#সুখের_খোঁজে
(বড় গল্প)
পর্ব ১
বাবা পুলক, আমার শরীরটা ভালো লাগছেনা আজ। আমার কাজের মেয়েটা বাসায় আসেনি। তোদের কাজের মেয়েটাকে বলবি আমায় দুটো ভাত ফুটিয়ে দিয়ে যেতে।
– কি হয়েছে আবার তোমার? বলি একটা ডাক্তার দেখাও। কি যে করো টাকা পয়সা দিয়ে বুঝিনা। আমি সুমনাকে বলছি তোমার দুপুরের খাবার পাঠিয়ে দেবে। অবশ্য তোমার যদি আপত্তি না থাকে। তোমার তো আবার সুমনাকে পছন্দ না। তা তোমার গুণধর ছোটপুত্র কোথায়? তাকেও তো বলতে পারো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে।
অন্যসময় হলে হয়তো ছেলেকে দুকথা ফিরিয়ে বলতাম। এখন কেন যেন আর কাউকে কিছু বলতে ইচ্ছে করেনা। কিছু বলে কিছু না বলে, কিছু করে কিছু না করে একটা জীবন তো কাটিয়েই দিলাম। মাঝে মাঝে মনে হয় একটা জীবন সুখে থাকতে আসলে কি করতে হয়? সুখ নামক মরীচিকার খোঁজে পুরোটা জীবনইতো প্রায় কাটিয়ে দিলাম। না কেউ আমাকে বুঝেছে কোনদিন না আমি কাউকে বুঝেছি। ভুল যে কোথায় ছিল, কার ছিল তা যেন খোঁজাটাই এখন অবান্তর কিছু।
……………..
আমার বাবা ছিলেন রেলওয়ের অনেক বড় অফিসার। কলোনীর সবচেয়ে ভালো বাসাটায় ছিল আমাদের বাস। ছোটবেলা থেকেই আমি একটু অহংকারী ধরনের ছিলাম। এর কারণ বোধহয় আমাদের মা। কলোনীর সবার থেকে উনি আমাদের একটু আলাদাই রাখতেন। সবাই যখন বিকেলে গায়ে ময়লা লাগিয়ে হুটোপাটি করে খেলতো তখন আমরা তিন বোন নাক উঁচিয়ে বারান্দায় বসে থাকতাম। খেলতে ইচ্ছে করতো কিন্তু ঐ যে মায়ের নিষেধ। ভাবছেন খুব মায়ের বাধ্যগত বুঝি? ব্যাপারটা ঠিক তা না । শৈশবে অন্যদের থেকে নিজেকে বড় বা আলাদা দেখানোর ভাব সব শিশুই নিতে চায়। অনেকটা নিজের দামী খেলনা দেখানো কিন্তু ছুঁতে না দেয়ার মতো। আমাদের মা শিখিয়েছিল আমরা বড় অফিসারের মেয়ে, বাকিদের সাথে আমাদের হুল্লোড় করা মানায়না। তার ওপর আমরা তিনবোনই ছিলাম দারুন সুন্দরী। আমার মা খুব ভালো সেলাই জানতেন। যে কোন নতুন ডিজাইনের জামা বাজারে এলেই তিনি আমাদের বানিয়ে দিতেন। মোদ্দাকথা আমাদের শৈশব কেটেছে ধুলোবালি বাঁচিয়ে অন্য শিশুদের নাক সিঁটকে।
কৈশোরে এসে যখন একটু একটু বুঝতে শিখলাম তখন জানলাম বাবা মায়ের সম্পর্কের ভেতরের ফাঁপা অংশটুকু। আমরা তিনবোন কোন ভাই নেই তা নিয়ে বাবা আর দাদীবাড়ির যে এক জীবনের আক্ষেপ ছিল সেটা তাদের এক রাতের কথোপকথন থেকে জেনে যাই আমি। তারপর থেকে খেয়াল করতাম বাবা যেকোন কথার মারপ্যাচেই মাকে ধরাশায়ী করতেন এই বলে, তিনি আরেকটা বিয়ে করবেনই করবেন। কারণ ওনার বংশের প্রদীপ লাগবে। শুধুমাত্র আমার নানা নিজেও বেশ প্রতিপত্তিসম্পন্ন ছিলেন বলেই বাবা চাইলেও মাকে ছেড়ে দিতে পারেননি। বাবার কাছ থেকে পাওয়া অনাদর আর অবহেলাটুকু মা লুকিয়ে রাখতেন আমাদের অধিক যত্ন নিয়ে। আর মাত্রাতিরিক্ত আদর আর জীবনের অন্ধকার দিকগুলো সম্পর্কে জানতে দেরী হওয়া এই আমি ততদিনে অনেকটা পথ চলে এসেছি নিজের কোন যত্ন না নিয়েই। অর্থাৎ নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কোন চেষ্টা বা স্বপ্ন না নিয়েই। আমার মনে ধারনা হয়েছিল বড়লোকের বৌ হবো, অঢেল টাকা থাকবে, নিজের মতো করে জীবন উপভোগ করবো। সত্যিকারের জীবন উপভোগ মানে যে কি তা যে জীবনের শেষপ্রান্তে এসে বুঝবো তা কে জানতো সেই সুদূর শৈশব, কৈশোরে?
