#আড়ালে_ভালোবাসি_তোমায়
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব১০
মস্তিষ্কের নিউরন সেলে অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজনের ফলে ব্রেইন টি*উ*মা*র হয়েছে রাশফিনের। আর একটু দেরি করলেই হয় তোবা তা রূপ নিতে পারত ক্যা*ন্সা*র নামক কঠিন ম*র*ণ ব্যাধি রোগে।
এ ছাড়াও রাশফিনের রক্তে এসজিপিটি এর পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। এই এসজিপিটি টা মূলত মানুষের লিভার সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা তা বুঝতে সাহায্য করে। যেখানে স্বাভাবিক মানুষের নরমাল রেঞ্জ ৪২-৫৭ থাকা উচিত সেখানে রাশফিনের কি না ২৩০৩, যা অস্বাভাবিক এর থেকেও অস্বাভাবিক। এমন হলে রোগী কে ইমিডিয়েটলি আইসিউ তে ভর্তি করতে হয়। ফলে ওকে আইসিউ তে ভর্তি করা হয়েছে।
রাশফিনের অবস্থা একদমই ভালো নয়। যে কোনো সময় যা কিছু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন ডক্টর।
এই তো কাল রাতে রাহেলা খাতুন ছেলে রাশফিনকে রাতের খাবার খেতে ডাকতে গিয়েছিলেন। পুরো রুম এ অসময়ে অন্ধকার দেখে তিনি কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। লাইট অন করে রুমে কাওকে না দেখে বেলকনির দিকে পা বাড়ালেন তিনি। বেলকনিতে গিয়ে দেখলেন রাশফিন পড়ে আছে ফ্লোরে, নাক দিয়ে হালকা র*ক্ত গড়িয়ে পড়ছে। চি*ৎকার করে ছেলেকে ডাকলেন তিনি। ছেলের কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে তিনি দ্রুত হসপিটালে নিয়ে এলেন।
রাশফিনের শরীরের এমন খারাপ অবস্থার কথা শুনে আমিও আর বাসায় থাকতে পারলাম না। দ্রুত ছুটে চলে এসেছি হসপিটালে।
একটু আগে মামনি আমায় ফোন দিয়ে উপরোক্ত খবরটা জানালো। আমার কর্নকুহরে কথাটা পৌছানো মাত্রই যেন আমার সর্বাঙ্গ ঝিনঝিনিয়ে উঠল। কিছু সময়ের জন্য আমি থমকে গিয়ে ছিলাম যেন। হুশ ফিরতেই সাত পাচ না ভেবে দৌড়ে ছুটে গেলাম হসপিটালে।
মামনি আমায় দেখতেই দৌড়ে এসে জাপটে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদতে লাগলেন। আমি তাকে কি বলে স্বান্তনা দিব তার কোনো ভাষা খুজে পেলাম না আমি। আমার নিজেরও তো কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। এই মানুষটাকে ভালো বেসেছিলাম। আমি কখনোই ভাবতে পারিনি রাশফিনের এমন অবস্থা হবে।
কেবিনের দরজার ছোট কাচের জানালার দিকে তাকাতেই শুধু রাশফিনের মুখটা দেখতে পেলাম। মুখে অক্সিজেন মাক্স লাগানো। শুধু এতো টুকু বুঝতে পারলাম, রাশফিনের মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে একদম। সেই আগের মতো সুন্দর চেহারাটাও আর নেই। ফর্সা মুখ খানা একদম কালসিটে হয়ে গেছে।
রাশফিনের এমন করুণ অবস্থা দেখে আমার বুকটা ধক করে উঠল। চোখের অবাধ্য অশ্রু গুলো আমার গাল বেয়ে টপটপ করে পড়তে লাগল। আমি চাইলেও আমার কান্না থামাতে পারছি না কিছুতেই।
মামনি এবার কিছুটা কান্না থামিয়ে কিছুটা শান্ত হয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এতো কিছুর মাঝে এই মানুষটার খোজ খবর নেওয়ার কথা আমি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। এজন্য আমার নিজের মাঝেই কেমন একটা অপরাধ বোধ কাজ করতে লাগল। রাশফিনের সাথে না হয় আমার যোগাযোগ বা সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু মামনির সাথে তো ছিল।
আমার উচিত ছিল একবার হলেও খোজ নেওয়া এই মানুষ টার, এখানে তো আর মামনির কোনো দোষ ছিল না। মামনি কান্না থামিয়ে ধরা গলায় আমায় বললেন
-‘ কেমন আছিস রে মা? তোকে অনেক মিস করছি রে এতো দিন। এক বার তো খোজ নিতে পারতিস তুই? বাড়িতেও এক বারের জন্যে এলি না।
আমি চুপ করে রইলাম। কিছুটা সময় অতিবাহিত হলে আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললাম
-‘ আছি কোনো রকম। আমি আসলে ভুলে গিয়েছিলাম তোমাদের কথা। সরি, মামনি। আর আসতাম কোন অধিকারে…
আমি থেমে গেলাম। মুখ ফোসকে বেরিয়ে যাচ্ছিল কিছু কথা। এই মুহূর্তে এ কথা গুলো বলা ঠিক হবে না। মামনি কে পরেও বলা যাবে এ ব্যাপারে। তাই চুপ করে গেলাম আমি।
ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে মামনি বললেন
-‘ কি বলতে গিয়ে থেমে গেলি রে তুই?
