#আড়ালে_ভালোবাসি_তোমায়
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব৫
মুখোমুখি বসে আছি আমি আর আহনাফ। দুজনের মাঝেই নিরবতা বিরাজ করছে। বেশ কিছুটা সময় পর নিরবতা কাটিয়ে আহনাফ শান্ত কণ্ঠে আমায় বলল
-‘ অনেক তো কান্নাকাটি করলি। এবার বল কি হয়েছে তোর? তোকে এতো মনমরা কেন লাগছে? তোকে হাসিখুশিতেই মানায় রে, মন খারাপ এ নয়।
আমি তখনও হেচকি তুলেই যাচ্ছি। নিজেকে কিছুটা শান্ত করে করুন কণ্ঠে বললাম
-‘ জানিস, গত কয়েক মাস আগেই আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।
আমি এতোটুকু বলে থামলাম। আহনাফ চমকালো। আহনাফের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর মুখটা কেমন যেনো শুকিয়ে গেছে। হয়তো ও মানতে পারছেনা বিষয়টা। সে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল
-‘ তোর বিয়েও হয়ে গেছে, বাহ্। ভালোই তো। একবার আমাকে জানানোর প্রয়োজনবোধও করলি না। এতোটাই পর হয়ে গেলাম আমি তোর কাছে।
আমি চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিয়ে বললাম
-‘ তুই কখনোই পর ছিলি না আমার কাছে। তোকে বলার সময় বা সুযোগ হয়ে উঠেনি আমার। এক প্রকার তাড়াহুড়ো করেই রাশফিনের সাথে আমার বিয়েটা হয়ে যায়। আর তারপর..
একে একে সব কিছু বলতে শুরু করলাম।
সব শুনে আহনাফ অবাক হয়ে গেল। ওর মুখে কোনো কথা নেই। এবারও বেশ কিছুটা সময় নিরবতা বিরাজ করল। একটু থেমে আকাশের দিকে তাকিয়ে করুন কণ্ঠে বললাম
-‘ আমি অনেক খারাপ তাই না? এই জন্যই তো আমার সাথে এমনটা হলো। এমনটা না হলেও পারত, তাই না বল?
-‘ কে বলেছে তুই খারাপ। আমার দেখা সবচেয়ে ভালো তুই। মন খারাপ করিস না। দেখবি একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
-‘ আর কি ঠিক হওয়ার আছে। সব তো শেষ। এখন আমি বেচে থেকেও বা কি হবে। তার থেকে বরং ভালো হবে ম*রে..
আর বলতে পারলাম না। আমার মুখ চেপে ধরে আহনাফ। রাগান্বিত স্বরে বলল
-‘ খবরদার বলে দিচ্ছি, একদম এইসব আজেবাজে কথা বলবি না, তাহলে কিন্তু ঠিক হবে না বলে দিলাম।
আমি অবাক হলাম। আহনাফকে এতোটা রে*গে যেতে এর আগে কখনোই দেখিনি আমি।
আড়াল হতে সবই শুনে ফেলেন রেহানা বেগম অর্থাৎ অরনিশার মা। শাড়ির আচলটা মুখে চেপে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন তিনি। মেয়ের এমন করুণ পরিনতি তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। মেয়েটার সুখের কথা ভেবে কতো শখ করে বড় বাড়িতে নিজের একমাত্র মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছিলেন। তাও কিনা আবার রাহেলা খাতুনের মতো এতো ভালো মানুষ যার সাথে অনেকে আগে থেকে খুব ভালো সম্পর্ক, তার-ই একমাত্র ছেলে রাশফিনের সাথে বিয়েটা দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন মেয়েটা হয়তো অনেক বেশি সুখী হবে। কিন্তু না, রাহেলা খাতুনের ছেলে হয়েও রাশফিন যে এতোটা অ*মানুষ হবে, তা জানতেন না তিনি। ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালেও যে তার আসল চেহারা লুকিয়ে আছে তা তিনি বা অরনিশার বাবা, দুজনের কেউ-ই বুঝতে পারেননি। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, কে জানত যে তাদের মেয়েটাই এতো বেশি দুঃখীনি হবে। মেয়েটার ভালো করতে গিয়ে উল্টে আরও ক্ষ*তি করে বসলেন তারা। নিজের ভেতরেই কেমন একটা অ*পরাধবোধ কাজ করছে। মেয়েটার সামনে মুখ দেখাবেন কিভাবে তারা। কতো করে মেয়েটা নিষেধ করেছিল, বিয়েটা করবে না, কিন্তু তারা মেয়েটার কথা কানেই তোলেনি। এক প্রকার জোড় করেই বিয়েটা দিল। যার শেষ পরিনতি এটা।
