্রের অনুপস্থিতিতে যখন আপনার গ্রামের মাতাল, গাঞ্জাখোর ছেলেটার সাথে ওর সৎ মা বিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় করছিল কোথায় ছিলেন আপনি? আর কোথায় ছিল আপনাদের ভদ্রতা, সভ্যতা?”
উপস্থিত মানুষের মাঝে একটা প্রাণিও কথা বলে না। প্রতিত্তোরে সবাই নিরব। ক্ষেপে ওঠে সারফারাজ। ব্যাগ্র কন্ঠে শুধায়, “কি হলো কথা বলছেন না কেন? মুখে তালা লাগিয়ে বসে আছেন কেন? আমার তো মনে হয় দুই ঘন্টায় পরিচিত এই মেয়েটার জন্য আমার যতটুকু দয়ার উদ্রেক হয়েছে তার ছিটে ফোঁটাও আপনাদের কারো মধ্যে নেই। এখানে একটা মানুষের মধ্যে সামান্যতম মায়া দয়া নেই। মানুষ নামের অমানুষ একেকটা। জানোয়ারের দল।”
“দেখ এবার কিন্তু বেশি বেশি করছো ছেলে। যা নয় তাই বলবে?”
“একশবার বলব। কি করবেন?”
সারফারাজ ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়িয়েছে। শার্টের হাতা গুটিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতেই অবস্থা বেগতিক দেখে দুরে দাড়ানো সারফারাজের বন্ধু রাকিব এসে আটকায় সারফারাজকে। কেউ না জানুক সে অন্তত জানে সারফারাজকে আটকাতে না পারলে একটাকেও আস্ত রাখবে না সে। প্রচণ্ড রকম রাগী ছেলেটা।
আস্তে আস্তে বিয়ে বাড়ির লোকজন যে যার মত প্রাণ নিয়ে সরে পড়ছে। আপাতত তাদের তামাশা দেখে প্রাণ খোয়াবার কোন ইচ্ছে নেই। মিনিট খানিকের মধ্যে বিয়ে বাড়ি ফাঁকা। হাতে গোনা দু চারজন মানুষজন আছে। কিছুক্ষণ পর অন্বেষার বাবা এসে সারফারাজের উদ্দেশ্য নমনীয় কন্ঠে বলে উঠলো, “জামাই বাবা শান্ত হোন। ওদের কথায় কিছু মনে করবেন না।”
শশুরের নরম কন্ঠে মন গললো না তার। বিরক্তির রেখা ফুটে উঠলো চোখে মুখে। বিরক্তিকর কন্ঠে বলল, “রাখেন আপনার ফ্যচফ্যাচানি। আপনার এ অবস্থার জন্যই মেয়েটার এ দশা। বলি আপনি কি কোন খোঁজ খবর রাখেননি? মেয়ের কোথায় বিয়ে ঠিক হলো কার সাথে ঠিক আবার বিয়েটা যখন ভেঙে গেল পূনরায় আবার কার সাথে দিতে চাইলো কিছুই কি আপনার চক্ষুগোচর হয়নি? কেমন বাবা আপনি?”
মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। প্রতিত্তোরে কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।
সারফারাজ পূনরায় বলল, “আমি এখন আমার বউকে নিয়ে চলে যেতে চাই। কেউ যদি আটকানোর দুঃসাহস করে গলা থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে দিব। আমার বউয়ের সাথে এ বাড়ির এ প্রাণিও যেন যোগাযোগ করার চেষ্টা না করে। আর একটা কথা আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী শাস্তিটা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা দিবেন। আল্লাহ্ ছাড় দেয় কিন্তু ছেড়ে দেয় না। মা হারা মেয়েটার সাথে যে ঘৃণ্য অন্যায় করতে যাচ্ছিলেন আল্লাহর ওপর আস্থা রাখছি এর বিচার তিনি করবেন।”
সারফারাজ অন্বেষাকে এক প্রকার টেনে নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেল। পিছনে রেখে গেল কতগুলো মানুষ রূপি অমানুষ।
রাকিব নিরব দর্শকের মত সবটা দেখছিল। সে ভাবতেও পারেনি ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হৃদয়ের ছেলেটার মধ্যে এতটা দয়া লুকিয়ে থাকতে পারে। কত অনুরোধ করে ছেলের আকিকায় নিমন্ত্রণ করে এনেছিল সারফারাজকে। তার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেই কি বিপদে পড়লো ছেলেটা। কখনও বিয়ে করবে বলে পণ করা ছেলেটারও আজ বিয়ে হয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো বুক চিরে। প্রাণপ্রিয় বন্ধুর সামনে নিজের অবস্থান খুব নিচে নেমে গেল এমনটাই মনে হচ্ছে রাকিবের।
“সারফারাজ আমি কি তোর সাথে যাবো?”
“নাহ্ দরকার নেই। তোর এখন তৃণা আর বাবুর কাছে থাকা উচিত। আমার জন্য চিন্তা করতে হবে না।”
“বললেই হলো চিন্তা করতে হবে না। চিন্তা এসে যায় রে ভাই। বাড়িতে জানিয়েছিস?”
“সময় পেলাম কোথায়?”
“তাও ঠিক। তোরা ক্লান্ত। আমি বড় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি?”
