#কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে
#পর্ব_২৭
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
“মা!”
এই কথাটা শুনে কুয়াশা থমকে দাঁড়ায়। ঢাকায় ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কুয়াশা বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল। এরইমধ্যে নিহাল কুয়াশাকে মা বলে সম্মোধন করে। কিছু মুহূর্তের জন্য সে যেন অন্য এক জগতে চলে গিয়েছিল। নিজ জ্ঞানে ফিরে কুয়াশা নিহালকে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে নেয়। অতঃপর পরম ভালোবাসাময় একটি চুমু এঁকে দেয় পিচ্চি ছেলেটার কপালে। কুয়াশাকে বিদায় দেওয়ার জন্য সবাই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। এমন দৃশ্যের সাক্ষী হতে পেরে সবার মুখেই হাসি ফুটে ওঠে। মিসেস নাহার মেয়ের কাঁধে হাত রাখতেই সে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে,
“মা দেখলে? নিহাল আমাকে মা ডাকল। কিন্তু এই ডাক সে আমাকেই কেন ডাকল?”
“আমি শিখিয়েছি ওকে। যে তমি ওদের দুই ভাই-বোনকে এত ভালোবাসা দিয়ে বড়ো করে তুলছ সেই তোমার মা ডাক শোনার অধিকার আছে। আর্শিয়াও তো এমনই চেয়েছিল। ওর ছেলে আর মেয়ে যেন কখনো মায়ের অভাব বুঝতে না পারে।”
মায়ের কথা শুনে কুয়াশা মা থা নেড়ে হ্যাবোধক জবাব দেয়। প্রথমে নিহাল তারপর ওয়ানিয়াকে আদর করে সবার থেকে বিদায় নিয়ে সে খুশিমনে বের হয়ে যায় বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে। আজ তার অনেক ভালো লাগছে। এই প্রথম সে কোনো বাচ্চার মুখে মা ডাক শুনেছে। এর থেকে তৃপ্তিদায়ক আর কি কিছু হতে পারে? উত্তরটা হয়তো নাবোধক হবে।
পথিমধ্যে কখন সে ঘুমিয়ে গিয়েছিল তা জানা নেই কুয়াশার। তার ঘুম ভাঙে ফোনের রিংটোনে। তিন্নি কল করেছে।
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। বোন জানিস? তোর বুদ্ধি কাজে দিচ্ছে। গতকাল তোর সাথে দেখা করে ফিরে আসার পর থেকে আমি ফয়সালকে পাত্তা দিইনি একদম। রাতে ঘুমের ঘোরে খেয়াল করছিলাম ওও আমার দিকে বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছিল। আমার সাথে একটু কথাও বলতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি শুনিনি ওর কোনো কথা।”
“এভাবে আরো কিছুদিন চালিয়ে যাও। আর নিজের যত্ন নিয়ো। এখন আমি রাখছি। গাড়িতে আছি তো।”
“আচ্ছা। সাবধানে থাকিস।”
“হুম।”
কথা বলা শেষে ফোন ব্যাগে ঢুকিয়ে একটা বই বের করে পড়তে শুরু করে সে। “ইট এন্ড উইথ আস” বইটা পড়ছে সে। কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পর তার বেশ ভালো লেগে যায় বইটি। তাই অনেকটা সময় ধরে সে বেশ মনোযোগ দিয়েই বইটা পড়তে থাকে।
অনেকটা পথ অতিক্রম করে দীর্ঘক্ষণ বাসে বসে থেকে কুয়াশা ঢাকায় এসে পৌঁছায়। নিজের ব্যাগ নিয়ে বাস থেকে নেমে একটা রিকশা নিয়ে সোজা বাসায় চলে আসে। বাসায় ঢোকার সাথে সাথে আদ্রিতা কুয়াশাকে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে,
“দোস্ত তোকে এই কয়েকদিন অনেক মিস করেছি রে। কেমন আছিস তুই?”
“এতখানি পথ বাসে বসে আসার পরে কেমন থাকে মানুষ? ক্লান্ত নিশ্চয়ই?”
“ওহ হ্যা, তাই তো!”
