#বসন্তের_একদিন (সিজনঃ০২)
#পর্বঃ০২
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
” ভাইয়া ভাবী আর বাবুকে দেখতে যাবে না?”
তিথির কথা শেষ হতে দেরি তবে ধ’ম’ক খেতে মোটেও দেরি হলোনা।
” দেখতে যেতে হবে কেন? তিনি কি এমন রাজকার্য করেছেন যে ওনাকে ঘটা করে দেখতে যেতে হবে? বংশের আলো তো দিতে পারেনি, এতো আদ্যিখেতা দেখানোর কিছু নেই।” নন্দিনী বেশ বি’রক্ত হয়ে বললো। তার কথায় গুরুত্বপূর্ণ না দিয়ে তিথি আবারো তেজবীনকে প্রশ্ন করলো।
” পরে যাবো৷ হসপিটালে এখন তার ভাই-ভাবী আছে তো, আমি না গেলেও সম’স্যা নেই। বেশি প্রয়োজন হলে ফোন দেবে। ” দায়সারা ভাবে বললো তেজবীন।
” ভাইয়া এগুলো কি বলছো তুমি? তুমি ভাবীকে হসপিটালে নামিয়ে দিয়ে সেই যে এলে আর ওমুখো হওনি। এমনকি এখনো পর্যন্ত নিজের বাচ্চাটাকে পর্যন্ত দেখোনি। এসব তুমি কি শুরু করেছো ভাইয়া? কতটা ধকল গিয়েছে এতোদিন তার উপর, এই সময় তোমার উচিত ভাবীর পাশে থাকা। কিন্তু তোমরা তো অন্য কাহিনী করছো।”
” তিথি। ছোট ছোটদের মতো থাকো। আমরা তোমার বড় আমরা জানি কি করতে হবে, তোমার থেকে কেউ কিছু জানতে চাইনি৷ নিজের মতামত নিজের কাছে রাখো আর ঘরে যাও।” মায়ের কথা শুনে তিথি আর কিছু বলার সাহস পেলোনা। ভাই-বোনদের সাথে তর্ক করতে পারলেও মায়ের উপর কথা বলার সাহস তার নেই। বেশি কিছু বললে পরবর্তীতে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে চিন্তা করে চুপচাপ চলে গেলো সে।
.
.
মেয়েকে কোলে নিয়ে বিষন্ন মনে বেডে বসে আছে তৃধা। তার শশুড়বাড়ির লোকেরা যে গেলো আর ফিরে এলোনা আর তেজবীন তো দেখতে আসা দূরে থাক একটা ফোন পর্যন্ত করেনি।
” কিরে মা এখন কেমন লাগছে শরীর? ”
” ঠিক আছি মা। তুমি এতোরাতে কেন কষ্ট করে এলে? আর এতো গুলো বাটিতে কি এনেছো?”
” তোর জন্য খাবার নিয়ে এলাম। এই সময় একটু ভালো খারাপ খেতে হয়। এখন তো তুই একা নস। তোর উপর এখন আরেকজনও নির্ভরশীল। তুই ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া না করলে তারও যে পর্যাপ্ত খাওয়া মিলবে না।”
” সেটা বুঝতে পেরেছি কিন্তু তুমি কেন শুধু শুধু এগুলো বয়ে আনতে গেলে? হসপিটালের ক্যান্টিন থেকে কিনে খেতাম।”
” চুপ কর। আমি তোর মা, আমি জানি কোনটা ভালো। এবার হা কর, তাড়াতাড়ি খেয়ে তারপর বাচ্চাটাকেও খাইয়ে দে।”
এতোক্ষণ একা একা তৃধার ভীষণ খারাপ লাগছিলো, সকল চিন্তা তার মাথায় চেপে বসেছিলো। এখন মায়ের সাথে কথা বলে, তার হাতে খাবার খেয়ে তৃধার কিছুটা হালকা লাগছে। কথার একপর্যায়ে তৃধার মা শায়লা খাতুন কিছুটা ইতস্তত হয়ে জানতে চাইলো,
” জামাই এখনো আসেনি যে? কাজে ব্যস্থ নাকি? ফোন করেছে?”
” জানিনা।”
” জানিনা মানে কি? তুই একবারো ফোন করে জিজ্ঞেস করিস নি কোথায় আছে? তাকে জানিয়েছিস মেয়ের ব্যপারে?”
