#বসন্তের_একদিন
#পর্বঃ০২+৩
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তৃধা।তার সামনেই তেজবীন দাঁড়িয়ে আছে।ফাতেমা বেগম সোফায় বসে মনের সুখে পান চিবোচ্ছেন।
” তুমি আমাকে মারলে কেন তেজবীন?”
” তুই আমার মাকে না খাইয়ে রাখার প্ল্যান করেছিস তাই না?”
” এসব তুমি কি বলছো?আমি এরকম কিছুই করেনি।”
” তুই কি রান্না করেছিস আজ?মা আজকে রাতের খাবার খেতে পারেনি কেন?নাকি তুই খেতে দিসনি?”
” আমি এরকম কিছুই করিনি তেজবীন।আমি তো ঠিকভাবেই রান্না করেছি।উনি শুটকি ভর্তা খাবেন বলেছেন আমি ওটাও তো করে দিয়েছি।এখন আমার খাবার ওনার পছন্দ না হলে আমি…..”
তৃধার কথা শেষ হওয়ার আগেই তেজবীন তাকে আবারো থাপ্পড় মেরে বসে।
” পছন্দ না হওয়ার মতো রান্না করেছিস কেন?আমার মায়ের যেরকম পছন্দ সেরকম রান্না করবি।”
” আমাকে কি তোমরা চাকর পেয়েছো?মা বলে একরকম রান্না কর,ছেলে বলে একরকম রান্না কর।আমি কি তোমাদের বাড়ির কাজের লোক নাকি যে তোমরা এভাবে আমাকে গাধার খাটুনি খাটাচ্ছো।” আর সহ্য করতে না পেরে তেজবীনের মুখের উপর বলে দেয় তৃধা।
” দেখেছিস বাবু(তেজবীন)মেয়ের তেজ।কেমন করে চিৎকার করে কথা বলছে।এই মেয়ে আমাকে না খাইয়ে মারতে চাইছে।আর দেখেছিস আজ একটু শুটকি ভর্তা চেয়েছি বলে কিরকম খোঁটা দিচ্ছে।”
” এই তোর এতো সমস্যা কেন হয়?আমার মা আমার টাকায় খাচ্ছে,তোর এতে এতো সমস্যা কেন?চাকরি করিস বলে তোর এতো দেমাক তাই না?চাইলেই কিন্তু আমি এখন তোর পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখতে পারি।তারপর চাকরি করার শখ একদম বেরিয়ে যাবে।” তৃধার চুল ধরে বলে তেজবীন।তৃধা তেজবীনের হাতটা নিজের চুল থেকে ছাড়িয়ে নেয়।
” আমার কোন সমস্যা নেই আর না আমি চাকরির দেমাগ দেখাচ্ছি।প্রয়োজন না হলে না আমি চাকরিটা করতাম না।আর তোমরা কি ভেবেছো আমি বুঝিনা আমার চাকরি করা নিয়ে তোমাদের যত সমস্যা।কিন্তু হাজার চেষ্টা করলোও আমি চাকরি ছাড়বোনা।”
তৃধা রেগে নিজের রুমে চলে আসে।মাটিতে একটা কাঁথা বিছিয়ে তৃধা শুয়ে পড়ে তৃধা।এটাই প্রথম নয়,এরআগেও তাদের মধ্যে কোন অশান্তি হলে তৃধা নিচেই শুয়।মাঝরাতে তেজবীন তৃধার কাছে আসতে চাইলে তৃধা তাকে ঠেলে সরিয়ে দেয়।এতে তেজবীনেও রেগে দূরে সরে যায়।
পরেরদিন সকালে,
আজ শুক্রবার বিদায় তৃধার অফিস বন্ধ।তেজবীন এখনো ঘুমাচ্ছে আর ফাতেমা বেগম বাইরে হাঁটতে গিয়েছেন।ওনার আবার সকালে হাঁটতে বের না হলে বাতের ব্যথা বেড়ে যায়।শুক্রবার হওয়ায় আজকে তৃধার কাজের চাপ আরো বেশি।ফাতেমা বেগম যাওয়ার আগে বলে গিয়েছেন মুরগীর মাংস রান্না করার জন্য।সেই অনুযায়ী তৃধা চুলায় ভাত বসিয়ে দিয়ে মাংস কাটতে থাকে।
” তৃধা,তৃধা।”
তেজবীনের চিৎকার শুনে তৃধা তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে রুমে আসে।
” কি হয়েছে?”