“আমার প্রচুর মা থা ব্যাথা করছে। আমি ঘরে যাচ্ছি।”
“হ্যা তুই ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। আমি তোর জন্য একটু লেবুর শরবত বানিয়ে আনি।”
“আচ্ছা।”
কোনোরকমে ফ্রেস হয়ে আদ্রিতার বানানো লেবুর শরবত খেয়ে কুয়াশা লম্বা একটা ঘুম দেয়। সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ছয়টার দিকে আদ্রিতার ডাকে তার ঘুম হালকা হয়ে যায়।
“উফ আদ্রিতা ডাকছিস কেন আমাকে? একটু ঘুমাতে দে দোস্ত। আমার কাঁচা ঘুম ভেঙে দিস না।”
“এই মেয়ে এই, এটা তোর কাঁচা ঘুম? প্রায় তিন ঘন্টা ধরে তুই ঘুমাচ্ছিস। আর কত ঘুমাবি?”
“আর একটু!”
“একটুও না। তাড়াতাড়ি উঠে পড়। আমাদের বের হতে হবে?”
কুয়াশা ঘুম জড়ানো কণ্ঠে কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করে,
“কোথায় যাব আমরা?”
“গেলেই তো দেখতে পাবি। এখন এত প্রশ্ন না করে তাড়াতাড়ি উঠে চোখেমুখে পানি দে।”
“না, আগে বল কোথায় যাবি?”
“এখন বলা যাবে না। তোর জন্য বিশেষ একটা উপহার অপেক্ষা করছে।”
“উপহার?”
“হ্যা উপহার। এখন আর একটা প্রশ্নও করবি না। ওঠ বলছি।”
কুয়াশা বিছানা ছেড়ে উঠছে না দেখে আদ্রিতা এক প্রকার টেনেই তাকে তোলে। তারপর ঠেলে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দেয়। কুয়াশা চোখেমুখে ভালো করে পানি দিয়ে পরিষ্কার করে বের হয়ে আসে।
“কী পড়বি? আমি বোরকা পড়ব।”
“হ্যা বোরকা পড়বি। কিন্তু সব সময় যেটা পড়িস সেটা না।”
“তাহলে?”
“তুই এই বোরকা পড়বি আজকে।”
এটুকু বলেই আদ্রিতা তার হাতে থাকা ব্যাগ থেকে খুব সুন্দর কারুকাজ করা গাঢ় নীল রংয়ের বোরকা আর হিজাব বের করে।
“একি! আমি এই বোরকা পড়ব কেন? এটা তো কোনো অনুষ্ঠানে গেলে তখন পড়ার জন্য মানানসই।”
“আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে একটু সুন্দর করে তৈরি হয়ে যেতে হবে। আমিও সুন্দর একটা জামা পড়ব।”
এই বলে আদ্রিতা ওর জামাও বের করে। হালকা বেগুনি রংয়ের অল্প কাজ করা একটা সুন্দর থ্রি-পিস পড়বে আদ্রিতা। কুয়াশা নিজের ভ্রূদ্বয় কুঁচকে প্রশ্ন করে,
“তুই মার্কেটে কখন গেলি? আর এসব কখন কিনে আনলি?”
“তুই ঘুমানোর পরে গিয়ে এসব নিয়ে এসেছি। এখন চটজলদি তৈরি হয়ে নে।”
“কীভাবে তৈরি হব?”
“আমিই তৈরি করে দিচ্ছি। তুই শুধু এই বোরকা পড়ে নে।”
বান্ধবীর কথামতো কুয়াশা বোরকা পড়ে চুপচাপ আয়নার সামনে থাকা চেয়ারে বসে পড়ে। আদ্রিতা খুব যত্নসহকারে করে কুয়াশাকে সাজাতে শুরু করে। সাজ বলতে আহামরি কিছু নয়। মুখে হালকা করে পাউডার ব্রাশ করে সামান্য একটু ব্লাশঅন লাগিয়ে দেয়। যেন গাল দু’টো গোলাপি হয়ে যায়। এরপর চোখে গাঢ় করে কালো রঙের কাজল আর ঠোঁটে অল্প করে খয়েরী রঙের লিপস্টিক লাগিয়ে দেয়। ব্যাস! কুয়াশার সাজ সম্পূর্ণ। সাজ শেষে কুয়াশা নিজের মা থা য় খুব সুন্দর করে হিজাব পড়ে নেয়। এই সুযোগে আদ্রিতা নিজেও তৈরি হয়ে নেয়। দুই বান্ধবীর তৈরি হওয়া শেষ হতে হতেই ঘড়ির কাঁটায় আটটা বেজে গিয়েছে। আদ্রিতা তাড়া দেখিয়ে বলে,
“তাড়াতাড়ি চল কুয়াশা। এবার কিন্তু আমাদের দেরি হয়ে যাবে।”
“দেরি কে করল? আমি না তুই?”
