#প্রণয়_হাওয়া_লাগলো_মনে(০২)
#সুমাইয়া_ইসলাম_জান্নাতি(লেখনীতে)
__________________
কলিং বেল চাপতেই সাথে সাথে ওপাশ থেকে দরজা খুলে দিল সারফারাজদের বাসার হেল্পিং হ্যান্ড হাসুর মা। পঞ্চাশর্ধো পৌঢ় মহিলা। ওদের দেখেই নিরষ বললেন, “এসে পড়েছ বাপজান? এদিকে বিশাল কান্ড ঘটে গেছে। তোমার মায়ের অবস্থা তো ভালো না বাপজান!”
সারফারাজের কপালে মৃদু চিন্তার ভাজ ফুটে উঠলো। তার পাশেই ক্লান্ত দূর্বল অন্বেষা। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন জোর করিয়ে দাড় করে রাখা হয়েছে।
সারফারাজ বলল, “খালা, আগে ঢুকতে তো দেন। এসেছি তো শুনবো সব কথা।”
দাঁত দিয়ে হালকা জিভ কাটলেন হাসুর মা। অর্থাৎ বিরাট ভুল হয়ে গেছে। দ্রুত সদর দরজা থেকে সরে দাড়ালেন। একপাশে দাড়িয়ে কৌতূহলী দৃষ্টিতে অন্বেষাকে দেখছেন তিনি।
“মা কোথায় খালা?”
“আফায় তো তেনার রুমে। ছোট মা যখনই খবর দিল আপনার বিয়ার, শুনেই তার প্রেশার হাই হয়ে গেছে। খানিকক্ষণ চিৎকার চেচামেচি করেছে। অবস্থা বেগতিক দেখে বড় মা প্রেশারের ওষুধ আর ঘুমের ওষুধ খাওয়ায় দিয়েছে।”
“তাহলে মা এখন ঘুমিয়েছে?”
“হ বাপজান।”
“সাইমা, সাইফাও কি ঘুমিয়ে পড়েছে?”
“ঘুমানোর কি সুযোগ আছে ভাইয়া? বল!” পেছন থেকে সাইমা বলে উঠলো। সাথে সাইফা। দুবোন এগিয়ে আসলো ড্রয়িং রুমে।
সারফারাজ ওদের দেখে বলল, “ওকে নিয়ে যা। তোদের মধ্যে যার পোশাক ওর গায়ে হয় ফ্রেশ করিয়ে পড়িয়ে দে। বেশ ধকল গেছে।”
সাইফা টিপ্পনি কেটে বলল, “বুঝেছি বুঝেছি। আমরা কি বুঝি না।”
“তোদের সাথে তর্কে জড়ানোর ইচ্ছে নেই বিচ্ছুরা। নিয়ে যা ওকে।”
সাইমা, সাইফা অন্বেষার কাছে এসে আগ্রহভরা দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। বিব্রত বোধ করছে অন্বেষা। কিন্তু কিছু বলতে পারছে না মেয়েটা। অন্বেষার বিব্রতকর অবস্থা হয়তো সারফারাজ বুঝলো। বোনেদের উদ্দেশ্য বলল, “পরে দেখিস। পালিয়ে যাচ্ছে না। এখন ফ্রেশ হওয়া দরকার।”
সাইমা অবাক কন্ঠে বলল, “ভাইয়া এই হুর পরীকে কোথায় থেকে ধরে এনেছো? রূপের আগুনে আমি নিজেই তো ঝলসে যাচ্ছি মনে হচ্ছে। এজন্যই কি এত তাড়াহুড়ো করে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেললে?”
ধমকে ওঠলো সারফারাজ। বলল, “তখন থেকে ফালতু বকছিস একেকটা। কানের নিচে দিব একেকটার। বলেছি না ওকে নিয়ে যা। পরে বলব সব।”
সাইমা, সাইফা তাৎক্ষণিক অন্বেষাকে নিয়ে তাদের রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ালো। বাঘের সামনে থাকার ইচ্ছে নেই তাদের। অতি কৌতূহলে ভুলেই গেছিল তার ভাইটা আস্ত এক বদমেজাজি গোছের মানুষ।
সারফারাজ পাশে দাড়ানো হাসুর মা’র উদ্দেশ্য ক্লান্ত গলায় শুধালো, “খালা, খাবার কিছু আছে?”