” দেখছো না আমি ঘুমাচ্ছি।জানালার পর্দাটা টেনে দাও।একটুও আক্কেল জ্ঞান নেই।”
তৃধা পর্দাটা টেনে দিয়ে আবারো রান্না ঘরে চলে যায়।এরই মধ্যে ফাতেমা বেগম হেঁটে চলে এসেছে।তিনি এসেই সোফা বলে তৃধাকে গলা ছেড়ে ডাকতে থাকেন।
” জ্বি মা বলুন।”
” আমার জন্য এককাপ চা নিয়ে এসো তো।হেঁটে এসে চা খেতে ইচ্ছা করছে।”
” আচ্ছা মা আপনি গোসল করে নিন ততক্ষণে আমি চা নিয়ে আসছি।”
ফাতেমা বেগম সোফা থেকে উঠে নিজের রুমে চলে যান।ভাতের পাত্রটা নামিয়ে রেখে তৃধা চুলোতে চায়ের পানি তুলে দেয়।
আধাঘন্টা পর,
” বউমা,বউমা।” নিজের রুমে বসে তৃধাকে ডাকতে থাকেন ফাতেমা বেগম।
” হ্যাঁ মা বলুন।”
” এটা কি দিয়েছো তুমি?তোমার কাছে চা চেয়েছিলাম,ঠান্ডা শরবত নয়।”
” মা আমি তো গরম চা’ই দিয়েছিলাম।হয়তো আপনি গোসল করে বের হতে হতে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।”
” কি হয়েছে কি?এতো চিৎকার করছো কেন?শুক্রবারের দিনটাও কি আমাকে ঘুমাতে দেবে না নাকি?” তেজবীন ঢলতে ঢলতে তেজবীন বলে।
” দেখ না বাবু,ওকে বলেছি একটু চা দিতে কিন্তু দেখ ও আমাকে ঠান্ডা একদম পানির মতো চা করে দিয়েছে।”
” তৃধা তোমার সমস্যাটাকি বলো তো?তোমার কি ঝামেলা না করলে কি হয়না?”
” আমি তো ওনাকে চা করেই দিয়েছি,তাও গরম।কিন্তু এখন সেটা ঠান্ডা হয়ে গেলে এতে আমার কি দোষ।”
” দেখেছিস বাবু,ও বলতে চাইছে আমার কারণে নাকি চা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।”
” তৃধা তুমি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?যাও মায়ের জন্য আবারো চা করে নিয়ে এসো।” রেগে চিৎকার করে বলে তেজবীন।তৃধা একবার তেজবীন আর ফাতেমা বেগমের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে যায়।আবারো চা গরম করে এনে ফাতেমা বেগমকে দেয় তৃধা।
” হুম এখন ঠিক আছে।প্রথমেই যদি বলতে ‘আমার ভুল হয়ে গিয়েছে,আমাকে দিন আমি আবারো গরম করে নিয়ে আসছি ‘ তাহলে তেজবীন থেকে এতো কথা শুনতে হতোনা।এখন আর আমার সামনে শঙের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে রান্নাঘরে যাও তো।” তৃধা একটা নিঃশ্বাস ফেলে রান্না করতে চলে যায়।সে জানে ফাতেমা বেগম এসব ইচ্ছে করেই করেন।খাবার ভালো হলেও উনি এটাওটা খুঁত বের করেন আর তেজবীনকে উল্টোপাল্টা নালিশ করেন তৃধা বিরুদ্ধে।যা শুনে তেজবীনও তৃধার সাথে খারাপ ব্যবহার করে।তবে এমনটাও না যে ফাতেমা বেগমের কথা শুনেই শুধু তেজবীন তৃধার সাথে খারাপ ব্যবহার করে।মাঝেমধ্যে অকারণেও তেজবীন তৃধার সাথে খারাপ ব্যবহার করে থাকে।তবে সবসময় তৃধা প্রতিবাদ করে না আবার চুপও থাকে।যেখানে প্রয়োজন সেখানেই সে প্রতিবাদ করে নয়তো চুপ থাকে।
দুপুরের খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ আগে শুয়েছে তৃধা।চোখে ঘুম এসেছে সেই মূহুর্তেই বেল বেজে উঠে।বিরক্ততে তৃধার চোখ মুখ কুচকে যায়।বিছানা ছেড়ে তৃধা দরজা খুলতে চলে যায়।
দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে তৃধার বড় ননদ নন্দিনী আর ছোট ননদ তিথি।বড় ননদের বিয়ে হয়েছে ২ বছর হচ্ছে আর ছোট ননদটা এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবে।তৃধার ছোট ননদ কিছুদিনের জন্য নিজের বোনের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল।ননদের দেখা তৃধার মনে মনে বিরক্ত লাগলেও সে হাসি মুখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
” এভাবে দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি আমাদের ঢুকতে দেবে।” মুখ বাঁকা করে বলে তৃধার বড় ননদ নন্দিনী।তৃধা চুপচাপ দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়াই।তৃধা সরে দাঁড়াতেই তারা দুজন ভেতরে ঢুকে পড়ে।তৃধা মনে মনে চিন্তা করছে “এতদিন ছিল না তাতে কিছুটা হলেও শান্তি ছিল।এখন এ দুটোও আমার উপর হুকুম করবে।”
তৃধা নিচে তাকিয়ে দেখে চারপাঁচটা ব্যাগ।তৃধার বোঝা হয়ে গিয়েছে তার বড় ননদ এখন আর সহজে এই বাড়ি ছেড়ে যাবেনা।এরই মধ্যে তৃধার বড় ননদ নন্দিনী ভেতর থেকে চেঁচিয়ে তৃধাকে বলে,
” ওখানেই মরে গেলে নাকি?এতো সময় কেন লাগছে আসতে?তাড়াতাড়ি ব্যাগগুলো নিয়ে ভেতরে এসো।”
তৃধা অনেক কষ্ট করে ব্যাগগুলো নিয়ে তার ননদের রুমে রেখে আসে।ব্যাগ রেখে এসে তৃধা দেখে ফাতেমা বেগম আর নন্দিনী সোফায় বসে গল্প করা শুরু করে দিয়েছে।এটা দেখে তৃধার খুবই খারাপ লাগে।আজ পর্যন্ত তার শাশুড়ী তার সাথে দুদণ্ড বসে ভালোভাবে কথা বলেনি।এমনকি তার বাপের বাড়িতেও যদি ফোন করে তাহলেও ২/১ মিনিটের বেশি তৃধা কথা বলতে পারেনা।আসলে ফাতেমা বেগমই তাকে কথা বলার সুযোগ দেয়না।তৃধা যথাসম্ভব চেষ্টা করে মানিয়ে চলার,সবার মন জয় করার কিন্তু কোন এক অজানা কারণে তৃধা সেটা পেরে উঠছেনা।আরো একবার ফাতেমা বেগম আর নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে রান্নাঘরে চলে যায় তৃধা।এখন আর তার ঘুমালে চলবেনা।এখন থেকেই রাতের খাবার রান্না করা শুরু করে দিতে হবে নয়তো এরা সবাই মিলে তৃধার সাথে খারাপ ব্যবহার করার আরেকটা সুযোগ পেয়ে যাবে।
” বউমা,ও বউমা।কোথাই গিয়ে লুকিয়ে আছো শুনি?আমার মেয়েটা এতোদিন পর এলো,ওকে কিছু খেতে না দিয়ে কোথায় বসে আছো?”
” এইতো মা আমি আপুর জন্যই খাবার আনতে গিয়েছিলাম।” ট্রে করে নাস্তা আনতে আনতে বলে তৃধা।
” এখানো রাখো।খা মা খা কত শুকিয়ে গিয়েছিস তুই।”
তৃধা ট্রেটা টেবিলে রেখে নন্দিনীকে প্রশ্ন করে,”আপু আছেন আপু?”
” ভালো না থাকলে কি আর এখানে আসতাম নাকি।ভালো আছি বলেই তো এসেছি।আর শোন এতদিন অনেক কাজের ফাঁকি দিয়েছো কিন্তু এখন আমি যতদিন আছি তোমাকে কোন কাজে ফাঁকি দিতে দেবোনা।এখন এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে রাতের রান্নার প্রস্তুতি নাও।”
নন্দিনীর কথা শুনে তৃধার অনেক খারাপ লাগে।আর যাইহোক সে কখনো ঘরের কাজে ফাঁকি দেয়না।আর দেবেই বা কেন,এটাতো তারই সংসার।সে যদি কাজগুলো না করে তাহলে কে করবে।তৃধা আর সেখানে না দাঁড়িয়ে রান্নাঘরে চলে যায়।
চলবে……..