“তোকে সাজাতে গিয়েই তো আমার তৈরি হতে একটু সময় লাগল।”
“ওহ তাই না?”
“তাই তো।”
“তুই এমনিতেও সব সময় দেরি করিস দোস্ত। এটা নতুন কিছু না।”
“পরে ঝগড়া করিস। এখন বের হ বোন।”
বাসা থেকে বের হয়ে গাড়ি নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগে না তাদের। আধ ঘন্টার মধ্যেই তারা দু’জন পৌঁছে যায় সেখানে। চারপাশে সুন্দর করে সবকিছু সাজানো একটা রুফটপ রেস্টুরেন্ট দেখে কুয়াশা মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে। মূলত এখানেই কুয়াশার জন্য সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে।
“কী? কেমন লাগছে?”
“অনেক সুন্দর। তুই কী এখানে আমাকে খাওয়াতে নিয়ে এলি? তাহলে তো সাফওয়ানকেও ডাকতে পারতিস।”
“কেন রে? ভাইয়াকে মিস করছিস নাকি?”
“আরে ওও আমাদের বন্ধু না? আমরা তিনজন তো একসাথেই বেশিরভাগ সময় ঘুরতে বের হই। এজন্য বললাম। ওকে ডাকলে খুশি হতো।”
“আমাদের বন্ধু না। বল শুধু তোর একার বন্ধু। আমাদের তো ভাইয়া হয়।”
“আমার আর তোদের ক্ষেত্রে আলাদা কেন?”
কথা বলতে বলতে কুয়াশা হঠাৎ খেয়াল করে তার পুরো পরিবার একপাশে বসে আছে। কুয়াশা ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে এটা দেখে। রীতিমতো চিৎকার করে বলে,
“মলি তোরা এখানে?”
সবার কুয়াশার এমন অবস্থা দেখে হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা হয়ে যায়। মলি হেসে কুয়াশার কাছে এগিয়ে আসে।
“এটা হলো তোর জন্য প্রথম সারপ্রাইজ।”
“তোরা এখন এখানে কীভাবে?”
“তুই বের হয়ে আসার এক ঘন্টা পরই আমরা বের হয়েছি। আমরা বগুড়া থেকে এসে সোজা এখানকার পাশের একটা হোটেলে উঠেছি। ওখান থেকে ফ্রেশ হয়ে সুন্দর করে সাজুগুজু করে এখানে চলে এসেছি।”
“কিন্তু এসবের মানে কী? আর প্রথম সারপ্রাইজ মানে? আরো কয়টা সারপ্রাইজ আছে?”
মলি আর কিছু বলে না। চোখের ইশারায় কুয়াশাকে পেছনে তাকাতে বলে। কুয়াশা পেছনে তাকিয়ে আরেক দফা চমকে যায়। আজ যেন তার চমকানোরই দিন!
চলবে??
বিঃদ্রঃ গত পর্বে অনেকেই কুয়াশার উপর রাগ করেছেন। কারণ সে এখনো রায়াদকে ভালোবাসে। আমি কিন্তু গল্পে স্পষ্ট বলে দিয়েছি যে কেন কুয়াশা রায়াদকে এখনো ভালোবাসে। রায়াদের দেওয়া আ ঘা ত গুলো তাকে অনেক বেশি শক্ত হতে সাহায্য করেছে। এর জন্য সে কৃতজ্ঞ। এজন্যই কুয়াশা ভালোবাসার কথা বলেছে আর কিছু নয়। এখানে রায়াদকে পুনরায় চাওয়া কিংবা কাছে পাওয়ার আকাঙ্খা বোঝানো হয়নি। আশা করি সবাইকে বোঝাতে পেরেছি।