কোনরকমে স্কুলের চৌকাঠ পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম। নিত্য নতুন ফ্যাশনেবল পোশাক আর সাজগোজ করে সুন্দর হয়ে থাকার স্বপ্নে বিভোর এই আমি পড়াশোনাকে ভেবেছিলাম জীবনের অর্থহীন প্রয়োজন। আর তাই সাজগোজ, প্রেম, বিয়ে, বড়লোকের বৌ হওয়া এসবই ছিল আমার জীবনের মূল লক্ষ্য। লাফাঙা একটা প্রেমিকও জুটে যায়। আমার ভাবলেও অবাক লাগে আজ থেকে এতো বছর আগেও সংস্কারে ভরা সমাজের বিধিনিষেধকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আমি সেই প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যাবার সাহস কিভাবে করি? হয়তো বয়সের কারণে, নয়তো বুদ্ধির অপরিপক্কতায় কিংবা বিয়ে মানেই জীবনের সব পূর্ণতা এমন অবুঝ ধারনায় একরাতে আমি বাড়ি থেকে পালাই।
তখনকার দিনে রাস্তাঘাট এতো ভালো ছিলনা বিধায় ট্রেনে করে দূরে যাওয়াটাই সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল। মায়ের কিছু গয়না আর কিছু টাকা একটা ব্যাগে নিয়ে পা বাড়াই অজানার পথে। প্রেমান্ধ আর হুজুগে মেতে থাকা আমার মাথাতেই ছিলনা বাবার সুবাদে রেলপথে পালানোটাই আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন কোন ব্যাপার হবে। রেলগাড়ি ছেড়ে দেয়ার কয়েক মূহুর্ত আগে বাবা এসে আমার সামনে দাঁড়ান। আমার প্রেমিক প্রবর কিন্তু ততক্ষণে চম্পট। যাওয়ার পথে আমার ব্যাগখানা নিয়ে যেতে ভোলেনি কিন্তু সে। আজ অবেলায় বসে ভাবি আচ্ছা সেদিনের সেই বিপদ থেকে না হয় বাবা বাঁচিয়েছে কিন্তু তারপরে তাদের ইচ্ছেমতো সুখের আশায় যে ঘর বেঁধে দিয়েছে তারা তাই কি আমায় সুখী করেছে?
বাবা বড় অফিসার হবার সুবাদে কলোনীতে আমার পালিয়ে যাবার খবর দশ কান হওয়ার আগেই আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় নানাবাড়ি। দশদিনের মাথায় আমার বিয়ে হয়ে যায় জনৈক বিদেশী পাত্রের সাথে, আমার মতামতের কোন তোয়াক্কা না করেই। অবশ্য আমার এহেন কর্মের পর আমার মতামত নেয়া হবে সে ধারনাই যে অবান্তর। আমার শ্বশুরবাড়ি ছিল নিতান্ত গন্ডগ্রামে। বিয়ের পরে ঐ বাড়িতে যেয়ে দু সপ্তাহ থাকতে হয়েছিল আমার। আজীবন ধুলো মাটি থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা এই আমি প্রচন্ড ভেঙে পরি। সারাদিন চিৎকার করে কান্না আর স্বামীকে দোষারোপ করেই দুটো সপ্তাহ কাটে আমার।তার ওপর আমি জানতে পারি ইঞ্জিনিয়ার বলে আমাকে বিয়ে দেয়া হলেও ছেলে আদতে পলিটেকনিক থেকে পাস করা। ছেলের সাথে আমার বয়সেরও বিস্তর ফারাক তার ওপর ছেলে দেখতেও তেমন কোন সুপুরুষ না। কি দেখে যে আমার বাবা আমায় এখানে বিয়ে দিলেন এই ভেবেই আমার কষ্টে বুক ভেঙে যেত। নিজের পড়াশোনার তথৈবচ অবস্থা থাকলেও আমাকে কেন মিথ্যাচার করে বিয়ে দেয়া হলো সেই দুঃখেই যেন আমি জ্বলেপুড়ে যাচ্ছিলাম। একে তো বড়লোকের মেয়ে আমি তার ওপর দারুন সুন্দরী তাই আমার স্বামী বাদল পারলে আমাকে মাথায় তুলেই রাখলো। আমাকে বোঝালো এখানে আমার থাকতে হবেনা, আমি শহরে আমার বাবামায়ের কাছেই থাকবো। সে আমার যাবতীয় হাতখরচ পাঠাবে বিদেশ থেকে। আমার পড়াশোনা শেষ হলে সে আমাকে দুবাই তার কাছে নিয়ে যাবে। এতোসব কথার মায়ায় অবশেষে আমি কিছুটা বুঝলেও মন থেকে তাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারিনি তখনো।