____________________________________________
#বসন্তের_একদিন
#পর্বঃ০৩
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
নুডুলস বানিয়ে তিথির(ছোট ননদ)জন্য নিয়ে এসেছে তৃধা।
” তিথি তোমার নুডুলস।”
” টেবিলে রেখে দাও।” মোবাইল দেখতে দেখতে বলে তিথি।
বাটিটা টেবিলে রেখে তৃধা তিথির দিকে তাকাই।
” কি করছো তিথি?”
” দেখছো না কাজ করছি।” বিরক্তি নিয়ে বলে তিথি।তৃধা বুঝতে পেরেছে তিথি তার সাথে কথা বলতে বিরক্তবোধ করছে তবে সে চাইছে তিথির সাথে ইজি হতে।
” আপুর বাসায় তোমার দিন কেমন কাটলো তিথি।”
” সেটা জেনে তুমি কি করবে?তোমার কাজ নেই নাকি?যাও না গিয়ে নিজের কাজ করোনা।দেখছো যে আমি একটা কাজ করছি।”
তিথির কথা শুনে তৃধা খুব কষ্ট পাই।সে তিথি নিজের ছোটবোনের মতো ভাবে কিন্তু তিথি কেন যেন তার সাথে বেশি কথা বলে না বললেও তা দায়সারা।তৃধা চলে যেতে নিবে তখন তিথি বলে উঠে,
” ভাবী শোন।”
” হ্যাঁ বলো তিথি।”
” পরেরবার রুমে ডুকার আগে নক করে ঢুকবে।ভুলে যেওনা আমি কোন ছোট বাচ্চা নয়।এবার আসতে পারো।”
তিথির কথা শুনে তৃধা খুব অপমানবোধ করে আর রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
ঘরের কাজ শেষ করে অফিসের কয়েকটা ফাইল নিয়ে বসেছে তৃধা।এরই মধ্যে নন্দিনী নক না করে রুমে মধ্যে ডুকে পড়ে।
” কি করছো গো তুমি?”
হঠাৎ করো আওয়াজ শুনে চমকে যায় তৃধা।
” কি গো এভাবে চমকে গেলে যে?খারাপ কিছু বা লুকিয়ে কিছু করছিলে বুঝি?”
” আরে না না আপু সেরকম কিছু না আসলে হঠাৎ করে আপনার আওয়াজ শুনলাম তো তাই ভয় পেয়ে গিয়েছি।”
” তা কি করছিলে শুনি?”
” ও কিছুনা আপু,অফিসের কয়েকটা ফাইল দেখছিলাম।আপনি কি কিছু বলবেন আপু?”
” ও হ্যাঁ যা বলতে এসেছিলাম,আমার না একটু পায়েস খেতে ইচ্ছে করছিলো।আমার জন্য একটু পায়েস রান্না করো তো।রাতে খাবার পরে খাবো।”
” কিন্তু আপু সব রান্না তো শেষ।চুলাও বন্ধ করে দিয়েছি।”
” চুলা বন্ধ করেছো তো কি হয়েছে?আবার চুলা জ্বালাবে।এখন এতো বেশি কথা না বলে তাড়াতাড়ি পায়েস বানানোর জন্য যাও তো দেখি।”
তৃধার বড় ননদ রুম থেকে বেরিয়ে যায়।তৃধা ফাইলগুলো গুছিয়ে রেখে নিজের শাশুড়ীর রুমের দিকে পা বাড়ায়।
” মা আসবো।”
ফাতেমা বেগম তখন টিভি দেখছিলেন,তৃধাকে এই অসময়ে দেখে ফাতেমা বেগমের ভ্রু-কুচকে যায়।
” এসো।বলো কি বলবে?”
” মা আপু বলেছেন যে উনি রাতে পায়েস খাবেন।”
” তো কি?নন্দু খাবে তো তুমি না বানিয়ে আমার কাছে কেন এসেছো?”