” আমাকে জানাতে হবেনা। তাকে খবর দেওয়ার মানুষের অভাব নেই। সে জানে এখানে কি কি হয়েছে, তাই তো এমুখো হয়নি। মা তুমি সব জানো, বুঝো তাও অবুঝের মতো এসব কেন জিজ্ঞেস করছো?”
সাইলা খাতুন মেয়ের কথা কান না দিয়ে তার হাতে ফোন ধরিয়ে দিলো।
” নে জামাইকে ফোন কর, খোঁজখবর নে।”
তৃধা একপ্রকার ছুঁড়ে ফোনটি বেডে রাখলো।
” এমন মেরু’দণ্ডহীন, কা’পুরুষ লোককে ফোন করতেও আমার ল’জ্জা লাগছে। যে লোক নিজের মা-বোনের কথায় বউয়ের সাথে তো অশা’ন্তি করেই কিন্তু কতটা মেরুদণ্ডহীন পুরুষ হলে নিজের নবজাত শিশুকেও অব’হেলা করে, ছিঃ। এমন লোকের সাথে কথা বলতেও আমার রু’চিতে লাগে। পারছিনা, না হলে কবেই এসব ছেড়ে ছুঁড়ে চলে যেতাম।”
” তোর এই এধরণের কথার জন্যই তো সবসময় অশা’ন্তি লেগে থাকে। একটু কি রয়েসয়ে পরিস্থিতি বুঝে কথা বলতে পারিস না?” বেশখানিকটা বি’রক্ত নিয়ে বললেন শায়লা খাতুন।
” না মা পারিনা। এতো রয়েসয়ে কথা বললে আজ আমাকে নিজের সামনে পেতেনা। রয়েসয়ে কথা বলিনা বলেই এতো এই সংসার টিকিয়ে রাখতে পেরেছি৷ কথার বিপরীতে কথা বলি বলেই এখনো স্বাবলম্বীভাবে চলা ফেরা করতে পারছি। রয়েসয়ে কথা বললে এসব পারতাম তুমিই বলো? তুমিও তো রয়েসয়ে কত কথা বলেছিলে তাও শান্তি ছিলো তোমার জীবনে?” মেয়ের কথায় শায়লা বেগমের মুখে বিষন্নতার চাপ ফুটে উঠলো। পুরোনো ক্ষত আবারো তাজা হতে শুরু করলো। চোখ পানিপূর্ণ হওয়ার পূর্বেই তিনি নিজেকে সামলে নিলেন। পড়ে থাকা ফোনটা তুলে নিজেই ফোন করলেন তেজবীনকে।
” কাকে ফোন করছো তুমি?”
” জামাইকে। তুই তো ফোন করবিনা, মানসম্মান রেখে আমাকেই ফোন করতে হচ্ছে।”
তৃধা কিছু বললোনা, বিরক্তি নিয়ে বসে রইলো। সে শুধু দেখতে চাই তার মা কি করতে চলেছে।
বিছানায় শুয়ে ফোনে নাটক দেখছিলো তেজবীন। এর মাঝে ফোনের রিংটোনে ব্যঘাত ঘটলে বিরক্ততে তার মুখশ্রী কুঁচছে গেলো। ফোন রিসিভ করতে গিয়ে স্ক্রিনে “তৃধা” নাম দেখে রিসিভ করলোনা। পুনরায় নাটক দেখায় মনোযোগ দিলো। কিন্তু ফোন কেটে গেলেও পরমুহূর্তেই আবারো ফোন করছেন শায়লা খাতুন। তিনি যেন পণ করে রেখেছেন তেজবীন ফোন না ধরা অবদি তিনি ফোন করেই যাবেন। বির’ক্তর চরম সীমানায় পৌঁছে না পেরে তেজবীন ফোন রিসিভ করলো। অপরপাশে কে আছে তা নিশ্চিত না হয়েই ঝাঁ’ঝালো কন্ঠে বললো,
” তোমার কি একটুও কনমসেন্স নেই? দেখছো একটা মানুষ ফোন ধরছেনা তারপরও কেন বারবার ফোন দিয়ে যাচ্ছো? পড়াশোনা নিয়ে যে এতো দে’মাগ দেখাও এটা কি শেখোনি?”