“সমস্যা নেই। আমি পারবো। তুই বাসায় যাহ্।”
সারফারাজ গাড়িতে উঠে পড়েছে। পাশে দাড়ানো অন্বেষাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তোমাকে কি নিমন্ত্রণ করে উঠাতে হবে? উঠে বসো!”
অন্বেষা ঠায় দাড়িয়ে তখনো। সে প্রয়োজনে কয়েকবার মাইক্রেবাসে উঠেছে। কিন্তু তখন তো ড্রাইভার দরজা খুলে দিয়েছে। কিন্তু এসব প্রাইভেট কারে চড়ার অভ্যাস নেই সাথে দরজাটাও খুলতে পারছে না। সারফারাজ গাড়ি থেকে নেমে রাগী স্বরে বলল, “এটুকুও পারো না? তবে পারো কি মেয়ে, ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে?”
সারফারাজ গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলল, “যাও উঠে বসো।”
অন্বেষা বাধ্য মেয়ের মত উঠে বসলো। সারফারাজ সামনে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিবে এমন সময় আবারও রাকিবের আগমন। সারফারাজ অবাক কন্ঠে বলল, “কিরে যাসনি এখনো?”
“চলেই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলে যাওয়া উচিত। অগ্যতা আবার ফিরে আসা।”
“দয়া করে আপনার গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো বলে আমাকে উদ্ধার করেন। এমনিতেই তোদের এদিকটার রাস্তা ভালো না। ঢাকায় পৌছাতে না জানি কত সময় লাগে।”
“বলছি মেয়েটার ওপর অযত্ন অবহেলা করিস না। সবটা তো দেখলি সচক্ষে। অন্তত ওর আত্মীয়দের মত আচরণ করিস না।”
“এই চিনলি আমাকে? সারফারাজ কখনও দায়িত্ব অবহেলা করে না। ইনশাআল্লাহ দায়িত্ব পালনে কোন হেরফের হবে না। নিশ্চিন্তে বাড়ি যা।”
“আমি জানি তুই কেমন। তবুও পরিস্থিতি এখন পুরাই হাতের বাহিরে। মেয়েটার অভিভাবক এখন তুই। দেখে রাখিস। আমি যায় তাহলে।”
“আচ্ছা যা। আসসালামু আলাইকুম। আল্লাহ হাফেজ।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আল্লাহ হাফেজ।”
রাকিব বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছে। অতঃপর সারফারাজ গাড়ির ইঞ্জিন স্টর্ট দিল।
সন্ধা লগ্ন পার হয়ে রাত্রি নেমেছে ধরণীতে। সফেদ রঙা প্রাইভেট কারটির ভেতরে বহু লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অবহেলা, অনাদর সহ্য করা মেয়েটা যাচ্ছে তার অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে বিয়ে হওয়া স্বামীর সাথে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।
গ্রামের আধ ভাঙা রাস্তায় গাড়িতে থাকা মানুষগুলোর জীবন তেজপাতা হয়ে যায়। একের পর এক ধকল সহ্য করে অন্বেষার শরীর আর চলছে না। দৃষ্টি নিভে আসছে। একটানা ঘুম হলে ভালো লাগতো। হঠাৎই গাড়ির চাকা ছোট্ট একটা গর্তে পড়েছে। বেশ ঝাকুনি খেয়েছে অন্বেষা। ফলে তার পেটের সব যেন বেড়িয়ে আসতে চাইছে। বমি করতে পারলে ভালো হতো। সারাটা সময় জড় বস্তুর মত চুপ থাকা অন্বেষা সামনের মানুষটির উদ্দেশ্য নিভু গলায় বলল, “শুনছেন? গাড়িটা একটু থামাবেন? আমার বমি আসছে।”
অন্বেষার কন্ঠস্বর সারফারাজের কর্ণকুহরে ঠিক স্বদ্য জন্মানো বিড়ালের বাচ্চার চেও চেও আওয়াজের মত লাগলো। এক সাইডে গাড়ি থামিয়ে পিছন ফিরে অন্বেষার উদ্দেশ্য বলল, “কি হয়েছে?”
“বমি পাচ্ছে।”
বিরক্তিতে কপাল কুচকে গেল সারফারাজের। শুরু হয়ে গেল তার জীবনেও মেয়ে মানুষের ফ্যাচফ্যাচানি। এজন্যই বিয়ে করতে চাইছিল না।
প্রয়োজন সমাধা করে বোনের ফোনে একটা টেক্সট পাঠিয়ে সারফারাজ আবারও গাড়ি স্টার্ট দিল। চললো নির্দিষ্ট গন্তব্যে।
______________
সারফারাজের ভার্সিটির ফ্রেন্ড রাকিব আর তৃণা। বেস্ট ফ্রেন্ড বলা চলে। ভালোবেসে বিয়ে করেছিল রাকিব-তৃণা। বিয়ের প্রায় তিন বছর পর কোল আলো করে ছেলে সন্তানের জন্ম। প্রাণপ্রিয় দুই বন্ধুর অনুরোধে ঢাকা ছেড়ে ফুলতলী গ্রামে ছুটে আসতে হয় সারফারাজের। কিন্তু সেখানে তার জন্য ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছিল কে জানতো!
ইনশাআল্লাহ চলবে,
#প্রণয়_হাওয়া_লাগলো_মনে(০১)
#সুমাইয়া_ইসলাম_জান্নাতি(লেখনীতে)
কিছুটা ভিন্নধর্মী। কেমন লাগলো জানাবেন। আসসালামু আলাইকুম।