কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে #পর্ব_২২

0
194

#কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে
#পর্ব_২২
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“কুয়াশা আমার বাচ্চা দু’টোকে তুই বাঁচা বোন। ওদের একমাত্র তুই বাঁচাতে পারবি। দরকার হলে ওদের অনাথ আশ্রমে দিয়ে আসিস। তবুও আমার বাচ্চাদের বাঁচিয়ে নে এখান থেকে।”

বাল্যকালের সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবীকে কাঁদতে কাঁদতে এসব বলতে শুনে চমকে যায় কুয়াশা। সবাই মিলে রাতের খাবার খেয়ে মাত্রই আড্ডা দিতে বসেছে এমন সময় কুয়াশার ফোনে কল আসে। কলের অপরপ্রান্তে থাকা মেয়েটা তাকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই এক নিঃশ্বাসে উপরোক্ত কথাগুলো বলে ওঠে।

“আর্শিয়া কী হয়েছে তোর? এভাবে কথা বলছিস কেন? আর বাচ্চাদের বাঁচাব মানে? ওদেরই বা কী হয়েছে?”

“প্রায় বছর দুয়েক হলো তোর সাথে আমার যোগাযোগ ছিল না। এই দুই বছরে আমার জীবন সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। কি কি হয়েছে সেইসব আমার ডায়েরিতে লেখা আছে। তুই সেই ডায়েরি পড়লে সব জানতে পারবি পরবর্তীতে। তবে এই মুহূর্তে তুই আমাদের বাঁচিয়ে নে। আমার হাতে বেশি সময় নেই। যেকোনো মুহূর্তে ওরা আমাকে আর আমার বাচ্চাদের মে রে ফেলবে।”

“কারা এমন করবে?”

“আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন!”

“কী বলছিস এসব?”

“আমি সত্যি বলছি কুয়াশা। আমাকে না হোক, অন্তত আমার বাচ্চাদের বাঁচা বোন।”

“আচ্ছা তুই শান্ত হ। এখন তোরা কোথায় আছিস? আমাকে ঠিকানা বল। আমি এখনই আসছি।”

“আমি এখন বাচ্চাদের নিয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি রে। কখন কোথায় যাচ্ছি নিজেও জানি না। আপাতত গাজীপুরের একটা হোটেলে আছি।”

“হোটেলের নাম বল।”

“গ্রিন প্যালেস।”

“আচ্ছা শোন, আমি এখন কক্সবাজারে আছি। এখান থেকে সোজা তোর কাছে যাচ্ছি। তুই কোথাও যাবি না। ওখানেই থাক। আর কিছু হলে সাথে সাথে আমাকে কল করে জানাবি।”

“তাড়াতাড়ি আয়।”

“হুম। রাখছি এখন।”

কুয়াশা ফোন রেখে সবার উদ্দেশ্যে বলে,

“আমাদের এখনই গাজীপুর যেতে হবে।”

সাফওয়ান কুয়াশাকে অস্থির হতে দেখে প্রশ্ন করে,

“কী হয়েছে? কে কল দিয়েছিল? তুমি এমন করছ কেন?”

“আর্শিয়া কল দিয়েছিল। ওও আমার বাল্যকালের বন্ধু। মলি আমার জীবনে এসেছে হাইস্কুলে থাকতে। আর আর্শিয়া আমার প্রাইমারি স্কুলের বান্ধবী। ওর অনেক বিপদ এখন। ওকে আর ওর বাচ্চাদের ওর শ্বশুর বাড়ির লোকজন মে রে ফেলতে চাচ্ছে।”

“কী বলছিস কী তুই?”

“আমি ঠিকই বলছি মলি। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। যেভাবেই হোক ওদেরকে বাঁচাতে হবে। এখনই বের হতে হবে আমাদের।”

“আচ্ছা আমি সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছি।”

আদ্রিতার কথায় মলিও উঠে সবকিছু গোছাতে শুরু করে। সবাই মিলে যত দ্রুত সম্ভব সবকিছু গুছিয়ে রওনা দেয় গাজীপুরের উদ্দেশ্যে।

অন্যদিকে তিন্নি আর ফয়সালের সম্পর্কে ফাটল ধরতে শুরু করেছে। ফয়সাল এখন তিন্নিকে সময় দেয় না। এই নিয়ে দু’জনের মধ্যে সারাক্ষণ ঝামেলা লেগেই থাকে। এখনো দু’জনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া চলছে।

“তোমার সমস্যা কী ফয়সাল? তুমি এখন আমাকে আগের মত সময় দাও না কেন?”

