” এই বাচ্চা আমাদের না, এটা আমার ছেলের বাচ্চা না। আপনারা নিশ্চয়ই বাচ্চা পরিবর্তন করে অন্যকারো বাচ্চা আমাদের গছিয়ে দিচ্ছেন।” নবজাতক সম্পর্কে শাশুড়ী ফাতেমা বেগমের মুখে এধরণের কথা শুনে থমকে গেলো তৃধা, উজ্জ্বল হাসিমাখা মুখশ্রী মূহুর্তেই ঘনকালো মেঘে ছেঁয়ে গেলো। সদ্য মা হওয়া কোন নারীই নিজের নবজাতক সম্পর্কে এধরণের কথা শুনতে পারবেনা, তৃধাও পারলোনা। প্র’তিবা’দী কন্ঠে বললো,
” মা আপনি এসব কি ধরনের কথা বলছেন? ওনারা কেন বাচ্চা পরিবর্তন করবেন? আমাদের সাথে কি ওনাদের কোন শ’ক্রতা আছে?”
” চুপ করো তুমি, বেশি ফটরফটর করবে না একদম।” ধ’ম’ক দিয়ে বললেন ফাতেমা বেগম। নার্সদের উদ্দেশ্য করে আবার বললেন, ” দেখুন ভালোই ভালোই আমাদের বাচ্চা ফেরত দিন, নাহলে আমি থানায় যাবো।”
” দেখুন ম্যাডাম আমাদের কোন ভু’ল হয়নি। সব বাচ্চাদের পায়ে একটা ট্যাগ লাগানো থাকে, ভুল হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাও আপনি অ’ভিযো’গ তুলেছেন বলে আমরা আবারো চেক করেছি কিন্তু সব ঠিকই আছে। এই বাচ্চাটা আপনাদেরই।” একটু কঠরভাবে বললেন নার্সটি। কিন্তু ফাতেমা বেগম কোনভাবেই এই বিষয়টি মানতে রাজি নন। শাশুড়ীর কাজকর্ম তৃধা কিছুই বুঝতে পারছেনা। সে জানে এটা তার সন্তান, অজ্ঞান হওয়ার পূর্বে সে দেখেছিলো তাকে৷ যেখানে সে নিশ্চিত এটা তারাই সন্তান তাহলে ফাতেমা বেগম কিসের ভিত্তিতে এতো বড় একটা অভিযোগ তুলছেন সেটাই তৃধার বুঝতে পারছেনা। ফাতেমা বেগমের এতো চিৎকার চেঁচামেচিতে ওয়ার্ডে থাকা বাকি রোগী এবং তাদের পরিবারের সবাই উৎসুক হয়ে থাকি আছেন এবং কয়েকজন বেশ বি’র’ক্ত।
” দেখুন এখানে আরো অসুস্থ রোগী আছেন, আপনি প্লিজ ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে যা বলার বলুন।”
” না আমি যাবোনা। আমি আমার ছেলের বাচ্চাকে নিয়ে তবেই যাবো।”
” ডাক্তার এই দেখুন আপনাদের নার্সরা কতটা অ’সভ্য। এরা আমার ভাইয়ের ছেলেকে লুকিয়ে কার না কার বাচ্চা আমাদের গছিয়ে দিয়েছে। আমরা এতোবার বলছি তাও সত্যিটা স্বীকার করছেন না। নিশ্চয়ই এরা টাকার বিনিময়ে ছেলেটাকে বিক্রি করে দিয়েছে।” বড় ননদ নন্দীনির কথা শুনে তৃধার মনে হলো তার মাথায় পুরো পৃথিবী ভে’ঙে পড়েছে। সে তার কোলে থাকা শিশুটির দিকে তাকালো। পিটপিট করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বাচ্চাটিকে সে নিজের সাথে আরেকটু মিশিয়ে নিলো। কেন যেন তার মনে কু ডাকছে।
” আপনারা শান্ত হোন। এভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করলে কোন কিছুর সমাধান হবে না উল্টো বাকি রোগীদের সমস্যা হবে। নার্স ওনারা এসব কি বলছেন?”