” বাবা আমি তোমার শাশুড়ী বলছিলাম।” মিনমিন কন্ঠে বললেন তিনি। তৃধার জায়গায় শাশুড়ীর কন্ঠে শুনে তেজবীন কিছুটা বিব্রত হয়ে পড়লো।
” কেন এতোবার ফোন দিচ্ছিলেন? ফোন ধরছিনা দেখছেন, আপনার বোঝা উচিত ছিলো আমি কাজে ব্যস্ত।” কন্ঠ ভারী করে বললো সে। জামাইয়ের মুখে এধরণের কথা শুনে শায়লা খাতুন বেশ ল’জ্জা পেলেন।
” আসলে বাবা আমি বুঝতে পারিনি। তুমি কিছু মনে করোনা।”
” কেন ফোন দিয়েছেন?”
” তুমি যে হসপিটালে এলেনা বাবা? তৃধা তোমার জন্য কত চিন্তা করছিলো। তুমি কখন আসবে বাবা?”
” আমি এখন ব্যস্ত আছি। এখন আসতে পারবোনা। পরে কোন সময় দেখা করে যাবো।”
” তুমি না আসো তোমার মা বা বোন কাউকে আসতে বলো। রাত বিরতে যদি কোন কিছুর প্রয়োজন হয়।”
” এতোটাও তো সিরিয়াস কিছু হয়নি যে তাকে পাহারা দিয়ে একজনকে বসে থাকতে হবে। বেশি প্রয়োজন হলে আপনারা থাকুন। আমার মা বৃদ্ধ মানুষ এতোসব ঝা’মেলা তিনি নিতে পারবেন না। আপনারা থাকতে না পারলে নার্সকে বলে চলে আসুন। হসপিটালে তো নার্স, ডাক্তার আছেই। সমস্যা হলে তাদের বললেই তো হলো। আমি এখন রাখছি।”
শায়লা বেগমকে পরবর্তীতে কিছু বলতে না দিয়েই ফোন কেটে দিলে তেজবীন। পুনরায় নাটক দেখতে গিয়েও কি মনে করে যেন গ্যালিরিতে গেলো। তিথির দেওয়া বাচ্চার আবছা ছবিতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে আবারো নাটক দেখায় মনোনিবেশ করলো।
মায়ের মুখভাব দেখে তৃধা যা বোঝা বুঝতে পেরে গিয়েছে।
” কি বলেছে? ব্যস্ত তাই না?”
” হুম। পরে কোন সময় এসে দেখে যাবে বলেছে।”
মায়ের কথা শুনে তৃধার তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো।
” ‘কোন একসময় দেখে যাবে’ আচ্ছা আমরা কি তার আত্নীয়? যে অসুস্থ হয়ে হসপিটালে পড়ে আছি, সে নিয়ম রক্ষার্থে একসময় এসে মুখদর্শণ করে যাবেন? মানুষ কথাটা মেরুদণ্ডহীন হলে এধরণের কথা বলতে পারে আমি তাই চিন্তা করছি।”
” উফ…. তৃধা চুপ কর। বড্ড বেশি কথা বলিস তুই। একদম নিজের ফুফির মতো হয়েছিস, ক্যাটক্যাট ধরণের। তাকে যেমন কিছু বললেই তেলের ছটার মতো লাফিয়ে উঠে তুইও হয়েছিস সেরকম। অবশ্য হবি না কেন ওই বংশের র’ক্ত যে বইছে তোর শরীরে।”
” একদম আমার সাথে ফুফিকে মেলাবেনা। আমি ওনার মতো হলে আজ এই দিন দেখতে হতোনা। আর যাইহোক ওনার মতো বাপের বাড়িতে ছ’ড়ি ঘুরাইনা, অন্যের সংসারে ঝা’মেলা সৃষ্টি করিনা। আমি ফুফির মতো হলে মোহনাকে নিজের বন্ধু না ভেবে তোমাকে যেমন পরের বাড়ির মেয়ে ভেবে দূর’ব্যব’হার করে গিয়েছেন সবসময় আমিও তাই করতাম।”
মেয়ের কথা শুনে শায়লা খাতুন আবারো চুপ হয়ে গেলেন। পুরনো কিছু অপ্রতাশিত, ল’জ্জাজনক স্মৃতি মানসপটে ভেসে উঠতে লাগলো।
চলবে……