#আড়ালে_ভালোবাসি_তোমায়
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব১৪
দুদিন হতে চলল হসপিটাল থেকে রিলিজ পেয়ে নিজের বাসায় এসেছে রাশফিন। এখন মোটামুটি বেশ অনেকটাই সুস্থ রাশফিন। রাহেলা খাতুন যত্নের যেন কোনো কমতি রাখছেন না তার ছেলের জন্য।
তবে সব কিছু ঠিক থাকলেও রাশফিনের মন একদমই ঠিক নেই। অরনিশা একবারের জন্যও আর রাশফিনের সামনেই পরেনি। চোখ দুটো প্রিয় মানুষটিকে দেখার জন্য কতো আনচান করে কিন্তু এতো খুজেও পেল না অরনিশার দেখা। মনটা যে তার খালি বউ বউ করে। কিন্তু বউ তো বুঝেই না তার মনের কষ্ট। একা একা বিরবির করে বলে রাশফিন। পর মুহূর্তে কিছু একটা ভেবে মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠে রাশফিনের।
কাপা কাপা হাতে ফোনটা বের করে সাহস করে অরনিশাকে ফোন দেয় রাশফিন। কয়েকবার রিং হতেই রিসিভ করে অরনিশা।এতে রাশফিনের খুশি যেন উপচে পড়ছে।
-‘ কেমন আছো বউ? তোমাকে ছাড়া আমি মোটেও ভালো নেই যে, চলে আসো না বউ?
অরনিশা দাতে দাত চেপে বলল
-‘ আসবো না।
-‘ কেন বউ? সরি বললাম তো।
-‘ ফোন দিয়েছেন কেন আপনি আমায়? আর কখনো ফোন দিবেন না আমায়। আপনার সাথে কোনো কথা নেই আমার।
-‘ ও বউ শোনো না?
রাশফিনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দুম করে ফোনটা কেটে দেয় অরনিশা। ফোনটার দিকে তাকিয়ে রাশফিন মাথায় হাত দিয়ে অসহায়ের মতো বসে থাকে কিছুক্ষণ।
পর মুহূর্তে কিছুটা একটা ভাবতেই যেন মুখে রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে রাশফিনের।
আড়াল থেকে ছেলের এমন কান্ড কারখানা দেখে মুচকি মুচকি হাসেন রাহেলা খাতুন।
.
.
.
রকিং চেয়ারে বসে ফোনটা হাতে নিয়ে নিজের মেয়ের ছবি দেখছেন আর ছবিতে হাত বুলাচ্ছেন নাফিয়া রহমান। সেই সাথে চোখ দিয়ে তার অশ্রু কণা গুলো টপটপ করে পড়ছে মোবাইলের স্ক্রিনের ছবিটার উপর।
রুমটাকে তিনি পুরো অন্ধকার করে রেখেছেন। বাইরের রোড লাইটের আলোতে যত টুকু আলোকিত হয়েছে তাতে আবছা আবছা ঘরের কোণা দেখা যাচ্ছে। আজ সারা বাড়িতেও সন্ধ্যের বাতিটাও জ্বলেনি। হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে ভুতের বাড়ি। মেয়েকে ছাড়া যেন পুরো বাড়িটাই হাহাকার করছে। আজ এক সপ্তাহের বেশি হতে চলল ফারিহা মা*রা গেছে। তার কোল যে খালি হয়ে গেছে। তিনি যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না নিজের মেয়ের অ’কা’ল মৃ*ত্যুটা। বেচে থাকলে পুরো বাড়িটা যেন মাতিয়ে রাখত ফারিহা। মেয়ের সাথে তার ছিল অন্য রকম বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক। স্বামী মা*রা যাবার পর তার এই একমাত্র সম্বলই ছিল তার এই একমাত্র মেয়েটা ফারিহা। আর তিনি কিনা অরনিশা নামক মেয়েটার জন্যই খুইয়েছেন নিজের একমাত্র সম্বলটাকে।
কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি এসব। যখন মেয়ের মৃত্যুর কথাটা তার কর্ণ কুহরে গিয়ে বাড়ি খেল তখন যেন তিনি স্তব্ধ হয়ে যান কয়েক মুহূর্তের জন্য। পরে বোধগম্য হতেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে ঢলে পরেন।
রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে তিনি চোখ বুজে প্ল্যান করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অরনিশার জন্যই যেহেতু সব কিছু হয়েছে, সেহেতু তিনিও দেখে নিবেন অরনিশা কিভাবে সুখে থাকে। প্রয়োজন পড়লে অরনিশাকে খু*ন করে তিনি জে*লের ভাতও পর্যন্ত খাবেন। তবুও শান্তিতে বাচতে দিবেন না অরনিশাকে। ওর জীবনটাকে একেবারে বি*ষিয়ে তুলবেন তিনি। তিনি তার কল্পনায় আকতে লাগলেন হী*ন স্বরযন্রের চিত্র গুলি।
হঠাৎ দরজায় কারো নক করার শব্দে ফিরে তাকালেন সেদিকে। অন্ধকারে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে কারও অবয়ব। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এই ব্যক্তিটি আহনাফ। আহনাফকে দেখে মুখে হাসির রেখা প্রশস্ত হলো নাফিয়া রহমানের। ইশারায় তিনি ভেতরে আসতে বললেন আহনাফকে। কাল অতি বিলম্ব না করে ভেতরে চলে যায় আহনাফ।
