#সুখের_খোঁজে৬
(বড় গল্প)
(শেষ পর্ব)
সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো এটা মেনে নিয়ে আমি নিজের একলা জীবনে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি। সেই যে সেলাই বাবদ জমিয়ে রাখা জমানো টাকারা আমার জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে এই বেলা। নয়তো যে ছেলের মুখাপেক্ষি হয়েই বাকীটা জীবন মুখ বুঁজে কাটিয়ে দিতে হতো। সাহায্যকারী ছোট একটা মেয়ে আছে, রান্নার একজন ছুটা বুয়া এসে রোজ রেঁধে দিয়ে যায়। একা মানুষের আর খাওয়াই বা কতটুকু? দিনের নানা সময়ে ছেলেরা দেখা করে যায়, সুমনা এটা ওটা রান্না করলে পাঠায় অথবা নিজেই নিয়ে আসে আর প্রকাশ চলে আসে যখন তখনই। ছেলের সাথে এক ঘরে না থাকাতে সবাই যখন ভালো থাকে তখন সেটা মেনে নেয়াই যে বুদ্ধিমানের কাজ। তবু একাকী বিকেল কিংবা বৃষ্টিভেজা রাতে যখন একাকী ঘরে কথা বলার একটা লোক খুঁজে মনের হাহাকারেরা গুমরে কাঁদে তখন মনে হয় একটু মেনে নিয়ে কি পুলক সুমনার সাথে থেকে যাওয়াই ভালো ছিল?
…………….
– মা, আপনি কি ব্যস্ত? পুলক বললো আপনার রান্নার মেয়েটা আসেনি।
হ্যা দেখোনা কাল বললো শরীর খারাপ। কিন্তু আজ আসবেনা সেটা আমিও ভাবিনি। তুমি আজ অফিসে যাওনি, সুমনা?
– না মা যেতে পারিনি। প্রকাশের স্কুলে একটা মিটিং ছিল সেখানে যেতে হবে। এদিকে আমার আম্মাও আসতে পারবেনা আজ তাই ছুটি নিয়েছি অফিস থেকে।
কেন বেয়াইনের কি হয়েছে? শরীর খারাপ না তো?
– না মা শরীর খারাপ না। আসলে সুমন ভাইয়ার বিয়ের পর থেকেই সমস্যা হচ্ছে বাসায়। আমার ভাবী একদমই আম্মাকে কোন ব্যাপারে সাহায্য করেনা। অফিস থেকে এসে যে নিজের রুমে ঢোকে আর খাওয়ার আগে বের হয়। আম্মাকে একা হাতে সব রান্না করতে হয়। বলেন কেমন লাগে? আমার কাছে যে এনে রাখবো সেই উপায় ও নেই। বাবা তাহলে একলা হয়ে যাবে।
চিন্তা করোনা। নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে তাই হয়তো মানিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে। তুমি অফিস যেতে হলে যাও, প্রকাশকে চাইলে আমার কাছে রেখে যেতে পারো। অবশ্য তুমি যদি ইনসিকিওরড ফিল না করো।
– মা, প্লিজ এভাবে বলবেন না। আমি আমার সেদিনের ব্যবহারের জন্য খুবই দুঃখিত। আমি বুঝতে পেরেছি সংসারে সবাইকেই মানিয়ে চলতে হয় নয়তো জীবন কঠিন হয়ে যায় সবার জন্যই। মা, চলেন না আমরা আবার একসাথে থাকি।
না সুমনা সেটা হয়না। ভেঙে যাওয়া কোন কিছু জোড়া দিলে তা হয়তো দাঁড়িয়ে থাকে কিন্তু ভাঙা দাগটুকু কিছুতেই দূর হয়না। আমিতো তোমাদের কাছেই থাকি। তুমি কখনো ভেবোনা আমি আলাদা থাকি বলে তোমাদের আলাদা কিছু ভাবি। তোমাদের যে কোন প্রয়োজনে যতদিন বেঁচে আছি সবসময় আমাকে পাশে পাবে।
…………….
একাকী জীবনে এবাদত ছাড়া, বাসার সহকারী মেয়েটাকে পড়ানো, মানুষের জন্য টুকটাক কিছু করা ছাড়াও ইদানীং খুব বই পড়ার নেশা হয়েছে আমার। সাতকাহন নামে বিশাল মোটা একটা বই পড়লাম সেদিন। বইতে কয়েকটা লাইন ছিল এরকম,
‘কাছে আসা বড্ড বেশী হবে
এই এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো।
তোমার ঘরে থমকে আছে দুপুর
বারান্দাতে বিকেল পড়ে এলো।’
যদিও বইয়ের ঐ লাইনগুলো স্বামী তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেছে তবু সুমনার গমন পথের দিকে তাকিয়ে আমার ঐ লাইনগুলো ওকে শুনিয়ে বলতে ইচ্ছে হলো। নিজ জীবনের মধ্যদুপুরে এসে যখন নিজের সবচেয়ে প্রিয়জন স্বামীর মনই পাইনি আজ সেই জীবনের এই শেষ বিকেলে এসে অন্য কারো মধ্যদুপুর উপভোগের সময় বিরক্তির কারণ হওয়া কি মানায় আমাকে?
প্রতিটা মানুষ জন্ম নেয়ার সাথে নাকি তার ভাগ্য নিয়ে জন্মায়। সেই যে মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে দূর্ভাগ্যকে সাথী করে নিজের জীবন শুরু হলো আজ শেষ বেলায় ছেলের বৌয়ের দুটো সান্ত্বনার কথা আমার বিষাদমাখা জীবন ইতিহাসে একটু শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দিলেও আমার জন্য সুখ আসলে কোথায় বা কিসে যে লুকিয়ে আছে তা বুঝি এক জীবন আমার অজানাই রয়ে গেলো। শুধু বুঝি সুখ একটা দারুন আপেক্ষিক শব্দ আর তার সংজ্ঞা একেকজনের জন্য একেকরকম। নিজের যা আছে তা নিয়ে খানিক ভালো থাকতে পারাই যেমন সুখ আবার নিজের চাহিদার লাগাম টেনে অন্য কারো সুখে সুখী হতে পারাও সুখ। একটা জীবন নিজের স্বামী সন্তানের সুখকে নিজের সুখ ভেবে কাটাতে যেয়ে বারেবারেই দুঃখ পেয়ে গেছি। জীবনের বাকী কটা দিন না হয় অন্যের জন্য কিছু করে নিজের সুখ খুঁজে নেই।
#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস
পর্ব ৫
https://www.facebook.com/groups/canvasbd/permalink/2448288978549614/