“হ বাপজান। আমি গরম করে রাখতাছি। তুমি বউরে নিয়া আসো।”
সারফারাজ রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়ালো। কি যেন মনে পড়তেই আবার ফিরে এলো। ততক্ষণে হাসুর মা ও কিচেনে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিল। সারফারাজকে আবার ফিরে আসতে দেখে শুধায়, “কিছু লাগবো বাপ?”
সারফারাজ স্মিত হেসে প্রতিত্তোরে বলল, “মাঝ রাত্রিরে খুব কষ্ট দিলাম খালা?”
“কি যে কও না বাপ। তুমি সাইমা, সাইফা সবাই আমার সন্তান তূল্য। তোমাগে সেবা কইরা মুই শান্তি পাই। এই কথা কইও না। তুমি যাও বাপজান। হাতমুখ ধুইয়া আসো।”
“একটু দুধ গরম করে রাইখেন খালা। ও খুব ক্লান্ত। উষ্ণ দুধ খেলে কিছুটা ভালো লাগবে।”
“আইচ্ছা। তুমি চিন্তা কইরো না।”
অতঃপর সারফারাজ নিশ্চিন্তে চিত্তে রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ায়। সাময়িক ভাবে চিন্তা গেলেও মস্তিষ্কে স্থায়ী চিন্তা থেকেই যায়। মাকে কি বলবে সে? অন্য আত্মীয়স্বজনের ধার ধারে না সে। কিন্তু মাকে ভিষন ভালোবাসে। তার এহেন কান্ডে যদি কষ্ট পান তিনি। তবে? ক্লান্ত মস্তিষ্ক আর কিছু ভাবতে পারলো না। যা হয় ভালোই হয়। এই বলে মনকে বুঝ দিল সারফারাজ। আল্লাহ্ আছেন তো। এত দুশ্চিন্তা কিসের!
————————–
অন্যদিকে সাইমা, সাইফা অন্বেষাকে রুমে নিয়ে রিতিমতো প্রশ্নের ঝড় তুলছে। দু বোনের অবুঝ পনা কান্ডে ক্লান্ত অন্বেষার অবস্থা নাজেহাল। না কিছু বলতে পারছে আর না পারছে ক্লান্ত শরীরে এত ধকল সইতে।
দু বোনের উদ্দেশ্য রিনরিনে কন্ঠে অন্বেষা কোনরকম বলল, “শরীর খুব খারাপ লাগছে আপু। আপনাদের ভাইয়ার থেকে সবকিছু জেনে নিয়েন আপুরা। প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।”
এটুকু বেশ ভয় নিয়েই বলেছে অন্বেষা। যদি রাগ করে বশে!
অন্বেষাকে অবাক করে দিয়ে সাইফা বলল, “ঠিক বলেছেন মিষ্টি ভাবি। ভাইয়ার থেকেই জানা যাবে। হুদাই আপনাকে প্যারা দিলাম। রাগ করেননি তো? বাই দা ওয়ে আপনাকে মিষ্টি ভাবি বলে সম্বোধন করতে পারি?”
