#আড়ালে_ভালোবাসি_তোমায়
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব৪
ব্যাগপত্র সব গুছিয়ে নিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম এ বাড়িতে আর এক মুহুর্তও থাকব না। তাই যে ভাবা সেই কাজ। সবকিছু প্যাক করে রুমের দরজা খুলতেই এ অসময়ে রাশফিনকে দেখে অবাক হলাম। আমার হাতে ব্যাগ দেখে ভ্রু কুচকে তাকাল রাশফিন। আমি তাকে দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছি তখনই গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল
-‘ কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?
আমি একবার পেছন ফিরে তাকালাম। তবে কোনো কথা বললাম না। যে মানুষটা তার বউয়ের সামনে নির্দ্বিধায়, নিঃসংকোচে অন্য একটা মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে থাকতে পারে, ইভেন এতো অ*পমান করা সত্ত্বেও কোনো প্রতিবাদ করেনা, আর যাই হোক সে কোনো মানুষের কাতারে পড়েনা। আমি তার ভিতরে কোনো অ*পরাধবোধও দেখলাম না।
আবারও আমি যেতে নিলে সে আমার হাত ধরে ফেলে। আমি ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করলাম। তিনি আবার বললেন
-‘ আগে একবার বলেছি আবারও বলছি কোথায় যাচ্ছো?
-‘ আপনাকে বলতে আমি বাধ্য নই।
-‘ আলবাত বাধ্য তুমি। আমার পারমিশন ছাড়া এবাড়ির বাইরে তুমি এক পাও রাখতে পারবে না।
হঠাৎ করে আমি চি*ৎকার দিতেই তিনি ঘাবড়ে গিয়ে আমার হাত ছেড়ে দিলেন। বাধন আলগা হতেই আমি ছুটে মেইন গেটের সামনে চলে এলাম। পিছন থেকে তিনি আমায় চি*ৎকার করে ডেকে চলেছেন। আমি না শুনে চলে যেতে নিব তখনই মামনি এসে আটকে দিলেন। উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন
-‘ এতো ব্যাগপত্র নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?
-‘ বাবার বাড়ি।
-‘ কিন্তু এ অসময়ে কেন? আচ্ছা, যা, রাশফিন এগিয়ে দিয়ে আসুক।
-‘ তার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। আমি সারাজীবনের মতো চলে যাচ্ছি এ বাড়ি ছেড়ে আর কখনো ফিরব না।
-‘ কিন্তু কেন রে? তোদের ভেতর কি আবার ঝগড়া হয়েছে?
-‘ সেটা না হয় তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করে নিও। আসি। ভালো থেকো।
ইতোমধ্যে রাশফিন, ফারিহা দুজনেই হাজির।মামনি রাশফিনের দিকে তাকাতেই রাশফিন বলে উঠল
-‘ না, মা, দেখো ও শুধু শুধু রা*গ করে চলে যাচ্ছে।
আমি নিজেকে এতোকিছুর পরেও শান্ত রাখলেও এখন আর পারলাম না। জোরে চি*ৎকার করে বললাম
-‘ শুধু শুধু রা*গ করেছি মানে? এমন একজন চ*রিত্রহী*ন, ল*ম্পট যে কিনা ঘরে বউ থাকতেও কাজিনকে তার রুমে নিয়ে গিয়ে কোলে নিয়ে বসে থাকে, তারই কাজিন যা নয় তাই বলে অ*পমান করে, তারপরও কোনো প্রতিবাদ করে না, তার সাথে কিভাবে সংসার করবো আমি? এতোদিন মুখ বুজে সব সহ্য করেছি, ভেবেছিলাম হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু না, ঠিক তো হলোই না বরং আরও….
এতোটুকু বলে থামলাম। আজ মনের সব রা*গ, ক্ষো*প উগড়ে দিলাম। ইতোমধ্যে মামনির চোখে অশ্রু টলমল করছে। তিনি ছেলের বিরুদ্ধে এতো অভিযোগ মেনে নিতে পারছেন না।
ফারিহা মিটিমিটি হাসছে, ফাইনালি তার প্ল্যান কাজ করতে শুরু করেছে। তবে ও ভাবতে পারেনি, এতো দ্রুত কাজ করবে। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল।
রাশফিনের মাথা যেন নুয়ে পড়েছে। আমি সবার দিকে একবার করে চোখ বুলালাম। আজ হাজার চেষ্টা করেও কেউ আটকাতে পারল না আমায়। আমার জে*দের কাছে হার মানল সবাই। তবে আমি তো এমন ছিলাম না। নিজেকেই যেন নিজে চিনতে পারছি না। পরিস্থিতি বানিয়েছে আমায় এমন। তারপর ওই বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম। যাওয়ার আগে রাশফিন যেন আমায় চোখের ইশারায় কিছু বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু আমি পাত্তা না দিয়ে বেরিয়ে এলাম। আমার কোনো ইচ্ছাই নেই রাশফিনের থেকে কিছু শোনার বা জানার। ইচ্ছেটা যে ম*রে গেছে অনেক আগেই। আমিই যে এখন একটা জীবন্ত লা*শ।
-‘ অরনিশা….