কারো কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়ে উঠে গিয়ে দেখতে লাগলাম কোথা থেকে কান্নার আওয়াজটা আসছে। আম্মুকে কাদতে দেখে ঘাবড়ে গেলাম। আমি কিছু বলতে যাওয়ার আগেই আম্মু আমায় জাপটে ধরে কাদতে লাগলেন। আম্মু কাদতে কাদতেই বললেন
-‘ আমাদের ভুল হয়ে গেছে রে মা, ক্ষমা করে দিস। বুঝতে পারিনি যে তোর ভালো করতে গিয়ে উল্টে ক্ষতি করে ফেলবো।
-‘ না, মা কিচ্ছু হয়নি। তুমি এভাবে কাদলে আমার খুব কষ্ট হয়। তোমাদের তো কোনো দোষ নেই এখানে। তোমরা তো আর জানতে না। দোষটা আসলে আমারই, আমার ভাগ্যটাই এমন।
-‘ শুধু শুধু কেন নিজের ঘাড়ে দোষ নিচ্ছিস।
-‘ থাক, বাদ দাও আম্মু। তোমার মেয়ে তোমার কাছেই সারা জীবনের মতো চলে এসেছে। ও বাড়িতে আর ফিরব না আমি।
-‘ হ্যাঁ, কোনো দরকারও নেই ও বাড়িতে যাওয়ার। আজ থেকে ওদের সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ। কতো বড় সাহস আমার মেয়েকে কষ্ট দেয়।
-‘ আজ সারাদিন কিছু খাইনি আমি, বড্ড খিদে পেয়েছে আমার।
-‘ইস্ আমি তো ভুলেই গেছি রে। আয় মা খেতে চল।
শত কষ্টের মাঝেও আমার মুখে ফুটে উঠল এক চিলতে হাসি।
একপাশে বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে মা মেয়ের কথা শুনছিল আহনাফ। ওরা চলে যেতেই কিছু একটা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আহনাফ। আজ আহনাফের মনটাও বেশ খারাপ। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে বেশ কিছুটা সময়।
অরনিশার ডাকে ধ্যান ভাঙে তার। সেও ওর সাথে খাবার খেতে চলে যায়।
.
.
.
রেস্টুরেন্টে বসে আছি আমি আর আহনাফ। গত দুদিন যাবত আমাকে মনমরা দেখে একদমই ভালো লাগছে না আহনাফের। তাই তো আমাকে নিয়ে আজ ঘুরতে বের হলো, আমার মন ভালো করার জন্য। ঘুরাঘুরি শেষে আমরা চলে এলাম রেস্টুরেন্টে। আমরা বসে বসে টুকটাক কথা বলছিলাম, গল্প করছিলাম আর খাচ্ছিলাম।
এমন সময় হঠাৎ কোনো কিছু ভা*ঙার শব্দে আমরা দুজনই সেদিকে ফিরে তাকালাম। দেখলাম রাশফিন আমার দিকে অ*গ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
আজ ফারিহা এটা সেটা বাহানা করতে করতে জ্বা*লিয়ে মা*রছিল রাশফিনকে। তাইতো বি*রক্ত হয়ে ওকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে এলো। আর এসেই ঘটল এই বি*পত্তি। এমনিতেই গত দুদিন ধরে রাশফিনের মন মেজাজ একদমই ঠিক নেই। তার উপরে আবার অরনিশাকে এসময় অন্য একটা ছেলের সাথে দেখে মাথায় ধ*প আ*গুন জ্ব*লে উঠল। মনে পড়ে গেল সেদিন রাতের কথা। তার মানে ছবিতে যাকে দেখেছিল সেটা সত্যি সত্যিই অরনিশা ছিল। রা*গে হাতের কাছে থাকা গ্লাসটা তুলে আ*ছাড় মেরে মাটিতে ফেলে দিল।
আমার দিকে রাশফিন তে*ড়ে এসে আমাকে টেনে উঠিয়ে দাতে দাত চেপে বলল
-‘ খুব তো আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলেছিলি। তো এখন কি হচ্ছে এখানে।
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম ফলে আমার মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হচ্ছিল না। আমায় চুপ থাকতে দেখে যেন আরও বেশি রে*গে গেল রাশফিন। আমার গালে ঠা*স করে চ*ড় মারতে গেলে আমি ভ*য়ে চোখ বন্ধ করে নিলাম কিন্তু না আমার গালে কোনো চ*ড় পড়েনি। চোখ খুলতেই দেখলাম আহনাফ হাত ধরে আছে রাশফিনের। রাশফিন দাত কিড়মিড় করে বলল
-‘ হাও ডেয়ার ইউ? তুমি আমার হাত ধরো কোনো সাহসে, তুমি জানো আমি কে?