মিষ্টি দেখতে দুটো মেয়ের এত স্বাভাবিক ব্যবহার অন্বেষাকে আবেগী করে তুলছে। চোখ যুগল ছলছল করে উঠলো। মিষ্টি হেসে ক্লান্ত গলাই প্রতিত্তোরে বলল, “রাগ করবো কেন আপুরা? রাগ তো আপনাদের করার কথা। সম্বোধনটা খুব সুন্দর। এত সুন্দর সম্বোধন পাওয়ার যোগ্যতা আদৌ আমার আছে! খুব ভালো লেগেছে।”
সাইফা বলল, “আব্বু মা’রা গিয়েছে আছ পাঁচ বছরের বেশি। এরপর থেকে কখনও ভাইয়া আমাদের কোন অভাব রাখেনি। অভিযোগ করার সামান্যতম চেষ্টা টুকুও দেয়নি। ভাইয়া কম বাবার দায়িত্ব পালন করেছেন মানুষটা। সেই মানুষটার কোন সিদ্ধান্তে অসম্মতি জানানোর কোন প্রশ্নই আসে না। আমরা জানি ভাইয়া কখনও নিজের জন্য বেমানান, খারাপ কিছু বেছে নিবেন না। যেখানে সে হাসুর মা থেকে শুরু করে আমাদের জন্য পর্যন্ত বেস্ট জিনিস বাছাই করেন। সেখানে নিজের জীবনসঙ্গী নিশ্চয়ই যাকে তাকে বানাবেন না!
পেছন থেকে সাইমাও সম্মতি জানিয়ে বলে উঠলো, “একদম ঠিক বলেছিস সাফু। প্রথম বার কোন কথা ঠিকঠাক বলতে পারলি। সবই আমার ক্রেডিট। ধন্যবাদ জানাবি মেয়ে!”
ফুঁসে উঠলো সাইফা। রাগী স্বরে বলল, “রাখ তোর ক্রেডিট। ফাজিল মেয়ে। কই জামা এনেছিস? দেরি হলে ভাইয়া বকবে পরে।”
সাইমা বাম হাতে ধরা একটা সুতির সুতার অসম্ভব সুন্দর কারুকার্য খচিত সালোয়ার কামিজের সেট সাইফার উদ্দেশ্য বাড়িয়ে দেয়। বলল, “দেখ তো এটা কেমন? ভাবির জন্য চলবে?”
“চলবে কি দৌড়াবে।”
জামাটা অন্বেষার হাতে দিয়ে সাইফা পূনরায় বলল, “মিষ্টি ভাবি ওইদিক টাই ওয়াশরুম। যান গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। কিছু লাগলে ছোট্ট একটা ডাক দিলেই আমরা হাজির হবো।”
অন্বেষা বাধ্য মেয়ের মত ঘাড় নাড়িয়ে স্বায় জানালো। তারপর কলের পুতুলের মত ওয়াশরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হতে।
রাতে খাওয়া শেষে সারফারাজ ঘুমানোর উদ্দেশ্য রুমে এসেছে। যদিও আর দের ঘন্টা পরেই ফজরের আজান দিবে। পিছনে গুটিগুটি কদমে অন্বেষাও হাজির।
সারফারাজ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছে। অন্বেষা রুমের কোনায় তখনও ঠাঁই দাড়িয়ে। সারফারাজের ভ্রু যুগল কুচকে এলো। কর্কশ কন্ঠে অন্বেষার উদ্দেশ্য বলল, “ছোট বেলায় মেবি বাংলা সিনেমা দেখতে? শাবান খালা আলমগীর মামার। তুমি কি ভেবেছো তোমাকে নিচে শুতে বলব? দ্রুত শুতে এসো। ড্রামা করো না। বিয়ে করেছি বউ নিয়ে ঘুমানোর জন্য। বউকে মেঝেতে রেখে নিজে বিছানায় কাপুরুষের মত শোয়ার জন্য না। কাম!”
অন্বেষার মুখ রক্তশূন্য হয়ে উঠেছে। তার আবেগতাড়িত মস্তিষ্ক সারফারাজের বলা কথার উল্টা মিনিং খুজতে ব্যস্ত।
অন্বেষার মুখভঙ্গি দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসে সারফারাজ। মনে মনে বলে, “কি অদ্ভুত মেয়ে মানুষ। অচেনা মানুষটাকে বিয়ে করে ফেলল অথচ চেনা স্বামীর সাথে বিছানায় শুতে যত আপত্তি!”