বিয়ের তিন সপ্তাহের মাথায় বাদল চলে যায় তার কাজের অবস্থানে। এতোদিন বাবা মায়ের সংসারে প্রাচুর্য্য থাকলেও আমার হাতে সেভাবে টাকা পয়সা থাকতো না। কিন্তু বাদলের সাথে বিয়ের পর দেখা গেলো আমার সেই অভাবটাও আর রইলোনা। যেই পড়ালেখার জন্য আমায় রেখে গেলো সে সেটা বাদে আর সব ব্যাপারই ছিল আমার দারুন আগ্রহ। যখন যা ইচ্ছে করে কিনতে পারার স্বাধীনতা পাওয়া আমার বয়সী একটা মানুষের জন্য অনেকটা দুনিয়া জয়ের সমান। আমার বেসামাল খরচের হাত দেখে মা জোর করে কিছু টাকা ব্যাংকে রাখার ব্যবস্থা করেন। শুধুমাত্র মাকে খুশী করতেই আমি ঐ টাকাতে হাত দিতাম না। এদিকে মাস গড়িয়ে বছর প্রায়। এর মধ্যে বাদল আমার কাগজপত্র গুছিয়ে আনে দুবাই যাবার। কিন্তু দেশের এই আরাম আয়েশ আর সুখের জীবন ছেড়ে বিদেশ যেয়ে সব কাজ নিজের হাতে করাকে আমার বুয়াগিরি ছাড়া আর কিছুই মনে হয়না। তাই নানা অজুহাতে এমাসে না ও মাসে করে ওকে ঘোরাতে থাকি।
কথায় বলে আগের হাল যে পথে হাঁটে পেছনের হাল ও নাকি সে পথ ধরে। প্রেম করে আমি সফল না হলেও আমার ছোটবোন শায়লা সফলতা ঠিকই পেয়ে যায়। মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের এক ছেলের সাথেই তার প্রেম হয়ে যায়। বলতে দ্বিধা নেই তাতে আমার খানিক ইন্ধন এবং সহযোগীতাও ছিল। বাবা মা এবার আর কোন বাঁধা দেননি। কয় মেয়েকে থামাবেন। আমাকে কিছু বলবেন সে উপায় ও ছিল না। ততদিনে স্বামীর টাকায় ভারী ব্যাগ নিয়ে আমিও মুখে চোটপাট করা শিখে গেছি। বিয়ে হয়ে যায় ছোটবোনের। আমার তিন নম্বর বোন শর্মীর সাথে আমার বয়সের তফাত প্রায় সাত বছর হওয়াতে ওর সাথে আমার তেমন একটা বনতো না। তার ওপর ওটা আবার পড়াশোনায় খুব মনোযোগী ছিল। শায়লা ছাড়া একা একা বাড়িতে আমার মন সেভাবে টিকছিলোনা। তাই বাদলকে জানাই আমি দুবাই এসে সংসার শুরু করতে চাই।
বৌয়ের একটু মতি ফিরেছে, নিজে থেকেই আসতে চাইছে, এসব ভেবে আনন্দের আতিশয্যে বাদল টিকেট করে ফেলে তিন সপ্তাহের মধ্যেই। আবার কবে দেশে আসি, কত কি কাপড় লাগে কে জানে; এসব ভাবনায় পরের তিন সপ্তাহ শুধু কেনাকাটা করেই পার হয়ে যায়। সেসব দিনগুলোতে আমার সাথে সার্বক্ষনিক লেগে থাকতো আমার মা। অন্তত একটা মেয়ে সুখে থাক সেজন্যই বুঝিবা। আমি ছিলাম মায়ের সব গল্প শোনার সাথী। সঙ্গী হারিয়ে ফেলার কষ্ট মেটাতেও হয়তোবা সারাক্ষণ পাশে পাশে থাকা। সব গোছগাছ করতে করতে যাওয়ার দিনও চলেই এলো। বাসা থেকে বেরুবার ঠিক আগ মূহুর্তে কাঁদতে কাঁদতে আমার মা অজ্ঞান হয়ে গেলেন। মামারা বোঝালেন আমরা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছি তুমি এয়ারপোর্ট চলে যাও নয়তো প্লেন ছেড়ে দেবে।
পেছনে সংজ্ঞাহীন মা আর সামনে অজানা ভবিষ্যতের মধ্যখানে দোলাচলে দুলতে দুলতে সবার কথামত আমি পা বাড়াই অজানা জীবনের পথে; সংসার নামক অচেনা জীবনে নিজেকে জড়িয়ে নিতে।
#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস
চলবে…