ডাক্তাররা কিছুক্ষণ দায়িত্বরত নার্স এবং ডাক্তারের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলো এবং সকল কিছু ভালো মতো বিবেচনা করে দেখলো।
একজন সিনিয়র ডাক্তার এগিয়ে এসে বললেন,
” দেখুন আপনারা শুধু শুধু একটা বা’জে পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। আমি জানিনা কি কারণে আপনাদের মনে হয়েছে এটা আপনাদের বাচ্চা না তবে সব ঠিক আছে। এই বেবিটা আপনাদেরই।”
” না আমি এটা মানিনা। আমার ছেলের ছেলে হওয়ার কথা, কোনভাবেই তার মেয়ে বাচ্চা হতে পারেনা। আপনারা সবাই আমার নাতী লুকিয়ে রেখে অন্যকারো বাচ্চা আমাদের গছিয়ে দিচ্ছেন। আমি থানায় যাবো, আপনাদের সবাইকে জেলের ভাত খাওয়াবো।”
শাশুড়ীর কথা শুনে এবার তৃধা পরিষ্কার বুঝতে পারলো কেন ফাতেমা বেগম তখন থেকে তার বাচ্চা নিয়ে এতো প্রশ্ন তুলছেন। আর বিষয়টি বুঝতে পেরে তৃধার মন চাইছিলো নিজের মেয়েকে নিয়ে এখুনি কোথাও লুকিয়ে যেতে।
” মা দয়া করে আপনি এবার এসব বন্ধ করুন। আমি মা, আমি জানি আমার সন্তান কোনটা। দয়া করে আপনি এধরণের বা’জে কথা আর বলবেন না।”
তৃধার কথা শুনে ফাতেমা বেগম যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। তিনি একপ্রকার দৌড়ে তৃধাকে মা’রতে উদত্য হলেন কিন্তু হসপিটালের কর্মচারীদের জন্য পারলেন না।
” চুপ অল’ক্ষুনে মেয়ে। এতোবছর পর বাচ্চা পেটে ধরতে পেরেছে কিন্তু বংশের উওরাধিকারী তো দিতে পারলোই না উল্টো আরেকটা বোঝা জন্ম দিয়েছে। এতোদিন একজনে আমার ছেলেটাকে খেয়েছে এখন আরেকটা উদয় হয়েছে। হে খোদা কোন পা’পের শা’স্তি দিচ্ছো তুমি? এই মেয়ে তো আমার ছেলেটাকে খে’য়ে ফেলবে, তাকে সর্বশান্ত করে পথে বসিয়ে ছাড়বে। তুমি কেন এই ঝামেলা দুনিয়ায় পাঠালে? পেটেই মে’রে ফেললে না কেন? মা-মেয়ে দু’টোই অপারেশন টেবিলে মে’রে গেলেই সব বি’পদ দূর হতো। আমার ছেলেটাকে এখন এই দু’টো গিলে খাবে।” একপ্রকার আহাজারি করে বলতে লাগলেন ফাতেমা বেগম। একজন মায়ের মুখে অন্যজন সদ্যজাত মা সম্পর্কে এধরণের কথা শুনে থমকে গেলো অনেকজন। ওনার মুখে এধরণের কথা শুনে অনেক রোগীর মুখে চিন্তা ভর করলো। নিশ্চিত তারা তৃধার স্থানে নিজেদের কল্পনা করছে এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশংকায় ভুগছে।
একজন সদ্যজাত মা আশা করেন বাচ্চা ভূমিষ্ট হওয়ার পর সবাই তাকে আগলে রাখবে, তার যত্ন নেবে কিন্তু তৃধার বেলায় হলো সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে তার বাচ্চা আগলে রাখা তো দূর উল্টো মে’রে ফেলার কথা বলা হচ্ছে। তৃধার কিছুক্ষণের জন্য মনে হলো সে কানে শুনতে না পেলেই বুঝি ভালো হতো। তাহলে নিজের নবজাতক কন্যার বিরুদ্ধে এত কু’রুচিপূর্ণ কথা সে শুনতে পেতোনা। সে এতোটাই ভেঙে পড়েছে যে প্রতিবাদ করে কিছু বলার শক্তিটুকু তার মধ্যে নেই। মধ্যবয়স্ক মহিলা ডাক্তারটি তৃধার অবস্থা বুঝতে পেরে ফাতেমা বেগমকে এক ধম’ক দিলেন।
” ছিঃ এসব কি ধরনের কথা বলছেন আপনি? কন্ঠ কাঁপছে না এধরণের জ’ঘন্য কথা বলতে? নিজের নাতনীকে নিয়ে এধরণের মন্তব্য করছেন একবারো বুক কাঁপছে না? কতটা নীচু মনমানসিকার মানুষ হলে একজন সদ্যজাত মায়ের সামনে তার বাচ্চাকে নিয়ে এধরণের কথা বলতে পারে আমি তাই ভাবছি। আপনি যদি এখন আর কোন ধরণের সিনক্রিয়েট করেন তাহলে আমিই পুলিশ ডাকবো। নার্স সবাইকে ওয়ার্ড থেকে বের করে দিন।”