সারফারাজের মনের কথা জানা হলো না অন্বেষার। সে তখনও আকাশ পাতাল ভাবনায় মশগুল।
সারফারাজ পূনরায় বলল, “শোন মেয়ে এত কিছু ভেব না। তুমি যা ভেবে ফেলেছো না আমি কল্পনায় ও আনিনি। সুতরাং অহেতুক ভাবনা চিন্তার অবসান ঘটিয়ে শুতে এসো।”
অন্বেষা বড্ড লজ্জা পেল। লজ্জায় গৌর বর্ণ মুখখানায় গোলাপি আভা ফুটে উঠেছে। দ্রুত পায়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো সে। হুদাই অহেতুক ভাবনা। কতগুলো দিন পরে এমন নরম বিছানায় শোয়ার সৌভাগ্য হলো অন্বেষার। আরামদায়ক বিছানায় শুতেই ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো অন্বেষা।
সারফারাজ এক নজর ঘুমন্ত অন্বেষার দিকে চাইলো। ভয়ংকর সুন্দর মেয়েটা। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকা বিপদ। মাথা ঝিম ধরে যায়। নেশা ধরে যায় চোখে। সাথে বেশ আন্দাজ করলো মেয়েটা বেশ লম্বা। সে নিজেই ছয় ফুট। হয়তো অন্বেষা পাঁচ ফুট পাঁচ বা ছয়ের কাছাকাছি। মেয়ে মানুষ এটুকুতেই অনেক লম্বা লাগে। সুন্দরী মেয়েগুলোর জীবন তাদের চেহারার মত সুন্দর হয় না। সাথে যদি থাকে অন্বেষার সৎ মায়ের মত বিষাক্ত নড়বড়ে অভিভাবক। এসব ভাবতেই সারফারাজের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। মানুষ এমন কেন হয়!
_____________
সারফারাজের মা মিসেস সাওদা বেগম ফজরের নামাজ শেষে বলকনিতে গিয়ে বসে আছেন। প্রেশার কিছুটা কমেছে। হাসুর মা চা নিয়ে রুমে উপস্থিত হলো। এ সময়টা মিসেস সাওদা আর হাসুর মা একসাথে বসে চা খাই আর সকালে স্নিগ্ধ রুপ উপভোগ করে। বেশ সখ্যতা দুজনের মধ্যে। গৃহপরিচারিকার সাথে বাড়ির কর্তির এমন সম্পর্কই হওয়া উচিত। যদিও তা বর্তমান সমাজে নেই বললেই চলে। মিসেস সাওদা বললেন, “আজ চা খেতে মন চাইছে না হাসুর মা। ভালো লাগছে না কিছুই। সারফারাজ উঠেছে?”
“না আফা।”
“সে কি নামাজ পড়াটাও ভুলে গেল?”
“বাপ জান ঘুমাতে গেছে চারটার দিকে। হয়তো রুমের মধ্যেই পড়ছে। নতুবা উঠবার পারে নাই।”
“তোমার কি মনে হয় না হাসুর মা সারফারাজ যা করেছে অন্যায় করেছে?”
“আফা, বাপজানরে আমার থৈইকা আফনে ভালো চিনেন জানেন। যতটুকু বুঝবার পারছি সে জেনেশুনে অন্যায় করবে না। সেখানে আপনারে কষ্ট সে কিভাবে দিবে? সে আসুক সবটা জানেন শুনেন তারপর বিচার কইরেন। আগের থেকে খারাপ কিছু ভাইবেন না আফা। লন চা খান!”
মিসেস সাওদা চা নিলেন। বিষণ্ণ মনে চুমুক দিলেন চায়ে। সূর্যের আলোই দিবালোকে আধার কেটে ফকফকে দিন শুরু হচ্ছে। কিন্তু মিসেস সাওদার মনের খচখচ ভাব আর আধার কোনটাই দুর হচ্ছে না। সময় যাচ্ছে আর তিনি তত অস্থির হয়ে উঠছেন।
ইনশাআল্লাহ চলবে….
আঞ্চলিক ভাষা না জানার দরুন হাসুর মায়ের কথোপকথন গুলিয়ে ফেলেছি। ভুলত্রুটি মার্জিত ভাষায় ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইলো। আসসালামু আলাইকুম।