ফয়সাল মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থেকেই বিরক্তির সুরে বলে,

“এই রাতের বেলা আমাকে জ্বালিয়ো না তিন্নি। বাচ্চা ঘুমাচ্ছে। তুমিও ঘুমাও এখন।”

“ঘুমাব মানে কী হ্যা? আজ তোমাকে বলতেই হবে। কেন করছ এমন?”

“কী করলাম আমি?”

“জানো না?”

“না, জানি না।”

“মিথ্যা বলবে না একদম। তুমি এখন আর আগের মত আমার কাছে আসো না। আমাকে স্পর্শ পর্যন্ত করো না। সব সময় দূরে দূরে থাকো। এমন কেন করছ তুমি?”

“এসব তোমার ভুল ধারণা। এমন কিছুই আমি করিনি।”

“তাহলে কেন আমার কাছে আসো না তুমি?”

“ভালো লাগে না তাই।”

“মানে?”

“মানে তোমার কাছে যেতে এখন আমার ভালো লাগে না। বিরক্ত লাগে তোমাকে দেখলে।”

“এই কথা বলতে পারলে তুমি? আমাকে ভালো লাগে না তো কাকে ভালো লাগে তোমার?”

“কাউকেই ভালো লাগে না। হয়েছে? তোমাকে ভালো না লাগার অনেক কারণ আছে।”

“কী কারণ?”

“তোমার মধ্যে তোমার সেই সৌন্দর্য নেই যার প্রেমে পড়েছিলাম আমি। তুমি এখন নিজের প্রতি উদাসীন। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখ, কতটা অসুন্দর লাগে তোমাকে। তোমার কাছে গেলে আমি আগের মত কিছু অনুভব করতে পারি না। অনুভূতি কাজ করে না আমার মধ্যে। এখন আমি কী করতে পারি?”

নিজের স্বামীর মুখে এমন কথা শুনে তিন্নি থমকে যায়। তার চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। ভালোবাসার মানুষের মুখ থেকে এমন কথা শুনে নিজেকে অনুভূতিহীন মনে হচ্ছে তার।

“তুমি সন্তান চেয়েছিলে। আমি তোমার চাওয়াকে সম্মান করেছি। তুমি বলেছিলে তুমি বাবা ডাক শুনতে চাও। তোমার ইচ্ছা পূরন করার জন্য আমি এত তাড়াতাড়ি সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দীর্ঘ নয় মাস একুশ দিন নিজের মধ্যে একজনকে বড়ো করে তুলেছি। অসহনীয় যন্ত্রণা সহ্য করে অবশেষে তোমাকে একটা রাজকন্যা উপহার দিয়েছি। এরপর বাচ্চাকে একা হাতে সামলানো, সংসার সামলানো, আবার তোমাকে সময় দেওয়া, এসব কিছুর পরে আমি নিজের যত্ন নেওয়ার সময় পাইনি। হ্যা, হয়তো নিজের জন্য সময় বের করতে পারতাম৷ কিন্তু আমি তা করিনি। কারণ তোমাদের সময় দেওয়া কম হোক এটা আমি চাইনি। যার জন্য এতকিছু করলাম আজ সেই মানুষটা আমাকে এসব বলছে? আমি কি সত্যিই এসব শোনার মত কাজ করেছি ফয়সাল?”

তিন্নি এক নাগাড়ে কথাগুলো বললেও ফয়সাল কিছুই শোনেনি। কারন সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তিন্নি নিজের চোখের পানি মুছে পুনরায় বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। যে কান্নার আওয়াজ এই মুহূর্তে ফয়সালের কান অবধি পৌঁছাচ্ছে না। হয়তো কখনো পৌঁছাবেও না!