” আসলে মা ফ্রিজে এখন বেশি দুধ নেই।এখন পায়েস বানালে কাল সকালে চায়ের জন্য দুধ থাকবেনা।”
” পরশুই না বাবু দুখ আনলো।”
” মা ওটাতো মাত্র এক লিটারের একটা প্যাকেট।৩ কাপের মতো ব্যবহার করা হয়েছে।এখন যা আছে পায়েস বানালে তা সব শেষ হয়ে যাবে।”
” আমি জানিনা কিছু।নন্দুর জন্য তুমি পায়েস বানাও।কিভাবে কি করবে তা তুমিই জানো।”
তৃধা চিন্তিত হয়ে ফাতেমা বেগমের রুম থেকে বেরিয়ে আসে।এখন অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছে,না হলে তৃধা বের হয়ে নিজেই দুধ নিয়ে আসতো।আর এখন তৃধা বের হলে ঘরে আরেকটা অশান্তি হবে।অনেক ভেবে তৃধা তেজবীনকে ফোন দেয়।প্রথমবার তেজবীন ফোন রিসিভ করলো না দেখে আবারো ফোন দেয় তৃধা।এবার ফোন ধরে তেজবীন রাগী কন্ঠে তৃধাকে বলে,
” কি সমস্যা কি তোমার?এতোবার ফোন দিচ্ছো কেন?”
” আসলে একটা দুধের প্যাকেট লাগতো।আসার সময় নিয়ে এসো।”
” পরশুই না একটা আনলাম।ওটা শেষ নাকি?”
” না ওটার এখনো কিছুটা আছে।”
” তাহলে আরেকটা দিয়ে কি করবে?”
” আসলে আপু নাকি রাতে পায়েস খাবেন।এখন যা আছে তা পায়েস বানাতেই চলে যাবে।সকালে চায়ের জন্য থাকবে না।তাই আরেকটা আনতে বলেছি।”
তেজবীন আর কিছু না বলে ফোনটা কেটে দেয়।
চুলার মধ্যে পায়েসের জন্য যা লাগবে সময় কিছু মিশিয়ে চুলোর উপর তুলে দেয় তৃধা।এরমধ্যেই সেই শুনতে পাই তার ফোন বাজছে।চুলার আঁচ ছোট করে দিয়ে তৃধা নিজের রুমে আসে।কিন্তু রুমে এসে তৃধা দেখে নন্দিনীর হাতে তৃধার ফোন।তৃধা তাড়াতাড়ি এসে নন্দিনীর হাত থেকে নিজের ফোনটা নিয়ে নেয়।
” আপু আপনি এখানে কি করছেন?আর আমার ফোন আপনার কাছে কেন?”
” ও আসলে…ফোন বাজছিল,ভাবলাম তোমাকে দিয়ে আসি।কিন্তু তার আগেই তুমি চলে এলে।আচ্ছা আমি যাই হ্যাঁ।”
নন্দিনী চলে যায়।ততক্ষণে তৃধার ফোনটাও কেটে গিয়েছে।নন্দিনী যাই বলুক না কেন,তৃধা ঠিকই বুঝতে পারছে আসলে নন্দিনী তার ফোন নিয়ে ঘটাঘাটি করছিল।এরমধ্যে তৃধার ফোনটা আবারো বেজে উঠে।তৃধা দেখে তার মা ফোন করেছে।
” হ্যালো মা।”
” কেমন আছিস অনি?(আনিশা)”
” এইতো মা ভালো আছি।তুমি কেমন আছো?”
” আমিও ভালো আছি।”
” বাবা কেমন আছে মা?”
” তোর বাবাও আছে ভালো।কিন্তু মারে তোর বাবার যে এ মাসের ওষুধ শেষ হয়ে গিয়েছে।”
” কবে শেষ হয়েছে মা?আর তুমি আমাকে এতোদিনে বলছো কেন?”
” আমি ভেবেছিলাম কয়েকদিন না খেলে কিছু হবেনা।কিন্তু এখন দেখলাম ওষুধ না খাওয়ার ফলে ওনার শরীর খারাপ করছে তাই না পেরে তোকে ফোন দিলাম।”
” মা তুমি চিন্তা করোনা।আজকের রাতটা একটু বাবাকে সহ্য করতে বলো।আমি কালকের মধ্যে বাবার ওষুধ পাঠিয়ে দেবো।”
” আচ্ছা মা ভালো থাকিস।জামাই কেমন আছে রে?আর তোর শাশুড়ী,ননদরা কেমন আছে?”