-‘ আপনি কে তা আমার জানার কোনো ইচ্ছা বা আগ্রহ কোনোটাই নেই। তবে এতোটুকু জানি, আপনি অরনিশার হাসবেন্ড যে কিনা ওকে প্রতিনিয়ত অত্যাচার করে।
-‘ কিহ্, কি বললে তুমি? আমি ওকে অত্যাচার করি? ও তার মানে জল এতো দূর গড়িয়ে গেছে। তা তোমার ল*জ্জা করে না, অন্যের বউকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে বসে বসে কথা বলতে?
-‘ অভিয়েসলি না, কারণ আমরা কোনো প্রেমালাপ করছিলাম না, জাস্ট কথা বলছিলাম। আর না আপনার মতো কোলে নিয়ে বসেছিলাম না যে ল*জ্জা করবে আমার।
আহনাফের কাটকাট জবাবে রে*গে আ*গুন হয়ে গেল রাশফিন। এতোটা অ*পমানিত সে, এর আগে কখনোই হয়নি। আহনাফের উপর রা*গ ঝা*ড়তে না পেরে আমার দিকে তে*ড়ে এসে শ*ক্ত করে আমার হাত চেপে ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগল রাশফিন। আর চি*ৎকার করে বলল
-‘ আজ তুই শুধু বাড়ি চল আমার সাথে। তোর একদিন কি আমার একদিন। আজ আমি তোকে মে*রেই ফেলব।
আমি অসহায় দৃষ্টিতে তাকালাম আহনাফের দিকে। ততক্ষণে আহনাফও রে*গে একদম লাল বর্ণ ধারণ গিয়েছে। যে মানুষটাকে সবসময় যেকোনো পরিস্থিতিতে শান্ত থাকতে দেখেছি, সেই মানুষটাও আজ রে*গে গিয়েছে।
আহনাফও চি*ৎকার করে বলল
-‘ খবরদার, অরনিশার যদি আজকে কিছু হয়ে যায় আর ওর গায়ে যদি একটা ফুলের টোকাও লাগে। তাহলে কিন্তু আজ একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে।
রাশফিন আচমকাই আমার হাত ছেড়ে দিল। বাধন আলগা হতেই আমি দৌড়ে আহনাফের কাছে ছুটে গিয়ে ভ*য়ে জড়োসড়ো হয়ে দাড়ালাম।
রাশফিন সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাল আমাদের দিকে। জোড়ে হেসে আমায় উদ্দেশ্য করে বলল
-‘ ওহ্ আমি তো ভুলিয়ে গিয়েছিলাম। তুই তো আরেকটা জুটিয়েছিস। যাহ্ তোকে তালা*ক দিয়ে দিলাম। কালই ভি*ভোর্স পেপার পেয়ে যাবি। তোর মতো মেয়ের সাথে সংসারও করবো না। চরিত্র*হীন মেয়ে কোথাকার।
এবার রাশফিন আহনাফের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল
-‘ যাহ্ তোর মা*ল, তোকে ভি*ক্ষা দিয়ে দিলাম। তবে ভাবিস না, তোর কথায় আমি ভ*য় পেয়ে এমমটা করেছি। কারো ইউজ করা প্রোডাক্ট আমি নিই না।
বলে রা*গে গটগট করে ফারিহার হাত ধরে নিয়ে বেরিয়ে চলে যায়।
রাশফিনের বলা এসব বি*শ্রী বাক্য শুনে আমার চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না, মাথা ঘুরে উঠল। চারিদিকে কেমন যেন অন্ধকার দেখতে লাগলাম। জ্ঞান হারাবার আগে শুধু শুনতে পেলাম আহনাফের চিৎকার।
#চলবে ~