-‘ ক কই কিছু না তো মামনি।
আমায় আমতা আমতা করতে দেখে মামনি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। যেন আমার কথা তার বিশ্বাসই হচ্ছে না।
তিনি বললেন
-‘ কিছু তো একটা হয়েছেই। না বললে আমি কিভাবে বুঝবো? সেদিন রা*গ করে চলে এলি। বাসায় একবারও গেলি না, ব্যাপার কি বল তো?
এই খারাপ সময়ে আমি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাচ্ছিলাম না, তবে মামনির জোড়াজুড়ি করাতে কিছু না বলেও পারলাম না।
-‘ এক নিমিষেই যে সব শেষই হয়ে গেল আমার, মামনি। কোন মুখ নিয়ে আর কোন অধিকারে যেতাম আমি তোমাদের বাসায়?
-‘ মানেহ্, কি হয়েছে সবকিছু খুলে বল তো আমায়?
-‘ তোমার ছেলে আমায় ডিভোর্স দিয়েছে, মামনি।
কথাটা বলতে বলতে আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম।
রাহেলা খাতুন চমকালেন। তার ছেলে খারাপ আচরণ করেছে এটা ঠিক কিন্তু তাই বলে ডিভোর্স দিবে, এটা কখনোই হতে পারেনা। অরনিশা চলে যাওয়ার পর তিনি ছেলেকে যতটা পেরেছেন চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করেছেন, প্রতি মুহূর্তে নিজের ছেলেটাকে কাদতে দেখেছেন শুধুমাত্র অরনিশার জন্য।
এইতো সেদিনও রাশফিন তার মাকে জড়িয়ে ধরে কেদেছিল, অনেক কেদেছিল। নিজের করা কৃতকর্মের জন্য বড্ড অনুতপ্ত সে। কিন্তু এগুলো তো ও আর সজ্ঞানে করেনি। রাশফিন বুঝতে পারেনা ওর সাথে হচ্ছেটা কি।
তার পরই তো প্রচণ্ড মাথা ব্যাথায় অসুস্থ হয়ে পড়ল রাশফিন। আর আজ এই অবস্থা।
আমার কথায় ধ্যান ভাঙল মামনির। মামনি আমায় একে একে সব বলতে লাগলেন ঠিক যা যা রাশফিন বলেছিল রাহেলা খাতুনকে।
আমি সব শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লাম আমি। মামনি রাশফিনের ফোনটা বের করে ছবি গুলো দেখালেন আমায়। আমি আরও এক দফা অবাক হলাম। অবাক হয়ে বললাম
-‘ এটা তো আহনাফ, আর ওর পাশে এই মেয়েটা কে? আর এই ছবি গুলো রাশফিনের ফোনে এলো কিভাবে?
-‘ রাশফিনের ভাষ্য মতে এটা নাকি তুই ছিলি?
-‘ ইম্পসিবল, আমি এটা কখনোই হতে পারি না। আরে আমার সাথে তো আহনাফের বেশ কয়েক বছর ধরেই কোনো যোগাযোগ ছিল না। আর না আমি কখনো কোথাও এভাবে গিয়েছিলাম ওর সাথে। আর না আমার ফেস বুঝা যাচ্ছে। আমি যে গিয়েছিলাম সেটা আমি নিজেই জানি না।তাহলে আমি এটা হলাম কিভাবে?
সবার আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ছবিতে আমি না হলে এটা কে তাহলে? আমায় কেউ ফাসাতে চাইছে না তো? এসব ভাবতে ভাবেই আমি কিছুটা থেমে বললাম
-‘ আচ্ছা, মামনি এই ছবি গুলো রাশফিন কে দিয়েছে কে, বল তো?
-‘ ফারিহা দিয়েছে এই ছবি গুলো। আমার তো মনে হচ্ছে সব কিছুর মুলে এই ফারিহা ই আছে। তোদের সম্পর্কে ফাটলটা এই ফারিহা ই ধরিয়েছে।
আমি হতভম্ব হয়ে রইলাম। ফারিহার জন্যই তবে এতো কিছু হলো। এবার কিছুটা পরিষ্কার হলো। তবে সবটা না। এতো কষ্ট পেলাম আমি যার জন্য তার যেন জীবনেই ভালো না হয়। কঠিন শাস্তি পায় যেন ফারিহা। নিজের অজান্তেই ফারিহাকে অ*ভিশাপ দিয়ে বসলাম আমি।
আমাদের দুজনের মাঝেই পিন পতন নিরবতা বিরাজ করছে। হঠাৎ মামনির ফোন বেজে উঠায় ধ্যান ভাঙল আমার। ফোন বের করে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই বিরক্তির ছাপ মুখে ফুটে উঠল মামনির। বেশ কয়েক বার ফোন বাজার পর বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করলেন তিনি।
লাউড স্পিকারে দেওয়ার কারণে আমরা ফোনের অপর পাশ থেকে শুধু শুনতে পেলাম নাফিয়া রহমানের কান্না মিশ্রিত কণ্ঠের করুন আর্তনাদ..
#চলবে ~