” হুম ভালো আছে সবাই।আচ্ছা মা রাখি এখন আমি চুলায় রান্না বসিয়ে এসেছি।”
” আচ্ছা ঠিক আছে।সাবধানে থাকিস।”
তৃধা ফোন কেটে দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে পড়ে।তার নিজের উপর এখন প্রচুর রাগ হচ্ছে।সে কি করে এতোটা কেয়ারলেস হলো,তার বাবা ওষুধ শেষ কিন্তু সে জানেই না।
পরেরদিন,
আজ শনিবার বিদায় তৃধার অফিস দুপুরেই ছুটি হয়ে গিয়েছে।অফিস থেকে তৃধা সোজা ব্যাংকে চলে আসে বেতন তোলার জন্য।বেতন তুলে তৃধা প্রথমে নিজের বাবার জন্য ওষুধ কিনে তারপর ওনাদের জন্য কিছু ফলমূল কিনে আবারো রিকশায় উঠে বসে তৃধা।
বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে তৃধা।ছোট একটা ফ্ল্যাটে থাকেন তৃধার বাবা-মা।তৃধার এখন কোন ভাই-বোন নেই।এখন নেই মানে তার একটা বড় ভাই ছিল।কিন্তু তৃধা যখন ক্লাস টেনে ছিল তখন একটা এক্সিডেন্টে তৃধার ভাই মারা যায়।তৃধার বাবা একজন রিটায়ার্ড স্কুল টিচার আর মা হচ্ছে এখন গৃহিণী।তৃধার বাবা-মায়ের এখন তৃধাকে ছাড়া আর কেউ নেই।এই ফ্ল্যাটাও তৃধাই টাকা জমিয়ে ওনাদের কিনে দিয়েছে।
এতো সবকিছু ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলে যায়।
” আরে অনি মা তুমি এসেছিস।আয় আয় ভেতরে আয়।আজ কত দিন পর এলি।”
” এই নাও না বাজারগুলো রেখে এসো।আর এই নাও বাবার ওষুধ।সময় মতো খাওয়াবে কিন্তু।”
” ওসব তুই চিন্তা করিস না।দেখি তুই একটু বসতো।অফিস থেকে এতো দূর এলি।দাঁড়া আমি তোর জন্য একটু শরবত করে আনি।”
” আরে মা এতো ব্যস্ত হতে হবেনা।আমি ঠিক আছি।তুমি বরং এই বাজারগুলো রেখে এসো।আমি বাবার সাথে দেখা করে আসছি।”
রুমে এসে তৃধা দেখে তার বাবা শুয়ে আছে।তৃধার বাবা একজন হার্টের পেশেন্ট,তাই ওনাকে প্রতিদিন ওষুধ খেতে হয়।এছাড়াও আরো বেশি কিছু রোগ বাসা বেঁধেছে ওনার শরীরে।যার কারণে উনি দুর্বল হয়ে পড়েছেন।
তৃধা তার বাবার পাশে বসে।ওনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম স্বরে ওনাকে ডাকে তৃধা।
” বাবা,বাবা।দেখে আমি এসেছি।একটু উঠে বসো।”
” মা এসেছিস তুই।এতোদিনে তোর এই অভাগা বাবাটার কথা মনে পড়লো বুঝি।” তৃধার তার বাবাকে উঠে বসতে সাহায্য করে।
” মনে তো সবসময় পড়ে বাবা কিন্তু কি করবো বলো চাইলেই তো আর আসা যায় না।”
” তা কেমন আছিস মা তুই?”
” আমি ভালো আছি বাবা।শোন তোমার ওষুধ আমি নিয়ে এসেছি।নিয়ম করে খাবে।এখন আমি আসছি।পরে আবার আসবো।”
” এইমাত্রই তো এলি।দুপুরের খাবারটা অন্তত খেয়ে যায়।” রুমে ডুকতে ডুকতে বলেন তৃধার মা।
” না মা এমনিতেই অনেকটা সময় চলে গিয়েছে।আর থাকলে দেরি হয়ে যাবে।বাড়িতে অনেক কাজ আছে।তোমরা খেয়ে নাও আর কোন সমস্যা হলে আমাকে ফোন দেবে।আমি আজ আসছি সাবধানে থেকো।”
তৃধা তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায়।বেশি দেরি হলে আবার তার শাশুড়ী তাকে কথা শোনানোর থেকে বাদ যাবেন না।তৃধার মা অসহায় দৃষ্টিতে তৃধার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন।উনি মনে মনে ভাবছেন না জানি মেয়েটার সাথে আবার কত দিন পর দেখা হবে।
চলবে…….