দীর্ঘ কয়েক ঘন্টার বাস ভ্রমণ শেষে কুয়াশা, সাফওয়ান, মলি আর আদ্রিতা এসে পৌঁছায় “গ্রিন প্যালেস” হোটেলের সামনে। হোটেলের ভেতরে ঢোকার পর উপরের ঘর থেকে চিৎকারের আওয়াজ শুনে সবাই ছুটে যায় সেদিকে। চারপাশে মানুষের আনাগোনা দেখে আৎকে ওঠে সবাই।

“কী হচ্ছে ওখানে? আদ্রিতা আর ওর বাচ্চারা ঠিক আছে তো?”

মলির কথায় কুয়াশা দৌড়ে এগিয়ে যায় সেদিকে। কয়েকজন মুখোশধারী লোক হাতে বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ভয়ে কেউ নড়তে পারছে না। সবাইকে ভয় দেখিয়ে এক পাশে দাঁড় করিয়ে রেখেছে লোকগুলো। আর্শিয়া নিজের দুই বাচ্চাকে বুকে আগলে নিয়ে একপাশে জড়সড় হয়ে বসে আছে। কুয়াশা ছুটে ওর কাছে চলে যায়। কুয়াশাকে দেখে মুখোশধারীদের মধ্য থেকে একজন বলে ওঠে,

“এই মেয়ে, কে তুমি? এখানে কেন এসেছ?”

“আমি কে সেটা পরে জানবেন। আগে বলুন আপনারা কারা? আর এখানে কী হচ্ছে এসব?”

“নিজের ভালো চাও তো চলে যাও এখান থেকে।”

“একদম চুপ। একজন মেয়েকে অসহায় পেয়ে তার সামনে নিজেদের শক্তির অপব্যবহার করা হচ্ছে হ্যা? এত সাহস হয় কী করে আপনাদের?”

“এই মেয়ে তো অতিরিক্ত কথা বলছে। বস এটাকেও কি মে রে দিব?”

পাশ থেকে একজনের মুখে এমন কথা শুনে কুয়াশা রাগে চোখ বন্ধ করে নেয়। কয়েকবার লম্বা শ্বাস নিয়ে চোখ খুলে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“আপনারা কেমন মানুষ বলুন তো? একটা মেয়ে আর তার সন্তানদের এভাবে মে রে ফেলার হুমকি দিচ্ছে কয়েকজন, আর আপনারা সেটা দেখে ভয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনাদের এতজনের সাথে এই কয়েকজন কি সত্যিই পেরে উঠবে? নিজেদের প্রতি কী একটুও আত্মবিশ্বাস নেই আপনাদের? সাহস থাকলে রুখে দাঁড়ান এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে।”

কুয়াশার কথা শুনে প্রথমে সাফওয়ানসহ কয়েকজন ছেলে এগিয়ে আসে। বাকিরা এটা দেখে মনে সাহস নিয়ে মুখোশধারী লোকগুলোর দিকে এগিয়ে যায়। এক পর্যায়ে সবাই হৈচৈ করতে শুরু করলে মুখোশধারী লোকগুলোর মধ্যে থাকা তাদের বস একটা ধারালো ছু রি নিয়ে কুয়াশার দিকে তেড়ে যায়। সবাই হৈচৈ করার ফলে এটা কারোর চোখে পড়ে না। কুয়াশা পেছন ঘুরতেই লোকটা ছু রি সরাসরি তার পেটে ঢুকিয়ে দেয়। কুয়াশা চিল্লিয়ে ওঠে। কুয়াশার চিৎকারে সবাই তার দিকে তাকিয়ে চমকে যায়। আকস্মিক এমন কিছুর জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। সবাই থমকে দাঁড়ায়। এক মুহূর্তের মধ্যেই যেন চারপাশের চিত্র পুরোপুরি পাল্টে যায়!

চলবে??

বিঃদ্রঃ আজকের পর্বে সবার উপস্থিতি চাই। লেখিকার অনুরোধ এটা তার পাঠক/পাঠিকাগণের কাছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here