ডাক্তারের আদেশে তৃধার পরিবারসহ সবাইকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তৃধা বাকি রোগীদের দিকে চোখ বুলিয়ে তাকালো। সবাই চিন্তিত ভীত মুখশ্রী নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
” নার্স একটু আমার বাচ্চাটাকে রাখুন। আমার বাচ্চাটাকে আমার বড় ভাবী ছাড়া আর কারো কাছে দেবেন না দয়া করে। আমার পরিবার কিংবা আমার শশুড় বাকি কারো কাছে নয়। এমনকি কেউ আমার স্বামী হিসেবে পরিচয় দিলেও নয়। দয়া করে আমার মেয়েটাকে দেখে রাখবেন। ওরা এতোটাই হৃদয়হীন যে আমার মেয়েটার ক্ষ’তি করতে দু’বার ভাববেনা ….” সম্পূর্ণ কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই অজ্ঞান হয়ে বেডে ঢলে পড়লো তৃধা। এতো বা’জে পরিস্থিতি তার দু্র্বল শরীর এবং মন কোনটিই সহ্য করতে পারেনি।
চোখ খোলার পর নিজের আশেপাশে মেয়েকে না দেখে তৃধা বিচলিত হয়ে পড়লো। সে চিৎকার করে নার্সকে ডাকতে যাবে তখনই দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো তার ভাবী মোহনা। তার কোলে মেয়েকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো তৃধা।
মেয়েকে নিজের কাছে নিতে নিতে তৃধা জিজ্ঞেস করলো, ” কখন এসেছিস তুই?”
” কিছুক্ষণ আগেই এসেছি। শরীর কেমন লাগছে এখন?”
” এইতো আছি। তোর ছেলে কোথায়?”
” তোর ভাইকে দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। ওরা ঝা’মেলা করছে তাই না?”
” হুম।” মেয়েকে ফিডিং করতে করতে বললো তৃধা।
” এখন কি বলছে ওরা?”
” আমার বাচ্চাটাকে তারা স্বীকার করতে চাইছেনা। মিথ্যা জঘ’ন্য অপবাদ দিচ্ছে।”
” ভেঙে পড়িস না তৃধা। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
” ভেঙে পড়ছি না মোহনা। এতোদিন যখন ভেঙে পড়িনি আজও পড়বোনা। দুর্বল হলেই ওরা চেপে বসবে আর সব ঠিক না হলেও আমি ঠিক করেই ছাড়বো। চিন্তা করিস না তুই, তুই শুধু আমার মেয়েটাকে একটু দেখে রাখিস।”
” তোর বর কোথায়? আসার সময় তোর শাশুড়ী আর বড় ননদকে চলে যেতে দেখলাম, তোর ছোট ননদ আমাকে ওয়ার্ড দেখিয়ে দিয়ে চলে গেলো। তেজবীনকে তো দেখলাম না।”
” জানিনা কোথায়। হয়তো আমাকে হসপিটালে তুলে দিয়ে আর ফেরত আসেনি।” বেশ গম্ভীর কন্ঠে বললো তৃধা।
বাইরে থেকে নিজেকে বেশ শক্ত দেখালেও মনে মনে ভিষণ কষ্ট পেয়েছে সে। একটা মানুষ কতটা পা’ষাণ হলে নিজের সদ্যজাত সন্তান এবং স্ত্রীকে এভাবে ফেলে চলে যেতে পারে তৃধা তাই ভাবছে।
” তেজবীন তোমার আমার প্রতি না হোক অন্তত নিজের রক্তের প্রতিও কি কোন টান নেই? এতোটাই অমা’নবিক তুমি?”
চলবে………
#বসন্তের_একদিন (সিজন ২)
#পর্বঃ০১
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
( প্রথম সিজনের মতো এই সিজনও সত্যি ঘটনা থেকে লেখা হবে। তবে এই সিজনে আমি বেশ কিছু ঘটনা নিজের মতো পরিবর্তন করে ঘুছিয়ে লিখবো। মূল চরিত্রগুলো একই থাকবে, গল্পের স্বা’র্থে অনেক কিছু সংযোজন বা বিয়োজন করা হতে পারে। সিজন ১ না পড়লেও আপনাদের এইটা বুঝতে কোন সমস্যা হবেনা।)