রাস্তা দিয়ে হাটছিলাম এমন সময় পরিচিত কণ্ঠস্বরে আমায় কেউ ডাকায় পেছন ঘুরে তাকালাম। পরিচিত সেই মুখশ্রী দেখে আমি অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে গেলাম সাথে অবাকও হলাম বেশ। বেশ অনেকদিন পর দেখা আমাদের।
-‘ কি রে অরনিশা, কেমন আছিস? কতোদিন পর দেখা। কোথায় যাচ্ছিস, এখন তুই? তাও আবার এতো কিছু নিয়ে।
-‘ ঐ তো আছি কোনোরকম। বাবার বাসায় যাচ্ছি।
-‘ কোথা থেকে যাচ্ছিস বাসায়? আর তোকে এমন কেন লাগছে? কিছু কি হয়েছে?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম
-‘ অনেক কথা রে। তোকে পরে বলবো। বাসায় চল।
-‘ আজ না রে, পরে কোনো একদিন…
-‘ যাবি কিনা, তাই বল। আজকে তুই আমার সাথেই আমার বাসায় যাবি। যাবি মানে যাবি।
আমার জোরাজোরিতে আর না করতে পারে নি আহনাফ। আহনাফ আমার ছোটবেলার বেস্টফ্রেণ্ড। পড়াশোনার জন্য বাইরে থাকতে হতো ওকে। যে কারণে ওর সাথে আমার বেশ অনেকদিন যাবত যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে।
আহনাফের সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে বাসায় চলে এলাম খেয়ালই নেই।
কলিংবেল দিতেই মা এসে দরজা খুলে দিলেন। এই অসময়ে আমাকে ব্যাগ হাতে দেখে সাথে আহনাফ দেখে বেশ অবাকই হলো আম্মু। আমি কোনো কথা না বাড়িয়ে আহনাফকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে এলাম।
মা আমায় জিজ্ঞেস করাতেই আমি বললাম
-‘ চলেই এলাম সারাজীবনের মতো।
আমার এমন কথায় মা, আহনাফ দুজনেই বেশ অবাক হলো। আমি তাদের অবস্থা বুঝে মুচকি হেসে বললাম
-‘ পরে সব বলবো তোমাদের। আমি এখন আমার রুমে গেলাম। এখন আমায় একটু একা থাকতে দাও। আহনাফ, তুই আম্মুর সাথে গল্প কর।
এটুকু বলেই আমি আর কারো উত্তরের অপেক্ষা না করে আমার রুমে চলে এলাম। ব্যাগপত্র রেখে ফ্রেশ হয়ে চলে গেলাম আমার চিরপরিচিত বেলকনিতে।
আমার যখন খুব মন খারাপ থাকে তখন আমি এই বেলকনিতেই আসি। আজকের পরিবেশটা খুব সুন্দর, সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্তের পরিবেশ এটা। সব কিছু সুন্দর, গোছালো থাকলেও, একেবারে তছনছ হয়ে গেল আমার জীবনটা। এমনটা না হলেও কি পারত না। আজ আমার চোখে কোনো পানি নেই। যে আমি কি-না কিছু হলেই কেদে বুক ভাসাতাম, সে-ই আমি এখন আর সহজে কাদতে পারি না। চোখের জল যে শুকিয়ে গেছে আমার। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলাম
“আমার সবটুকু বিশ্বাস যে দিয়েছে ভেঙে
তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই
সে দিয়েছে আমার অন্ধ চোখ এ
আলো যার বিশালতার মাঝে আমি
একটুকু পাই নি ঠাই তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই
সে যে দিয়েছে আমায় মহাশূন্যে আশ্রয়।
আমার সব অপূর্ণতাই যেন হয় আমার শূন্য-পথে
প্রতি শ্রেয়তম আশীর্বাদ।”
এতো টুকু গেয়েই ডুকরে কেদে উঠলাম আমি। গানের প্রতিটি লাইন যেন আমার জীবনের সাথে মিলে যায়।
হঠাৎ কাধে কারো স্পর্শে চমকে উঠলাম আমি। দ্রুত চোখ মুখ মুছে নিলাম। পেছন ফিরতেই দেখলাম আহনাফ দাঁড়িয়ে। আমি মেকি হাসার চেষ্টা করলাম। আহনাফ ভ্রু কুচকে বলল
-‘ তুই কাদছিলি? কি হয়েছে তোর?
-‘ ক কই ন না তো। আ আমার কিচ্ছু হয়নি।
-‘ মিথ্যা বলছিস আমায়। স্পষ্ট তোর চোখ দেখলে বোঝা যাচ্ছে তুই কাদছিলি। তাহলে মিথ্যা কেন বলছিস? কি হয়েছে বল না আমায়?
আমি আহনাফের কথা শুনে নিজেকে আটকাতে পারলাম না, ওকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেদে উঠলাম। এই মানুষটাকে কখনো মিথ্যা বলতে পারিনি আমি। মিথ্যা বলতে গেলেও ধরা খেয়েছি বহুবার। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। হয়তো আহনাফ কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে। ও নিঃশব্দে আমার মাথায় যত্ন করে হাত বুলিয়ে দিল।
.
.
.
রা*গে মাথা ফে*টে যাচ্ছে রাশফিনের। মাথার চুলগুলো খা*মচে ধরে মাথা নিচু করে বসে আছে সোফায়। আজ পর্যন্ত কেউ রাশফিনের মুখের উপর কথা বলেনি। আর আজ কি-না অরনিশা নামের মেয়েটা ওকে অ*পমান করল সবার সামনে। শুধুমাত্র অরনিশার জন্য তার মা তার সাথে কথা বলছে না। তার উপর আবার, সকালে অরনিশা বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই রাশফিন পিছু নেয় অরনিশার। তখনই দেখে অরনিশা একটা ছেলের সাথে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। ব্যাস্, এটুকু দেখেই সেই তখন থেকে রে*গে আ*গুন হয়ে আছে রাশফিন। রুমে এসে সেই যে তখন থেকে দরজা দিয়েছে এখনও পর্যন্ত আর খোলেনি। অরনিশার পাশে জাস্ট কাওকে সহ্য করতে পারে না রাশফিন। দেখলেই ওর গা জ্ব*লে যায়। কিন্তু কেন? তবে কি রাশফিন অরনিশাকে….
#চলবে ~