আহনাফকে আগেই নিজের বাড়ির চাবি দিয়ে দিয়েছিল ফারিহা। যে কারণে আহনাফের আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি। মেইন গেইট দিয়ে এসেই ও সোজা চলে যায় নাফিয়া রহমানের রুমে।
আহনাফ গিয়ে চেয়ার টেনে বসল নাফিয়া রহমানের পাশে। নাফিয়া রহমান আহনাফের দিকে তাকিয়ে বললেন
-‘ আমার যে সব শেষ হয়ে গেল যে বাবা, আমার পুরো পৃথিবীটাই ছিল ফারিহা, আমার মেয়ে। সে-ই যে আর বেচে নেই…
কথাটা বলে নাফিয়া রহমান ডুকরে কেদে উঠলেন। নাফিয়া রহমানের অবস্থা দেখে আহনাফের মায়া হলো বেশ। কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকল আহনাফ। পর মুহূর্তে কিছু একটা ভাবল।
যত্ন সহকারে হাত বুলিয়ে দিল নাফিয়া রহমানের মাথায়। করুন কণ্ঠে বলল
-‘ যা হবার তা তো হয়েই গেছে, আম্মু৷ আমিও তো আপনার ছেলের মতোই তাইনা? আমাকে কি আপনি আপনার ছেলে হিসেবে মানতে পারবেন না? আমি যে মা ম*রা ছেলে। সেই কোন ছোটবেলায় হারিয়েছি মাকে। মায়ের চেহারাও মনে নেই আমার। আমি কি আপনাকে আম্মু বলে ডাকতে পারিনা? তাহলে আপনার অভাবও পূরণ হতো, আর আমার অভাবও পূরণ হতো।
আহনাফের কথা শুনে আহনাফের দিকে চমকে তাকালেন নাফিয়া রহমান। ছেলেটার জন্য বড্ড মায়া হলো তার। তিনি আহনাফের গালে হাত রাখলেন। পরম স্নেহময়ী মাতার মতো হাত বুলিয়ে দিলেন আহনাফের মাথায়। আদুরে গলায় তিনি বললেন
-‘ হ্যা, অবশ্যই, কেন নয় বাবা। তুমি তো আমার ছেলের মতোনই। ফারিহা আর তোমাকে কখনোই আলাদা চোখে দেখিনি আমি। তবে বিপত্তি তো ঘটিয়েছে ওই অরনিশা মেয়েটা। আজ ওর জন্য আমার মেয়েটা আজ বেচে নেই।
আমার বুকটা খালি হয়ে গেল যে বাবা।
কথাটা বলে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি।
আহনাফ কটমট করে বলে উঠল
-‘ যার জন্য আমার বোন মা*রা গেছে, তাকে আমি কিছুতেই ছাড়ব না। মিলিয়ে নিবেন আমার কথা।
নাফিয়া রহমান অবাক চোখে তাকালেন আহনাফের দিকে। আহনাফ তা দেখে মুচকি হেসে বলল
-‘ আমি জানি, আপনি মনে মনে প্ল্যান করছেন অরনিশাকে মা*রার জন্য। কিন্তু আপনার কোনো টেনশন করতে হবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আপনার এই অসুস্থ শরীর নিয়ে কিছুই করতে হবেনা। যা করার আমি-ই করবো। আপনার ছেলে আহনাফ জুবায়ের, আমি আছি তো নাকি?
আহনাফের কথায় আস্বস্ত হলেন নাফিয়া রহমান, হাফ ছেড়ে যেন বাচলেন তিনি। কিন্তু কিছু একটা ভাবতেই কেমন যেন সন্দেহ হয় আহনাফকে। তিনি সন্দিহান চিত্তে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। মনে মনে আওড়ালেন
-‘ ছোটবেলার থেকে যার সাথে এতো ঘনিষ্ঠ, বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক তাকেই কিনা শাস্তি দিবে আহনাফ? শুধুমাত্র আমাদের সাথে দুদিনের ভালো সম্পর্কের জন্য এমনটা করবে আহনাফ? এরপর কোনো কারণে আমার সাথেও কোনো ঝামেলা বাধলে আমাকেও তো মে*রে ফেলতে দুবার ভাববেনা হয়তো আহনাফ।
পর মুহূর্তে আহনাফের ইনোসেন্ট চেহারা আর চাহনির দিকে তাকিয়ে তার মনের যেন সব সন্দেহ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল এক নিমেষেই। নিজেকেই নিজে কয়েক দফা বকা দিলেন, শুধু শুধুই এমন নিষ্পাপ ছেলেটাকে কেন সন্দেহ করছেন তিনি।
কি একটা মনে করে যেন তিনি নিজের গাড়ির চাবিটা দিয়ে দিলেন আহনাফকে।
এতে যেন আহনাফের চোখ মুখ খুশিতে চিক চিক করে উঠল। এটাই তো চাচ্ছিল এতোক্ষণ ধরে। পরিশ্রম বৃথা যায়নি তবে আহনাফের।
আহনাফের মুখে ফুটে উঠল রহস্যময় হাসি। ব্ল্যাকমেইলটা ভালো মতোই করতে পারে সে। এক মুহূর্তেই কিভাবে নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিলো নাফিয়া রহমানকে। নাফিয়া রহমান যদি জানতেন যে তার-ই একমাত্র মেয়ে ফারিহাকে তার প্রাপ্য টাকার না দেওয়ার কারণে আহনাফ-ই মে*রে ফেলেছে, তাহলে কি নাফিয়া রহমান এতোটা করুনাময়ী হতেন আহনাফের উপরে? যদি জানতেন তাহলে হয়তো অরনিশাকে নয় আহনাফকেই কে*টে কে*টে স্লাইস করে ফেলতেন নাফিয়া রহমান।
#চলবে ~